আলোছায়া পর্ব ১৩

আলোছায়া পর্ব ১৩
ফারহানা কবীর মানাল

মিরা পিছনে ফিরে মুচকি হাসি দেয়। তারপর নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মিরা আজ বড্ড খুশি। আবার পড়তে পারবে সে। ঘরে গিয়ে আয়নার নিজের গলার তিলটা দেখতে থাকে। মিরার এতো লজ্জা লাগছে কেন! তবে কি মিরা আশরাফুলের প্রেমে পড়লো?

ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করে না মিরা, তাড়াতাড়ি করে শুয়ে পড়ে। কাল সকালে আবার কলেজে যেতে হবে। আশরাফুল কি সত্যি তাকে ভর্তি করে দিবে? নাকি মিরা কোনো স্বপ্ন দেখছে!
সকালে ঘুম থেকে উঠে মিরা তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে নেয় মিরা। সকাল থেকে মিরা আশরাফুলের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আশরাফুল দরজা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা ১১টা বেজে গেছে। আশরাফুল তখনও ঘুম। আশরাফুলের কি মনে নেই তার আজকে মিরাকে নিয়ে কলেজে যাওয়ার কথা, মিরার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে, সকাল থেকে নিজের ঘরটা পর্যন্ত গোছায়নি মিরা, এখনও জানালা দরজা বন্ধ করে রেখেছে। কিছু সময় খাটের উপর বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে। তারপর উঠে গিয়ে জানালা খুলে দেয়। দম আটকে আসছে তার৷ জানালার উপরে একটা চিঠি পড়ে আছে। মিরা চিঠিটা উঠিয়ে নেয়, তাতে লেখা-

প্রেয়সী,
অযোগ্য মানুষকে এতোটা ভালোবাসতে নেয়। তবুও আমি তোমাকে জোর করবো না, একটা আবদার করবো তোমার কাছে। একদিন অন্তত দেখা করো আমার সাথে। তোমার সব স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আমি নিবো। আমাকে ভালোবাসতে হবে না তোমাকে, শুধু একবার সামনাসামনি দেখা করো প্লিজ।
ইতি,
ব্যাথিত হৃদয়।

মিরা চিঠিটা পড়ে একটু চিন্তায় পড়ে যায়। কি উত্তর দিবে সে? যদিও একটুও ভালো লাগছে না মিরার। আশরাফুল তাকে আজ কলেজে ভর্তি করে দিবে বলেছে কিন্তু বেলা বারোটা বেজে গেলো এখনও ঘুম দিয়ে উঠছে না। কাল আশরাফুলের একটা কথা মিরার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো আবার জোড়া লাগিছে, আজ আবারও সে-ই স্বপ্ন ভেঙে যাবে না তো?

আশরাফুল কি মিরার সাথে কাল মজা করেছে? কিছু বুঝতে পারছে না মিরা। আচ্ছা আশরাফুলের কিছু হলো না তো আবার! কথাটা ভাবতেই মিরার মুখ শুঁকিয়ে যায়। আশরাফুল তো কখনো এমনটা করে না, মিরা কখনো আশরাফুলকে এতো বেলা করে ঘুম দিয়ে উঠতে দেখেনি। একবার আশরাফুলকে ডেকে দেখা উচিত, কি হলো না হলো। চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে মিরা আশরাফুলের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

দরজার কাছে আসতেই আশরাফুল মিরাকে ডাক দেয়। মিরা দৌড়ে খাবার টেবিলের কাছে যায়, আশরাফুল ওই দিক দিয়ে কথা বললো বলে মনে হয়। আশরাফুল খাবার টেবিলে বসে আছে। হয়তো খেতে এসেছে। মিরাকে দেখে প্রশ্ন করে, ” দুইটা প্লেটে খাবার বেড়ে রেখেছ যে? কে খায়নি সকালে?”

মিরা আশরাফুলকে সুস্থ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, পরক্ষণেই হতাশ হয়ে যায়। আশরাফুল যখন ঠিক আছে তাহলে কেন মিরাকে নিয়ে কলেজে গেলো না? মিরা এসব ভাবতে থাকে, কোনো কথা বলে না।
আশরাফুল জবাব না পেয়ে বলে আবারও বলে উঠে, ” কোনো সমস্যা তোমার? নাকি তুমি সকালে খাওনি? মুখ শুঁকিয়ে গেছে তোমার। ”

আশরাফুলের কথায় মিরার হুশ ফিরে আসে। মন মরা হয়ে বলে, ” হ্যাঁ আমি খাইনি সকালে। আপনি বলেছিলেন আজ কলেজে নিয়ে যাবেন আমাকে। আমি আবার পড়তে পারবো। তাই ভেবেছিলাম আপনার সাথে বসে খাবো। কিন্তু আপনি তো ঘুম দিয়ে উঠলেন এখন। আমাকে কি কলেজে নিয়ে যাবেন না? যদি ভর্তি করে না-ই দিবেন তাহলে বললেন কেন? এভাবে আশা দেখিয়ে নিরাশ না করলেও পারতেন।”

মিরার কথায় আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, ” এতো গুলো প্রশ্ন একসাথে করলে আমি কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবো শুনি? একটা একটা করে প্রশ্ন করো। ”
আশরাফুলের উত্তর মিরার খুব একটা পছন্দ হয় না। তা-ই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একটা তার হাত ধরে ফেলে। মিরা আশরাফুলের হাতের নাগালে দাঁড়িয়ে ছিলো, বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না যে আশরাফুলই মিরার হাত ধরেছে, হয়তে মিরাকে আটকানোর জন্য!

–” কোথায় যাচ্ছো? ”
মিরার কিছু ভালো লাগছে না। চারদিকের নানান চিন্তার ভিতর এসব মজা তার একটুও ভালো লাগছে না। তবুও শান্ত গলায় বলে, ” ঘরে যাবো, শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। ”
–” না খেয়ে থাকলে শরীর আরো খারাপ হবে। আগে খেয়ে নাও। তারপর ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিও। ”
–” আমার কলেজে যাওয়া?”

–” আজকে শুক্রবার। যেদিন কলেজ খোলা থাকবে সেদিন তোমাকে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো। তোমাকে মিথ্যা আশা দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, আমি জানি মিথ্যা আশা মানুষকে কতটা কষ্ট দিতে পারে। নাও এখন খেতে বসো। বললে তো আমার সাথে বসে খাবে। ”

মিরা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখে আজ সত্যি শুক্রবার। আজকে তো কলেজ বন্ধ। আজ কলেজে গেলে তো কোনো লাভ হতো না। ধূর! সবকিছু খেয়াল না করে আশরাফুলকে এতোকিছু বলা উচিত হয়নি। এখন নিজেকেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।
–” সাত পাঁচ কি এতো চিন্তা করছো? খেতে বসো। ”

মিরা আশরাফুলের পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ে। আশরাফুল মিরার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের খাওয়ার মন দেয়। মিরা লজ্জায় কিছু খেতে পারছে না, প্লেটের খাবারগুলো নাড়াচাড়া করছে। আশরাফুল হয়তো বুঝতে পেরেছে মিরার সমস্যা হচ্ছে। তাই সে বলে ওঠে, ” আরে রিলাক্স! এমন ভুল আমাদের সবার কম বেশি হয়ে থাকে। এতো লজ্জা না পেয়ে খাওয়া শেষ করো। ”

মিরা মুচকি হেসে খাওয়ার চেষ্টা করে। দূরে দাঁড়িয়ে রেশমা বানু সবকিছু লক্ষ্য করে। বহুকাল পুরনো শাশুড়ি বউমা সম্পর্কের সাথে তাল মিলিয়ে মিরাকে সে তেমন পছন্দ না করলেও চায় আশরাফুল সুখে থাকুক। সেঁজুতির ব্যাপারটা তিনি জানেন। ছেলের কষ্টে মা’য়েরও কষ্ট হয়। রেশমা বানুও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনিও চান আশরাফুল সবকিছু ভুলে মিরার সাথে সুখে থাকুক।

খাওয়া শেষ করে আশরাফুল নিজের কাজে চলে যায়। জুমার নামাজ পড়তে গেছে হয়তো। মিরা সকালেই দুপুরে রান্না করে রেখেছে। তাই মিরাও গিয়ে বিছাবায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। এই কলেজ যাওয়ার চক্করে আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে, তারপর সারাদিনের সব কাজ করেছে, এখন খুব ক্লান্ত লাগছে তার। মিরা চিঠির উত্তর লেখার প্রয়োজনবোধ করে না। বিছানায় শুয়ে পড়ে। বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে তাঁর। কখন যে চোখটা লেগে আসে মিরা বুঝতেও পারে না।

” সময় কারো জন্য বসে থাকে না। মিরা এখন নিয়মিত কলেজে যায়। সে-ই অচেনা ছেলেটা এখন আর অচেনা নেই মিরার কাছে। মিরার সাথে প্রতিদিন কলেজ শেষ দেখা করতে আসে। চিঠিপত্র, গোলাপ, চকলেট এসব এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গেছে। একদিন ছেলেটা মিরার সাথে পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। মিরার কাছে সম্পূর্ণ তার হয়ে যাওয়ার বায়না করে। মিরাও তাতে রাজি হয়ে যায়। সেদিন কলেজে যাওয়ার আগে মিরা আশরাফুলের জন্য একটা চিঠি লেখে-
প্রিয় স্বামী,

আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমি আপনাকে সম্মান করি, আপনাকে কখনো আশরাফুল বলেও ডাকতে চাই না। আপনি আমার অনেক উপকার করছেন, তবে বাসর রাতে যে পুরুষ আমাকে অস্বীকার করে, তাকে আমি কখনো মেনে নিতে চাই না। আমার ভালোবাসার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।
আপনিই বলতেন বেইমানদের মনে রাখতে নেই। আশা করি আমাকে ভুলে যাবেন৷ আমি চললাম অচেনা এক গন্তব্যের পথে, আমার অচেনা ভালোবাসার হাত ধরে।

ইতি,
মিরা।
তারপর চিঠিটা আশরাফুলের বালিশের নিচে রেখে বেরিয়ে পড়ে নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সব যাত্রা তো সুখের হয় না। রাস্তায় একটা গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে মিরা। বাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে। রক্তে সারা শরীর একাকার হয়ে যায় মিরার। মৃত্যু যেন তার দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। মিরার দম আটকে আসছে, মনে হচ্ছে তার জীবন এখানে শেষ। ”

ভয়ে লাফিয়ে উঠলো মিরা, সারা শরীর ঘেমে গেছে তার। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় দম আটকে যাবে। মিরা নিজেকে খাটের উপর আবিষ্কার করে, হ্যাঁ সে তো নিজের ঘরে রয়েছে, নিজের খাটের উপর। মিরা কিছু মনে করতে পারছে না, মনে হচ্ছে শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় আশরাফুল মিরার ঘরে আসে। মিরা তখন খাটের উপর বিছানার চাদর খামছে বসে আছে। বারবার নিঃশ্বাস নিচ্ছে, হয়তো এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না। আশরাফুল মিরার কাছে গিয়ে কয়েকবার মিরার নাম ধরে ডাকে। কিন্তু মিরা কোনো সাড়া দেয় না। আশরাফুল মিরার দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে, ” কি হয়েছে তোমার? ঠিক আছো তুমি?”
মিরা আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। আশরাফুল বেশ অবাক হয়। কিন্তু মিরাকে কিছু বলে না। মিরা ভীত কন্ঠে বলে, ” আমি কোথায়?”

আশরাফুল হয়তো বুঝতে পারে মিরার কিছু সমস্যা হয়েছে। তাই শান্ত গলায় বলে, ” তুমি তোমার ঘরে মিরা। একদম ঠিক আছো। ভয় নেই, কোনো সমস্যা নেই এখানে। শান্ত হও।”
মিনিট পাঁচেক পরে মিরা নিজে থেকে আশরাফুলকে ছেড়ে দেয়। হয়তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মিরার মনে পড়ে সে আশরাফুল সাথে বসে সকালের খাবার খেয়েছে তারপর আশরাফুল মসজিদে চলে গেছিলো আর মিরা ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো। ওহ্! তার মানে মিরা এতো সময় স্বপ্নে দেখছিলো। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিরা। তারপর আশরাফুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” কিছু বলবেন আপনি?”

আশরাফুল মিরার হাতে কয়েকটা জিলাপি দিয়ে বলে, ” আজ মসজিদে মিলাদ দিয়েছে তাই তোমার জন্য নিয়ে এলাম। তুমি জিলাপি খাও?”
সত্যি বলতে মিরা খুব পছন্দ জিলাপি। ছোট বেলায় মিরার বাবা একবার মিরাকে জিলাপি এনে দিয়েছিলো মিরা তখন খুব ছোট তবুও যেন ওই একটা স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে। বয়সের সাথে মিরা বুঝেছে তার বাবা কোথায় চলে গিয়েছে, কেন তার মা’য়ের জীবনটা এমন কষ্টে ভরে আছে। মিরা চাইলেও তার বাবাকে মাফ করতে পারে না।

–” কি হলো মিরা কেনো সমস্যা? ”
–” না কোনো সমস্যা নেই। মা তো বাড়িতে উনাকে দিবেন না?”
আশরাফুল প্রথমে বুঝতে পারে না মিরার মা কোথা থেকে এলো, তারপর খেয়াল হয় মিরা তার মা’কে মা বলে ডাকছে। মেয়েটা কেমন অদ্ভুত। যে তাকে এতো কষ্ট দেয় তার কথাই জানতে চাইছে।
–” হুম মা’য়ের জন্য রেখেছি। তুমি খেয়ে নেও। আমি বরং মা’কে এগুলো দিয়ে আসি। ”

আলোছায়া পর্ব ১২

আশরাফুল নিজের কাজে চলে যায়। মিরার সাত-পাঁচ না ভেবে জিলাপিতে কামড় বসায়। কতদিন হয়ে গেলো তার পছন্দের মিষ্টি খায়নি।

আলোছায়া পর্ব ১৪