আলোছায়া পর্ব ১৫

আলোছায়া পর্ব ১৫
ফারহানা কবীর মানাল

সারাদিন বেশ ভালোই কাটে দু’জনের। আশরাফুলের বাইকে সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে মিরা। আগে কখনো কারো সাথে এভাবে ঘোরা হয়নি তার। মিরা আশরাফুলের প্রতিটা কাজে বেশ অবাক হয়েছে, সে-ই সাথে একরাশ ভালো লাগা ছুঁয়ে গেছে তার মনে। আশরাফুলকে কোনো এক সময় মিরার বড্ড বেশি খারাপ মানুষ মনে হতো, তবে আস্তে আস্তে সে-ই ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে, এখন মনে হয় আশরাফুল এই পৃথিবীর সব থেকে ভালো মানুষদের মধ্যে একজন। যে মিরার এলোমেলো জীবনটাকে আবারও সুন্দর করে সাজিয়ে দিবে।

বাড়ি ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে যায় ওদের, মিরার বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধূয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে শরীরটা এলিয়ে দেয়। সারাদিন অনেক জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছে আজ, শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে, তবুও খুব ভালো লাগছে। বিছানায় শুয়ে সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে করতে থাকে।
তখন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আইসক্রিমটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে মিরা। উফফ সত্যি অনেক ঝাল লেগেছে! আইসক্রিম খাওয়ার পর আর ঝাল লাগছে না। আশরাফুল সত্যি খুব ভালো ছেলে, ঠিক বুদ্ধি করে আইসক্রিমটা নিয়ে এসেছিলো না হলে কত বোতল পানি শেষ করতে হতো আল্লাহই ভালো জানে।
–” আইসক্রিম খাওয়া শেষ হলে চলো যাই। ”
মিরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বাইকের পিছনে উঠে বসে। আশরাফুল মিরাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মিরা জানে না, জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করছে না কারণ এভাবে ঘুরতে তার বেশ ভালোই লাগছে। একটা কাপড়ের দোকানের সামনে আশরাফুল বাইক থামায়। তারপর মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আমার সাথে এসো। ”

–” কোথায় যাবো? ”
–” গেলেই দেখতে পাবে। ”
আশরাফুল মিরাকে নিয়ে দোকানের ভিতরে প্রবেশ করে, মিরা প্রশ্ন করে বসে, ” এখানে কেন আসলাম আমরা, আপনি কি কাপড় কিনবেন? কিন্তু এটা তো মেয়েদের কাপড়ের দোকান। ”
–” মেয়েদের কাপড় কিনবো তাই এখানে এসেছি, আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ তো তাই এই দোকানে এসেছি৷ ”
আশরাফুলের কথা মিরা কিছু বলে না, শুধু মুখ বেঁকিয়ে ভেংচি কাটে। মিরা কি উনাকে বলেছে এটা কেমন দোকান বা উনি কেন এখানেই কাপড় কিনতে এসেছে। এই ছেলেটা একটু বেশি কথা বলে।

–” মিরা দেখো তো কোন কোন থ্রি-পিসটা সুন্দর লাগে। যে কোনো চারটা পছন্দ করো। ”
মিরার জানতে ইচ্ছে করে কার জন্য এসব কিনছে আশরাফুল। তবে মুখ ফুটে জানতে চায় না। সবগুলো থ্রি পিস অনেক সুন্দর। মিরা পছন্দ মতো চারটা বেছে দেয়। আশরাফুল নিজে একটা থ্রি-পিস পছন্দ করে দোকানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ” এটা সহ এই চারটা প্যাক করে দিন। আর কত দাম হলো?”

–” ছয় হাজার টাকা স্যার। ”
দোকানির কথা শুনে মিরা চোখ বড় করে বলে ওঠে, ” এই থ্রি-পিসগুলোর এতো দাম? এগুলোর তো ৮০০-৯০০ এর বেশি দাম হওয়ার উচিত নয়। ”
মিরার কথায় আশরাফুল মুচকি হাসে, তবে মুখে কিছু বলে না। দোকানি মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আসলে মেডাম আপনি যে গুলো পছন্দ করেছেন তার দাম ৮০০ টাকা করে, তবে স্যার যে থ্রি-পিসটা পছন্দ করে দিয়েছে ওটা একটু দামী। ”

–” বললেই হলো নাকি! এই একটা থ্রি-পিসের দাম ২৮০০ টাকা। আপনি কিন্তু বেশি বেশি দাম বলছেন। ঠিকঠাক দাম বলেন না হলে একটা কাপড়ও নিবো না। ”
দোকানি হতভম্ব হয়ে আশরাফুলের দিকে তাকায়। আশরাফুল তখনও হেসে চলেছে।
মিরার দোকানির থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও বলে, ” কি হলো আপনি ঠিকঠাক দাম বলবেন না?”

–” মেডাম এটা একদরের দোকান। এখানে দামাদামি চলে না। ”
মিরা দোকানের বাইরে, ভিতরে ভালো করে দেখে বলে, ” এখানে কোথাও লেখা নেই এটা একদরের দোকান। আচ্ছা সমস্যা নেই। নিবো না আপনার দোকান থেকে কাপড়। আরো অনেক দোকান আছে৷ ”
মিরা রাগ করে বেরিয়ে যেতে গেলে দোকানি বলে ওঠে, ” আচ্ছা মেডাম বলেন আপনি কত টাকা দিবেন। ”

–” সাড়ে চার হাজার। এর থেকে এক টাকাও বেশি দিবো না। ”
–” এতে অনেক লস হয়ে যাবে মেডাম। পাঁচ হাজার দিলে কাপড়গুলো নিয়ে যান। ”
–” বললাম তো সাড়ে চার হাজার। ”
–” আর দুইশো টাকা বেশি দেন। ”
মিরা কিছু বলতে যাবে এর আগেই এতো সময়ের নিবর দর্শক আশরাফুল বলে ওঠে, ” আচ্ছা কাপড়গুলো দিয়ে দেন৷ এই নিন টাকা রাখেন। ”

মিরা রাগি চোখে আশরাফুলের দিকে তাকায়। কিন্তু আশরাফুলের চোখের দিকে তাকিয়ে রাগটা কেমন হারিয়ে যায় তার। আশরাফুলের চোখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে সে। দাম পরিশোধ করে আশরাফুল কাপড়গুলো নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়৷ মিরাও আশরাফুলের পিছন পিছন হাঁটা ধরে। বাইকে বসতে বসতে মিরা বলে ওঠে, ” আপনি কিন্তু ঠকে গেলেন। ”
আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, ” না না আমি জিতে গেছি। ”

–” ওই লোকটা আপনার থেকে দুইশো টাকা বেশি নিলো আর আপনি বলছেন জিতে গেছেন। ”
–” ওসব তুমি বুঝবে না ঠিক হয়ে বসো না হলে পড়ে যেতে পারো। ”
মিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠিক হয়ে বসে। আশরাফুল মিরাকে নিয়ে একটা দর্জির দোকানে যায়। একজন মহিলা সেখানে বসে কাপড় বানাচ্ছে। বাইক থামিয়ে দোকানে গিয়ে বলে, ” কাকিমা এই কাপড়গুলো বানাতে হবে। ”
চল্লিশ বছরের বেশি মহিলা আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আরে বাবা তুমি। কতদিন পর এলে, তা কার কাপড় বানাবে? মাপ নিতে হবে তো তার। ”

আশরাফুল মিরাকে দেখিয়ে বলে, ” ও-র জন্য। ”
তারপর মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” যাও ভিতরে গিয়ে মাপ দিয়ে এসো। ”
মিরার যেন বিশ্বাস হয় না এতোগুলা কাপড় আশরাফুল তাঁর জন্য কিনেছে। বুঝতে শেখার পর থেকে কখনো এতোগুলা কাপড় একসাথে বানায়নি সে। আচ্ছা আশরাফুল তাকে কাপড় কিনে দিলো কেন? এসব সাত-পাঁচ ধীর পায়ে হেঁটে দোকানের ভিতর চলে যায় মিরা। আশরাফুল দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। মাপ নেওয়া শেষ হলে মিরা বেরিয়ে আসে।
মিরাকে বেরিয়ে আসতে দেখে আশরাফুল বলে, ” কাপড়গুলো কবে নিতে আসবো কাকিমা?”

–” চার পাঁচদিন পর এসো। সময় করে বানিয়ে রাখবো। ”
–” আচ্ছা ঠিক আছে। ”
আশরাফুল উনার দিকে এক হাজার টাকার দুইটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ” আচ্ছা সময় করে নিয়ে যাবো। আপনি সব গুছিয়ে রাখবেন। ”
মিরা কিছু বলতে যাবে তার আগে আশরাফুল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ” চলো। ”
মিরার আর কিছু বলা হলো না। মিরা অবশ্য জানতে চেয়েছিলো পাঁচটা থ্রি-পিস বানাতে কেন দুই হাজার টাকা দিলো। কিন্তু প্রশ্নটা মনের ভিতরই রয়ে গেলো। ওদের কথা শুনে মিরার মনে হলো ওঁরা পূর্ব পরিচিত। তা-ই আর কিছু জানতে চাইলো না।

দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। মিরার ক্ষুধাও লেগেছে বেশ, কিন্তু বলতে পারছে না। কোথাও একটা দ্বিধা কাজ করছে তার। আশরাফুল এক মনে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। লোকটা বেশ ভালোই বাইক চালাতে পারে।
–” মিরা চলো দুপুরের খাওয়াটা বাইরেই সেরে ফেলি। আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। ”
–” আচ্ছা ঠিক আছে। ”
আশরাফুল একটা রেস্তোরাঁয় সামনে গিয়ে বাইক থামায়। তারপর দুইজনে মিলে ভেতরে প্রবেশ করে। আশরাফুল পেছনের দিকে একটা টেবিলে বসে পড়ে মিরারও আশরাফুলের সাথে একই টেবিলে বসে। আশরাফুল মিরা মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে।

–” কি খাবে মিরা?”
–” আপনার যা ইচ্ছে। ”
–” আমার পছন্দের খাবার তোমার পছন্দ হবে তো। আমি তো জানি না তুমি কিসব খেতে পছন্দ করো বা কোন কোন খাবার খাও না। ”
–” আমি প্রায় সব খাবার খেতে পছন্দ করি। তবে ঝাল খেতে পারি না বেশি। ”

প্রতি উত্তরে আশরাফুল শুধু মুচকি হাসে। অভাবের সংসারে মিরা কখনো খাবার বেছে খাওয়ার সুযোগ পায়নি। মা’য়ের কষ্ট দেখে কখনো বলতে পারেনি এটা খাবো না। তাই প্রায় সব খাবার খেতে পারে সে। আশরাফুল দুইজনের জন্য বিরিয়ানি অর্ডার দেয়। বিরিয়ানির নাম শুনেই মিরার মন খুশিতে নেচে ওঠে। বিরিয়ানি তার খুব পছন্দের খাবার। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর খাবার চলে আসে। আশরাফুল চুপচাপ খেতে থাকে। মিরাও নিজের খাওয়ার মনোযোগ দেয়। তবে আশরাফুল সামনে বসে খেতো কেমন অস্বস্তি বোধ করছে মিরা। আশরাফুলও হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারে তাই মিরার পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়ে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, ” এখন আর তোমার সামনে বসে নেই। আশা করি এখন আর খেতে কোনো অসুবিধা হবে না তোমার। ”

সামনে থেকে এখন পাশে এসে বসে বলছে তোমার অসুবিধা হবে না। আশরাফুল লজিক দেখে মিরার খুব হাসি পায়। তবে হাসি চেপে যথা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। আশরাফুল খাওয়া শেষ করে কাউন্টারের দিকে যায় বিল পরিশোধ করার জন্য। মিরা যতোদূর জানে বিলটা টেবিলে দিয়ে যায়। কি জানি হবে হয়তো কোনো নতুন পদ্ধতি।
মিরা খাওয়া শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে রেস্তোরাঁ থেকে আশরাফুলের সাথে বেরিয়ে আসে।

এরপর দু’জন মিলে সারা বিকাল ঘুরে বেড়িয়েছে। সারা শহর ঘুরে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরেছে। মিরার জীবনের সুন্দর দিনগুলোর মধ্যে আজকেরটা অন্যতম। আশরাফুল আজ মিরাকে একটা সুন্দর বোরকাও কিনে দিয়েছে। বোরকা কেনার জন্য মিরাকে নিয়ে একটা একদরের দোকানে গিয়েছিলো। তারপর মুচকি হেসে বলেছিলো, ” মিরা এটা একদরের দোকান তো?”
মিরা প্রতিত্তোরে শুধু মুচকি হেসেছিলো। বোরকাটা আশরাফুল নিজেই পছন্দ করে দিয়েছে মিরাকে। কালো রংয়ের বোরকাটা দেখতে খুব সুন্দর।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে মিরার চোখ লেগে যায় বুঝতে পারে না মিরা। চোখ খুলে দেখে রাত দশটা বেজে গেছে। রাতের রান্না করা হয়নি। না জানি এখন আবার কি অশান্তি শুরু করে রেশমা বানু। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় মিরারৃ এভাবে ঘুমিয়ে পড়া উচিত হয়নি তার। কিছু একটা রান্না করে ঘুমালে আর সমস্যা হতো না।

আলোছায়া পর্ব ১৪

গায়ের ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে রান্না ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করে। কিন্তু রান্না ঘরে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় মিরার। সম্পূর্ণ রান্নাঘরে এলোমেলো করে রাখা। মিরার যতদূর মনে পড়ছে সকালে সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিলো সে।

আলোছায়া শেষ পর্ব