আলোছায়া পর্ব ১৪

আলোছায়া পর্ব ১৪
ফারহানা কবীর মানাল

আশরাফুল নিজের কাজে চলে যায়। মিরার সাত-পাঁচ না ভেবে জিলাপিতে কামড় বসায়। কতদিন হয়ে গেলো তার পছন্দের মিষ্টি খায়নি।

সকাল থেকে নিজের সকল কাগজপত্র রেডি করছে মিরা, আজ আশরাফুল তাকে কলেজে নিয়ে যাবে। এই দুইদিনে ওই লোকটার কাছ থেকে চারটা চিঠি পেয়েছে মিরা, একটাও পড়ে দেখেনি। কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছে। মিরা নতুন কোনো টেনশন নিতে চায় না, আশরাফুল তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেই হলো। মিরার সামনে নতুন সাজানো জীবন পড়ে আছে, সে-ই বাগানের পথে মাত্র কয়েকটা লোভনীয় জিনিস, মিরা ও-ই লোভের ফাঁদে পা দিতে চায় না।
আশরাফুল সবকিছু গুছিয়ে মিরার কাছে এসে বলে, ” তুমি সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছো তো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। আশরাফুল মিরার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিরা খুব সুন্দর একটা কালো বোরকা আর কালো হিজাব পরেছে, মুখ খোলা। কিন্তু কোনো প্রকার প্রসাধনী ব্যবহার করেনি। এতেই মিরাকে বড্ড সুন্দর লাগছে।
–” আচ্ছা মিরা তুমি আগে কোন কলেজে পড়তে?”
–” আমি সে-ই কলেজেই পড়বো?”
আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, ” হুম, তোমার কিছু কাগজপত্র সেখানে জমা দেওয়া রয়েছে, অন্য কোথাও পড়তে গেলে তো সেগুলো আনতে হবে। ”

–” আমি জানি, শুধু জানতে চাইলাম। ”
আশরাফুল মুচকি হাসে। মিরা আশরাফুলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনে চলে এসেছে। হঠাৎ মিরা প্রশ্ন করে, ” আচ্ছা আমরা কিসে যাবো?”
–” আমার বাইকে যাবে?”
মিরা অবাক হয়। আশরাফুলের বাইক আছে, তা মিরা জানতো না, কখনো দেখেনি।
–” আপনার বাইকও আছে?”
–” হুম ছিলো একটা, কিন্তু আমার কাছে নেই। ওই যে বাড়িটা দেখছো ওইখানে থাকে। ”
–” আপনার যা ভালো লাগে। ”

মিরার বড্ড অবাক হয়, নিজের বাইক থাকতে কি কেউ অটোরিকশাতে চলাচল করে নাকি! তা-ও অন্য এক জায়গাতে রেখে দিয়েছে। হবে হয়তো কোনো কারণ। আশরাফুল গিয়ে বাইকটা নিয়ে আসে। তারপর মিরাকে ইশারা দিয়ে উঠতে বলে। মিরা বাইকের পিছনে উঠে বসে। সেভাবে কখনও কারো বাইকে চড়া হয়নি মিরার। সামান্য ভয় লাগেছে, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে এতো বড় মেয়ে বাইকে বসতে ভয় পাচ্ছে, এতো নেকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়। তবুও মিরা উসখুস করছে, শান্ত হয়ে বসতে পারছে না। আশরাফুল খুব শান্ত হয়ে বাইক চালাচ্ছে। খুব বেশি জোরে বা অনেক আস্তে নয়।

–” অসুবিধা হচ্ছে তোমার মিরা? তাহলে আমাকে ধরে বসতে পারো। ”
মিরার সত্যিই অসুবিধা হচ্ছে, তবে আশরাফুলকে ধরতে পারছে না৷ কোনো এক অজানা দেওয়ালে আটকে গেছে, কি এমন হবে আশরাফুলের কাঁধে হাত রাখলে, সে তো নিজেই অনুমতি দিচ্ছে তাকে ধরার, তবে কিসের এতো জড়তা। কয়েক মিনিট পর হয়ে গেলেও মিরা আশরাফুলের কাঁধে হাত রাখে না, আশরাফুল বাইকের গতি কমিয়ে দেয়।
মিরা আস্তে আস্তে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আগে পরে বাইকে ওঠেনি তার জন্যই হয়তো এতো সময় সমস্যা হচ্ছিল। কলেজের সামনে গাড়ি থামায় আশরাফুল। মিরা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে কলেজটাকে দেখছে। বিয়ের পর সে ভেবেছিলো আর পড়াশোনা হবে না। কিন্তু আজ সবকিছু নতুন করে শুরু হচ্ছে।

কলেজে গিয়ে জানতে পারে মিরাদের ফরম ফিলাপ চলছে, করোনার সমস্যার কারণে এতো দেরিতে ফরম ফিলাপ হচ্ছে। মিরা বেশ খুশি হয়, সে ভেবেছিলো তার হয়তো একটা বছর লস হবে, ভাগ্যক্রমে আজই ফরম ফিলাপের শেষ তারিখ ছিলো, আশরাফুল টাকা দিয়ে মিরার ফরম ফিলাপ করে দেয়। মিরার চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা ফুটে ওঠে। আশরাফুল টাকা না দিলে এতোগুলো টাকা জোগাড় করতে বেশ সমস্যায় পড়তো মিরা। কাজ শেষ করে দুইজন কলেজ থেকে বেরিয়ে পড়ে।
–” আপনাকে সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে হয়তো আমার আর পড়াশোনা হতো না। ”
–” তোমার পড়াশোনা বন্ধ তো আমার জন্যই হয়েছিলো, ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু হয়নি, বরং আমার তোমার কাছে মাপ চাওয়া উচিত। ”

আশরাফুল এতো ভালো ছেলে, ভাবতেও কেমন অবাক লাগে মিরার। এই মানুষটাকে এক সময় কত খারাপ ভেবেছে মিরা। সময় হয়তো সবকিছু বদলে দেয়। আগামী কয়দিন মিরা কলেজে আসবে, সব কিছুর সাজেশন নিতে হবে স্যারদের কাছ থেকে। কলেজের কেউ তার পরিচিত নয় তেমন, নতুন ভর্তি হয়েছিলো আর তখনই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিয়ে হয়ে গেছিলো। আশরাফুলের এমন সিদ্ধান্তে রেশমা বানু রাগারাগি করবেন না তো, হয়তো করবেন। এতো খুশির মাঝেও মিরার ভয় থেকেই যায়।

পাশাপাশি হেঁটে চলেছে মিরা আর আশরাফুল। আশরাফুল কলেজের সামনে বাইক রেখে এসেছে, যদিও ভেতরে গাড়ি নিয়ে আসতে পারতো কিন্তু আসেনি।
–” মিরা একটা জায়গাতে যাবে?”
–” কোথায় যাবো?”
–” বাড়ি যেতে ভালো লাগছে না, তুমি চাইলে একটু ঘুরতাম আর কি। ”
–” আচ্ছা, কিন্তু বাড়ির কাজগুলো রয়েছে তো। ”
–” তুমি সকালে রান্না করে রেখেছো? তোমার যদি সমস্যা থাকে তাহলে বাড়িতেই চলো। ”

মিরার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না। সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকতে কার ভালো লাগে। সকালে রান্না করে রেখেছিলো। দুপুরের রান্না নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। নিজের কয়েকটা কাপড় ভিজিয়ে রেখে এসেছিলো, বাড়ি গিয়ে ধূয়ে দিবে। এ ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই মিরার।
–” না সমস্যা নেই। আপনি চলেন কোথায় যাবেন। ”
–” আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানেই যাবে তুমি?”
আশরাফুলের এমন প্রশ্নের কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না মিরা প্রশ্নটা খুব সহজ তবে উত্তর দোওয়াটা বেশ শক্ত বলে মনে হচ্ছে মিরার। তবুও সাত-পাঁচ না ভেবে বলে,

–” হুম চলেন। ”
দুইজনে বাইকে চড়ে বসে, মিরা বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে আশরাফুলের থেকে, আশরাফুলও আস্তে আস্তে বাইক চালাচ্ছে। আজ মনটা খুব ভালো মিরার, জীবন আমাদের নতুন নতুন কতকিছুই না শেখায়!
–” মিরা ফুচকা খাবে?”
ফুচকা জিনিসটা বরাবরই মিরার বেশ পছন্দের। তাই আর না করতে পারে না। রাস্তার পাশে বাইক দাঁড় করিয়ে দুইজন হেঁটে ফুটপাতে চলে যায়। মিরার তেমন ঝাল খেতে পারে না। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। আশরাফুল নিজের মতো ফুচকার অর্ডার দেয়।
(মিরার কেন এতো ঢ়ং বুঝি না বাপু, বললেই হয় ঝাল কম খাই হুহ)

সামনাসামনি দুইটা চেয়ারে মিরা আর আশরাফুল বসে আছে। দুইজনের হাতে ফুচকার প্লেট। মিরা লোভ সামলাতে না পেয়ে একটা ফুচকা মুখে পুরে নেয়।
–” জানো মিরা, এই ফুটপাতে বসে ফুচকা খাওয়ার মজাই আলাদা। আমার এসব খুব ভালো লাগে, দামী দামী হোটেলের থেকে এখানের ফুচকা বেশ ভালো হয়। এই জায়গাতে আমি আগে প্রায়ই ফুচকা খেতে আসতাম। এখন অবশ্য তেমন আসা হয় না। ”

–” কেন এখন আসা হয় না কেন?”
–” যার সাথে আসতাম, সে নেই। ”
মিরা কিছু বলে না, তবে বেশ খারাপ লাগে আশরাফুলের জন্য। চলার পথে কত মানুষের সাথে কত স্মৃতি থাকে আমাদের। তাদের কেউ স্পেশাল কেউ হয়তো অনেক বেশি স্পেশাল হয়। তবুও তারা আমাদের জীবনে থাকে না, সময়ের স্রোতে তাদের কথা হয়তো আমরা ভুলে যাই। সব কথা কি আদো ভুলে যাওয়া যায়!

আশরাফুল হয়তো ফুচকা জিনিসটাতে ঝাল খুব পছন্দ করে। মিরা সবগুলো ফুচকা খেয়ে নিয়েছে বটে কিন্তু এখন ঝালে সবকিছু অন্ধকার দেখছে। চোখ নাক দিয়ে পানি পড়ছে, ঠোঁটেও ঝাল লেগেছে, ঠোঁট কামড়ে ঝাল কমানোর চেষ্টা করে চেলেছে, তখন ঝাম কম খাই বললে এই দশা হতো না। আজ রুমাল বা টিস্যু কোনোটাই সাথে আনেনি মিরা। কি একটা বিশ্রী অবস্থা! এখন কি হিজাব দিয়ে নাক মুছতে হবে নাকি!

আশরাফুল মিরাকে একটা রুমাল দিয়ে বলে, ” ঝাল খেতে পারো না তা বলবে তো নাকি!”
মিরা রুমালটা নিয়ে চোখ নাক মুছতে থাকে, আশরাফুলের কথাট জবাব পরেও দেওয়া যাবে আগে নিজে ঠিক হয়ে নিতে হবে। ”
–” রুমালটা কি আপনার?”
–” না তোমার জন্য পকেটে নিয়ে ঘুরছিলাম। দেখো ঠিক কাজে লেগে গেলো। ”
আশরাফুলের ট্যারা উত্তর শুনে মিরার বেশ রাগ হয়, পরক্ষণে নিজের বোকা বোকা প্রশ্নের জন্য নিজেকে ধমকাতে থাকে মনে মনে।

–” একটু পানি খেয়ে দেখো ঝাল কমে নাকি! তুমি বাচ্চাদের মতো ঝাল খেতে পারো না আমি বুঝতে পারিনি৷ ”
–” আমি তো বাচ্চাই নাকি হুহ। ”
–” হুম বাচ্চা বলা যায় তোমাকে, ঠিক সময়ে বিয়ে হলে নিজেই বাচ্চার মা হতে। ”
মিরা কিছু বলতে যাবে, এর আগেই আশরাফুল কোথায় হাঁটা লাগায়। মিরা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মিনিট দুই পরে আশরাফুল মিরার দিকে একটদ আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

আলোছায়া পর্ব ১৩

–” তোমার যে অবস্থা তাতে পানি খেলে ঠিক হবে না। এই নাও, এটা খেয়ে নাও। বাচ্চা মেয়ে। ”
মিরা কপাল কুঁচকে তাকায় আশরাফুলের দিকে। ঝাল একটা মানুষ কম খেতেই পারে, তাই বলে কি তাকে বাচ্চা বাচ্চা বলতে হবে নাকি। আইসক্রিমটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে মিরা। উফফ সত্যি অনেক ঝাল লেগেছে!

আলোছায়া পর্ব ১৫