অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬২

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

রাশেদের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরের কথা। তার তৈরী করে যাওয়া এতিমখানাতেই তার জন্যে মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। দোয়া করা হয়েছে। সব আয়োজন ওখানকার লোকেরাই করেছে। এসব আয়োজন করার মতো পরিস্থিতি ছিলোনা রুদ্রর। তবে ওর বাবার জন্যে করা হচ্ছে। তাই আমের ভিলার সকলেই গিয়েছিল ওখানে। চরম এক বিষাদময় দিন কাটল সেদিন। ওখানকার প্রতিটা মানুষের চোখের জল, নীরব হাহাকার স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল রাশেদ আমের কী ছিলেন তাদের জন্যে। তাদের জীবনের ঠিক কতটা অংশ জুড়ে ছিলেন, রাশেদ বাবা।

কুহু একদম চাবি দেওয়া পুতুলের মতো হয়ে গেছে। পরপর দুটো ধাক্কায় স্তব্ধ হয়ে গেছে মেয়েটা। সারাদিন পাথরের মতো বসে থাকে। সবকিছুই নিজ হাতে ধরে ধরে করিয়ে দিতে হয়। ভাগ্যিস নীরব ছায়ার মতো লেগে আছে পেছনে। না হলে বেঁচে থাকাই দুর্বিষহ হয়ে যেত মেয়েটার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জ্যোতি সামলে নিয়েছে নিজেকে। সবাই ভেঙ্গে পড়লে চলবে কীকরে? তবে নিজের ভাইজানের কথা মনে পড়তেই চোখ ভিজে ওঠে জাফরের। রুদ্র বা উচ্ছ্বাসকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওদের মানসিক পরিস্থিতি। প্রিয়তার শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এ অবস্থায় রাণীর মতো করে রাখতো ওকে সবাই। কিন্তু নিয়তি এতোটাই নিষ্ঠুর যে এ অবস্থাতেই বজ্রপাত হল গোটা আমের ভিলার ওপর।

সবকিছুর মধ্যেও গোটা আমের ভিলা সেই বজ্র, গমগমে কন্ঠস্বর শোনার জন্যে ছটফট করে। দৃঢ়, সুঠামদেহী,তেজস্বী সেই পুরুষের পদচারণের অভাবে যেন শুষ্ক মরুভূমি মতো প্রাণহীন হয়ে গেছে আমের ভিলার প্রতিটা কোণ।
সবকিছু শেষ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হল। ওদের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল রুদ্র, উচ্ছ্বাস আর জাফর। উচ্ছ্বাস আর জাফর নিজের মতো গেল। আর রুদ্রর সঙ্গে গেল রঞ্জু। রাশেদের মৃত্যুর সময় রঞ্জু ঢাকা ছিলো না। ফিরে আসতে আসতে দাফন করে ফেলা হয়েছে তাকে। মনে মনে ভয়ানক আঘাত পেয়েছে ছেলেটা। কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। এখন হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসার সময় নয়।

রুদ্র জিপ চালাচ্ছে। পাশের সিটে বসে আছে রঞ্জু। মাঝেমাঝে আড়চোখে দেখছে রুদ্রকে। ইদানীং কেমন অদ্ভুত শান্ত, স্থির লাগে রুদ্রকে। কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় সাক্ষাৎ জোয়ালামুখী দেবে আছে ভেতরে। ভয়ানক কিছু ঘটানোর কথা ভাবছে এইলোক। কোন সন্দেহ নেই তাতে।
‘শুরু কর।’

রুদ্রর গলায় আওয়াজে ভাবনায় ছেদ ঘটল রঞ্জুর। এক ঢোক গিলে বলতে শুরু করল, ‘চায়ের কাপটায় পয়জন ছিল, ভাই।’
অবাক হয়নি রুদ্র। বরং অন্যকিছু শুনলেই বোধ হয় অবাক হতো। স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘বলে যা।’
‘কিন্তু কিচেনে থাকা চায়ের সব উপকরণে কোনরকম বিষ পাওয়া যায়নি। চা পাতি, দুধ, সুগার ফ্রি সবকিছুই চেক করা হয়েছে। সম্ভবত আলাদা করে মেশানো হয়েছে।’
‘কিংবা উপকরণটা কিচেন থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’

কথাটা যেন নিজেই নিজেকে বলল রুদ্র। জেনছে, সেদিন সকালে রাশেদের জন্যে চা নিয়ে গিয়েছিল জ্যোতি। কিন্তু সে রান্নাঘরে ঢুকে দেখেছিল অর্ধেক চা নার্গিস বানিয়ে ফেলেছিল। বাকি অর্ধেকটা জ্যোতি বানায়। চা বানানো থেকে শুরু করে রাশেদের ঘরে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জ্যোতি এবং নার্গিস ছাড়া অন্যকেউ চায়ের ধারকাছেও আসেনি। সে বিষয়টা পরিস্কার। নার্গিস বহুবছর কাজ করছে এ বাড়িতে।

তারচেয়েও বড় কথা, নার্গিসের বাড়ি গুলশানেই। কেবল নার্গিস না। নার্গিসের পুরো ফ্যামলি রেকর্ড আছে রুদ্রর কাছে। এবং খুব কঠোরভাবে নজরদারী করা হয় ওর ওপর। যাকেতাকে আমের ভিলায় স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা করতে দেওয়া, রান্নবান্না করতে দেওয়ার মতো দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমেরদের নেই। প্রতিবার আমের ভিলা থেকে বের হওয়া এবং ঢোকার সময় আপাদমস্তক ভালোকরে চেক করা হয়। তাহলে কে? জ্যোতি?
‘কুহু ম্যাডামের ব্যপারেও কথা ছিল।’

রুদ্র কিছু বলল না। অর্থাৎ, বলে যা। রঞ্জু একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ম্যামের রে/প কারা করেছিল জানা গেছে। দু-দুজন ছিল। সেন্টু আর বুলেট। কিন্তু ওদের কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। সম্ভবত গা ঢাকা দিয়েছে।’
রুদ্র এবারেও কিছু বলল না। তবে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সেটা সহজেই বুঝে ফেলল রঞ্জু।
‘আরেকটা ব্যপার ভাই।’

একবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল রুদ্র। রঞ্জু বলল, ‘রাশেদ বাবার মৃত্যুটা আন্ডারওয়ার্ল্ডে নীরব ঝড় তুলে দিয়েছে। আমাদের পার্টনার গ্রুপগুলোর সন্দেহ বেড়েছে। সোলার সিস্টেমের ওপর আর কতটা ভরসা করা যায় সে নিয়ে তারা যথেষ্ট সন্দিহান। বিপক্ষ দলগুলো এ সুযোগটাই খুঁজছিল আর_’

বলে থামল রঞ্জু। একবার রুদ্রর দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে বলল, ‘চুক্তিভঙ্গের ব্যপারটা দ্রুত সামাল দিতে না পারলে সবদল একজোট হয়ে খুঁজে খুঁজে কুকুরের মতো খু/ন করবে সোলার সিস্টেমের প্রত্যেক সদস্যকে। ওদের উস্কে দেওয়ার কাজটা শওকত মীর্জা আর করিম তাজওয়ার খুব ভালোভাবেই করছে। শুনেছি সম্রাট কয়েকটা গ্রুপের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছে। শানকে ক’দিন আগেও উত্তরার গোডাউনে কিছু করতে দেখা গেছে দলবল নিয়ে। ভয়ানক কিছু করতে চলেছে ওরা ভাই।’
রুদ্র কিছু বলছে না। একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থেকে ড্রাইভ করছে।

মতিঝিলে ভাড়া করা এক ফ্ল্যাটের ডাইনিং স্পেসে বসে আছে শওকত মীর্জা, করিম তাজওয়ার এবং পলাশ মীর্জা। ফ্ল্যাটটার মালিকানা সম্রাটের নামে। দুটো বেডরুম এবং ডাইনিং স্পেস আছে। একটা রুমকে সম্পূর্ণ অফিসরুমে পরিণত করেছে সম্রাট। আরেকটা বেডরুম। ডাইনিং স্পেসে বড় দামি সোফা বসানো হয়েছে। দুপুর থেকে তিনজন এখানেই ছিল। সন্ধ্যার খানিক বাদে এসে পৌঁছেছে সম্রাট আর শানও। ভাজা মুরগীর সঙ্গে কড়া ড্রিংক করতে করতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সাড়বে। পাঁচজনই আপাতত ভীষণ ফুর্তিতে আছে। সিগারেট আর মদের গন্ধে ভরে আছে ঘরটা।

করিম তাজওয়ার খোশমেজাজে বললেন, ‘অবশেষে রাশেদ আমেরকে পৃথিবী থেকে সরানো গেল। কতদিন! কতদিনের চেষ্টার ফল। এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা কাজটা আমরা করতে পেরেছি।’ বলে থামল। মদের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘কিন্তু একটাই আফসোস। রাশেদ আমেরকে ওনার একমাত্র ছেলের মৃতদেহ দেখানোর স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল। ঠিক যেমন আমায় নিজের বড় ছেলের মৃতদেহ দেখতে হয়েছিল।’

শওকত সিগারেটের প্যাকেটটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘তোমার বড়ছেলের এনকাউন্টারের কারণ রাশেদ আমের না, তোমার ছেলের নির্বুদ্ধিতা ছিল। সে যাই হোক, রাশেদ আমের তার একমাত্র ছেলের মৃতদেহকে না দেখলেও একমাত্র মেয়ের ধ/র্ষি/ত দেহতো দেখেছে। সেটাও কম কী?’

একটা সিগারেট বের করে প্যাকেটে টোকা দিল শওকত। শ্রাগ করল করিম। শান মাংসের পিসে কামড় বসাতে যাচ্ছিল। থেমে গিয়ে বলল, ‘কিন্তু বুলেট আর সেন্টুর কী খবর? ঐ ঘটনার পরতো দুটোকে দেখলাম না। আছে না গেছে?’
পলাশ বলল, ‘আছে। লুকিয়ে রেখেছি। রুদ্র কুত্তার মতো দৌড় করিয়ে মা/রবে যদি হাতে পায়। ‘

শান মৃদু হাসল। ভাজা মাংস ছিড়ে মুখে পুড়ে বলল, ‘রুদ্র না মা/রলেও ‘ও’ মারবে। শান্ত আছে বলে ভুলে যেওনা ও কী।’
শওকত বলল, ‘সে মারলে মারুক। ঐদুটোকে নিয়ে ভাবার সময় নেই এখন আর। যারা সময়মতো নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারেনা ঐসময় অকর্মার ঢেকিদের দরকার নেই আমার।’

গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে করিম বলল, ‘ওদের করা কাজটা আমাদের পরিকল্পনার অংশ না হলেও লাভ বৈ ক্ষতি হয়নি কিন্তু। ঐ ঘটনাটা না ঘটলে রাশেদ আমেরকে মানসিকভাবে এতোটা গুড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হতোনা। আর রাশেদ আমের ওরকম বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলেই এতো সহজে তাকে মারা গেল।’

শওকত সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে বলল, ‘কিন্তু এভাবে তাকে মা/রতে চাইনি আমি। অনেকটা কাপুরুষদের কাজের মতো হয়ে গেছে ব্যপারটা। এতে এটাই বোঝায় তাকে সরাসরি মা/রার ক্ষমতা ছিলোনা আমাদের।’
এতক্ষণ কাউচে হেলান দিয়ে, পায়ের ওপর পা তুলে ওদের কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সম্রাট। এতক্ষণে মুখ খুলে বলল, ‘কখনও কখনও পেছন থেকে আঘাত করতে হয়। নিজের প্রয়োজনে। সেটাকে কাপুরুষত্ব না, স্ট্রাটেজি বলে। তোমরাতো ঐ মেয়েটার রে/প হওয়ার পরেই ঘাবড়ে গিয়ে ‘প্লান বি’ স্থগিত করতে চেয়েছিলে। আমার জন্যে পারোনি। এখন দেখ? কাজটা হয়েছে তো? সোলার সিস্টেম ইজ অলমোস্ট ফিনিশড।’

সবাই চুপ থাকল। শওকত সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘কিন্তু পুরোপুরি কাজটা এখনো হয়নি। ‘প্লান বি’ যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতো তাহলে ওখানে সেদিন রুদ্র ম/রতো, অতঃপর এখানে এই পদ্ধতিতে রাশেদ। কিন্তু গন্ডগোলটা হল রুদ্র বেঁচে আছে।’

‘বেশিদিন থাকবেনা।’ ঠোঁটে শয়তানী হাসি ফুটিয়ে বলল সম্রাট।
শান মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘এতো সহজ হবেনা। ঝামেলা এখন একটা না দুটো। মাথায় রেখো।’
করিম তাজওয়ার শব্দ করে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘নতুন এই ঝামেলাটা কাঙ্ক্ষিত ছিল কী? শওকত সাহেব?’
হঠাৎই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল সম্রাটের। সুর্দশন মুখটা হিংস্র দেখাল। দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল শওকতের দিকে। চাপা গলায় বলল, ‘আপনার দেওয়া কথাটা মাথায় রাখবেন কিন্তু। এতকিছুর মাঝে এটা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে কেন ব্লাক হোল আর ডার্ক নাইট এক হয়েছিল? যদি সেকথার খেলাপ হয়। পরিণাম কিন্তু ভালো হবেনা মীর্জা।’

শওকত মীর্জা ভাবলেশহীনভাবে বললেন, ‘আমার দিক থেকে পূর্ণ প্রচেষ্টা থাকবে। কিন্তু সবকিছুতো আর আমার বলাতেই হবেনা। তাইনা? আমার দিক থেকে আমি হাত তুলে নেব। বাকি দায়িত্ব তোমার।’
সম্রাট কিছু বলতে যাচ্ছিল। পলাশ মীর্জা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সেসব ছাড়ো! নিজেদের মধ্যে রেশারেশি করে সময় এটা না। ওসব অনেক পরের ব্যপার। এটা বলো যে, প্লান বি এর অসম্পূর্ণ অংশ কীভাবে সম্পূর্ণ করা সম্ভব? ঝামেলাটা এড়িয়ে গিয়ে?’

কিছুক্ষণ নীরব থাকল ঘরটা। হঠাৎই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল সম্রাট। গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘রাশেদ আমেরের সঙ্গে যে খেলাটা খেলা হয়েছিল, সেই একই খেলা খেলব রুদ্রর সঙ্গে।’
‘ঝেড়ে কাশো।’ বিরক্ত হয়ে বলল শান।

সম্রাট কিছু বলল না। কাউচের পাশ থেকে ছোট্ট একটা বারবী ডল বের করল। চোখের সামনে ধরে ওটা নাড়িয়ে দেখল কিছুক্ষণ। আচমকাই দু আঙুলে চাপ দিয়ে দিয়ে এক এক করে ভাঙল ডলটার হাত, পা অতঃপর গলা। বিস্ময়ভর্তি চোখে তাকিয়ে রইল উপস্থিত সবাই।
*
চারদিকে পিনপতন নীরবতা। মাঝেমাঝে নাম না জানা পোকা আর পাখির ডাক ভেসে আসছে। দূরে ব্যস্ত শহরের আলো রুদ্রর ঘরের বারান্দা থেকেও দেখা যায়। শীত প্রকৃতির বুকে পরিপূর্ণভাবে চেপে বসার বন্দবস্ত করে ফেলেছে। ঠান্ডা বাতাসে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে রুদ্রর। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। দৃষ্টি শূণ্য। সদ্য জ্বালানো সিগারেটটা ধরে আছে দু আঙ্গুলের মাঝে। মাঝে মাঝে মৃদু টান দিচ্ছে।

উপলব্ধি করল কেউ ধীরপায়ে এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। না তাকিয়েও বুঝতে পাল প্রিয়তার উপস্থিতি। প্রিয়তা গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে রুদ্র ঘরে সিগারেট ধরায় না। কিন্তু আজ হঠাৎই ধরালো। রুদ্র প্রিয়তার দিকে তাকাল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, ‘রুমে যাও।’

প্রিয়তা নড়ল না। তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্র আবারও শান্ত গলায় বলল, ‘রুমে যেতে বলেছি আমি। ধোঁয়া যাচ্ছে তোমার দিকে। ঠান্ডাও পড়েছে। গিয়ে ঘুমোও।’
প্রিয়তা তবুও নড়ল না। রুদ্র ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। সিগারেটটা পাশের উঁচু ছোট আয়তনের টেবিলটার ওপর রাখা অ‍্যাশট্রেতে গুঁজে রাখল। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কথা বললে শুনতে চাওনা কেন তুমি?’
‘আপনি শোনেন?’

প্রিয়তার পাল্টা প্রশ্নের জবাব দিলোনা রুদ্র। তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর প্রিয়তা রুদ্রর হাতের ওপর হাত রাখল। অনুনয়ের সুরে বলল, ‘এখনো সময় আছে রুদ্র। আমার কথাটা শুনুন।’
রুদ্র নিরুত্তর। যেন আকাশের দিকে চুম্বকের মতো আটকে আছে ওর দৃষ্টি। প্রিয়তা বিরক্ত হল। এক ঝকটায় হাতটা সরিয়ে নিল। ঝাঁঝালো, কান্নামাখানো গলায় বলল, ‘আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?’
‘শোনার মতো কিছু তুমি বলোনি প্রিয়। রুমে যাও।’

রুদ্রর একরোখা জবাব প্রিয়তার হৃদয়কে তীরবিদ্ধ করল। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল নিষ্ঠুর স্বামীর দিকে। অধৈর্য কেঁপে ওঠা গলায় বলল, ‘প্লিজ!’
‘ঘরে যাও।’
‘আমি যাবোনা।’
‘প্রিয়তা!’

রুদ্রর ধমকে ফুঁপিয়ে উঠল প্রিয়তা। রুদ্র নিভল। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে তাকাল প্রেয়সীর দিকে। এক হাতে প্রিয়তার বাহু ধরে নিজের দিকে টানল। অপরহাতে ওর অপূর্ব সুন্দর চোখদুটো মুছে দিতে দিতে বলল, ‘সবসময় সবরাস্তা থেকে ইউটার্ন নেওয়া যায়না প্রিয়। এই রাস্তাটাই ওয়ান ওয়ে। পিছিয়ে আসা সম্ভব না।’

‘চাইলেই সম্ভব। আমরা এখান থেকে চলে যাইনা রুদ্র? অনেক দূরে কোথাও। দেশের বাইরে কোথাও, অনেক দূরে।বাবার মৃত্যুর পরতো নীরবের বাবা-মা একবার এসেছিলেন এ বাড়িতে। যদিও নীরব আর কুহুর বিষয়ে কিছু বলেনি। তবে আমার বিশ্বাস ওনারা শীঘ্রই মেনে নেবেন ওদের সম্পর্কটা। আর যদি এখন নাও মানে নীরব-কুহুও আমাদের সঙ্গে যাবে। আমি, আপনি, আমাদের সন্তান, কুহু, নীরব, জ্যোতি আপু, উচ্ছ্বাস আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব। কোন ঝামেলা থাকবেনা। কোন শত্রু থাকবেনা। প্রতিমুহূর্তে মৃ/ত্যুভয়ে থাকবেনা।’

কথাগুলো বলে দম নেওয়ার জন্যে থামল প্রিয়তা। কাঁদছে মেয়েটা। রুদ্র তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। প্রিয়তা রুদ্রর দু কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমি কোনদিন আপনার কাছে কিছু চাইনি। আপনাকে ভালোবেসে সবটা মেনে নিয়েছি। আপনার অতীত, বর্তমান সব। কিন্তু ভবিষ্যত মেনে নেওয়ার সাহস নেই আমার। প্রথমে কুহু, এরপর বাবা। আর পারব না আমি। সত্যিই পারবনা। আমার সন্তানের কিছু হয়ে গেলে আমি শেষ হয়ে যাবো রুদ্র। আমার ওকে চাই। আমি আমার বাচ্চাকে সুস্থভাবে কোলে নিতে চাই।’

কথাগুলো বলতে বলতে হিঁচকি উঠে গেল প্রিয়তার। শরীর ভেঙে এলো। নিজের প্রায় সমস্ত ভর ছেড়ে দিল রুদ্রর ওপর।রুদ্র প্রিয়তাকে ভালোভাবে ধরে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘শান্ত হও।’
প্রিয়তা অবুঝের মতো এদিক-ওদিক মাথা নাড়াল। হাত-পা ছুড়তে চাইল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘পারছিনা আমি। দয়া করে আমার কথাটা শুনুন। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।’

প্রিয়তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ওয বাহু শক্ত করে ধরল রুদ্র। মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘প্রিয়?’
প্রিয়তা মোটেও শুনছেনা। আবার ধমক দিল রুদ্র, ‘প্রিয়!’
প্রিয়তা থেমে গ্রল। প্রাণহীন দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। ‘শোন আমার কথা। দূরে কোথাও চলে যাব বললেই যাওয়া যায়না। এই মুহূর্তে অনেক কাজ আছে আমার। অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে। লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার লোক রুদ্র আমের নয়। পালিয়ে বেড়ানো আমার র/ক্তে নেই। আমার অর্ধাঙ্গিনীর মুখে এধরণের কথা মানায় না।’

প্রিয়তা কান্না থামিয়ে শক্ত দৃষ্টি ফেলল রুদ্রর চোখে। স্থির কন্ঠে বলল, ‘আপনার এই জেদ সবকিছু শেষ করে দেবে।’
রুদ্র নরম গলায় প্রিয়তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আমাদের সন্তানের কিচ্ছু হবেনা প্রিয়। ও পৃথিবীতে আসবে। একদম সুস্থভাবেই আসবে।’
‘যে নিজের বোন আর বাবাকে রক্ষা করতে পারেনি, সে আমার অনাগত সন্তানকে রক্ষা করবে? সেটা আমি কীকরে বিশ্বাস করি?’

রুদ্র ব্যথিত হল। মনে পড়ে গেল নিজের ব্যর্থতা। লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার ওপর বিশ্বাস রাখো।’
‘বিশ্বাস করেই আপনার হাত ধরে আপনার এই বিষাক্ত জীবনে পা রেখেছিলাম রুদ্র। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবেন। যদি আপনার এই জেদের জন্যে আমি আমার সন্তানকে হারাই। সেদিন আপনি কেবল আমার বিশ্বাসই হারাবেন না, আমাকেও হারাবেন।’

কথাটা বলে ঘরে চলে গেল প্রিয়তা। রুদ্র প্রিয়তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরও একবার প্রিয়তাকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়ানোর জন্যে আফসোস হচ্ছে ওর। কিন্তু এখন কিছু করার নেই। প্রিয়তা যা চাইছে সেটা সম্ভব না। আর যাই হোক কাপুরুষের মতো পিছিয়ে আসতে পারবেনা রুদ্র। রাশেদের আমেরের অসম্পূর্ণ কাজ ওকেই সম্পূর্ণ করতে হবে। তার দিয়ে যাওয়া শেষ আদেশগুলো পালন করতে হবে। তারপরও যদি সব ঠিক থাকে। তাহলে সত্যিই এ পথ ছেড়ে দেবে রুদ্র। নিজের প্রিয়, নিজের পরিবার নিয়ে চলে যাবে অনেক দূরে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কাটাবে। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো।

বর্তমান ~
‘পানি, পানি খাবো একটু।’
হঠাৎই জ্যোতির পানি চাওয়াতে মনোযোগ ছিন্ন হলো তুহিনের। এতক্ষণ যেন হারিয়ে গিয়েছিল আমের ভিলার অজানা রহস্য গহ্বরে। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে মহিলা কন্সটেবলকে ইশারা করল তুহিন। সে সঙ্গে সঙ্গে এক গ্লাস পানি এনে এগিয়ে দিল জ্যোতির দিকে। পানিটা শেষ করে দুটো লম্বা শ্বাস নিল জ্যোতি। তুহিন থুতনিতে হাত রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। যখন বুঝল জ্যোতি সামলে নিয়েছে নিজেকে তখন বলল, ‘আপনার কী মনে হয়? রাশেদ আমেরের মৃত্যুটা স্বাভাবিক? নাকি খু/ন?’

জ্যোতি স্থির চোখে তাকাল তুহিনের দিকে। ভাবলেশহীনভাবে বলল, ‘আমি জানিনা। তবে খু/ন হলে রুদ্র নিশ্চয়ই বুঝতে পারতো।’
‘আপনাকে কে বলল রুদ্র বোঝেনি?’
চমকে উঠল জ্যোতি। তুহিন বলল, ‘রাশেদ আমেরের মৃত্যুর দিন সকালে আপনি চা নিয়ে গিয়েছিলেন। সেরকমই তো বললেন। তাইনা? সেই কাপটা পেয়েছিলেন আর?’

‘আমার খেয়াল নেই।’
জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকাল তুহিন। তারপর আবার জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তারপর? আমের ভিলা ছাড়লেন কেন আপনারা?’
‘বাধ্য হয়ে।’

‘নিজেদের বহু পুরোনো বাড়ি, আর যদি হয় আমের ভিলার মতো আলিশান বাংলো। মানুষ সেটা বাধ্য হয়েই ছাড়ে। কী কারণে বাধ্য হলেন আমি সেটা জানতে চেয়েছি। নিজের চাকরিটাই বা ছাড়লেন কেন?’
‘সেসবের সঙ্গে আপনার কেইসের কোন যোগসূত্র নেই।’
‘কী আছে। কী নেই। সেটা নিয়ে আমাকেই ভাবতে দিন মিস জ্যোতি। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’

তখনই টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। জ্যোতির ফোন ওটা। জ্যোতি দ্রুত ফোনটা তুলতে গেল কিন্তু তার আগেই সেটা নিয়ে নিল তুহিন। জ্যোতি হতবাক হয়ে তাকাল তুহিনের দিকে। তুহিন স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল আননোন নাম্বার। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি রিসিভ করছি। ভদ্র মেয়ের মতো কথা বলবেন। কোনরকম উল্টোপাল্টা কথা বললে ক্ষতি আপনারই। ওপাশের ব্যক্তি যেন জানতে না পারে আপনি থানায় আছেন।’

বলে রিসিভ করে লাউডে দিল কলটা। বাড়িয়ে ধরল টেবিলের মাঝামাঝি জ্যোতির দিকে। সঙ্গেসঙ্গে ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠে কেউ বলে উঠল, ‘হ্যালো? জ্যোতি? কোথায় তুমি? তুমি ঠিক আছোতো? এখনো ফেরোনি কেন এখনো? আমাদের টেনশন হচ্ছে?’

জ্যোতি একবার তাকাল তুহিনের দিকে। তুহিন শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে জ্যোতির দিকে। জ্যোতি জীভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘তোমরা টেনশন করোনা। আমি ঠিক আছি। আসলে আটকে গেছি এক জায়গায়। কখন ফিরতে পারব জানিনা। অপেক্ষা করোনা তোমরা। সাবধানে থেকো।’

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আটকে গেছো মানে? তুমি কোথায় বলোতো? সত্যিই ঠিক আছোতো?’
জ্যোতি আবার দেখল তুহিনকে। তুহিন এখনো একইভাবে তাকিয়ে আছে। ও বলল, ‘হ্যাঁ, নিরাপদ জায়গাতেই আছি। চিন্তার কিছু নেই। খুব বেশি দরকার না হলে আর কল করোনা। প্রয়োজনে আমি করব।’
‘শিওর?’
‘হুঁ।’

‘সাবধানে থেকো। আর তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। চিন্তা করব আমরা।’
‘তোমরাও সাবধানে থেকো।’
কলটা কেটে দিল ওপাশ থেকে। তুহিন আস্তে করে ফোনটা টেবিলে রেখে বলল, ‘কে ছিল?’
‘নীরব।’ ভনিতা না করেই বলল জ্যোতি।
তুহিন অবাক হল। কিছু বলতে যাবে তার আগেই বেজে উঠল ওর নিজের ফোন। জ্যোতির দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল তুহিন। বারান্দায় গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে বলল, ‘বলো, তমাল।’

ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠে তমাল বলল, ‘স্যার, শান মীর্জা যে হসপিটালে ভর্তি আছে তার আশেপাশে কোন বিল্ডিংয়ঙেই নতুন কোন ভাড়াটিয়া ওঠেনি। কিন্তু একটা বারোতালা বিল্ডিং আছে। কাজ অসম্পূর্ণ। তাই এখনো কেউ থাকেনা ওখানে। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে ঐ বিল্ডিংয়ে একটা ছেলেকে দুবার যাতায়াত করতে দেখা গেছে। আর রুদ্রর ফটো দেখে তারা বলছে, সেই ছেলেটার সঙ্গে রুদ্রর চেহারা নাকি প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে। তারমানে স্যার_’

তুহিন বলল, ‘তার আর কোন মানে নেই তমাল। রুদ্র ঐ বারোতলা বিল্ডিংয়েই আছে। ওখান থেকেই নজর রাখছে শান মীর্জার ওপর।’
‘অ‍্যাটাক করব স্যার?’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬১

‘না। ফোর্স রেডি করতে হবে। ভীষণ ধুরন্ধর রুদ্র আমের। ভালোভাবে আটঘাট বেঁধে নামতে হবে আমাদের। নয়তো আবার ফসকে যাবে। ততক্ষণ তোমরা আড়াল থেকে কড়া নজর রাখো বিল্ডিংটার ওপর। কোনভাবেই যাতে হাতছাড়া না হয়। আজ রাতের মধ্যে আমার রুদ্র আমেরকে চাই। আই ওয়ান্ট হিম এট এনি কস্ট।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৩