অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৩

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৩
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

কল কেটে বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইল তুহিন। অদ্ভুত এক ভাবাবেগ ঘিরে ধরল মনকে। রাশেদ আমের মৃত। সেটা ও সেদিনই জানতে পেরেছিল যেদিন প্রথম গুলশান থানায় যায় এই কেসটার বিষয়ে কথা বলতে। ইন্সপেক্টর আজিজ প্রথম ওকে যেই ফাইলটা দিয়েছিল। সেটাতে রাশেদ আমেরের রহস্যময় মৃ/ত্যু এবং সে বিষয়ে আজিজের নিজস্ব কিছু সন্দেহের কথা লেখা ছিল। এই সেই ঘটনা যার পর শান্ত হয়ে গিয়েছিল অশান্ত গুলশান।

তখন ব্যপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল ও। একজন আন্ডারওয়ার্ল্ড লীডারের রহস্যময় মৃ/ত্যু। ব্যস, আর কিছুই না। কিন্তু এ কয়েকদিনে কেসটা নিয়ে ঘাটে ঘাটতে আমের ভিলা, আমের পরিবারের প্রতিটা সদস্য, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বেশিই জড়িয়ে গিয়েছিল ও। নিজের অজান্তেই। ওদের নিয়ে গবেষণা করতে করতে ওদের সম্পর্কে জানতে জানতে অদৃশ্য এক টান তৈরী হয়ে। যেটা মোটেও প্রফেশনাল ব্যবহার না। সেটা জানে তুহিন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু মনের ওপরতো কোন নিয়মের নিয়ন্ত্রণ চলেনা। রাশেদ আমের নেই। ব্যপারটা যেন অদ্ভুতভাবেই ব্যথিত করছে তুহিনকে। তারপর কুহু। অ‍্যালবামে মেয়েটার ছবি দেখেছিল ও। কী মিষ্টি একটা মেয়ে। মুখভর্তি মায়া, চোখভর্তি সরলতা, নিষ্পাপ হাসি। অথচ এই নরপশুদের ঘৃণ্য থাবা থেকে রক্ষা পেলোনা সেও। কতটা আ/ঘা/ত পেয়েছিল সেই নিষ্পাপ মনটা? চিৎকারটাও করতে পারেনি মেয়েটা! দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। মনটা খারাপ হয়ে গেছে। সঙ্গে নিজের ভেতর অকারণ এক ক্রোধ অনুভব করল যেন। আচ্ছা ঘটনাগুলো ওর মনেই এরকম প্রভাব ফেলে দিয়েছে। তাহলে রুদ্রর মনে কী চলছিল সেই সময়? হোক না সে ক্রিমিনাল। তবুও।

তুহিন ভেতরে এসে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে দেখল। টেবিলে রাখা ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। তুহিন ফোনটা হাতে নিতেই জ্যোতির ধ্যান ভাঙল। তুহিন ফোনটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে নিজের চেয়ারে বসল। জ্যোতির দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘রুদ্রর সঙ্গে সত্যিই কোনরকম যোগাযোগ নেই আপনার?’
জ্যোতি জবাব দিলোনা। তুহিন আবার বলল,’নীরব আপনাকে কেন ফোন করেছিল? আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি ও নিখোঁজ। কিন্তু আপনার কাছে ওর খোঁজ আছে। একটু এক্সপ্লেইন করবেন?’

বলে ফোন থেকে চোখ তুলে তাকাল জ্যোতির দিকে। জ্যোতি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তুহিন টেবিলে দুই কুনুইয়ের ভর দিয়ে বলল, ‘প্লিজ।’
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল জ্যোতি। বলল, ‘নীরব আমাদের সাথেই থাকে।’
‘আর কুহু?’ নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে প্রশ্নটা বেড়িয়ে এলো তুহিনের।

জ্যোতি নিরুত্তর। ভেতরে ভেতরে মেজাজ খারাপ হল তুহিনের। মেয়েটা বলছে ঠিকই। কিন্তু ততটুকুই যতটুকু বলতে চায়। কিন্তু ধৈর্য হারালো না ও। বরং শান্ত গলাতেই বলল, ‘রুদ্রর সঙ্গে যোগাযোগ আছে আপনাদের। মিথ্যে বলবেন না জ্যোতি। ব্যপারটা আমি পছন্দ করিনা।’

জ্যোতি তুহিনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। কৌতুক খেলা করছে ওর চোখে। বলল, ‘আপনার কী মনে হয়? রুদ্র এতো কাঁচা কাজ করবে? যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেও। কোন নির্দিষ্ট নাম্বার বা জায়গা থেকে করবে?’
তুহিন তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। কয়েক সেকেন্ড। তারপর টেবিলের ওপর দুহাত রেখে ঝুঁকে বলল, ‘আপনাদের রুদ্র কাঁচা-পাকা যে খেলাই খেলুক। ধরা ওকে পড়তেই হবে। আর সেটা হয়তো আজকেই।’

‘রুদ্রকে আন্ডারেস্টিমেট করবেন না অফিসার। এই ভুলটা এর আগে অনেকেই করেছে। তার ভয়ানক মূল্যও দিতে হয়েছে।’
তুহিন জ্যোতির চোখে চোখ রাখল। মুচকি হেসে বলল, ‘আপনিও আমাকে আন্ডারেস্টিমেট করবেন না ম্যাডাম। এই ভুলটাও এর আগে অনেকে করেছে। আর তার ভয়ানক মূল্যও দিতে হয়েছে।’

জ্যোতি চোখ নামিয়ে নিল। তুহিন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। জ্যোতির ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়িয়ে বলল, ‘এটা আমাদের কাছেই থাকল। আর অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে আপনাকে আমরা এখনই ছাড়তে পারছিনা। আমার ইন্ট্রোগেশন এখনো বাকি। ততক্ষণ আপনাকে কষ্ট করে আমাদের কাস্টাডিতেই থাকতে হবে। তবে চিন্তা করবেন না, এখানে আপনার কোন অসুবিধা হবেনা।’

জ্যোতি যেন প্রথমবারের মতো রেগে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনারা এভাবে আমাকে আটকে রাখতে পারেন না।’
তুহিন নির্বিকারভাবে বলল, ‘আমরা আরও অনেক কিছুই করতে পারি। করছিনা সেটা আপনার জন্যেই ভালো হচ্ছে। ন’টা খু/ন। মানে বোঝেন? আরও দুটো খু/ন হবে যদি ওকে এখনই আমরা ধরতে না পারি। যদি সবকথা শুরুতেই বলে দিতেন তাহলে আপনার বা আমার কারোরই এই বাড়তি ভোগান্তিটা হতোনা। এখন আপনার সঙ্গে খোশগল্প করার সময় নেই আমার। বের হতে হবে।’

‘দুটো নরপিশাচকে বাঁচানোর জন্যে গোটা একটা ডিপার্টমেন্ট এতোটা লড়াই করছেন? নাকি আপনাদের আইনও বিক্রি হয়ে গেছে?’
জ্যোতির তিক্ত বাণীতে থেমে গেল তুহিন। অন্যরকম এক দৃষ্টিতে তাকাল জ্যোতির দিকে। অস্বাভাবিক শান্ত গলায় বলল, ‘আইনের ওপর মানুষের করা এই অভিযোগ সম্পূর্ণ যৌক্তিক। আমরা নিজেদের কাজ শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারলে সোলার সিস্টেম, ব্লাক হোল কিংবা ডার্ক নাইটের মতো দল এতগুলো বছর যাবত স্বাচ্ছন্দ্যে আন্ডারওয়ার্ল্ডে রাজত্ব করতে পারতোনা।’

বলে একটু থামল তুহিন। জ্যোতির দিকে দু’কদম এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘তাই বলে একটা অপরাধ থামাতে পারিনি বলে আরেকটা অপরাধ ঘটতে দিতে হবে সে যুক্তিতে আমি বিশ্বাসী নই। তবে আপনাকে একটা কথা দিতে পারি মিস জ্যোতি। শওকত মীর্জা আর শান মীর্জাকে বাঁচাচ্ছিনা আমি। ম/রতে হবে ওদের। রুদ্র আর আমার লক্ষ্য একটাই। ঐ দুজনের মৃ/ত্যু। কিন্তু পার্থক্য হল রুদ্র ওদের নিজের হাতে মা/রতে চায়। আর আমি ওদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে দেখতে চাই। দুজনেই নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। দেখা যাক, ঐ দুজনের মৃত্যু ঠিক কীভাবে লেখা আছে।’

কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল তুহিন। তারপর মহিলা কন্সটেবল দুজনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল জ্যোতিকে রাখার জন্যে। তারা এগিয়ে এলো। একজন কর্কশ কন্ঠে বলল, ‘চলুন।’
জ্যোতি বলল, ‘দেখুন এটা কিন্তু ঠিক করছেন না আপনারা। আমাকে যেতে হবে। আমি এখানে থাকতে পারব না।’
তুহিনকে বেরিয়ে যেতে দেখে বলল, ‘অফিসার! প্লিজ শুনুন আমার কথা। আমার যাওয়াটা দরকার। অফিসার!
আমি কিছু বলছি। প্লিজ।’
তুহিন পাত্তা দিলোনা। চুপচাপ বেরিয়ে এলো ইন্ট্রোগেশন রুম থেকে। যেনো শুনতেই পায়নি জ্যোতির অনুরোধ।

এখনো বারোতলা বিল্ডিংটার দিকে নজর রাখছে তমাল। শুধু ও নয়। আরও কয়েকজন পুলিশ সাদা পোশাকে ঘুরঘুর করছে আশপাশ দিয়ে। তবে একজন বেশিক্ষণ থাকছেনা। পালা করে করে পাহারা দিচ্ছে তারা। এটাও হচ্ছে তুহিনের নির্দেশে। কারণ একই চেহারার লোককে সারাক্ষণ বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখলে লোকে সন্দেহ করবে। আর যদি কোনভাবে রুদ্রর চোখ পড়ে তাহলে নিঃসন্দেহে সে বুঝে ফেলবে। আর ও একবার বুঝে ফেললে ওকে ধরাটা প্রায় অসম্ভব ব্যপার হয়ে যাবে।

চায়ের দোকানে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল তমাল। সিগারেট ধরাল একটা। তুহিন সঙ্গে থাকলে এই কাজটা করার সুযোগ পায়না ও।সিগারেটে ফুঁকতে ফুঁকতে মাঝেমাঝে চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে। সরাসরি না তাকালেও বিল্ডিংটার ওপর কড়া নজর আছে ওর। ফোন বেজে উঠতেই চমকে উঠল তমাল। তুহিনের ফোন। দ্রুত রিসিভ করে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে তুহিন বলল, ‘ওদিকের কী খবর?’

‘ঘটনা সত্যি স্যার। সন্ধ্যার পর এক লোককে ঐ বিল্ডিংটা থেকে বের হতে দেখেছি। নিচের দোকান থেকে কিছু একটা কিনে নিয়েছে। সম্ভবত সিগারেট।’
‘এক লোক মানে? ওটা রুদ্র নয়?’

‘আসলে স্যার আমরা খুব একটা কাছে নেই। তাই স্পষ্ট নয়।রুদ্র যদি ওখানে থাকেও ওর চোখে পড়তে চাইছিনা আমরা। তাই চারপাশ দিয়ে নজর রাখছি। কিন্তু দূর থেকে। তবে রুদ্র সম্পর্কে যা শুনেছি। আর এই লোকটার শারীরিক গঠন, আর অবয়ব দেখে যতটুকু বুঝলাম। এটা রুদ্র ছাড়া অন্যকেউ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।’
‘আচ্ছা। নজর রাখো। কোনকিছু অস্বাভাবিক লাগলে সঙ্গেসঙ্গে ইনফর্ম করবে আমাকে। আর আমার নেক্সট কলের জন্যে অপেক্ষা করো। তাড়াতাড়ি আসছি আমরা।’

‘রাইট স্যার।’
ফোনটা রেখে লম্বা শ্বাস ফেলল তমাল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবার দৃষ্টি ফেলল বিল্ডিংটার দিকে। বিশেষ কিছু দেখতে না পেয়ে আবার টান দিল সিগারেটে।
এদিকে তমালের সঙ্গে কথা বলে আবার ডিজিকে কল করল তুহিন। শাফায়াত হোসাইন কলটা রিসিভ করে তুহিন কিছু বলার আগেই বললেন, ‘কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। ফোর্স রেডী করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোর্স পৌঁছে যাবে।’

‘প্লিজ স্যার। আমি সিগন্যাল দেওয়ার আগে কেউ যেন কিছু না করে। প্রপার প্লান বানিয়ে এগোতে হবে আমাদের। নয়তো এবারেও রুদ্র আমেরকে হারিয়ে ফেলব আমরা।’
‘এ ব্যপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। তোমার অর্ডার ছাড়া এক পাও ফেলবে না কেউ। অপারেশনটায় লীড তুমিই দেবে। এ বিষয় কমিশনারের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে আমার। মনে রেখো। এই মুহূর্তের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল রুদ্র আমের। ওকে ধরা চাই। গোটা ডিপার্টমেন্টের সম্মানের প্রশ্ন। গুড লাক।’
‘থ্যাংক ইউ স্যার। আমি এক্ষুনি বের হচ্ছি।’

কথাটা বলে কলটা কেটে দিল তুহিন। একবার পুরোপুরি চেক করে নিল নিজেকে। ফোনটা হাতে নিতেই মনে পড়ল ইরার কথা। মনে হল এক্ষুনি একটা মেসেজ আসবে, “আমি জানি তুমি পারবে। অল দ্য বেস্ট।” কিন্তু তুহিনকে হতাশ করে এমন কোন মেসেজ আসেনি। আসার কথাও না। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল তুহিন। আর অপেক্ষা করল না। নিজের বেরেটা হোলস্টারে রাখতে রাখতে অফিস ত্যাগ করল।

আপাতত বিল্ডিং এর পাঁচতলায় অবস্থান করছে রুদ্র। অসম্পূর্ণ বিল্ডিং হওয়াতে চারপাশটা খোলা। একটা চাদর বিছিয়ে গা এলানোর ব্যবস্থা করেছে ও। ব্যাগটা ব্যবহার করছে বালিশ হিসেবে।

আপাতত কোন তাড়াহুড়ো নেই ওর মধ্যে। একটা পিলারে হেলান দিয়ে বসে সিগারেট টানছে। দৃষ্টি সামনের হাসপাতালটার পাঁচতলায়। কিছুক্ষণ অর্থহীনভাবে সেদিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা শ্বাস ফেলল রুদ্র। তাকাল নিজের চারপাশে। মনে পড়ল এমনই এক অসম্পূর্ণ বিল্ডিংয়ের ও আর প্রিয়তা প্রথমবার একসঙ্গে রাত কাটিয়েছিল। রুদ্র-প্রিয়তার একসঙ্গে কাটানো প্রথম রাত। কাঠ দিয়ে জ্বালানো আগুনের হলদে আলোয় কী অপূর্ব লাগছিল মেয়েটাকে।

নিজের সঙ্গে কতটা যুদ্ধ করে চোখ ফিরিয়ে রেখেছিল কেবল ওই জানে। সেই ভীত দৃষ্টি, কাঁপাকাঁপা ঠোঁট, সর্বাঙ্গে জড়তা। রুদ্রর পাথর হৃদয়কেও কম্পিত করেছিল। ওর পাশে শুতে কী ভয়টাই না পাচ্ছিল মেয়েটা। রুদ্র যখন নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। একদম ছোট্ট খরগোশ ছানার মতো গুটিয়ে গিয়েছিল। কথাগুলো ভেবে আনমনেই হেসে ফেলল রুদ্র। মেয়েটার মুখটা মনে পড়লেই স্বর্গীয় সুখ অনুভব করে ও।

হঠাৎই সব সুখের স্মৃতি বিলীন হয়ে গেল। তিক্ত, ভয়ানক কিছু স্মৃতি গ্রাস করল মনকে। অসহ্য এক যন্ত্রণায় ঝলসে গেল রুদ্রর ভেতরটা। পকেট থেকে দুটো লকেটের একটা লকেট বের করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওটার দিকে। শান্ত গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ভয় পেওনা প্রিয়। আর বেশি দেরী নেই। তোমাকে আর একা থাকতে হবেনা। আমি আসছি তোমার কাছে। খুব তাড়াতাড়ি।’

হঠাৎ সমস্ত ভাবাবেগ থেকে বেরিয়ে এলো রুদ্র। শক্ত করল নিজেকে। উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে একদম ধারে এসে তাকাল নিচের দিকে। রাস্তাটা যতদূর দেখা যায় ততদূর তাকাল ও। সতর্ক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আপনমনেই হাসল। একবার ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল। এখনই আসবে ওরা। বেশি দেরী নেই।

বিল্ডিং থেকে কিছুটা দূরেই গাড়ি থামাল তুহিন। যেখানে তমাল বসে আছে সেখানে। তুহিনকে দেখেই দ্রুত উঠে দাঁড়াল তমাল। তুহিন হনহনে পায়ে এগিয়ে এল। এগোলো তমালও। তুহিন বলল, ‘সব ঠিকঠাক?’
তমাল বলল, ‘জ্বি স্যার। লোকটা ভেতরেই আছে। শতভাগ নিশ্চিত আমরা।’

এখনো সব ঠিক আছে সেটা নিশ্চিত হতেই কিছুটা স্বস্তি পেল তুহিন। সাভারে প‍ৌঁছেই সবার আগে একজায়গায় হয়েছিল ওরা। সম্পূর্ণ ফোর্সকে পরিকল্পনা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে তুহিন। ওর ধারণা যেহেতু শান মীর্জা হাসপাতালের পাঁচ তালাতে আছে। রুদ্ররও বিল্ডিংয়ের পাঁচ তালাতে থাকার সম্ভাবনা বেশি। নজর রাখতে সুবিধা হয়। অন্য ফ্লোরেও থাকতে পারে। কোন নিশ্চয়তা নেই। দল ভাগ করে ফেলা হয়েছে। যেহুতু সকলেই সাদা পোশাকে আছে। এক এক করে গিয়ে গিয়ে প্রথমে চারদিক থেকে বিল্ডিংটা ঘিরে ফেলবে একটা দল। বারো তলা বিল্ডিং। তাই ছাদসহ তেরোটা দল ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। বিল্ডিংটা ঘিরে ফেলা হলেই ওরা এক এক করে ঢুকে ছড়িয়ে পড়বে এক এক ফ্লোরে। অর্থাৎ পালানোর কোন রাস্তা নেই।

কিন্তু এতোকিছুর পরেও মনটা কেমন খচখচ করছে তুহিনের। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। সবকিছু বেশিই সহজ মনে হচ্ছে। যেটা মোটেও ভালো লক্ষণ না। পরিস্থিতি বিবেচনা করে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল তুহিন। হসপিটালে শানের কেবিনে যারা নজর রাখছে তাদের একজনকে কল করল। রিসিভ হতেই জিজ্ঞেস করল, ‘শানের কী খবর?’
‘ঠিক আছে স্যার। ঘুমোচ্ছে।’

‘গুড! নজরে রেখো।’
ফোনটা রেখে অপেক্ষা করল না তুহিন। আরেকটা কল করে জানিয়ে দিলো। ঠিক দশ মিনিট পর অপারেশন শুরু হবে। সবাই যেন ঠিকভাবে নিজের পজিশন নিয়ে নেয়।

দশ মিনিট পর। আবার বিল্ডিংয়ের ধারে এসে দাঁড়াল রুদ্র। নাইন ভিশন চশমাটা পড়ে নিল চোখে। স্পষ্ট খেয়াল করল একেএকে এসে প্রফেশনালভাবে পজিশন নিয়ে, অল্পসময়ের মধ্যে ঘিরে ফেলা হয়েছে বিল্ডিংটা। রুদ্র সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ফোন বের করল। কাউকে কল কর‍ে বলল, ‘ওরা ওদের কাজ করে ফেলেছে। ঘিরে ফেলেছে বিল্ডিংটা। তুইও তোর কাজ শুরু করে দে। টাইমিংয়ে যেন একটুও গন্ডগোল না হয়। মনে রাখিস। যা করতে যাচ্ছি তাতে টাইমিংটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নয়তো সব ভেস্তে যাবে।’

ওপাশ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা করল না রুদ্র। ফোনটা কেটে দ্রুত চলে এলো ভেতরে। ব্যাগটা কাধে তুলে নিল সঙ্গে ছোট থলেটা। দ্রুত বের হল পাঁচতলার অসম্পূর্ণ রুম থেকে।

চারপাশ ঘিরে ফেলা সম্পূর্ণ হতেই তুহিনের ওয়াকিটকি থেকে আওয়াজ এলো, ‘বিল্ডিংটা ঘিরে ফেলেছি আমরা স্যার। ওভার এন্ড আউট।’
ওয়াকিটকিতে কথা বলল তুহিন, ‘ফার্স্ট ফ্লোর, টেক ইউর পজিশন। ওভার।’
বেড়ালের মতো নিঃশব্দে প্রথম তলায় ছড়িয়ে গেল একটা দল।

‘ফার্স্ট ফ্লোর পজিশন টেকেন। ওভার এন্ড আউট।’
‘সেকেন্ড ফ্লোর, টেক পজিশন। ওভার।’
‘সেকেন্ড ফ্লোর পজিশন টেকেন। ওভার এন্ড আউট।’
‘থার্ড ফ্লোর, টেক পজিশন। ওভার।’
‘থার্ড ফ্লোর পজিশন টেকেন। ওভার এন্ড আউট।’
‘ফোর্থ ফ্লোর, টেক পজিশন। ওভার।’

পাঁচ তলার রুম থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে পাঁচতলায় ওঠার সিঁড়িটার মাঝে গিয়ে দাঁড়াল রুদ্র। ঘুরে বসে পজিশন নিল। ছোট থলেটা সামনে রাখল। পি/স্ত/লের সাইলেন্সারটা আরেকবার চেক করে সন্তুষ্ট হল। বিন্দুমাত্র বিচলিত বা চিন্তিত দেখা যাচ্ছেনা ওকে। খুব স্বাভাবিক, সহজভাবে বসে অপেক্ষা করছে সে। চোখে এখনো নাইট ভিশন চশমা।

সেকেন্ড কয়েক পরেই খেয়াল করল অন্ধকারে বেড়ালের মতো শব্দহীনভাবে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে একজন। পি/স্ত/ল তাক করল রুদ্র। পেছনে আরও লোক আসছে। ঠোঁটে হাসি ফুটল ওর। তারমানে ওর ধারণা ঠিক ছিল। প্রথমজন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে। তখনই গু/লি করল রুদ্র। সোজা মাথায়। বু/লে/টের ধাক্কায় ঘরের ভেতরেই পড়ল সে। দ্বিতীয় জনকেও এভাবেই বিদায় করল। তৃতীয়জন গন্ডগোল টের পেল।

কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। ট্রি/গার চেপে দিয়েছে রুদ্র আমের। চতুর্থ এবং শেষজন বুঝে ফেলল ব্যপারটা। গু/লি করতে গিয়ে চিৎকার করল। কিন্তু শু/ট করার সুযোগ দিলোনা রুদ্র। প্রথমে গু/লি করল। এরপর সামনে রাখা থলেটা থেকে বের করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে আসার রাস্তায় ছুড়ে মারল একটা হ্যান্ড গ্রে/নে/ড। এটা কাউকে মারার জন্যে নয়। অন্য উদ্দেশ্যে মেরেছে ও। ওটা ফাটতেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ছুটল রুদ্র। একেকটা সিঁড়ি পার হচ্ছে আর পেছনে ছুড়ে মারছে গ্রে/নে/ড।

চার তলা কভারের অর্ডার দিয়ে নিজে দলসহ প্রস্তুত হয়ে এগোচ্ছিল তুহিন। কারণ পাঁচতলার কভারে ও নিজে থাকবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু ‘পজিশন টেকেন’ মেসেজের পরিবর্তে চিৎকারের আওয়াজ শুনে চমকে উঠল ও। ওর চমক বাড়িয়ে বি/স্ফো/র/ণের শব্দ। এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে দলসহ দৌড়ে ভেতরে ঢুকল ও। দৌড়তে দৌড়তে প্রথম তিনটেতলার লোকেদের পজিশন ছাড়তে নিষেধ করল। এটা ট্রাপও হতে পারে।

চারতলায় পৌঁছে হতভম্ব হয়ে গেল তুহিন। মারাত্মক ধোঁয়া আর সিমেন্টের ধুলোয় কাশতে কাশতে চারটে লাশ উদ্ধার করল ওরা। ঢুকতে ঢুকতে ও আরও কয়েকটা বি/স্ফো/র/ণের আওয়াজ পেয়েছে। হঠাৎই গু/লির আওয়াজে দিশেহারা বোধ করল তুহিন। আওয়াজটা নিচের দিক থেকেও আসছে আর ওপরের দিক থেকেও। তারমানে কী একাধিক লোক আছে এখানে? চারতলা চেক করতে করতে বাকিদের নিজের নিজের ফ্লোরে গিয়ে পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলো তুহিন। নিজের দল নিয়ে উঠে এলো পাঁচতলায়।

সেখানকার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়েও ধোঁয়া আর ধুলোয় কাশতে কাশতে জান বের হওয়ার অতিক্রম হল ওদের। আবার গু/লি/র আওয়াজ! আওয়াজ লক্ষ্য করে নিজেও গু/লি ছুড়ল তুহিন। খুব সাবধানে পিলারে আড়ালে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে পাঁচতলা চেক করল তুহিন। গু/লির আওয়াজ লক্ষ্য করে করে গু/লিও ছুড়ল। কিন্তু কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছতে পারছেনা। বারবার জায়গা পরিবর্তন করছে সে। নিজের টর্চটাও জ্বালাতে পারছেনা কারণ ওর অবস্থান জেনে যাবে রুদ্র। হঠাৎ কিছু অপ্রাসঙ্গিকতা অনুভব করল তুহিন। কিছু গন্ডগোল হয়েছে।

ঠিক তখনই বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত গো/লাগু/লির শব্দ। তুহিনও মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। দ্রুত ওয়াকিটকিতে বাইরে পজিশন নেওয়া লোকেদের কাছ থেকে জানলো কেউ বেরিয়ে গেছে কি-না। কিন্তু না। কেউ বেরিয়ে যায়নি। তুহিন ওয়াকিটকিতে প্রতি তলার খবর নিল। কোথাও নেই রুদ্র। তবুও নজর রাখতে বলল ও। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলালো। নিজের ফ্লোরটা মনোযোগ দিয়ে খুঁজতে শুরু করল ও। রাগে-জেদে পেন্সিল টর্চ জ্বালানোর ঝুঁকিটা নিয়েই নিল।

মুখে টর্চটা ধরে, পি/স্ত/ল হাতে খোঁজা শুরু করল প্রতিটা কোণ। হঠাৎ এক জায়গাতে চোখ আটকে এলো ওর। তখনই হাপাতে হাপাতে তমাল বলল, ‘রুদ্র বিল্ডিংয়ে নেই স্যার।’
সামনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুহিন। অদ্ভুত স্থির গলায় বলল, ‘আমি জানি।’

তমাল অবাক চোখে তাকাল তুহিনের দিকে। তুহিন চোখের ইশারায় দেখাল সামনে। তমাল তাকিয়ে দেখল একটা টেপ রেকর্ডার আটকে রেখে দেওয়া হয়েছে পিলারের সঙ্গে। তমাল ওটা হয়ে হাতে নিয়ে বলল, ‘স্যার এটাতো_’
‘এটা দিয়েই আমাদের বোকা বানানো হচ্ছিলো। আমার বিশ্বাস গোটা বিল্ডিংজুড়ে আরও কয়েকটা ফিট করা আছে। প্রত্যেকটাই রিমোট কন্ট্রোলড। রুদ্র আরও আগেই বেরিয়ে গেছে বিল্ডিং থেকে।’

‘কিন্তু কীভাবে? নিচে তো_’
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল তুহিন। কিছু না ভেবে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বোকার মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকল তমাল। এরপর নিজেও ছুটল তুহিনের পেছন পেছন।

শানের কেবিনে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে তমাল। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তুহিন। চোখদুটো স্থির হয়ে আছে শানের বেডে। যেখানে ওদেরই একজন অফিসার অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে। পাশ থেকেই যে ডাক্তারের আন্ডারে শান ছিল সে মাথা নিচু করে ইতস্তত কর‍ে বলল, ‘আমরা খুবই দুঃখিত অফিসার। কীকরে কী_’

বাক্য শেষ করতে পারলেন না ডাক্তার। বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছেনা আসলে। তমালও কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা তুহিনের চোখ-মুখ দেখে। তখন থেকে কোন কথাই বলছেনা সে। কেমন গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছুটে হসপিটালে এসে ও দেখতে পায় শানের কেবিনের দরজায় যে দুজন পুলিশ থাকার কথা তারা নেই। ভেতরে ঢুকে দেখে একজন ডাক্তার আর দুজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজিত তারা। ওদের অবাকের মাত্রা কয়েকগুন বেড়ে যায় যখন দেখে শানের বেডে শান নয়। সেই দুজন পুলিশেরই একজন শুয়ে আছে। আর সবচেয়ে ধাক্কা দেওয়ার মতো সংবাদ হল, শানকে পাওয়া যাচ্ছেনা। সে নিখোঁজ।

তুহিনের চোখ পড়ল বেডের পাশে ভাঁজ করে রাখা একটা কাগজের দিকে। ওটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গেল তুহিন। কাগজটা তুলে নিল। খুলল ধীরে গতিতে। সাদা কাজটায় জ্বলজ্বলে করছে কয়েকটা লাইন,

“তুহিন আহমেদ! প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আফসোস হচ্ছে আগে কেন দেখা হলোনা আমাদের। শত্রুতা বেশ জমতো। এখন সমস্যা হল, এমন একটা সময়ে আপনি এসেছেন যে আমার হাতে সময় বড্ড কম। আপনার সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলা খেলতে পারছিনা বলে দুঃখিত। BETTER LUCK NEXT TIME।”

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬২

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তুহিনের। কাগজটা মুচড়ে ধরল নিজের হাতে। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল, ‘রুদ্র আমের।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৪