অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৮

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৮
তাশরিন মোহেরা

‘যাবেন না, মিস.তিথিয়া! আমাকে ছেড়ে যাবেন না আপনি। প্লিজ যাবেন না। আমি আপনাকে ভীষণ রকমের ভালোবাসি! আমায় এভাবে ফেলে চলে গেলে খুব অন্যায় হবে। খুব!’

মুখরের আধভেঁজা বেদনাময় কণ্ঠে কথাগুলো কেমন যেন করে ঠেকলো আমার কানজোড়ায়। বুকটা ধুকপুক করতে করতেই যেন হুট করে থেমে গেল। সবকিছু উপেক্ষা করে চারিদিকে ধ্বনিত হতে লাগলো একটাই বাক্য, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’। ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’ কথাটা শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাক্যটা দেখতে যত ছোট হোক না কেন, এর মাহাত্ম্য অনেক। অন্তত মুখরের মতো শক্ত নীতিবদ্ধ ব্যক্তিত্বের কাছে আমি এটাই আশা করি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুখরের সাথে আমার প্রথম দেখাটা খুবই আজব প্রকৃতির ছিল। এরপর থেকেই তার সাথে একটু আধটু খুনসুটিতেই কেটে গেল অনেকটা মাস। আমি গম্ভীরমুখো মহৎ ব্যক্তিত্বের এই ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেলাম, যে কিনা মুচকি হাসাতেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আমায় ভয় দেখাতো। তাকে ভালোবাসাটা কেমন অজান্তেই হয়েছে আমার! ভালোবাসাটাকে ভালোলাগা বলে ক’বার যে ভুল করেছি! ক’বার এই ভালোবাসাটাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে রাস্তায় অন্য ছেলের দিকে হা করে মিনিটখানেক চেয়ে থেকেছি। তবে চোখ যে আমার বারংবার এক মানুষকে দেখতেই অভ্যস্ত! এই চোখ কি আর অন্য কোনো পুরুষের রূপে মোহাবিষ্ট হতে পারে? এই মন কি আর অন্য কারো দিকে আকৃষ্ট হতে পারে?

তবে এই গম্ভীরমুখো ছেলেটা এখন বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তার গাম্ভীর্যের চোয়ালটা ভেঙে ধীরে ধীরে এখন হাসিমুখে পরিণত হয়েছে। অন্যদের কাছে ছেলেটা এখন তার অনুভূতিদের প্রকাশ করতে পারে। প্রাণখুলে হেসেখেলে চারদিক মাতাতে পারে এই মুখর! তাই তার আমাকে ভালোবাসার কথাটা হুট করে বলে ফেলাতে আমি ভীষণ চমকে গেছি। তাকে ভালোবেসেছি আমি বহু আগে, তবে ভালোবাসার কথাটা কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি।

‘ভালোবাসি’ এই ছোট্ট কথাটা যেন মুহুর্তেই আমার জন্য খুব কঠিন কিছু হয়ে গেল। আর এই ছেলেটা কিনা এই কথাটাই আমায় কথাচ্ছলে বলে দিল? আমার প্রতি তার এই ভালোবাসাটা হলো কি করে? কবেই বা আমি তাকে নিজের প্রেমে ডুবিয়ে দিলাম। আব্বা যখন বলেছে মুখর আমায় বিয়ে করতে চায়, আমি সে রাত সারাক্ষণ চিন্তা করেছি। জানতে চেয়েছি মুখর আমায় কেন ভালোবাসলো? কিন্তু এর উত্তর আমি বের করতে পারিনি! যে মানুষটা আমায় ভালোবেসেছে তার কাছেই এর উত্তম উত্তর থাকা উচিৎ তাই না?

কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর জানার মতো পরিস্থিতিতে আমি এখন নেই। যা হওয়ার কথা ছিল তা এখন হচ্ছে না! বরং যার ভয়টাই আমি পেয়েছি তা-ই হচ্ছে! তাই এ মুহুর্তে মুখরের বেদনামাখা মুখশ্রী আমি দেখতে পারবো না! কিছুতেই পারবো না। বুকের উপর কি যেন দেবে আছে মনে হলো আমার! দেবে থাকা এই অদৃশ্য কিছুই আমায় ক্ষণে ক্ষণে দূর্বল করে ফেলছে। মনটা কেঁদে বলছে, ‘যা তিথি! মুখরের কাছে যা। তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনের সব ব্যাথাদের নিস্তার দে!’

কিন্তু আমার পা দুটো অবশ হয়ে আছে। মুখরের কাছে আমি যেতে পারবো না। পরিস্থিতিটা এখন এসবের নয়! আমি একটুও পিছু ফিরলাম না। মুখরের কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। যা হবার হবে, কিন্তু আমার এই পোড়া কপালের সাথে মুখরকে কিছুতেই সংযুক্ত করতে পারবো না আমি! সে থাকুক তার মতোই! সমউ সবটা ঠিক করে দেবে।
একঝাঁক পিছুটান ফেলে চুপচাপ এগিয়ে গেলাম ড্রয়িংরুমের দিকে।

তবে পর্দার আড়াল হতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথোপকথন তখনই আমায় মাঝপথে থামিয়ে দিলো। আন্টি আর আব্বা বসে কথা বলছেন সেথায়। আন্টি আব্বার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘অতীতকে মনে চেপে কেন আপনি আপনার বর্তমান আর ভবিষ্যৎটা নষ্ট করছেন, জহির ভাই?’
আব্বার রাগটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। তিনি অস্বাভাবিক রকমের শান্ত হয়ে আছেন। আন্টির কথায় তিনি কিছুই বলছেন না। উত্তর না পেয়ে আন্টিও আব্বাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,

‘আমাদের মাঝে অতীতে যা হয়েছে তা থেকে সরে আসুন, জহির ভাই। আপনি আপনার ফুটফুটে মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করছেন! তিথিয়া যাকে মন থেকে মানছে না তার কাঁধে সারাটাজীবন ঝুলে থাকাটা তিথিয়ার জন্য অন্যায় হবে। আর এই বিষয়টা আপনি ছাড়া ভালো আর কে বুঝবে, বলুন তো!’
আব্বা কেমন যেন চটলেন। বিরক্তি নিয়ে বললেন,

‘আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তোর এসব ভাবা উচিৎ ছিল, আমেনা। আমার মনে হয় না আমি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি! তাই এতো বছর পর অতীতটাকে আর টেনে আনিস না।’
তাদের কথোপকথন ভীষণ অগোছালো ঠেকলো আমার কাছে। ভ্রু কুঁচকে বেশ খানিকক্ষণ ভাবলাম। কিন্তু নাহ! বিষয়টা আরো গভীরভাবে ভাবা দরকার। এমন সময় পেছন হতে কেউ গলা খাকারি দিলো। আমি শিউরে উঠলাম হঠাৎ। পেছনে তাকিয়ে দেখি মুখর হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো সে,

‘এখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? যান, আপনার আব্বার সাথে কুমিল্লায় চলে যান। বিয়ের করার তো খুব শখ জন্মেছে!’
এটুকু বলে সে অসন্তুষ্ট ভাব নিয়ে পাশে তাকিয়ে রইলো। তার চোখমুখ জুড়ে কেমন একটা কোমল ভাব। আমার কেন যেন মায়া হলো। কিন্তু এখনের কথোপকথনটা একদমই মিস করা যাবে না। তাই মুখরকে ইশারায় চুপ হতে বলে ফিসফিস করলাম,

‘থামুন, জরুরি কিছু শুনছি!’
সেও আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকলো। আমার হাবভাবটা তার মাথায় ঠেকছে না। আমি তার হাত ধরে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে বোঝালাম পর্দার আড়ালে যা হচ্ছে তা শুনতে। আমি আবারো মনোযোগ দিলাম তাতে। আব্বা হঠাৎ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। রাগটা আবার চড়াও হয়েছে তার মাথায়।

গলাটাও কেমন কাঁপা কাঁপা। চরম রাগ তিনি আন্টিকে বলছেন,
‘তোর সাথে জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়েছি আমি। উঠতি বয়সে তোর প্রেমেও পড়ে গিয়েছিলাম। প্রায় পাঁচটা বছর তোকে গোপনে ভালোবেসেছি। কিন্তু ভালোবাসার কথাটা যখন তোকে প্রকাশ করলাম তুই আমায় প্রত্যাখ্যান করলি। আর ক’দিন পর বিয়ে করলি আমারই কাছের বন্ধু হাসিবকে। আমি কি করে মেনে নিতাম বল! নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি! ভালোবেসেছি বলে তোকেও দোষারোপ করতে পারিনি। এর বাইরে তুই আমার কাছ থেকে কি আশা রাখিস? তোর ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়েটা কি করে মেনে নেবো?’

আন্টি হু হু কেঁদে উঠলেন। এদিকে আমার ঠোঁট জোড়া আপনাআপনিই একে অপর থেকে আলাদা হয়ে গেল। মুখে হাত দিয়ে মুখরের দিকে চাইতেই দেখলাম তার মুখাভঙ্গিও একই! আমরা দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে রইলাম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে! আন্টির কান্না দেখে আব্বার মনটা বোধহয় কিছুটা গললো।

তবে অভিমানটা গেল না। অভিমানী সুরে তিনি বলছেন,
‘ভালোবাসাটা আমার জীবনে কখনো ঠাঁই পায়নি। তোকে হারানোর বেশ কয়েকটা বছর আমি সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে যাই। কোনোকিছুতেই নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পারছিলাম না। কষ্টে মনটা অসাড় হয়ে গিয়েছিলো। আর তুই তখন নতুন স্বামী, সংসার নিয়ে মজে ছিলি! আমার কথা কি একবারও মনে পড়েনি তোর, আমেনা? আমায় এভাবে নিঃশব্দে প্রত্যাখ্যান করে কি করে এতো খুশি থাকতে পারলি তুই?’

আন্টি তার কান্না থামিয়ে বলে উঠলেন,
‘আমি কখনোই আপনাকে প্রত্যাখ্যান করিনি, জহির ভাই! আমি তো আপনাকে নিজের ভাই ছাড়া অন্য কোনো চোখে কখনো দেখতেই পারিনি। তাই আমাকে দেওয়া আপনার প্রেমের প্রস্তাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলাম আমি। আমি চাইনি ভালোবাসা নামক বিষয়টা এভাবে আমাদের মাঝে দেয়াল হয়ে চলে আসুক। আর হাসিবকে আমি প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। যার কারণে তার সাথে থাকার লোভটা সংবরণ কর‍তে পারিনি আমি। আমায় ক্ষমা করে দেবেন, জহির ভাই! ক্ষমা করে দেবেন।’

আন্টিকে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে মুখর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সে কথোপকথনটা সেখানেই থামাতে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। এতো বছর পর দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির প্রলেপটা দূর্বল হতে চলেছে। এর মাঝে কারোরই হস্তক্ষেপ করা উচিৎ নয়। আমি তাকে ইশারায় শান্ত হতে বললাম। আব্বার ভীতটাও এবার নড়বড়ে হলো। তিনি ধপাস করে বসে পড়লেন সোফায়। মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনায় লিপ্ত হলেন। আন্টিও নাক টেনে কাঁদছেন। আব্বা একবুক কষ্ট নিয়ে বললেন,

‘তোর পর তিথির মা’কেই আমি মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম। সেও কারো প্রেমের কাঙাল হয়ে আমায় বাধ্যগত ভাবে বিয়েটা করেছিল। তাই আমরা একে অপরকে বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিলাম। তবে আমার অতিরিক্ত ভালোবাসাটাই তাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আর আমি কিনা বারংবার মেয়েটাকেই দোষারোপ করেছি!’
আন্টি কান্নাটা থামিয়ে হঠাৎ দৃঢ় হয়ে উঠলেন। বললেন,

‘জহির ভাই, আপনি কি তবে চান যে আপনার মেয়েটাও এভাবে আপনারই মতো করে আজীবন ধুকে ধুকে মরুক?’
আব্বা কেমন যেন ছটফট করতে লাগলো। আন্টি এই সুযোগে আরো বললেন,
‘ফুটফুটে মেয়েটা ক’দিনেই কেমন শুকিয়ে মলিন হয়ে গেছে। মেয়েটার চেহারায় বেদনার ভাব স্পষ্ট, জহির ভাই। আপনি বাবা হয়ে কিছুতেই মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারেন না।’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৭

আব্বা মাথাটা চেপে ধরলো শক্ত হাতে। ঘামতে শুরু করলো তৎক্ষণাৎ। শ্বাস নেওয়াটাও বাড়লো ভীষণ। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দৌঁড়ে পর্দার আড়াল হতে আব্বার কাছে ছুটে যাই। আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ছলছল দৃষ্টিতে। আমার মুখটা আলতো হাতে স্পর্শ করে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। আমি এতে ভীষণ চমকে উঠি। ভয়ে সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো আমার। কিছুদিন আগের ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না তো! জলদি মুখরের সাহায্য আব্বাকে আবারো হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো!

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৯