আলোছায়া পর্ব ১১

আলোছায়া পর্ব ১১
ফারহানা কবীর মানাল

মিরা চিঠিটা পড়ে হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। সে তো কখনো ওই অচেনা লোককে ভালোবাসি বলেনি। কেমন অদ্ভুত একটা লোক রে বাবা! মিরা চিঠি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। চিঠির উত্তর লেখারও প্রয়োজন মনে করে না। শুধু ভাবতে থাকে সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝি অবহেলিত হয়।

যেমন আশরাফুল নিজের ম্যানিব্যাগে সেঁজুতির ছবি না রেখে মিতালির ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এমন আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে মিরা ঘুমিয়ে যায়। সকালবেলা ঘুম হতে উঠে নিয়মিত সে সকল কাজ করে সে-ই সকল কাজ শেষ করে রেশমা বানুর কাছে যায়। রেশমা বানু তখন খাবার টেবিলে বসে চা খাচ্ছে। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে সে। মিরা তার কাছে গিয়ে কোনো প্রকার ভনিতা না করে প্রশ্ন করে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” আচ্ছা মা সেঁজুতি কে?”
সেঁজুতি নাম শুনে রেশমা বানু একটু নড়েচড়ে বসে। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলে, ” তোমাকে এই নাম কে বলেছে?”
মিরা রেশমা বানুর বিচলিত হওয়ার কারণ বুঝতে পারে না। শান্ত গলায় বলে, ” আপনার ছেলে বলেছে। ”
রেশমা বানুর চোখ চকচক করে ওঠে। চা’য়ের কাপের উপর একটা ঢাকনা দিয়ে চা ঢেকে রাখে। তারপর বলে, ” পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে আসো তুমি৷ আমি আসছি। ”

মিরা বুঝতে পারে না তার শাশুড়ি কি করতে চাইছে, তবুও ঘরে গিয়ে বোরকা পরে নেয়। সাথে মাথায় একটা ওড়না পেঁচিয়ে নেয়। রেশমা বানু একটা চাদর নিয়েছে শুধু। মিরার কাছে এসে ছোট করে বললো, ” এসো আমার সাথে। ”

মিরা বাধ্য মেয়ের মতো রেশমা বানুর সাথে চলে যায়। বাড়ির সামনে দিয়ে একটা রিকশা নিয়ে তাতে উঠে বসে। মিরা ভাবতে পারেনি রেশমা বানুর মতো মহিলা তার পাশে বসে কোথাও যাবে। এই মহিলা তাকে কতটা অপমান করেছে, কত কথা শুনিয়েছে। রিকশা ছুটে চলেছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে। দুইজন রমণী দুই দিকে মুখ করে বসে আছে। হালকা বাতাস মুখে লাগছে, এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি! রিকশা একটা জায়গায় থেমে যায়। রেশমা বানু ভাড়া মিটিয়ে মিরাকে নিয়ে একটা খোলা মাঠে নিয়ে যায়। খোলা মাঠ বলতে সামান্য ফাঁকা জায়গা উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, তার চারপাশের জমি গুলো খালি পড়ে আছে।

রেশমা বানু একটা কবরের দিকে ইশারা দিয়ে বলে, ” এই যে সেঁজুতি ঘুমিয়ে আছে।”
মিরা অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকায়। এই মহিলার চোখের কোণেও পানি জমে আছে। কি অদ্ভুত পৃথিবী। যারা মানুষকে কাঁদায় তাদেরকেও একদিন কাঁদতে হয়। চাইলেও সে সুখী হতে পারে না, মিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, ” তোমাকে তো কেউ ভালোবেসে ছিলো। আমার দিকে দেখো! ”

কবর জিয়ারত করে রেশমা বানু আর মিরা হাঁটতে থাকে। কিছু সময় পর একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। মিরার বড্ড কষ্ট হচ্ছে, অদ্ভুত কষ্ট। যার কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। বাড়িতে ফিরে রেশমা বানু মিরার হাত ধরে বলে, ” মা তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। পারলে আমাকে মাফ করে দিস। একটা অনুরোধ করি, আমার ছেলেটাকে আগের মতো হাসি খুশি বানাতে পারবি। ছেলেটা বড্ড শান্ত হয়ে গেছে। ”

রেশমা বানুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মিরার চোখ পানিতে টলমল করছে, এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে। মিরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়, রেশমা বানু চোখ মুছে চলে যায়। দুনিয়া কত বিচিত্রময়! যাদের আমরা সবসময় কষ্ট দিয়ে থাকি, প্রয়োজনে তাদের কাছে হাত জোড় করতেও দ্বিধা করি না।

সকালের খাওয়ার সময় মিরা এক দৃষ্টিতে আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন শুধু আশরাফুল একাই খাবার খাচ্ছে। মিরা পাশেই টেবিলের উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদি আশরাফুলের কিছু প্রয়োজন হয়। এই মানুষটা কি করে এতো কষ্ট সহ্য করেছে! একদম পাথর হয়ে গেছে হয়তো। আশরাফুল হয়তো মিরার তাকিয়ে থাকার অর্থ বুঝতে পারে। মিরার হাতের উপর হাত রেখে শান্ত গলায় বলে, ” যে তোমাকে কষ্ট দেয় তার কষ্ট দেখে তোমার কষ্ট পাওয়া উচিত নয়৷ এতে এরা মনে করবে তুমি দূর্বল। খুব সহজে তোমাকে আঘাত করা যাবে।”

মিরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। আশরাফুল মিরা হাত শক্ত করে চেপে ধরে পরক্ষণেই ছেড়ে দেয়। তারপর নিজের কাজে চলে যায়। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। মিরা চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কেন জানি আজ কাল শুধু কষ্ট হয় মিরার, বড্ড কান্না পায়।
দুপুরের রান্না করতে করতে প্রায় বারোটা বেজে যায়। মিরা সবকিছু গুছিয়ে নিজের ঘরে যায়। গোসল সেরে ফেলতে পারলে মন্দ হয় না। জানালার উপর একটা সাদা কাগজ পড়ে রয়েছে। হয়তো লোকটা চিঠি দিয়েছে। মিরা গিয়ে কাগজটা উঠিয়ে নেয়। তাতে লেখা রয়েছে–

প্রিয়তমা,
তুমি কিন্তু আমার মনে ইচ্ছে পূরণ করলে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। একটা চিঠি তো পেতে পারি, তাই না? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? কেন এতো দ্বিধা তোমার?”
ইতি,
আমি।

মিরা মনে হয় এইবার লোকটাকে একটা উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। কেন জানি এই চোর পুলিশ খেলা আর ভালো লাগছে না। মিরা চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে গোসল করতে যায়। গোসল শেষ করে সবার খাবার গুছিয়ে রাখে। হাতের নাগালে সবকিছু রেখে দেয় যাতে কারো মিরাকে ডাকার প্রয়োজন না হয়৷ সব কাজ শেষ করে মিরা নিজের খাওয়া শেষ করে, তারপর ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। চিঠির উত্তর লিখবে বলে। তার ঘরে একটা খাতা পড়ে আছে। পড়বে বাড়ি থেকে একটা বই আর খাতা কলম নিয়ে এসে ছিলো কিন্তু পড়াশোনা আর হয়নি। মিরা একটা সাদা কাগজে লিখতে শুরু করে–
জনাব,

আপনাকে আমি চিনি না। তাই প্রিয় বলে সম্মোধন করতে পারছি না। আমি একজন বিবাহিত নারী। আমার স্বামী আছে। আমি চাইলেও অন্য পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হতে পারি না। আপনাকে বড় জোড় বন্ধু ভাবতে পারি। এর থেকে বেশি কিছুই নয়। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। এতোদিন খেয়াল রাখার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবে না৷
ইতি,
মিরা

লেখা শেষ করে কাগজটা ভাজ করে জানালায় উপর রেখে দেয়। একটা ছোট ইটের টুকরো কাগজের উপর দিয়ে রাখে, পাছে যদি বাতাসে উঠে যায়।
মিরার কিছু ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে কোনো দমকা হাওয়া তার জীবনটা এলোমেলো করে দিবে। এতো দিন আশরাফুলকে ঘৃণা করার কারণ ছিলো মিরার কাছে কিন্তু আজ-কাল আশরাফুলকে দেখতে একদম রাগ হয় না। সহানুভূতি জেগে ওঠে। কতটা কষ্ট ছেলেটার জীবনে, তাও কি সুন্দর সবকিছু মানিয়ে চলেছে।

কোনো অচেনা লোককে বিশ্বাস করে ঘর ছাড়তে রাজি নয় মিরা। বাইরের দুনিয়ায় ভয়ংকর রূপ সে দেখেছে। মা’য়ের লড়াই দেখেছে। এই বাড়ির ভিতর তবুও তার সতীত্ব অক্ষত আছে, কিন্তু বাইরে হাজারও হিংস্র কুকুর ওত পেতে আছে একটা নরম শরীর ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য। শিক্ষিত ডিগ্রীধারী লোক হতে বাসের ড্রাইভার।

সত্যিকারের মানুষ পাওয়া যেন বড্ড দায়। অনেক ভাবে মিরা, শেষ মেষ সিদ্ধান্ত নেয় পরকীয়া নামক মরণ ফাঁদে সে পা দিবে না। আশরাফুলের সাথে যদি তার ডিভোর্স হয় তবেই কাউকে নিয়ে কিছু ভেবে দেখবে। সাগর দূর থেকেই সুন্দর। এর ভয়ংকর রূপ তো সাগরে ডুবে মারা যাওয়া লোকগুলো জানে। মুখে বলা যতটা সহজ বাস্তবে সেগুলো করে দেখানো বড্ড কঠিন।

একজন বিবাহিত মেয়ের সাথে হাজার ছেলে প্রেম করতে আসে, হাজার রকমের ভালোবাসা দেখায় কিন্তু বাস্তবে কেউ বিয়ে করতে চায় না। যদিও কেউ বিয়ে করে সে-ই সংসারে সুখের নিশানা থাকে না। যদি এমন কেউ সুখী হয়ে থাকে তবে সে অতিরিক্ত ভাগ্যবতী। তার কথা আলাদা। প্রেমিকদের স্বামীর মতো দায়িত্ব থাকে না। স্বামী হয়ে ওঠা বড্ড কঠিন!

সন্ধ্যার দিকে আশরাফুল আসে। ঘরে যাওয়ার আগে মিরাকে বলে, ” মিরা এক কাপ কফি দেবে আমাকে? মাথাটা বড্ড ধরছে। ”
মিরা মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। কি সুন্দর করে আবদার করে আশরাফুল! ফিরিয়ে দেওয়া যে বড্ড কঠিন। আচ্ছা আশরাফুল যদি কখনো মিরাকে আবদার করে বসে, কি করবে মিরা? অতিতের কষ্ট আঁকড়ে আশরাফুলকে ফিরিয়ে দিবে নাকি সবকিছু ভুলে নতুন করে পথ চলতে চাইবে?

মিরা কফির মগটা হাতে নিয়ে আশরাফুলের ঘরের দিকে যায়। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বলে,” ভিতরে আসবো?”
–” হুম আসো। ”
মিরা মগটা আশরাফুলের হাতে দেয়। আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, ” Thank you. ”

প্রতি উত্তরে মিরা মুচকি হাসে। আশরাফুল মিরার দিকে মগটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ” তুমি তো নিজের জন্য আনোনি। যেখানে দুইজন মানুষ থাকে সেখানে একা কোনো খাবার খাওয়া উচিত নয়। তুমি বরং এখান থেকেই একটু খাও। ”
মিরা আশরাফুলের কথায় হতভম্ব হয়ে যায়। এ ছেলে বলে কি! সত্যি কি মিরার এঁটো খাবার আশরাফুল খাবে নাকি? মিরার মনে প্রশ্ন জেগে ওঠে কিন্তু বলে, ” আসলে আমি কফি খাই না। আপনি খান। ”

আশরাফুল নিজের মতো কফি খেতে থাকে। মিরা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আশরাফুল ব্যপারটা লক্ষ্য করে বলে, ” একি! তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। ”
মিরা খাটের উপর বসে পড়ে। আশরাফুলের খাটের এক কোণে বসে কফি খাচ্ছে। আর মিরা দু-হাত দূরে বসে কিসব ভাবছে।
–” আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

আশরাফুল কফির মগে চুমুক দিতে দিতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। মিরা বলে উঠে, ” আপনি ম্যানিব্যাগে মিতালির ছবি কেন রাখতেন? সেঁজুতি তো আপনাকে সত্যি ভালোবাসতো। ”
–” আসলে মিরা আমরা তাদেরকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেরি যারা আমাদের খারাপ সময় একটু সান্ত্বনা দেয়। একটু সাপোর্ট করে। আমিও মিতালিকে এমনই ভালোবাসতাম। ”
কথাগুলো বলে আশরাফুল মিরার দিকে ম্যানিব্যাগ এগিয়ে দেয়।

–” সেঁজুতি ছবি তো এখনো আমার কাছে আছে। ”
মিরা মুচকি হাসে। কোনো এক অজানা কারণে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। ধীর পায়ে আশরাফুলের ঘরে থেকে বেরিয়ে আসে। রাতের খাবার গোছাতে হবে।

আলোছায়া পর্ব ১০

ওদিকে মিরার চিঠি পড়ে অচেনা লোকির চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে চিঠির উপর। কাগজের চিঠি আস্তে আস্তে পানিকণাগুলো শুষে নেয়। পরক্ষণেই লোকটার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। এই হাসি-ই কি মিরার জীবন উলোটপালোট করে দিবে?

আলোছায়া পর্ব ১২