আলোছায়া পর্ব ৮

আলোছায়া পর্ব ৮
ফারহানা কবীর মানাল

কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সেখানে, হনহন করে চলে যায়। মিতা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুল ইদানীং অদ্ভুত ব্যবহার করছে মিরার সাথে!

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, সেদিন পর প্রায় দুই মাস কেটে গেছে, আশরাফুল মিরার সাথে বেশ ভালোই কথা বলে, খাওয়ার টেবিলে মিরা রান্নার প্রশংসা করতে ভোলে না। মিরার এখন আশরাফুলকে নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। অচেনা সে-ই ছেলেটা প্রতিদিন মিরাকে নতুন চিঠি দেয়, ভরসা দেয়। আজও মিরা সকাল থেকে অপেক্ষা করছে চিঠির জন্য, বেশ কয়েকবার ঘরে গিয়ে দেখে এসেছে কিন্তু কোনো চিঠি নেই। অপেক্ষার সময় যেন পার হতেই চায় না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দুপুরে সকলের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, মিরা সবে মাত্র খেতে বসেছে এমন সময় আশরাফুল অফিস থেকে বাড়িতে আসে, আশরাফুল কখনো দুপুরবেলা বাড়িতে আসে না। আজ হঠাৎ চলে এসেছে, মিরা আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আপনি দুপুরে খাবেন?”

আশরাফুল মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়, তারপর নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মিনিট দশেক পর ফ্রেশ হয়ে খেতে আসে। মিরা বাড়তি খাবার রান্না করে না, কালে ভদ্রে খাবার বেশি থাকলেও আজ বাড়তি কিছুই নেই। মিরা নিজের খাবারটা রেখে বাকি ভাতগুলো পিছনের পুকুরে দিয়ে এসেছে, উপায় না পেয়ে নিজের প্লেটটা আশরাফুলের সামনে সাজিয়ে দিয়ে বলে, ” আপনি খেতে শুরু করেন। আমি ডিম ভেজে আনছি। ”

আশরাফুল আঁড়চোখে মিরার দিকে তাকায়, তারপর শান্ত গলায় বলে, ” তুমি খাবে না? আমার সাথেই বসে পড়ো। বেলা তো অনেক হলো। ”
মিরা কি জবাব দেবে ভেবে পায় না। হাতের আঙ্গুলে ওড়না পেঁচাতে থাকে।
আশরাফুল উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করে, ” কি হলো তুমি খাবে না? আমি যখন আসলাম তখন তুমি খেতে বসছিলে তাহলে?”

–” আসলে আমার খাওয়া শেষ। আপনি খেয়ে নিন। আমি ঘরে যাই। ”
আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, “জানো তো মিরা মিথ্যা কথা বলতে নেই। তুমি আমার সাথে একসাথে বসে খাবার খেতে চাও না, এটা বললেই তো পারো। অবশ্য তোমার আমার মুখ দেখাও উচিত না। ”
–” না মানে…”

মিরা কোনো জবাব খুঁজে পায় না। কি বলা উচিত বুঝতেও পারে না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুলের মুখে তখনও একটা হাসি লেগে রয়েছে, হয়তো বিদ্রুপের হাসি।
–” আচ্ছা মিরা আমি কি অনেক বেশি খারাপ?”
–” না তেমন কিছু না, আসলে আর খাবার নেই। আমি যে প্লেটে খেতে বসেছিলাম ওইটাই আপনাকে দিয়েছি। আমার প্লেট আপনাকে দিয়েছি শুনলে হয়তো রাগ করতেন তাই আর বলিনি। ”

আশরাফুল মুচকি হাসে, তারপর অন্য একটা প্লেটে নিয়ে তাতে সব খাবার অর্ধেক ভাগ করে। মিরার দিকে তাকিয়ে বলে, ” এবার এসো। এতো কাজ করে না খেয়ে থাকা উচিত নয়। ”

মিরা ভাবতেও পারেনি আশরাফুল এমন কিছু করবে, সে ভেবেছিলো হয়তো ও-র প্লেট আশরাফুলকে দিয়েছে জানলে আশরাফুল রাগ করবে, তাকে ছোটলোক বলে মারতে আসবে কিন্তু আশরাফুল খাবার ভাগভাগি করে খেতে চাইবে তা কখনো বুঝতে পারেনি। আশরাফুল দিন দিন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে। কত সাদামাটা একটা ছেলে, যে মেয়েকে বিয়ের রাতে অস্বীকার করেছে তার সাথে আজ খাবার ভাগ করে নিচ্ছে। দুনিয়ার মানুষগুলো কত অদ্ভুত।

–” তুমি কি আমার সাথে বসে খাবে? নাকি আমি উঠে যাবো। ”
মিরা চায় না আশরাফুল খাওয়া ছেড়ে উঠে যাক। এটা রেশমা বানু বা লাবণি শুনলে তাকে অনেক কথা শোনাবে, অশান্তি একদম ভালো লাগে না তার। তাই দেরি না করে একটা চেয়ার টেনে খেতে বসে পড়ে।
–” মিরা লাউ চিংড়ি রান্নাটা দারুণ হয়েছে। তুমি কিন্তু দারুণ রান্না করো। ”

মিরা মুচকি হাসে, তারপর প্লেটে হাত নাড়াচাড়া করে, খাবার মুখে তুলতে পারে না। হয়তো আগে কখনো আশরাফুলের সাথে এক টেবিলে খায়নি তার জন্য। আশরাফুলও ব্যাপারটা বুঝতে পারে, তাই মিরাকে জোর করে না, নিজের মতো খেয়ে চলে যায়। মিরাও খাওয়া শেষ করে ঘরে চলে যায়। এতোক্ষণে হয়তো লোকটা চিঠিটা রেখে গেছে, প্রতিদিন দুপুরে পরেই মিরা চিঠিটা হাতে পায়, জানালার পাশেই রাখা থাকে, এদিকে বাড়ির কেউ আসে না বলেই কেউ কখনো চিঠিটা হাতে পায়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো এখনও কেউ চিঠি রেখে যায়নি, মিরার মনটা বেশ খারাপ হয়। মন খারাপ করে ছাঁদে চলে যায় সে।

ছাঁদের উপর বেশ কয়েক রকমের ফুল ফলের গাছ। আশরাফুল নিজের হাতে লাগিয়েছে সবকিছু, মিরা ছাঁদে গিয়ে দেখতে পায় আশরাফুল কিছু পোড়াচ্ছে, আগুনের শিখার উপর দিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশের ওঠে যাচ্ছে, আশরাফুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে, চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে কপল ভিজিয়ে দিয়েছে আশরাফুলের। মিরা অবাক হয়, এই ছেলেটাও কাঁদতে পারে। যে কিনা মিরাকে এতো কাঁদিয়েছে সে-ও আজ কাঁদছে। হয়তো ভাগ্যই এমন হয়। মিরা উপস্থিতি বুঝতে পেরে আশরাফুল চোখ মুছে ফেলে তারপর শান্ত গলায় বলে, ” কিছু বলবে তুমি?”

মিরা মাথা নাড়িয়ে বলে, ” না এমনি ছাঁদে এসেছিলাম, ঘরে ভালো লাগছিলো না বলে।”
–” মিরা জীবন সিনেমার থেকেও অদ্ভুত হয় তাই না বলো? সিনেমা তো আমরা তিন ঘন্টা দেখে শেষ করে ফেলি, তবে জীবনে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পেতে হয়।”

–” আপনি এমন কেন বলছেন? আপনার জীবনে তো কোনো কষ্ট নেই। কত সুন্দর আপনার জীবন, এতো বড় বাড়ি, সকলে আপনাকে কত ভালোবাসে। এমন জীবন তো সবাই পায় না”
আশরাফুল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ” তুমিও আমাকে ভালোবাসো নাকি?”

মিরা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুলকে সে কখনো ভালোবাসতে পারে না। এই ছেলেটা মিরার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে, সেদিন মিরাকে বিয়ে করে নরক যন্ত্রণা বরণ করতে হয়েছে মিরাকে, শশুর শাশুড়ি লাবণি কত অত্যাচার করেছে ওকে, কখনো প্রতিবাদ করেনি, পাশে এসে দাঁড়ায়নি, এমনি স্ত্রী’র মর্যাদা পর্যন্ত দেয়নি। এমন মানুষকে ভালোবাসা যায় না, শুধু ঘৃণাই করা যায়। মিরার নিরবতা আশরাফুলকে বিচলিত করে না, সকলেই নিরবতাকে সম্মতি হিসাবে ধরে নেয়, তবে আশরাফুল নিশ্চিত এখানে উত্তরটা না। তাকে মিরার ভালোবাসার কোনো প্রশ্নই আসে না। আশরাফুল মিরার ভালোবাসা আশাও করে না।

শান্ত গলায় বলে, ” জানো মিরা সব জিনিস যেমন দেখা যায় তেমন হয় না, সমুদ্র কে-ই দেখো, কত সুন্দর, কত বিশালতা তার, হাজার হাজার মানুষ সমুদ্র পাড়ে বেড়াতে যায়, পানিতে সাঁতার কাটে, তবে সে-ই মাঝিই এর নিষ্ঠুরতা জানে যে সাগরে পড়েছে, খুব কাছ থেকে একে উপভোগ করছে, সে-ই নাবিক এর নিষ্ঠুরতা জানে যার শেষ সম্বলটুকু সাগর জলে বিলীন হয়ে গেছে। আমার জীবনটাও অনেকটা তেমন, দূর থেকে অনেক বেশি সুন্দর তবে কাছ থেকে আমি এর নিষ্ঠুরতা জানি। ”

মিরা অবাক হয় না। বরং কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে, ” কি এতো নিষ্ঠুরতা আপনার জীবনে?”
–” অনেক বিশাল কাহিনী। তুমি শুনবে নাকি?”
মিরা উত্তর দিতে দেরী করে না। চট করে বলে বসে, ” হ্যাঁ শুনবো। ”

আশরাফুল বলতে শুরু করে তার জীবন কাহিনী, মিরা উৎসুক শ্রোতার মতো আশরাফুলের দিকে চেয়ে থাকে। দূরের আকাশে সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে, তবুও সন্ধ্যা নামতে বেশ দেরী।
–” মিরা এই যে দেখো কিছু জিনিসকে আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে ফেলছে এগুলো আমার ভালোবাসার চিহ্ন। অনেক যত্ন করে রেখেছি এতোদিন, আজ কেন জানি আর রাখতে ইচ্ছে করলো না। ”

–” যাকে ভালোবাসা হয় তার জিনিস তো যত্ন করে রাখতে হয়, আমিও তার চিঠি যত্ন করে রেখেছি।”
তার চিঠি যত্ন করে রেখেছি কথাটা আস্তেই বলে মিরা তবুও আশরাফুল হয়তো শুনতে পেয়েছে তাই কপাল কুঁচকে তাকালো মিরার দিকে, কিন্তু কিছু বললো না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিরাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে মিরা প্রশ্ন করে, ” আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে ছেড়ে দিলেন কেন?”
ম্যানিব্যাগ থেকে মিরার মতো দেখতে মেয়েটার ছবিটা বের করে কয়েক টুকরো করলো আশরাফুল তারপর আগুনে পুড়িয়ে দিতে দিতে বললো, ” বেইমানদের মনে রাখতে হয় না। ”

–” আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। ”
–” বুঝতে হলে তো তোমাকে সবটা শুনতে হবে। তাই না? ”
–” হুম। ”

–” মিরা আমি তখন সবে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, পড়াশোনা নেই, রেজাল্টও বের হয়নি। কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সারাদিন ঘুরে বেড়ানো আর দিন শেষ বই পড়া, আড্ডা দেওয়া, সকলের সাথে গল্প করা। সেঁজুতি নামের একটা মেয়ে আমার ক্লাসমেট ছিলো।

একসাথে পড়তাম স্কুলে, কলেজে। কলেজে যাওয়া হতো না বলে ও-র সাথে তেমন যোগাযোগ হতো না। আমরা বন্ধুও ছিলাম না। একদিন হঠাৎ রাস্তায় ও-র সাথে দেখা হলো। হাতে ছোট বাচ্চাদের বই নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। আমাকে দেখে ডাক দিলো, আমি তখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়েছি্। সুখটান দেওয়ার আর সুযোগ পেলাম না।

–” আশরাফুল এদিকে শোন। ”
ও-র ডাক শুনে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে ও-র কাছে গেলাম। সেঁজুতি হয়তো আমাকে সিগারেট ফেলতে দেখে ফেলেছিলো। ও-র কাছে যাওয়ার সাথে সাথে বলে উঠলো, ” দেখ তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলে কিন্তু আমি কাকি মা-কে বলে দিবো। ”

ও-র কথায় বড্ড মেজাজ খারাপ হয়েছিলো। কে কোথা থেকে আসছে আমার মা’কে নালিশ করতে, রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ” তুই কে রে যে আমার মা’কে বলতে যাবি। তুই কি আমার মা’য়ের দাসীবাঁদী নাকি রে?”
সেঁজুতি মুচকি হেসে বললো, ” না রে পাগল, আমি তো তোর বড় ভাবি। তোর ভাইয়া আমাকে অনেক পছন্দ করে, কত্ত চিঠি দিয়েছে আমাকে জানিস তুই?”

সেঁজুতি কথায় আমি শক খেলাম বড়সড় রকমের কারণ আমার কোনো ভাই নেই। লাবণি তখনও বেশ ছোট। মুখ বেঁকিয়ে বললাম, ” দেখ আমার কোনো বড় ভাই নেই। বাজে কথা বলিস না তো। নিজের কাজে যা। ”
–” দেখো ছেলের রাগ, কতোদিন বয়স তোর যে এখন সিগারেট টানছিস? আমার মতো ভালো কাজ কর পারলে। ”
–” কি এমন মহান কাজ করিস তুই শুনি? আর তাছাড়া তুই তো মহান কাজ করবি কারণ কয়েকদিন পর তোর বিয়ে হবে, তুই তো বুড়ি হয়ে যাবি তখন। ”

সেঁজুতি আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো। আমিও ও-কে মনে মনে গালাগালি দিতে দিতে বাড়িতে আসলাম। কত শখ করে সিগারেট খেতে গেছিলাম, মাটি করে দিলো একদম। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেঁজুতি সোফায় বসে আছে আর মা’য়ের সাথে কথা বলছে, ও-কে এখানে দেখে আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো।

আলোছায়া পর্ব ৭

এই মেয়ে এতো ডেঞ্জারাস তা তো আগে জানা ছিলো না। আমি ওঁদের কাছে যাওয়ার আগেই সেঁজুতি কাঁধে ব্যাগ তুলে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আমি তখন মহা টেনশনে আছি।

আলোছায়া পর্ব ৯