আলোছায়া পর্ব ৯

আলোছায়া পর্ব ৯
ফারহানা কবীর মানাল

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেঁজুতি সোফায় বসে আছে আর মা’য়ের সাথে কথা বলছে, ও-কে এখানে দেখে আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। এই মেয়ে এতো ডেঞ্জারাস তা তো আগে জানা ছিলো না। আমি ওঁদের কাছে যাওয়ার আগেই সেঁজুতি কাঁধে ব্যাগ তুলে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আমি তখন মহা টেনশনে আছি।
মা’য়ের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ” মা ওই মেয়ে তোমাকে কি বলে গেলো?”

–” কেন তুই চিনিস নাকি ও-কে? মেয়েটা বড্ড ভালো রে৷ ”
–” আমাদের কলেজেই পড়তো। তোমাকে কিছু বলছে নাকি? ”
মা মুচকি হেসে বললো, ” না রে বাবা। আমি এতোগুলো বাজারের ব্যাগ তুলে আনতে পারছিলাম না, আবার শাড়ি পায়ে জড়িয়ে পড়ে গেছিলাম, মেয়েটা দূর থেকে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে উঠালো, তারপর ব্যাগগুলো বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে গেলো। এমন ভালো মেয়ে এখন পাওয়া যায় না। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি মুচকি হেসে চলে এলাম। যাক শয়তানি আমার নামে কিছু বলেনি। কিন্তু এদিকে ও কোথায় যাচ্ছে? ও-র বাড়ি তো এদিকে নয়। কি জানি, থাকবে কোনো কাজ। টোটোকোম্পানির চাকরিটা বাঁচাতে রেডি হয়ে বের হলাম। দরজার কাছে আবারও মা’য়ের সাথে দেখা।

–” সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াস? মেয়েটার মতো ভালো কিছু তো করতে পারিস নাকি?”
–” কোন মেয়েটা?”
–” আরে ও-ই মেয়েটা, সকালে যাকে দেখলি। তাড়াহুড়ায় নামটা জানতেই ভুলে গেছি। ”
–” কি ভালো কাজ করে শুনি?”
–” ওইতো সামনের পার্কে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ায়, আমার ছেলেটা যে কেন এমন ভালো হলো না কে জানে!”
–” তো আমি কি খারাপ নাকি?”
–” না না বাবা। ”

মা’য়ের উপর রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। সব হয়েছে ওই সেঁজুতিটার জন্য। কি এমন ভালো কাজ করে আমি দেখতে যাবো এখন। হয়তো প্রেম করছে পার্কে বসে আর এদিকে ভালো সেজে বেড়ানো হচ্ছে। পার্কে গিয়ে দেখলাম সেঁজুতি কতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে কিসব করছে, বাচ্চাগুলো গোল করে ঘিরে রেখেছে ও-কে। আমি ও-র কাছে গিয়ে বললাম,
” কি রে তুই সকাল সকাল আমার মা’য়ের কাছে এমন ভালো সাজতে গেলি কেন? দেখ আমার তোকে পছন্দ না। আর আমার মা’য়ের আর কোনো ছেলেও নেই। তা-ই আমার মা’কে তেল দিয়ে লাভ নেই। ও বাড়িতে তোর বিয়ে হবে না। ”
সেঁজুতি কয়েক মিনিট ভেবে বললো, ” সকালের মহিলাটা তোর মা ছিলেন? ”

–” হ্যাঁ। ”
–” আমি যদি জানতাম ওইটা তোর মা তাহলে আরো বেশি করে পটিয়ে আসতাম। ভাবি নয় তোর বউ হতে… হা হা হা! ”
সেঁজুতি হয়তো কথাগুলো মজা করে বলেছিলো তবে আমি সিরিয়াসভাবে নিয়েছিলাম। এরপর রোজ পার্কে গিয়ে ও-র সাথে দেখা করা, অনেক সময় বসে গল্প করতাম। মাস খানেক পর একদিন সেঁজুতিকে প্রশ্ন করলাম, ” একটা কথা বলবি?”
–” হুম, বল কি কথা।”

–” তুই কি সেদিন কি ওই কথাগুলো সত্যি বলেছিলি? ”
–” কোন দিন? কি কথা?”
–” যেদিন আমি প্রথম এই পার্কে এসেছিলাম, ”
–” তুই কবে প্রথম এসেছিস আমি কি জানি? তোর বাড়ি তো এখানে। ”
–” যেদিন এখানে তোর সাথে দেখা হয়েছিলো, ওই আমার মা’কে শাশুড়ি, ওই কথাটা। ”
–” ওইটা তো কথায় কথায় মজা করে বলেছিলাম। ”
–” ওহ্, সরি। ”

খুব খারাপ লেগেছিলো সেদিন, সরি বলেন সেখান দিয়ে চলে আসছিলাম এমন সময় সেঁজুতি আমাকে পিছন দিয়ে ডাক দিলো। তারপর
–” কেন তুই কি আমাকে পছন্দ করিস?”
–” ভালোবাসি! ”

কথাটা আস্তে বলেছিলাম, তবে সেঁজুতি শুনে ফেলেছিলো। মুখ কালো করে বললো, ” একটু ওদিকে চল তো। ”
ভেবেছিলাম হয়তো থাপ্পড় দিবে, কিন্তু আমার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ও আমার দুই কাঁধে হাত রাখলো, তারপর চোখ বন্ধ করে আমার ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে একটা চুমু এঁকে দিলো আমার ঠোঁটে, তারপর দুইহাত দিয়ে ও-র মুখ ঢেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। কতটা ভালো লেগে ছিলো বলে বোঝাতে পারবো না।

তারপর থেকে দু’জনের পথ চলা শুরু, রোজ কথা বলা, দেখা করা, একদিন ও ও-র মা’য়ের কাছে ধরা পড়ে গেলো। ও-র বাড়ি দিয়ে ওর বিয়ে ঠিক করলো। তখন সবে মাত্র অনার্স ২য় বর্ষে পড়ি আমরা দুইজন। ঠিক করলাম দুইজন পালিয়ে যাবো। দূরে কোথাও গিয়ে টিউশনি করে সংসার চালাবো, অভাব থাকলেও কষ্ট থাকবে না। কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো কিছুই জানতাম না। এইসব নিয়ে কথা বলতেই সেদিন সেঁজুতিকে পার্কে আসতে বলেছিলাম।

সেঁজুতি এসেছিলো, আমিও গেছিলাম। কিন্তু সব শেষ তো সুখের হয় না। একটা মোটরসাইকেল সেঁজুতিকে ধাক্কা দিলো, সেঁজুতি মাটিতে পড়ে গেলো। আমি এ পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে পা জড়িয়ে পড়ে গেলাম। একটা বাস সেঁজুতিকে চাপা দিয়ে ও-র পর দিয়ে চলে গেলো। আমি দৌড়ে গিয়ে ও-কে জড়িয়ে ধরলাম। ও ততোক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে। একটা বন্ধুকে কল দিয়ে আসতে বললাম, তারপর ও-কে নিয়ে জেলা হাসপাতালে চলে এলাম।

ডাক্তাররা বললেন যে অবস্থা ভালো না বিভাগীয় হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমাদের কিছু করার নেই। দেরী না করে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ও-কে নিয়ে গেলাম। বেডে নিবে এমন সময় ও-র জ্ঞান আসলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ” একটা কিস করবে আমাকে?”

আমি ও-কে জড়িয়ে ধরলাম। ততো সময় ও-কে নিতে চলে এসেছে, ও চোখ মেলে কিছু সময় চারদিকে দেখলো তারপর চিরতরে চোখ বন্ধ করে নিলো। এরপর থেকে আমার আর কোনো জ্ঞান ছিলো না, যতো সময় অজ্ঞান থাকতাম ততো সময় ভালো থাকতাম, জেগে উঠলে শুধু কাঁদতাম। ছয়দিন পর একটু স্বািহলাম। ও-র কবরে মাটি দিয়ে আসলাম। সেঁজুতির বাড়ি দিয়ে আমার নামে কেস করলো, খুনের! পরবর্তীতে ওঁরা কেস তুলেও নিয়েছিলো, কারণটা আমি জানি না। তারপর আর কি বড্ড এলোমেলো হয়ে গেলাম। খেতাম না, রাতে ঘুম আসতো না। চোখ বন্ধ করলে ও-র মরার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠত। এভাবেই দিন চলে যেতে লাগলো।

মিরা এতো সময় নিরবে সবকিছু শুনলেও এবার বলে উঠলো, ” তার তো কোনো দোষ ছিলো না। আপনি কেন নিজেকে কষ্ট দিবেন? ”
আশরাফুল মুচকি হেসে মিরার দিকে তাকালো। মিরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কপল দুইটা পানিতে ভিজে গেছে একদম। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে আছে। আশরাফুল হাত বাড়িয়ে মিরার চোখ মুছে দিলো। মিরা ইতস্তত হয়ে নড়েচড়ে বসলো।

–” আপনার জীবন তো একদম সিনেমার মতো। ”
–” তোমার কাছে হয়তো নাটক সিনেমার মতো কিন্তু এটাই আমার জীবন। ”
মিরার কেমন যেন খারাপ লাগছে, বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না, কিছু জড়িয়ে ধরে কাঁদলে হয়তো একটু ভালো লাগবে। তাই ঘরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আশরাফুল বলে উঠলো, ” চলে যাচ্ছো? আমার জীবন কাহিনী শুনবে না?”
মিরা আবারও বসে পড়লো। তারপর নিরাশ হয়ে বললো, ” এখনো শেষ হয়নি?”

–” না রে! কষ্টের জীবনের শুরুই তো এখান থেকে। ”
–” ওহ্!”
এভাবে দিন কাটতে থাকে, ঘুমের ঔষধ খেলে হয়তো কখনো কখনো ঘুম আসতো। সবকিছুর ভিতর একটা জিনিস আমার খেয়াল ছিলো যে আমি বড় ছেলের বাপের, পড়াশোনা আগের মতোই চালিয়ে যেতে লাগলাম, কিন্তু পড়তে পারতাম না, চোখের পানিতে বই ভিজে যেতো, পরীক্ষার খাতায় কি লিখবো খুঁজে পেতাম না, এভাবে সময় চলে যেতে লাগলো,

এক দিন দুই দিন, এক বছর দুই বছর, এভাবে তিন বছর পার হয়ে গেলো। পড়াশোনা খুব বেশি ভালো হচ্ছিল না, তখনই আমার জীবনে আসে মিতালি। যাকে একদম তোমার মতো দেখতে, মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে আমার সবকিছু বুঝে যেতো, আমার ছোট ছোট কষ্ট গুলো খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারতো, প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর আস্তে আস্তে প্রেম, সেখান দিয়ে কবে জানি ভালোবেসে ফেললাম।

মিতালির বয়স তোমার মতো, আমাদের বয়সের পার্থক্য থাকলেও সম্পর্কে তেমন কোনো সমস্যা হতো না। ও-কে নিজের করে পাওয়ার জন্য আবারও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। বেকার বলে সেঁজুতিকে ও-র বাড়ি থেকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চায়নি। মিতালি যেন সেভাবে হারাতে না হয় তাই দিন-রাত কষ্ট করতাম। জীবনটা আবারও নতুন রঙে ভরে গেলো।

আমি যেদিন চাকরি পেয়েছিলাম, কতটা খুশি হয়েছিলাম তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না, এবার মিতালির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিবো, আগের ভুলটা আর হবে না। বেশ কয়েকদিন ধরে মিতালির মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গেছিলো। আমাদের তেমন যোগাযোগ হতো না।

কথা বলতে না পারলে আমার দম আটকে যেতো মনে হয়। তাই সেদিন বাবার কাছ দিয়ে টাকা নিয়ে ও-র জন্য একটা মোবাইল কিনলাম, কথা না বলতে পারলে আমার কিছুই ভালো লাগতো না। ও-র জন্য কেনা মোবাইল নিয়ে পার্কে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিতালি প্রায় দিন এখানে ঘুরতে আসে বিকালে, যখন কথা হতো তখন মিতালিই বলেছিলো।

আলোছায়া পর্ব ৮

ওদের পাড়াতে আমি আগে কখনো যাইনি, সেদিনই প্রথম গেছিলাম সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, মনে মনে কত কিছু ভেবেছিলাম, মিতালি কতোটা খুশি হবে আমাকে দেখে, ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠছিলো।

আলোছায়া পর্ব ১০