অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৫

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৫
তাশরিন মোহেরা

দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা ঘুমের পর আড়মোড়া ভেঙে উঠলাম। চোখ জোড়া বন্ধ করেই ডান বাহুটা বাম পাশে ফিরিয়ে এবং বাম বাহুটা ডান পাশে ফিরিয়ে হালকা সহজ হলাম। এই অভ্যাসটা আমার বেশ পুরোনো। এরপর চোখ ঢলে তা খুলতেই দেখলাম মুগ্ধ আর মুখর আমার সামনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ জোড়া তখনও সম্পূর্ণ খুলিনি।

আর এর মধ্যেই ভাবছি, ঘুম থেকে উঠেই সচরাচর সর্বপ্রথম আমি আব্বা কিংবা সুমিকে দেখি। কিন্তু এখন সামনে মুগ্ধ-মুখর কি করে? তখনই হঠাৎ মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। চোখ দুটো ভালোমতোন কচলে আমি চারপাশটা একবার দেখলাম। এই মুহুর্তে আমি মুখরের রুমে অবস্থান করছি। মুখরের নরম বিছানায় আমার শুইয়ে দিয়েছ কেউ। কিছুক্ষণ আগেই মুখর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ায় আমি চিৎপটাং হয়ে নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই। এরপর?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এরপর আমি মুখরের রুমে কিভাবে এলাম? তবে কি আমাকে কোলে করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে? কিন্তু মুখর ছাড়া তো আমাকে কোলে নেওয়ার মতো শক্তি কারও নেই। তবে কি? তবে কি আমার স্বপ্নের মুখর সাহেবই আমাকে কোলে করে রুমে এনে শুইয়ে দিয়েছে?

নাহ! আমি আর ভাবতে পারছি না। কিছুই ভাবতে পারছি না। আমার হৃদপিণ্ডটা যেন এখনই লাফিয়ে আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। সবটাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কে। মুগ্ধ আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
‘ম্যাম, আপনি হঠাৎ তখন পড়ে গিয়ে বেহুশ হয়ে গিয়েছিলেন। আর এখন উঠলেন। কি হয়েছিলো আপনার?’
আমি বোকা বোকা চোখে মুগ্ধের দিকে চেয়ে আছি। বেহুশ হয়েছি মানে? আমার তো শুধু একটু ঘুম পেয়েছিলো। কেন আমি শুধু শুধু বেহুশ হতে যাবো? আমার ছাত্র এসব আমায় কি বলছে?

তখনই মুখর সামনে এসে গম্ভীরমুখে বললো,
‘সকালে কিছু খেয়ে এসেছিলেন আপনি?’
আমি তার কথা শুনে দু’দিকে মাথা দুলালাম। অর্থাৎ আমি কিছু খেয়ে আসিনি। আমার এই উত্তরে হঠাৎই মুখর রেগে যায়। আমার সামনে পায়চারি করে বলতে থাকে,
‘ঠিক! আমার ধারণা-ই ঠিক। কেন আপনি কিছু না খেয়ে আসতে গেলেন, বলুন তো? এজন্যেই তো সকালে দূর্বল হয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন!’

আমি চমকে তার দিকে চেয়ে আছি। কিসব ভাবছে দুইভাই? সকালে আমার দূর্বল লাগছিলো ঠিক তবে তা খাবারের জন্য নয়। রাতে ঘুম না হওয়ার দরুন আমার প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছিলো বলেই তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
মুখর আমার মুখের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়লো। এরপর আমায় বললো,
‘যখনই আপনাকে কোলে নিয়ে এখানে এনেছি তখনই বুঝেছি খাবারের প্রতি আপনার একটুও মন নেই। তাই তো এতো শুকনো, আস্ত একটা ক’ঙ্কা’লে’র মতো!’
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে শূন্য মস্তিষ্কে বললাম,

‘কিন্তু মুখর সাহেব, আমি তো আগে কখনো ভেজা ছিলাম না। মাঝে মাঝে আপনি পানি মারেন বলেই তো ভিজে যাই।’
মুখর সাহেব তার মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠে সাথে সাথে,
‘আর ইউ কিডিং মি অর আর ইউ ডাম্ব? আমি বলতে চাইছি আপনি বয়সের তুলনায় একটু বেশিই চিকন আর ছোট!’
নিজের ভুলে নিজেই জিভ কাটলাম। আসলে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছে আমার। কি বলছি কি শুনছি যেন নিজেই জানি না।

মনে মনে বিশাল এক অঙ্ক কষলাম। বড্ড ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে এ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। প্রথমত, এই বোকা দুইভাই ভাবছে আমি কিছুক্ষণ আগেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছি। তাদের চোখমুখ জুড়ে আমার জন্য ভীষণ আ’ত’ঙ্ক কাজ করছে। যা দেখে মনে মনে কিছুটা খুশিই হলাম আমি। এখন যদি তাদের আ’ত’ঙ্কে জল ঢেলে আমি ফাঁস করে দেই আমি আসলে জম্পেশ এক ঘুম দিয়েছি তবে সবটাই ভেস্তে যাবে। চিন্তার বদলে এরা আমাকে নিয়ে বিরক্ত হবে। এই ভুলটুকু আমি কিছুতেই হতে দেবো না। তাই চরম এক মিথ্যা আমার বলতে হবে যেকোনো মতেই।

দ্বিতীয়ত, আসলে দ্বিতীয় ব্যাপারটা বলতে আমার কেমন লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে! মুখর সাহেব আমায় কোলে নিয়েছে! ইশ! ভাবতে পারছিনা আমি। ভাবতেই মুখ দুটো লাল হয়ে উঠছে আমার। আচ্ছা মুখর আমাকে কিভাবে কোলে তুলেছিলো? নিশ্চয়ই সিনেমার হিরোর মতো পাজাকোলে আমায় বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। হায়! যদি আমার চোখটা খানিকক্ষণের জন্য খোলা রাখতাম!

পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, মুখর যখন আমায় কোলে তুললো আমার শরীর থেকে কোনো বাজে স্মেল আসেনি তো? কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটেনি তো? এই যেমন ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে কথা বলার অভ্যাস আছে আমার। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বলে ফেলিনি তো আমি? মুহুর্তেই লজ্জার বদলে একরাশ ভয় জমা হয়েছে।
মুখর ফোনে ব্যস্ত হয়ে রুম ছাড়লেই আমি মুগ্ধকে টেনে আমার পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আমি ঘু.. মানে বেহুশ হয়ে যাওয়ার পর কি হয়েছিলো আমায় একটু বিস্তারিত জানাও তো বাবা!’
মুগ্ধ নড়েচড়ে বসে বললো,

‘যখন আপনি বেহুশ হয়ে গেলেন তখন আমি আর ভাইয়া অনেক ডাকাডাকি করার পরও আপনি উঠলেন না। ভাইয়া তখন ভয়ে পেয়ে আপনার নিশ্বাস আছে কিনা দেখলো, যদি আবার মরে টরে যান তাই। যখন বুঝলো আপনি বেহুশ হয়েছেন ঠিক তখনই…’
আমি অতিরিক্ত উত্তেজনায় তাকে থামিয়েই বললাম,
‘ঠিক তখনই?’
মুগ্ধ এবার বললো,

‘জ্বি বলছি। ঠিক তখনই সিনেমার ভি’লে’ন’দে’র কি’ড’ন্যা’প করার মতো আপনাকে তুলে ভাইয়া রুমে এনে শুইয়ে দিয়েছে।’
এটুকু শুনেই আমি আবারো প্রশ্ন করলাম,
‘ভি’লে’ন’দে’র মতো মানে বুঝলাম না! কি’ড’ন্যা’প করে ওভাবে তুলেছেন উনি?’
মুগ্ধ উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে বললো,

‘জ্বি ম্যাম! ভাইয়া আপনার পা দুটো ধরে এইভাবে তুলেছিলো আর আপনার হাত আর মাথা দুটোই ভাইয়ার পিঠে ঝু’ল’ছি’লো। আমার খুব হাসি পেয়েছিলো তখন। কিন্তু আমি একদমই হাসিনি তখন।’
এই বলে মুগ্ধ ঠোঁট টিপে ভীষণ হাসলো। এদিকে তার এই বিবরণ শুনে মনের ইচ্ছেরা ভে’ঙে চু’র’মা’র হয়ে গেল আমার সঙ্গে সঙ্গেই। সাথে মুখরের উপর চরম রাগ করলাম। এরপর মুগ্ধ আমায় প্রশ্ন ছুড়লো,
‘কিন্তু ম্যাম! আপনি বেহুশ হয়েও ওরকম আরাম করে ঘুমাচ্ছিলেন কিভাবে?’

আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মানে? কেমন আরাম করে?’
মুগ্ধ বললো,
‘যখন ভাইয়া আপনাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয় তখনই আপনি ঘুমের মধ্যে ভাইয়ার কোলবালিশটা নিয়ে তার উপর পা তুলে দিলেন আর বালিশটা জড়িয়ে ধরে অনেক আরামে ঘুমালেন।’

আমি ক্ষণিকেই ধরা পড়ে গেলাম। কোলবালিশ নিয়ে শোয়ার অভ্যাস আছে আমার। যেখানেই যাই কোলবালিশ আমার নিয়ে যেতেই হয়! না হয় আমার ঘুমটা ভালোমতো হয় না। এবার মুগ্ধকে কি বলা যায়? বেচারাদের কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না আমি আসলে ঘুমুচ্ছিলাম। মুগ্ধকে বললাম,

‘আসলে এটিও বেহুশ হওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য বুঝলে? বেহুশ হয়ে গেলে আমরা কিছু একটা জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে পো’ষ’ণ করি। এজন্যই আমি অজান্তে তোমার ভাইয়ের বালিশটা জড়িয়ে ধরেছিলাম আরকি। হাহা!’
অপ্রস্তুত হেসে মুগ্ধকে বোঝালাম ব্যাপারটা। যার সম্পূর্ণটাই মি’থ্যে! মুগ্ধ বোঝার মতো করে বললো,
‘আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি!’

আমি মনে মনে খোদার কাছে বারবার মাফ চাইতে লাগলাম। এমন একটা মিথ্যা কথা বলতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। তখনই মুখর রুমে ঢুকে কিছু মনে পড়ার ভান করে বললো,
‘ওহ হ্যাঁ! আপনাকে গরু ফোন দিয়েছিলো।’
তার এমন অদ্ভুত কথায় আমি আর মুগ্ধ একে অপরের দিকে তাকালাম। কি বাজে বকছে ছেলেটা? ভ্রু কুঁচকে দুজনেই একসাথে বললাম,
‘মানে?’

মুখর আমার ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘মানে কিছুক্ষণ আগে আপনার ফোনে ‘গরু’ নামের একজন কল করেছিলো।’
আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ও তাই বলুন!’

মুখর সাহেব মুগ্ধের পাশে বসেই বেশ গম্ভীর হয়ে বললো,
‘প্রথমে ভেবেছি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গরুর ডাকের মতো মু মু শব্দ শুনবো। পরেই দেখলাম ওপাশে একটা ছেলে আমায় ‘তিথু, তিথু’ করছে।’

আমি আর মুগ্ধ মুখরের কথায় হো হো করে হেসে উঠলাম। সেকেন্ড খানেক আমাদের হাসি থামলোই না। এ হাসিতে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলো। আমি একগাল হেসে বললাম,
‘মুখর সাহেব, আপনিও মজা করতে পারেন! বিশ্বাস হলো না। যাই হোক, জোকসটা কিন্তু ফা’টা’ফা’টি ছিল।’
এই বলে আমি আবারো হেসে দিলাম। আমার হাসিতে মুখর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিন্তু অন্যবারের মতো আমি আজ তার দৃষ্টিতে হাসি থামালাম না। সে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,

‘এটা মজা ছিলো না, অভিয়াসলি!’
এরপরই সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘একটা ছেলের নাম ‘গরু’ দিয়ে সেভ করলেন ফোনে, নিশ্চয়ই অনেক ক্লোজ আপনারা, তাই না?’
আমিও মুচকি হেসে বললাম,
‘জ্বি, ভার্সিটির এক বড় ভাই। গতবছরই পরিচয় হলো।’
মুখর রুমটা ত্যাগ করতে করতে কঠিন গলায় বললো,
‘এক বছরেই এতো ক্লোজ? বাহ! ভালোই তো!’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৪

মুখরের মুখভঙ্গি আমার চোখে পড়লো না। তবে তার কথার সুরটা কেমন যেন ঝাঁ’ঝা’লো শোনালো আমার কানে। একরাশ অভিমান নিয়ে কথাটুকু বলে গেল যেন!

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৬