আলোছায়া পর্ব ১২

আলোছায়া পর্ব ১২
ফারহানা কবীর মানাল

ওদিকে মিরার চিঠি পড়ে অচেনা লোকের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে চিঠির উপর। কাগজের চিঠি আস্তে আস্তে পানিকণাগুলো শুষে নেয়। পরক্ষণেই লোকটার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। এই হাসি-ই কি মিরার জীবন উলোটপালোট করে দিবে?

রাতের খাওয়া শেষ করে মিরা নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা চেপে দিয়ে খোপা খুলে দেয়। কোমর সমান লম্বা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়ে। চুলগুলো বেঁধে ঘুমাতে যাবে মিরা, খোলা চুলে তার ঘুম আসে না। এমন সময় কেউ মিরার দরজায় কড়া নাড়ে। মিরা ভিষণ অবাক হয়। সচারাচর তার ঘরে কেউ আসে না, প্রয়োজন পড়লে তাকে ডাকে তবে এমন কখনো হয় নি। মিরা প্রশ্ন করে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” কে?”
ওপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠ বলে ওঠে, ” আমি আশরাফুল। ভিতরে আসবো?”
মিরা মাথার কাপড় টেনে দেয়। তারপর আস্তে করে বলে, ” হুম আসেন। ”

আশরাফুল মিরার ঘরে এই প্রথমবার এলো। বিয়ের এক বছর হয়ে গেলেও আশরাফুল মিরার ঘরে আসেনি। বাসর রাতে মিরাকে অপমান করে ছিলো। মিরাকে স্ত্রী বলে সম্মান দেয়নি। তারপরের দিন সকালে মিরা জন্য এই ঘরটা বন্দবস্ত করা হয়, আশরাফুল নিজেই তদারকি করে এই ঘরটা গুছিয়ে দিয়েছিলো।

মিরাকে হয়তো স্ত্রী অধিকার দেয়নি, তবে কখনো কারণে অকারণে মিরার গায়ে হাত তোলেনি। মিরা হয়তো মনেও করতে পারে না আশরাফুল তাকে কখনো চড় পর্যন্ত মেরেছিলো কিনা! আশরাফুল হয়তো মিরার পক্ষ হয়ে লাবণি বা রেশমা বানুকে কোনো কথা বলেনি, তবে কখনোই মা বোনের কাজকে সমর্থন করেনি। আশরাফুল নামের মানুষটাকে ঘৃণা করা গেলেও অসম্মান করা যায় না।

–” শুধু ঘরে আসবে বলবে? বসতে দিবে না?”
আশরাফুলের প্রশ্নে মিরা বিব্রত হয়ে বলে, ” না না তা কেন বসুন। আপনি এখন এখানে কেন? মানে কিছু দরকার কিনা তাই জানতে চাইলাম। ”

–” না তেমন কিছু না, এমনিই আসলাম। তোমার অসুবিধা থাকলে বলো, চলে যাচ্ছি। ”
মিরার বড্ড ঘুম আসছে৷ কিন্তু আশরাফুলকে চলে যেতে বলতে পারছে না। কি না কি ভেবে বসে কে জানে! মিরা ঘুমে পড়ে যাচ্ছে,, আশরাফুল হয়তো বুঝতে পারে মিরার ঘুম আসছে তাই উঠে দাঁড়িয়ে বলে,” সারাদিন অনেক কাজ করো তুমি, এখন ঘুমাও। ”

মিরা খুব খুশি হয়৷ সত্যি অনেক ঘুম আসছে। আশরাফুল মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মিরা মাথার ওড়না খুলে বিছানার পাশে রেখে চুল বাঁধতে থাকে। আশরাফুল কি মনে করে আবার ফিরে আসে, পর্দায় ওপাশে কোনো এক রমণী খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে, আশরাফুলের বড্ড লোভ হয় মিরাকে এক পলক দেখার কিন্তু ইচ্ছেটাকে দমন করে আবারও চলে যায়। ঘুমাতে যাওয়ার আগে মিরা জানালা লাগাতে গিয়ে আরো একটা চিঠি পায়। এই চিঠিগুলো মিরার খুব পছন্দের হলেও আজ ভয় হচ্ছে। মিরা কোনো প্রকার অশান্তি চায় না। চিঠিটা নিয়ে জানালা বন্ধ করে দেয়। চিঠিতে লেখা

প্রেয়সী,
আমি তোমার বিপদের দিনে তোমার পাশে ছিলাম। আমি তোমার খেয়াল রেখেছি, তোমার স্বামী কখনো তোমার দিকে ফিরে তাকায়নি। তোমাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। তাকে তুমি ছেড়ে আসতে চাইছো না। এমনটা করো না মৃগ নয়নী, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

ইতি,
আমি।
মিরার কিছু চিন্তা করতে পারছে না। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়, বড্ড ঘুম আসছে তার। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে নিয়মমাফিক গাছে পানি দিতে যায় মিরা। আজও সে-ই অচেনা ছেলেটা মিরাকে দেখছে। মিরার মনের মাঝে ভয় জন্মাতে থাকে। এ-ই আবার সেইটা নয় তো। মিরা কিছু ভেবে পায় না। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ঘরে চলে আসে। সকালে রান্না শেষ করতে হবে।

আশরাফুল ঘুম থেকে উঠেছে অনেক আগে, কোথাও গেছে হয়তো। খাওয়ার টেবিলে আশরাফুলের সাথে দেখা হয় না মিরার। মিরা বাড়িতে কোথাও আশরাফুলকে দেখেনি। কোথায় চলে গেলো কে জানে! কাজ শেষ করে মিরা একটা চিঠি লিখতে বসে,

জনাব,
আপনি কে জানি না, কখনো দেখিনি। কয়েকটা চিঠি দিয়ে খেয়াল রাখা ভালোবাসা হতে পারে নিশ্চয়ই তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আমি বিবাহিত। আপনি আমার স্বামীর দোষটা দেখেছেন। হ্যাঁ আমার স্বামী হয়তো আমাকে স্ত্রী সম্মান দেয়নি, তবে কখনো শারীরিক চাহিদাকে ভালোবাসা মনে করেনি। সে চাইলেই আমার সাথে শারীরিক করতে পারতো আমার তাকে বাঁধা দেওয়ার উপায় ছিলো না। কিন্তু সে এমন করেনি, সে আমার গায়ে হাত তুলতে পারতো, আমাকে নানান ভাবে অত্যাচার করতে পারতো কিন্তু কখনো এমন করেনি। আপনি যে-ই হন না কেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি না। কখনো আপনার কাছে যেতে চাই না।

ইতি
মিরা
চিঠিটা দেওয়ালের উপর ভাজ করে রেখে ছাঁদের দিকে পা বাড়ায় মিরা। সে অচেনা লোকটাকে এভাবে না বলে দিয়ে ভুল করছে না তো। লোকটা তার অনেক খেয়াল রেখেছে, পোড়া হাতের জন্য ঔষুধ কিনে দিয়েছে। হাজার প্রেমময় কথা শুনিয়েছে। তুবও কেন মিরা তাকে চাইতে পারছে না। মিরার তো উচিত তাঁকে মেনে নেওয়া। আশরাফুলকে ডিভোর্স দিয়ে ওই লোকটার কাছে চলে যাওয়া।

ছাঁদের একটা জায়গাতে মিরা বসে পড়ে। নানান চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে থাকে, আশরাফুলের জীবনে যা-ই হোক মিরা কোনো দোষ করেনি। মিরাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আবার আশরাফুলের কথা ভাবতে গেলে যে ও-কে সব থেকে বেশি কষ্ট দিয়ে চলে গেছে তার মতো দেখতে একটা মেয়েকে মেনে নেওয়া এতো সহজ নয়। তারপর আবার যেভাবে বিয়েটা হলো।

আশরাফুলকে সব কিছু জন্য দোষী করতে পারে না মিরা, সে নিজেও তো এভাবে বিয়েটা মানতে পারেনি। স্বামী খারাপ ব্যবহার করলে তার সাথে ঝগড়া করা যায়, অভিমান করা যায়, প্রয়োজনে ঘৃণা করা যায় তবে তার থেকে বেশি গুরুত্ব অন্য কাউকে দেওয়া উচিত না।

দুপুর হয়ে আসে তখনও মিরা ছাঁদে একাকি বসে আছ। না জানি এই অচেনা লোকটা কে,
বিকালে মিরা ছাঁদ থেকে নেমে ঘরে যায়। আজ কাল কিছুই ভালো লাগছে না তাঁর।

রেশমা বানু হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিরার দিকে। আজকাল মেয়েটা কেমন অদ্ভুত লাগে তার কাছে। রেশমা বানু কয়েকদিন মিরা তেমন একটা কাজের হুকুম করে না। সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকেন রেশমা বানু। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। লাবণি বাড়িতে নেই, কোনো এক আত্মীয় বাড়ি গেছে বলে শুনেছে সে। তেমন খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করেনি। লাবণি মিরা সাথে ভালো ব্যবহার করলে হয়তো মিরা খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করতো কিন্তু এই মেয়ে তো সবসময় মিরার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।

সন্ধ্যার দিকে মিরা আরো একটা চিঠি পায়। তাতে লেখা-
প্রিয়,
এতো দিন এতো খেয়াল রাখার কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে? আমি হয়তো আশরাফুলের মতো বড়লোক নই তবে সত্যি তোমার খেয়াল রাখবো। একটা কথা জানতে চাই তোমার কাছে, আমার প্রতি কি তোমার কোনো অনুভূতি নেই? কেন ভালো বাসতে পারো না তুমি আমাকে?”
ইতি,
আমি

মিরা চিঠিটা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর নিজেও লিখতে শুরু করে,
জনাব,
প্রথমেই আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনার আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, হয়তো খুব ভালো বন্ধু। তবে আমার ভালোবাসা নয়। আমি বিবাহিত একজন নারী। আমার অন্য পুরুষের প্রতি আসক্তি থাকা অন্যায়। আমি যদি কখনো ডিভোর্সি হই তবেই ভেবে দেখবো আপনার ব্যাপারে৷

ইতি,
মিরা।
মিরার নিজের চিন্তাকে বড্ড সেকেলে লাগছে। তবুও সে বিবাহিত, কারো প্রতি আসক্ত হয়ে পড়া উচিত নয়। আশরাফুল তাকে মেনে নিবে কিনা মিরা জানে না। মিরার নিজেও আশরাফুলের প্রতি অঘাত ভালোবাসা নেই। যে সবকিছু ভুলে সে শুধু তা
র হয়ে থাকবে।

মিরা আশরাফুলকে সম্মান করে, লোকটা চাইলে মিরার সতীত্ব নষ্ট করে মিরাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতো, দিনের পর দিন মারধর করতে পারতো, লাথি মেরে বাড়ও থেকে বের করে দিলেও অস্বাভাবিক কিছু হতো না। কিন্তু সে এমনটা করেনি। নিজেই মিরার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এতটুকুই বা কম কিসে!
সন্ধ্যার পরে আশরাফুল মিরাকে নিজের ঘরে ডাকে। মিরা বুঝতে পারছে তাক কেন ডাকছে আশরাফুল । ঘরের সামনে গিয়ে বলে,
–” ভেতরে আসবো। ”

আশরাফুল উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। তারপর মুচকি হেসে বলে, “হুম আসো। তোমার জন্যই বসে ছিলাম। ”
মিরা আশরাফুলের দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দিয়ে বলে, ” আপনি হয়তো এটা চাইতেন।”
আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, ” না আজ মাথা ব্যাথা করছে না। তবে তুমি যখন নিয়ে এসেছো তখন খেয়ে নিচ্ছি। ”
মিরা একটু ইতস্তত হয়ে বলে, ” তাহলে কেন ডেকেছেন আমাকে?”

আশরাফুল কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলে, ” তুমি আবার পড়াশোনা করবে? তুমি বললে আমি তোমাকে আবার কলেজে ভর্তি করে দিবো। ”
মিরা বিশ্বাস করতে পারে না সে আবার পড়াশোনা করবে। এ বাড়িতে প্রথম যখন পড়ার কথা বলেছিলো তখন রেশমা বানু মুখের উপর না বলে দিয়েছিলো। পরে আর কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। সময় বুঝিয়ে দিয়েছিলো সে এ বাড়ির দলীল বিহীন কাজের লোক। মিরা মুখে কিছু বলতে পারে না। শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়।
আশরাফুল হেসে বলে, ” তাহলে কাল আমার সাথে যাবে, তোমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে, আমি তোমাকে ভর্তি করে দিবো ইনশাআল্লাহ। ”

মিরা খুব খুশি হয়। সে আবার পড়তে পারবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। হারিয়ে যাওয়া সব স্বপ্ন যেন আবারও মিরার চোখে ধরা দেয়। খুশিতে চোখের কোণে আনন্দ অশ্রু টলটল করে। আশরাফুল নিজে হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে, ” খুশি হলে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকর আদায় করতে হয়। কাঁদতে হয় না পাগলী। ”
মিরার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। খুশি মনে মিরা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দরজার কাছে আশরাফুল বলে ওঠে, “তুমি সেদিন বললে না মিতালির দেখতে হুবহু তোমার মতো কিনা। তোমরা হুবহু এক রকম দেখতে নও, তোমার গলার তিলটা ও-র ছিলো না। ”

আলোছায়া পর্ব ১১

মিরা পিছনে ফিরে মুচকি হাসি দেয়। তারপর নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মিরা আজ বড্ড খুশি। আবার পড়তে পারবে সে। ঘরে গিয়ে আয়নার নিজের গলার তিলটা দেখতে থাকে। মিরার এতো লজ্জা লাগছে কেন! তবে কি মিরা আশরাফুলের প্রেমে পড়লো?

আলোছায়া পর্ব ১৩