আলোছায়া পর্ব ১০

আলোছায়া পর্ব ১০
ফারহানা কবীর মানাল

মিতালি প্রায় দিন এখানে ঘুরতে আসে বিকালে, যখন কথা হতো তখন মিতালিই বলেছিলো। ওদের পাড়াতে আমি আগে কখনো যাইনি, সেদিনই প্রথম গেছিলাম সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, মনে মনে কত কিছু ভেবেছিলাম, মিতালি কতোটা খুশি হবে আমাকে দেখে, ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠছিলো।

আনন্দগুলো বড্ড ক্ষীণ স্হায়ী হয় মিরা। সেদিন পার্কে মিতালিকে খুঁজতে খুঁজতে একটু নির্জন জায়গায় চলে গেছিলাম। পরে ভাবলাম এখন ফাঁকা জায়গায় মিতালি আসবে না, তাই ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই চোখে পড়লো একজন পুরুষ কোনো রমনীর কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শাড়ি আঁচল দিয়ে হাত ঢেকে গেলেও গাছের পাশ দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রথমে মনে করেছিলাম হয়তো কেউ একান্ত সময় কাটাচ্ছে, আমার এসব দেখা উচিত না কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম ওইটা মিতালি। মিতালি আমাকে দেখে চমকে গেলেও নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলো, ” আশরাফুল তুমি এখানে কেন?”
আমি শান্ত গলায় জবাব দিলাম, ” তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিতালি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মিতালির সাথের ছেলেটা দৌড়ে আমাকে মারতে আসলো আমার শার্টের কলার চেপে ধরে বললো, ” তোর এতো সাহস যে আমার বউয়ের সাথে দেখা করতে আসিস?”
আমি মুচকি হেসে বললাম, ” আর যাই হোক মিতালি আপনার স্ত্রী নয়। কেউ স্ত্রীকে নিয়ে পার্কের নির্জন জায়গায় নোংরামি করে না। ”

কথাগুলো বলে লোকটার হাত শার্ট থেকে সরিয়ে নিলাম। আর মিতালিকে প্রশ্ন করলাম, ” কে এই ছেলেটা?”
মিতালি ভিতু গলায় বললো, ” এটা আমার কাজিন। ”
ছেলেটা মিতালির উপর চিৎকার করে বলে উঠলো, ” সময় করে হোটেলে যেতে পারো না নাগর সামনে এলে কাজিন। ”

আমার কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। চুপচাপ চলে এলাম। শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছিলো। মিতালি এমন হতে পারে বা এমন করতে পারে আমি কখনো বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম মিতালি আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, নিজের ভুল বুঝতে পারবে। মিতালি একবার আমার কাছে ফিরে আসলে আমি সবকিছু ভুলে ও-কে নিজের করে নিতাম কিন্তু এমনটা হয়নি। ওই দিনের পর আরো সাতদিন কেটে গেলো। মিতালি আমাকে কোনো প্রকার কল বা এসএমএস দেয়নি। ওই সময়টাতে মিতালিকে ছাড়া আমি কোনো কিছুই ভাবতে পারতাম না। তাই নিজেই বেহায়ার মতো মিতালি কে কল দিলাম।

–” মিতালি কেমন আছো?”
–” অনেক বেশি ভালো আছি। শোনো আশরাফুল তুমি আমার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি, তোমাকে নয়। ”
–” এতোদিন কি বলেছিলে আমাকে?”
–” তুমি কষ্ট পেতে একা একা তা-ই সহানুভূতি দেখিয়েছিলাম। ”
–” এখন কি আমি কষ্ট পাচ্ছি না?”
–” জানি না। তোমার এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আমার নেই। ”
–” কেন এমন করলে? এটা শেষ প্রশ্ন। ”

–‘ কতদিন হয়ে গেছে তোমার কোনো চাকরি হয়নি। তুমি আমাকে সামান্য একটা মোবাইল কিনে দিতে পারো না, আর ওই ছেলে আমাকে আইফোন কিনে দিয়েছে। আমি ও-র সাথেই খুব সুখী। আমি ও-কে বিয়ে করবো। ”
–” যে ছেলে তোমাকে বিয়ের আগে হোটেলে নিয়ে যায় সে তোমাকে বিয়ে করবে বলে তোমার মনে হয়?”
–” তুমি কে এতো কথা বলার? আর কখনোই আমাকে বিরক্ত করবে না। ”

মিতালি সেদিন কল কেটে দেয়। এরপর হাজার বার ও-র সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আমাদের বিয়ের সাতদিন আগে মিতালি আমাকে ডেকে পাঠায়৷ জানি না কেন তখন এতো পাগল ছিলাম। মিতালির ডাকে ছুটে গেছিলাম ওর কাছে। ভেবেছিলাম হয়তো মিতালি ও-র ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমাকে আবার আগের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।

মিতালি ওইদিন আমাকে ডেকে নিয়ে ও-র বয়ফ্রেন্ড আর কিছু ছেলেদের দিয়ে আমাকে মারে, একদম মেরেই ফেলতে চাইছিলো কিন্তু পরে কি মনে করে আর মারেনি৷ যাওয়ার আগে ওয়ার্নিং দিয়ে গেলো জানি মিতালিকে বিরক্ত না করি। তাহলে পরের বার আমাকে মেরে ফেলবে। মিতালিও আমাকে অপমান করতে ভোলেনি। সবার সামনে বললো, ” তোর মতো একটা ছোটলোক আমার পিছনে কি করে আসতে পারে। আমার রূপ দেখেছিস তুই? এই রূপের যোগ্য তুই না। একটা চাকরি খুঁজে পায় না আসে আমার সাথে লাইন মারতে। ফাউল পোলাপান। ”

মাটিতে শুয়ে ছিলাম কিছু সময়। উঠায় শক্তি ছিলো না। যে মিতালি ভেঙে যাওয়া আমিকে জোড়া লাগিয়েছে, আমি সামান্য ব্যাথা পেলে যে ব্যাকুল হয়ে যেতো আজ সে নিজে দাঁড়িয়ে আমাকে মার খাওয়ালো। কতোটা বদলে যায় মানুষ। এরপর কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। পরে রাস্তার লোকজন তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো। বাড়িতে কল দিয়ে বলছিলাম আমি অফিসের কাজে বাইরে আসছি। ওদের টেনশনে রাখতে চাইনি। সাতদিন পর হাসপাতাল দিয়ে বাড়ি ফিরে জানতে পারি সেদিন নাকি আমার বিয়ে। অনেক ঝগড়া করেছি, কিন্তু আব্বু কিছু শুনতে চায়নি। পরে ভেবেছিলাম কার জন্য বসে থাকবো, বাড়ির লোকের মনে কষ্ট দিয়ে কি লাভ! তাই ওদের সাথে গেছিলাম। বিয়ের আগে তোমার সাথে অনেক দেখা করার চেষ্টা করেছি, কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।

মিরার মনে পড়ে সেদিন আশরাফুল অনেকবার বলেছিলো আমি একটু পাত্রীর সাথে কথা বলবো কিন্তু রোজিনা রেণু উত্তরে বলেছিলো বিয়ে হলে সারাজীবন কথা বলতে পারবে।
আশরাফুলের চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে, এক হাত দিয়ে পানি মুছে আবারও বলতে শুরু করে,
বিয়ের দিক সব থেকে বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম তোমাকে দেখে, কারণ তোমাকে দেখতে একদম মিতালির মতো। একটা পার্থক্য আছে বটে কিন্তু সেদিন অতো খেয়াল করিনি। আমি জানি না আমার জীবনটা কেন এমন হলো।

বাসরঘরে তোমাকেই মিতালি ভেবেছিলাম, পরে জানলাম তুমি অন্যকেউ। শেষ কথাগুলো বলতে কন্ঠ জড়িয়ে আসে। আশরাফুল উঠে দাঁড়ায়, মিরার কেন জানি বড্ড কষ্ট হচ্ছে আজ। যে মানুষটা এতোদিন দোষী ভেবে এসেছে আজ তার জীবন কাহিনী মিরাকে বড্ড আঘাত করছে। মিরা আর সহ্য করতে পারে না। আশরাফুলকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দেয়। আশরাফুল একটু অবাক কিন্তু কিছু বলে না।

মিরার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, প্রথম কোনো পুরুষের এতোটা কাছাকাছি এসেছে মিরা, আশরাফুলের উষ্ণতা অনুভব করছে তবে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মিমিট পাঁচেক পর মিরা বুঝতে পারে এমনটা করা উচিত হচ্ছে না। তবুও আশরাফুলকে ছেড়ে দেয় না, জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আশরাফুল নিজেই মিরার দুই বাহু ধরে মিরাকে মুক্ত করে নিজের বুকের উপর দিয়ে, তারপর দুইহাত দিয়ে মিরার দুই কপল মুছে দেয়। চোখের পানিতে গাল ভিজে একাকার হয়ে গেছে মেয়েটা।
শান্ত গলায় বলে, ” অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না?”

মিরা মাথা নাড়িয়ে না বলে, তারপর কান্না জড়িত কন্ঠে প্রশ্ন করে, ” আপনি কেন কাঁদছেন? সেঁজুতি কথা বলার সময় তো কাঁদতে দেখিনি। ”
আশরাফুল হাসে, তারপর বলে, ” বেইমান দের জন্যই আমি বেশি কষ্ট পাই। চোখের পানি বেইমানরা বেশি ঝরায়। তাদের জন্য তেমন কষ্ট হয় না যারা আমাদের সত্যিকারের ভালোবাসে। আমিও ব্যতিক্রম নই রে। ”

মিরা কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুল ছাঁদ থেকে নেমে নিচে চলে যায়। চারদিকে তখন অন্ধকারে ভরে গেছে, কখন সন্ধ্যা নেমেছে মিরা জানে না। ধীর পায়ে ঘরে চলে যায়। সবকিছু এলোমেলো লাগছে না, মিরা যাকে সব থেকে বেশি ঘৃণা করে সে-ই মানুষটার জন্যই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। এতোটা কষ্ট পেয়েও ছেলেটা কত সুন্দর হাসে। মিরা কি পারতো এমন হলে ঘুরে দাঁড়াতে? আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মিরা, মিতালিকে তার মতে দেখতে কেন? সে কি অন্য রকম হতে পারতে না। আশরাফুল মিরাকে দেখলে কেন ঘৃণা জন্ম নিবে, আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে মিরা।

জানালায় উপর একটা সাদা কাগজ পড়ে আছে। হয়তো অচেনা লোকটা চিঠি দিয়েছে, আজ মিরা চিঠির প্রতি আর্কষণ অনুভব করে না, তবুও গিয়ে চিঠিটা হাতে তুলে নেয়। অন্য কেউ দেখলে আবার কি সমস্যা হয়!

চিঠিটা পড়তে ইচ্ছে করছে না মিরার, বালিশের নিচে রেখে দেয়। কিছু সময় একা একা কাঁদতে থাকে। তারপর স্বাভাবিক হয়ে হাত মুখ ধূয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। বেশ রাত হয়ে গেছে সবাইকে খেতে দিতে হবে, সেদিন খাবার টেবিলে আশরাফুল আসে না। মিরা সাহস করে আশরাফুলের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দুপুরে ওইটুকু ভাত খেয়েছে এখন রাতে না খেলে হয়তো শরীর খারাপ করবে। আশরাফুলের ঘরের দরজা খোলা, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিরা কয়েকবার ভিতরে যাওয়ার অনুমতি চায়। কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না।

মিরা দরজার পর্দা সরিয়ে দেখে আশরাফ ঘুমিয়ে আছে। বালিশের সামান্য অংশ ভিজে গেছে। হয়তো কাঁদ ছিলো সে। মিরা সাহস করে ঘরের ভিতর গিয়ে আশরাফুলের গায়ে কম্বল টেনে দেয়। তারপর লাইট অফ করে বেরিয়ে আসে। মিরা এমন ব্যবহারের কারণ মিরা বুঝতে পারছে না। তবে এই মানুষটার জন্য বড্ড খারাপ লাগছে তার। কতটা কষ্ট নিয়ে ছেলেটা ঘুরে বেড়ায়, ছাড়া আড়ালে এতো কষ্ট লুকিয়ে রাখে মানুষ। আশরাফুল রাতে খায় না, মিরাও কেন জানি না রাতের খাবার না খেয়ে শুয়ে পড়ে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে মিরা কিন্তু ঘুম আসছে না। আশরাফুলের বলা কথা মনে পড়ছে। কতটা কষ্ট পেয়েছে আশরাফুল তা অনুভব করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মিরার চিটির কথা মনে পড়ে, চিঠিটা বের করে দেখে, তাতে লেখা রয়েছে –

আলোছায়া পর্ব ৯

প্রিয়তমা মিরা,
তোমার ভাগ আমি কাউকে দিবো না প্রিয়তমা। তোমার স্বামী আশরাফুলকেও নয়। তুমি একান্তই আমার, নিজস্ব সম্পত্তি! তুমি কখনো আমার চিটির উত্তর দেও না। তবে আজ আমি চাই তুমি এটার উত্তর দেও। অপেক্ষায় রইবো।
তোমার অচেনা ভালোবাসা,

আলোছায়া পর্ব ১১