অদ্ভুত প্রণয়নামা শেষ পর্ব 

অদ্ভুত প্রণয়নামা শেষ পর্ব 
তাশরিন মোহেরা

মুখর আর আমার বিয়ে হয়েছে আজ দেড় মাস হলো। কিন্তু এখনো মুগ্ধ আমাকে ভাবী ডাকতে অভ্যস্ত হলো না। তার মুখে ‘ম্যাম’ ডাকটা যতটা না সুন্দর তার চাইতে দ্বিগুণ সুন্দর হলো ‘ভাবী’ ডাকটা। তবে এই ক’দিনে তার সাথে আমার বন্ধুত্বটা আরো গাঢ় হয়েছে। সে আপনি থেকে তুমি’তে নেমেছে আর আমি নেমেছি তুই’তে।

প্রথমদিকে যদিও কিছুটা অস্বস্তিবোধ কাজ করতো। কিন্তু এখন ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আন্টি গতকাল বরিশাল ফিরে গেছেন। আমি, মুখর, মুগ্ধ প্রত্যেকেই জোর করেছি এখানে আরো ক’টা দিন থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আন্টির নাকি বরিশালেই স্বস্তি মেলে। ইশ! কথার ফাঁকে আবারো মা না ডেকে আন্টি ডেকে ফেললাম। দুঃখিত!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুখরদের বাসার বাগানটা আমার খুব পছন্দের। তবে এখন পছন্দটা আরো বেড়েছে। কেননা মুখর আমাদের বিয়ের পরই এখানে একটা ছোট বেলিফুলের চারা লাগিয়েছে। বেলিফুল বরাবরের মতোই আমার খুব পছন্দের। আর আমার স্বামীটা যে আমার পছন্দের এতো কদর করে তা নিয়ে আমি বেশ সন্তুষ্ট! বাগানটাতে এসে বেলিফুলের চারাটায় পানি দিচ্ছি। এমন সময় আমার পাশে এসে দাঁড়ায় মুগ্ধ। আমায় বলে,

‘বেলিফুল খুব সুন্দর, তাই না ম্যা- না ভাবী!’
আমি গাছটাতে পানি দিতে দিতে হালকা হাসলাম। মাথা দুলিয়ে বললাম,
‘সত্যিই খুব সুন্দর!’

চারাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি আমি। বেলিফুলের প্রতি মায়াটা আমি পেয়েছি আমার আব্বা থেকে। ফুলের প্রতি তার অদ্ভুত এক ভালোবাসা ছিল। যার কারণে তিনি চারপাশের মানুষের কাছ থেকে অনেক কথা শুনেছেন। চারপাশের নীতি অনুযায়ী, ছেলে হয়ে ফুলের প্রতি অতিরিক্ত মায়া থাকাটা হাস্যকর! ছেলেদের ফুল নিয়ে ঘাটাঘাটি করার অধিকার নেই। ফুল নিয়ে ভালোবাসা জন্মানোটা মেয়েদের অভ্যাস।

কিন্তু আমার আব্বাটা চারপাশ নিয়ে তেমন একটা ধার কখনোই ধারতেন না। ‘লোকে কি বলবে!’ এই চিন্তাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি তার পছন্দের সবকিছুকেই বেশ সযত্নে রাখতেন। ঠিক যেমনটা সযত্নে রেখেছেন আমার মা’কে! আর এই যত্নটা-ই যে কবে মায়ের বিরক্তির কারণ হয়ে গেল তিনি বুঝতেই পারেননি। আব্বার অতিরিক্ত স্বভাবটা-ই যেন আব্বাকে অন্যের কাছে খারাপ বানিয়ে দিয়েছে।

আব্বাকে ভীষণ মনে পড়ছে আমার! যদিও তিনি প্রতিদিনই ফোন দিয়ে আমার খোঁজ খবর নেন। কুমিল্লায় আব্বা ভালোই আছেন। তবে আমার যে আব্বাকে চোখের সামনে দেখার জন্যে মন কাঁদছে! মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখতে মন চাইছে।
মুগ্ধের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। চমকে তার দিকে ফিরতেই সে বললো,

‘ভাবী, তোমার কি মন খারাপ?’
আমি ক্ষীণ হেসে বললাম,
‘কই না তো বাবা! কেন এমন মনে হয়েছে তোর?’
সে আমার মুখের দিকে আঙুল তাক করে বললো,

‘তাহলে তুমি এভাবে মিথ্যামিথ্যি হাসছো কেন? মন খারাপ না থাকলে কেউ এভাবে হাসে?’
আমাকে নিয়ে ছেলেটার এমন পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ দেখে অবাক হলাম। মুগ্ধ আমাকে আবারো বললো,
‘দেখি, এখন ভালো করে হাসো তো। তোমার হাসিটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।’

আমি মুগ্ধের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ করেই দু চোখ পানিতে টলমল করে উঠলো। গাল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ থেকে লুকিয়ে কান্নাগুলো মুছলাম। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই মুগ্ধ আমাকে বাধা দিয়ে দাঁড়ালো। বললো,

‘ভাবী, যাওয়ার আগে বলো তোমার মন ভালো হয়েছে কিনা!’
আমি তার দিকে চুপচাপ চেয়ে আছি। এখন তো ছেলেটাকে মিথ্যা বলতেও ভয় লাগছে। আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুগ্ধ বললো,

‘সমস্যা নেই। দাঁড়াও আমি তোমার মন ভালো করে দিচ্ছি এখনই!’
এই বলে মুগ্ধ তার চেহারাটা বিভিন্ন রকম করে পাল্টাতে লাগলো। একবার ঠোঁট দুটো টেনে তো অন্যবার চোখ দুটো উল্টে। মুখ থেকেও কি যেন অদ্ভুত কিছু শব্দ করছে সে। এটুকু শুনে আমি আর না হেসে পারলাম না। চওড়া এক হাসি হেসে মুগ্ধকে আরো একবার আদর করে দিলাম। তার চুলগুলো এলোমেলো করে বললাম,

‘আমার মন ভালো হয়ে গেছে, জনাব মুগ্ধ! চলুন, এজন্য আপনাকে মজার কিছু বানিয়ে দেই।’
মুগ্ধ খুশি হয়ে বড়দের মতো বললো,
‘আপনাকে আমার মনের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমার প্রিয় ভাবী!’

আমি আর সে হো হো করে হেসে উঠলাম। এমন সময় ড্রয়িংরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ এলো। মুখর ভেতরে আসতে আসতেই কিছুটা অভিমানী সুরে বলে উঠলো,
‘আমাকে ছাড়াই সব মজা করে ফেলছেন আপনারা! উহু..নট ফেয়ার।’

দেখতে দেখতেই আমাদের সংসার জীবনের প্রায় সাড়ে তিনটে বছর চলে গেল! এর মাঝেই আমাদের কোল জুড়ে এলো একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। যার নাম দিয়েছি মায়িদা! মেয়েটা আমাদের সবারই বেশ আদরের হয়েছে। তার এখন আড়াই বছর চলছে। মুখে ফুটেছে আদো আদো বুলি, যা শুনতে বেশ মধুর লাগে! তবে মেয়েটা তার বাবা-মা থেকেও বেশি ভালোবাসে তার ছোট চাচাকে। মুগ্ধ এখন দিনের অর্ধেকটা-ই মায়িদার সাথে খেলাধুলায় কাটিয়ে দেয়। আর ছোট্ট মেয়েটা মামাকে পেলে কি যে খুশি! কি জানি মুগ্ধের ভেতর সে এতো খুশির কি পায়!

তবে আজ মেজাজটা একটু বেশিই খারাপ আমার! একে তো মুখর দেরিতে বাজার এনেছে, তারউপর ডিমের বদলে এনেছে এতোগুলো শুটকি। বাসায় ইতোমধ্যে ঢের শুটকি থেকে গেছে। তাই রাগ নিয়ে একটু চিৎকার করে মুগ্ধকে বললাম,
‘শুনছিস মুগ্ধ, আজও তোর ডিম খাওয়া হবে না!’

মুগ্ধ প্রথমদিকে আমার রাগ বুঝতে পারেনি। মায়িদাকে কোলে নিয়ে আমায় বললো সে,
‘ঠিক আছে ভাবী, সমস্যা নেই। ডিম ছাড়া-ই খেতে পারবো আমি!’
মুখর ফ্রেশ হয়ে সবে বেরিয়েছি। এ দেখে মুখরকে শুনিয়েই মুগ্ধকে বললাম,
‘ডিমের বদলে তুই বরং এই শুটকিগুলোই চিবিয়ে খেয়ে নিস।’

মুখর আমার কথা শুনে সোজা রান্নাঘরে চলে এলো। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করতে করতে বললো,
‘আরেহ, কাজের এতো চাপ ছিল কি আর বলবো! তাই ভুলে ডিমের বদলে শুটকি নিয়ে এসেছি।’
আমি মুখরের দিকে একবারও ফিরলাম না। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘আজ আপনাকে কাঁচা শুটকি খাওয়াবো, অপেক্ষা করুন!’

মুখর আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। কিছুটা আহ্লাদী হয়ে বললো,
‘আহ! এতো রাগছেন কেন বলুন তো, মিস.তিথিয়া?’
কথাটায় রাগ যেন তরতর করে আরো বেড়ে গেল। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালাম মুখরের দিকে। মুখর আড়চোখে তা দেখেও পাত্তা দিলো না। আমার দিকে পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘নিন, পানি পান করুন। দেখবেন রাগ সব ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে।’
বাবার মুখে ‘ফুড়ুৎ’ শব্দটা শুনে মায়িদা খিলখিল করে হেসে উঠলো। তার অমায়িক হাসিতে চোখ গেল আমাদের সবার। মুখর মায়িদার দিকে এগিয়ে আসতে আসতেই আদুরে গলায় বললো,
‘ইশ! আমার প্রিন্সেসটা হাসছে কেন? হুম? এদিকে এসো, আমার মা!’

মায়িদাকে কোলে তুলে মুখর তার সাথে দুষ্টুমি করতে লাগলো। খানিকক্ষণ পর, আমাকে জ্বালাতে মুখর মায়িদাকে বলে উঠলো,
‘তোমার মাম্মা আমার সাথে ঝগড়া করছে, দেখছো?’
আমি মুখরের দিকে তাকাতেই দেখি মায়িদা তার বাবার কথা বোঝার ভান করে বললো,
‘ঝগগা?’

মুখরও মাথা দুলিয়ে মেয়ের সাথে তাল মেলালো। মায়িদা তখন আমার দিকে দেখে বললো,
‘বাববা-মাম্মা ঝগগা!’
তার আদো আদো কথাতে আমার রাগটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। ফিক করে হেসে দিলাম আমি। আমার সাথে হাসছে মুগ্ধও! আর মুখর আমাকে নিয়ে তার যাবতীয় অভিযোগ পেশ করছে মেয়ের সামনে। মায়িদাও যেন বাবার সব কথা বেশ বুঝতে পারছে! বাবার সাথে মিষ্টি মিষ্টি করে কি যেন বলছে সে! দেখেই আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। মেয়েটা দেখতে যে এতো মিষ্টি হয়েছে!

প্রতিদিনের মতো আজও আমি আর মুখর বসে রাতের আকাশটা দেখছি। মায়িদা আমার কোলে আয়েশ করে ঘুমুচ্ছে। মেয়েটা হওয়ার পর থেকেই আমরা আকাশ দেখার সাথে সাথে আমাদের মেয়েটাকেও দেখি। তার দেহের সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্ম ভাঁজও যেন আমাদের চোখ এড়ায় না। আজও তার নিষ্পাপ মুখখানা দেখে দুজনেই চোখ জুড়িয়ে নিলাম। মেয়েটার মুখটা দেখেই আমি আনমনে বললাম,

‘মুখর সাহেব, মেয়েটা একদম আপনার মতোই হয়েছে।’
মুখর প্রতিবারের মতো আজও আমার কথার বিপরীতে বললো,
‘না, মিস.তিথিয়া। মায়িদা একদম তার মায়ের মতো হয়েছে দেখতে।’
আমি প্রত্যুত্তরে হেসে আর কিছু বললাম না। লোকটার সাথে এ বিষয়ে আমি কখনোই পারবো না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে চাঁদ দেখতে দেখতেই বললাম,

‘আমাদের প্রণয়টা খুব অদ্ভুতভাবেই হলো, তাই না মুখর সাহেব? আপনার সাথে প্রথম দেখাটা ভীষণ অদ্ভুত ছিল। আপনার সাথে আমার বিয়ে হওয়াটাও ছিল বড্ড অদ্ভুত! যা ভাবলেই আমার হাসি পায়।’
মুখর গলাটা অত্যাধিক শান্ত করে হঠাৎ বললো,

‘আমি অন্যদের মতো নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে পারিনি বলেই আমাদের প্রণয়টা খুব অদ্ভুত ছিলো। হায়! নিজের ভালোবাসার কথাটাও অন্যদের মতো সাহস নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলতে পারিনি!’
মুখরকে আচমকা কেমন দুঃখিত দেখালো। ছেলেটা এতো ছোট বিষয়েও এমন মন খারাপ করছে কেন?
তার কাঁধে মাথাটা রেখে আমি বললাম,

‘আপনাকে ভালোবাসি এটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য। অতোসব বিলাসিতা আমি কখনোই হজম করতে পারিনি। আমার যে অদ্ভুত বিষয়গুলোই প্রিয়। ঠিক যেমন আপনি এবং আমাদের অদ্ভুত প্রণয়নামাটা প্রিয়!’
মুখর মুচকি হাসলো। কিছুক্ষণ পর সে অনুরোধের সুরে বললো,

‘আর একটাবার বলবেন, মিস.তিথিয়া!’
আমি তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি ছুঁড়ে বললাম,
‘কি বলবো?’
সেও হালকা লজ্জা পেয়ে বললো,
‘ঐ যে ঐ কথাটা!’
আমি বুঝতে না পেরে বললাম,
‘কোন কথাটা?’
‘আরে আপনি বুঝছেন না! ঐযে..’
‘ঐ যে..?’

মুখর এবার রাগ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অভিমান নিয়ে বললো,
‘অনেক হয়েছে! দরকার নেই আপনার বলার।’
এমন সময় আড়মোড়া ভেঙে মায়িদা শব্দ করে কান্না করে উঠলো। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও সে শান্ত হলো না। মুখর এবার আমার কোল থেকে মায়িদাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাকে শান্ত করলো! বেশ কিছুক্ষণ পর, মেয়েটা বাবার কাঁধেই ঘুমিয়ে গেল। মুখর আলতো করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আমরাও বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঠিক তখনই ফিসফিস করে মুখরের কানের কাছে বললাম আমি,

‘আপনাকে খুব ভালোবাসি, মুখর সাহেব!’
ঘন অন্ধকারে মুখরের চেহারাটা দৃশ্যমান হলো না। তবে সে পরম আদরে আমার কপাল জুড়ে একটা দীর্ঘ চুমু বসিয়ে দিলো। যা থেকে বুঝতে পারলাম, মানুষটা আমার কথায় বেশ খুশি হয়েছে! এভাবেই যেন আমাদের অদ্ভুত প্রণয়নামা সার্থকতা লাভ করলো।

(সমাপ্ত)

(দীর্ঘ দু’মাস পর গল্পটার ইতি টানলাম। গল্পটা প্রথম যেদিন দিয়েছি, ভেবেছিলাম হয়তো তেমন কেউই পড়বে না। কিন্তু গল্পের পাঠকসংখ্যা দেখে আমি মুগ্ধ! আর পাঠকদের ভালোবাসা তো আমায় আরো মহিমান্বিত করেছে। প্রতিদিন একটা চিন্তা-ই মাথায় থেকে যেত, ‘কবে গল্পের নতুন পর্ব দেবো?’ আপনাদের ভালোবাসা আর আন্তরিকতা আমায় লিখতে বেশ অনুপ্রাণিত করেছে। সাথে মুখর-তিথিয়া জুটিটাও পেয়েছে পূর্ণতা! অনেক বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ধৈর্য সহকারে আমার গল্পটা শেষ অবধি পড়ার জন্য। প্রথম লিখছি বলে কোথাও না কোথাও ভুল হয়েছে ঠিকই, তবে দিনশেষে আপনারা তা আমায় শুধরে দিয়ে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। অবশেষে বলবো, গল্পটা কেমন লাগলো জানাবেন এবং অসংখ্য ধন্যবাদ।🖤)

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৪০