অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৭

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৭
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

রাস্তাটা এখন নির্জন। ল্যামপোস্টের মৃদু আলো। তারওপর ঘন কুয়াশার আস্তরণে ধোঁয়াশা লাগছে চারপাশ। উচ্ছ্বাস আর প্রিয়তা ছাড়া আপাতত আর কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। প্রিয়তার হাতের কবজির ওপরটা ধরে দ্রুত এগোচ্ছে উচ্ছ্বাস। এই মুহূর্তে রাস্তাটা নিরাপদ না। দ্রুত আমের ভিলায় ফেরা উচিত ওদের।

কয়েক পা এগোতে না এগোতেই রুদ্রর জীপ এসে থামল ওদের সামনে। দুজনেই থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল ড্রাইভিং সিটে বসা রুদ্র আমের। আবছা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে রাগে জ্বলছে চোখদুটো।
সেটা দেখে হতাশ নিশ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘দেখলে! বলছিলাম না কতদূর যেন চলে এসেছে। এবার সামলাও।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভাবান্তর হলোনা প্রিয়তার মধ্যে। ভ্রুকুটি করে মুখ ফিরিয়ে নিল। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই উচ্ছ্বাস রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখ ভাই, রাগারাগি, চেঁচামেচি যা করার ঘরে গিয়ে করিস। ব্যক্তিগত ঝগড়াঝাটি রাস্তায় করতে নেই। আমার সামনেতো একদমই না। আমার ভাই আবার হার্ট দুর্বল।’

রুদ্র কিছু বলল না। প্রিয়তার ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে হর্ন বাজাল কেবল। উচ্ছ্বাস চুপচাপ জিপের পেছনে উঠে বসল। কিন্তু প্রিয়তা নড়লোও না। রুদ্রও নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে আরও একবার হর্ন বাজাল। এবার প্রিয়তা তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর চোখ বলছে, উঠে এসো। নয়তো মাঝরাতে, মাঝরাস্তায় ভয়ানক কিছু হয়ে যাবে আজ।

রুদ্রর নীরব হুমকিতে বোধ হয় প্রিয়তাও ভয় পেল খানিকটা। তাই চুপচাপ রুদ্রর পাশে গিয়ে বসল। সঙ্গেসঙ্গে জিপ স্টার্ট করল রুদ্র। কেউ কোন কথা বলছেনা। কেমন থমথমে ভাব। পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকতা আনতে উচ্ছ্বাস বলল, ‘কেমন ব্যাডা তুই? মাঝরাতে বউ পালিয়ে যায়, আর তুই টেরও পাসনা? বউমণি যখন বের হচ্ছিলো ছিলি টা কই? এক্সের চিন্তায় বিভোর ছিলি?’

কোন জবাব এলোনা রুদ্রর দিক থেকে। পরিবেশ তখনও থমথমে। উচ্ছ্বাসও আর কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারল না। বুঝল রুদ্র সত্যিই রেগে আছে।

হুট করেই বেরিয়ে আসাটা সহজ ছিলোনা প্রিয়তার জন্যে। সে মুহূর্তে রুদ্রকে দেখেই মাথায় দ্রুত চিন্তা চলতে থাকে ওর। হাতে সময় বেশি নেই। যেকোন সময় উচ্ছ্বাস ফিরে আসবে। তারআগেই ওকে যেতে হবে। বাঁচাতে হবে উচ্ছ্বাসকে। এদিকে রুদ্র ওর সামনে দাঁড়িয়ে। কোনভাবেই বের হতে দেবেনা ওকে।

রুদ্রকে বলতেও পারবে না উচ্ছ্বাসের প্রাণ সংকট। কারণ উচ্ছ্বাসের বিপদ সেটা প্রিয়তার জানার কথা নয়। জানলেও তার বিশ্বাসযোগ্য কারণ চাই। সেই কারণটাই নেই। তখন রুদ্রর সন্দেহের তীর ঘুরে সোজা চলে আসবে প্রিয়তার দিকে। এতোদিন এতো পরিশ্রম করে, সুকৌশলে যে তীরের নিশানা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ও। এক ভুল পদক্ষেপে মুহুর্তেই সব শেষ হয়ে যাবে। এতোসব ভাবনা মাত্র কয়েক সেকেন্ডে ভাবে প্রিয়তা। কিন্তু ওর বের হওয়াটাও আবশ্যক। যেকোন মূল্যে।

তৎক্ষণাৎ বুদ্ধি খেলে যায় প্রিয়তার ধূর্ত মস্তিষ্কে। সন্ধ্যায় তৈরী হতে হতে না হওয়া দ্বন্দ্বটাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মনে মনে তৈরী করে নিজেকে। ভ্রুকুটি করে তাকায় রুদ্রর দিকে। বলে, ‘স্কুলের চাকরিটা আমি করছি। এবং করব। সেজন্যই দুপুরে স্কুলে গিয়েছিলাম। কাল কুহুর বিয়ে। এরপর আমি আবার চলে যাব। আশা করি আপনি কোনরকম সিনক্রিয়েট করবেন না। আর না এখন এ বিষয়ে আমাকে কোন জেরা করবেন।’

‘সিনক্রিয়েট আমি না, তুমি করছো। আজকে আমায় না জানিয়ে স্কুলে গিয়ে তুমি ঠিক করোনি। যাই হোক, যেটা হওয়ার, হয়ে গেছে। এ নিয়ে তর্ক করতে চাইছিনা আমি। এরপর থেকে তুমি আমার অনুমতি ছাড়া কোথাও যাচ্ছোনা।’ প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলে রুদ্র।
প্রিয়তা রেগে যায়। চেঁচিয়ে বলে, ‘আমি জেলখানার আসামি নই যে এভাবে আটকে রাখবেন।’
রুদ্র ভাবলেশহীনভাবে পাশ কাটিয়ে বলে, ‘চিৎকার করোনা। অযথা জেদ করে লাভ নেই। ফ্রেশ হয়ে ঘুমোও। কাল অনেক কাজ আছে।’

প্রিয়তা বোঝে এভাবে হবেনা। রুদ্র রাগী। কিন্তু ইচ্ছে অনুযায়ী রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতাও আছে তার। রুদ্রকে উত্তেজিত করতে হবে। নয়তো বের হওয়ার কারণ পাবেনা। লম্বা শ্বাস টানে প্রিয়তা। মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে নিয়ে বলে, ‘মনে পড়ে আমাদের বিয়ের দিন একটা খু/ন হয়েছিল এ বাড়িতে? টার্গেট কিন্তু অন্যকেউ ছিল। হয়তো আমি। যদি এবারেও তাই হয়?’

‘হবেনা।’
‘এখনো এতো আত্মবিশ্বাস! আর কাকে? আর কাকে কাকে হারালে, কার কার সর্বনাশ হলে আপনার এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ভাঙবে?’

রুদ্রর রাগ হয়। বারবার! বারবার ওর অতীতের ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে, ওকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলছে প্রিয়তা। প্রতিবার এই একটা জায়গায় এসেই ওকে আটকে দেয় মেয়েটা। কিছু বলার থাকেনা রুদ্রর। তবে রাগটাকে ভেতরে চেপে রেখেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে রুদ্র। জবাব দেয়না। প্রিয়তা এবার ব্রহ্মাস্ত্র ছোড়ে। আঘাত করে রুদ্রর সবচেয়ে দুর্বল জায়গাতে। বলে, ‘আর কী হলে ঠিক হবেন আপনি? আপনার মায়ের মতো আমাকেও কেউ বিষ দিয়ে মেরে ফেললে? নাকি কুহুর মতো আমাকেও কেউ দলবেঁধে…’

কথাটা কাজে দেয়। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে রুদ্রর। দ্রুত কদমে এগিয়ে এসে খামচে ধরে প্রিয়তার বাহু। বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারেনা প্রিয়তা। তারআগেই ওকে নিজের দিকে সবেগে টেনে নেয় রুদ্র। দাঁতে দাঁত পিষে বলে, ‘জাস্ট কিপ ইউর মাউথ শাট। আমার মুখের ওপর আর একটা কথা বলারও সাহস করোনা প্রিয়তা। ভালো হবেনা।’
রুদ্রকে আরও তাঁতিয়ে দিতে প্রিয়তা বলে, ‘কী করবেন? মা/রবেন?’

‘‍যদি প্রয়োজন পড়ে সেটাও করব। সেই প্রয়োজনটা আসতে দিওনা। আমার হাতের মার কিন্তু তোমার সহ্য হবেনা।’
‘আপনার শত্রুদের হাতের মার যখন সহ্য করতে পেরেছি আপনারটাও পারব।’
রুদ্র আরও রেগে যায়। তর্কের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ওয়াশরুমে ঢোকে রুদ্র। ঠান্ডা জলে শাওয়ার নিয়ে শান্ত করবে নিজেকে।

ততক্ষণে প্রিয়তাও থামবে। আর সে সুযোগটাই কাজে লাগায় প্রিয়তা। থামেনা ও। চিৎকার করে নিজের চলে যাওয়ার ঘোষণা করে। রুদ্র পাত্তা দেয়না। ভাবে চেঁচামেচি করে এমনিতেই থেমে যাবে। কিন্তু ততক্ষণে আমের ভিলা ত্যাগ করেছে প্রিয়তা। গেইটের সামনে প্রহরীরা আটকাতে চাইলেও পারেনা। কারণ প্রিয়তার দিকে নজর রাখার অধিকার থাকলেও ওর গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার নেই তাদের। তাদের উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায়। রুদ্র বা ওরা পেছন পেছন আসলে আসুক। কোন অঘটন ঘটার আগে উচ্ছ্বাসের কাছে পৌঁছতে পারলেই হল। এখন ওর কাছে বের হওয়ার কারণ আছে। সন্দেহ করবেনা রুদ্র।

এদিকে ফোনে দ্রুত রুদ্রর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে আমের ভিলার দ্বারপ্রহরী। কিন্তু রুদ্র শাওয়ারে ব্যস্ত থাকায় সেইমুহূর্তে ফোন ধরতে পারেনা।

আমের ভিলার বসার ঘর প্রবেশ করেই খপ করে প্রিয়তার হাত ধরল রুদ্র। কোনদিকে না তাকিয়ে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল। সেদিকে বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাঁধ ঝাঁকালো উচ্ছ্বাস। খানিকটা বিড়বিড় করে চলে গেল নিজের ঘরে। রাত অনেক হয়েছে। সবাই ঘুমোচ্ছে। কাল অনেক কাজ।

প্রিয়তাকে রুমে এনে হাত ধরে রেখেই ঘরের দরজা বন্ধ করল রুদ্র। ঘরের মাঝামাঝি এনে দাঁড় করাল ওকে। হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেই বলল, ‘বাড়াবাড়ির সীমা পাড় করে ফেলেছো তুমি। এতোরাতে বের হয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছিলে?’
প্রিয়তা শান্ত, কিন্তু কঠোরভাবে বলল, ‘প্রমাণ করার কিছু নেই। আর আমিতো এভাবে বের হতে চাইনি। ভালোভাবেই দুদিন থেকে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি বাধ্য করেছন। আমাকে আসামির মতো এভাবে আটকে রেখে।’

রুদ্রর বুঝল তিড়তিড় করে বাড়ছে ওর রাগ। এভাবে কথা চলমান থাকলে তা আরও বাড়বে। হয়তো সেদিনের মতো প্রিয়তার গায়ে হাতও তুলে ফেলবে। সেটা চাইলনা রুদ্র। তাই প্রিয়তার কথার জবাব না দিয়ে টি-টেবিলের কাছে চলে গেল। গ্লাসে পানি রাখাই ছিল। সেটা তুলে এক নিঃশ্বাসে গ্লাসটা ফাঁকা করে ফেলল। পানির স্বাদটা সামান্য উট্কো মনে হল রুদ্রর। কিন্তু ওর রাগ কমেনি এখনো। তাই ব্যপারটা পাত্তা না দিয়ে বসল বিছানায়।

জোরে জোরে দুটো শ্বাস নেওয়ার পর বুঝল মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত ও। সেই ক্লান্তি গ্রাস করছে শরীরকেও। টাকা ফেরত দেওয়ার ডেডলাইন খুবই নিকটে। চাঁদা তুলতে বিরতিহীন পরিশ্রম করতে হচ্ছে সকলকে। তারওপর ব্যক্তিগতভাবেও আরও অনেকদিক সামলাতে হচ্ছে ওকে।

মানসিক শান্তির ভীষণ প্রয়োজন এখন ওর। যেটা কেবলমাত্র প্রিয়তার কাছেই পায় রুদ্র। কিন্তু সেই মেয়েটার কাছেও আজকাল কেবল অশান্তিই পাচ্ছে। নিজের কাজকর্ম দিয়ে অশান্তির সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে রুদ্রকে। কোথাও শান্তির ছিঁটেফোঁটাও নেই। কথাগুলো চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস চাপল রুদ্র। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার জীবন সম্পর্কে সবকিছু জেনেশুনে সেচ্ছায় আমার জীবনে এসেছিলে তুমি। এখন এরকম ভিত্তিহীন কাজ কেন করছো?’

‘তখন জানতাম নাযে এই পাপের জগতের আগুনে এভাবে পু/ড়তে হবে আমাকে। আর আপনি এখন অন্যায় করছেন।নিজের দেওয়া কথা না রেখে।’

‘রুদ্র আমের কথার খেলান করেনা। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, সব ছেড়ে দেব। নিশ্চয়ই দেব। তবে আমার কাজ শেষ হওয়ার পর। আর একই কথা রিপিড করে কী প্রমাণ করতে চাইছো তুমি? ছোটবেলায় যাকে হারিয়েছি সে আমার মা। কদিন আগে যে লোকটা মারা গেছে সে আমার বাবা। যার সঙ্গে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে সে আমার নিজের বোন। পৃথিবীতে আসার আগেই যাকে নিষ্ঠুরভাবে শেষ করা হয়েছে সে আমারও সন্তান। তুমি ওকে গর্ভে ধারণ করেছে সেটা যেমন সত্যি, ও আমার অংশ ছিল সেটাও সত্যি। স্বপ্ন শুধু তোমার ভাঙ্গনি, আমারও ভেঙ্গেছে। দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, ক্ষোভ যাই বলোনা কেন? তোমার চেয়ে আমার কয়েকগুন বেশি।’

প্রিয়তা বলার মতো কিছু পেলোনা। রুদ্র ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘কাল কুহুর বিয়েটা মিটে যাক। এরপর ঠান্ডামাথায় এ ব্যপারে আলোচনা করব আমরা। তারআগে প্লিজ আর কোনরকম ঝামেলা করোনা। এই মুহূর্তে আমার একটু শান্তি প্রয়োজন প্রিয়। সেটা শুধুমাত্র তোমার কাছেই পাই আমি। এভাবে অসহায় করে দিওনা আমাকে।’

প্রিয়তার দৃষ্টি আচমকাই কোমল হয়ে এলো। রুদ্রর দিক থেকে চোখ সরিয়ে চুপচাপ গিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল। উল্টো ঘুরে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র। বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। দুচোখে ভারী হয়ে এলো। নিজের অজান্তেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

ডার্ক নাইটের প্রধান অফিস। বর্তমানে এটা শওকত মীর্জার ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিসের কভার নিয়ে আছে। শওকতের কেবিনে জড়ো হয়েছে শওকত, শান, পলাশ আর সম্রাট। ঠিক রাত তিনটা বাজে প্রিয়তাও এসে হাজির হয়েছে। এক মিনিটও এদিক-সেদিক হয়নি। সকলে পৌঁছলেও এখনো পৌঁছয়নি করিম তাজওয়ার। ব্যাপারটা নিয়ে বিরক্ত প্রিয়তা। সম্রাট যদিও করিমের দেরী হওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করে বলেছে, সে দূরে আছে। তাই দেরী হচ্ছে আসতে। কিন্তু তাতেও বিরক্তি বিন্দুমাত্র কমেনি ওর।

কেবিনটাতে একপ্রকার পিনপতন নীরবতাই বলা চলে। প্রিয়তা নিজের চেয়ার হেলান দিয়ে পায়ে পা তুলে বসে আছে। ফোন স্ক্রোল করে চলেছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। কপালে বিরক্তির ভ্রুকুটি। পরনে ছেলেদের টিশার্ট আর জিন্স। চুলগুলো অনেকটা উঁচু করে ঝুটি বাধা। চোখেমুখে শান্ত গাম্ভীর্যতা। যেচে আলাপ শুরু করার সাহস পাচ্ছেনা উপস্থিত কেউ।

প্রিয়তা না বললেও তারা জানে, কেন তাদের ডাকা হয়েছে। সেজন্যই আরও বেশি নীরব সকলে। শওকতের থেকে রানি মীর্জার প্রতি ভয়টাও সংক্রমিত হয়েছে সকলের মধ্যে। অপূর্ব সম্মোহনী ঐ চোখের হিংস্রতাকে ওরাও ভয় পায়। তবুও দমবন্ধকর নীরবতা কমিয়ে আনতে শওকত বলল, ‘হঠাৎ বেরিয়ে এলে কীকরে? সমস্যা হয়নি? রুদ্র দেখেনি?’
ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই প্রিয়তা বলল, ‘পানির গ্লাসে সামান্য ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। কয়েকঘন্টা বেঘোরে ঘুমোবে।’

ব্যপারটায় যেন মজা পেল সম্রাট। বেশ আমোদিত গলায় বলল, ‘ব্যাটাকে বেশ ভালোই ঘোল খাওয়াচ্ছো তাহলে?’
জবাব দিলোনা প্রিয়তা। তাকালোও না। যেন শুনতেই পায়নি। অপমানটা বেশ কষ্টে হজম করে নিল সম্রাট। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে রইল চুপচাপ। শওকত বলল, ‘গেটের দারোয়ানরা আটকায়নি।’

‘জয়ের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। ছেলে সেজে। দলেরই কোন লোক ভেবেছে। ঢুকবোও একইভাবে। কেউ টের পাবেনা।’
শওকত বলার মতো আর কিছু পেলোনা। বাকিরাও চুপ। প্রিয়তার এই শান্ত থাকাটা ঝড়ের পূর্বাভাস বলে মনে হচ্ছে সকলের।

আরও পনেরো মিনিট পর উপস্থিত হল করিম তাজওয়ার। কোনদিকে না তাকিয়ে দ্রুত এসে বসল নিজের নির্ধারিত চেয়ারে। সে বসতেই সোজা হয়ে বসল প্রিয়তা। অলস ভঙ্গিতে টেবিলের ওপর ফোনটা রাখতে রাখতে বলল, ‘এখন বুঝতে পারি, ব্লাকহোল কেন বারবার রুদ্রর কাছে নাকানিচোবানি খায়। দলের লীডার এমন ঢিলা কম্পানি হওয়ার পরেও এখনো যে দলটার অস্তিত্ব আছে সেটাই আশ্চর্যের!’

শক্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকাল করিম তাজওয়ার। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, ‘শহরের বাইরে_’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি। আপনার জীবন এক্সকিউজ দিয়েই কেটে যাবে। কিন্তু ঐসব প্যানপ্যান শোনার ধৈর্য্য আমার নেই। সো লীভ ইট।’

কটমটে দৃষ্টিতে সম্রাটের দিকে তাকাল করিম। এই ছেলের গদগদ প্রেমের জন্যেই দুদিনের মেয়ে তার সাথে এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলার সাহস করছে। একবার আসুক বাড়ির বউ হয়ে। এই মেয়েকে চোখে শর্ষেফুল দেখিয়ে ছাড়বে। সব তেজ বের করবে। সম্রাট গলা ঝেড়ে চোখ সরিয়ে নিল। ও নিজেও কী কম হেনস্তা হয় প্রিয়তার কাছে!
গম্ভীর দৃষ্টিতে সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল প্রিয়তা। কোনরকম ভনিতা করল না। থমথমে গলায় বলল, ‘ভাইকে, আই মিন উচ্ছ্বাসকে খু/ন করতে লোক পাঠিয়েছিলে তোমরা?’

আবার অস্বস্তিকর এক নীরবতা নেমে এলো কেবিনে। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা। সবার আগে মুখ খুলল শওকত, ‘হ্যাঁ। আজকে রাতেই কাজটা হয়ে যেতো। যদি তুমি এসে বাঁধা না দিতে।’
‘কেন?’
‘কেন মানে? তুমি কী ওকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছো?’ অনেকটা তেঁতে উঠল সম্রাট।

পরিস্থিতি সামাল দিল শান। প্রিয়তা কিছু বলার আগেই ঠান্ডা মাথায় বলল, ‘ওকে মেরে ফেলাটা দরকার ছিল। রুদ্র চুপচাপ আছে মানে কিছুই করছেনা তেমনটা নয়। চুপচাপ বসে থাকার লোক সে নয়। ও রুদ্র আমের। পরিস্থিতি বুঝে রিঅ্যাক্ট করে। আপোষে সিদ্ধান্ত নেয়না। সেকারণেই আমরা এখনো খোলা, নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াতে পারছি।’
শানের কথায় সম্মতি দিয়ে পলাশ বলল, ‘রুদ্র চুপচাপ বসে নেই। কিছু একটা করছে ও। গোপনে। কাউকে বিশ্বাস করছেনা সে এখন আর। সেকারণেই কেউ কিচ্ছু টের পাচ্ছেনা। আর সেকাজ সেড়েই আমাদের পেছনে পাগল কুকুরের মতো পড়বে। কোন সন্দেহ নেই তাতে।’

করিম তাজওয়ার দাম্ভিক স্বরে বলল, ‘আর সেকারণেই রুদ্রর কাছের কারো মরা দরকার ছিল। তাতে কিছুদিনের জন্যে হলেও ও ডিসট্রাকড থাকবে। টাকা শোধ করার ডেডলাইন অবধি ওকে আটকে রাখা গেলেই ইনাফ। এরপর ওকে নিয়ে আমাদের আর মাথা ঘামাতে হবেনা। আর কোন দল না হলেও আফ্রিকান “ভুড় হিট্টি” দলটা কোনভাবেই ছাড়বেনা ওকে। পৃথিবীর অন্যতম বর্বর, জঘন্য, হিংস্র স/ন্ত্রাসী দল ওটা।

বাংলাদেশে এসে খুঁজে বের করে তারপর খু/ন করবে। আর তারপর কোন বাঁধা ছাড়াই আন্ডারওয়ার্ল্ডে রাজত্ব্য করতে পারব আমরা। নিখুঁত পরিকল্পনা ছিল। সব নষ্ট করলে তুমি।’
শেষের কথাটা আক্রোশ নিয়েই বলল করিম। প্রিয়তা শক্ত চোখে তাকাতেই থমমত খেয়ে গেল সে। দৃষ্টি স্বাভাবিক করল প্রিয়তা। সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘বুঝলাম। কিন্তু আমাকে বলা হয়নি কেন?’

আরও একবার নীরবতা নামল ঘরটাতে। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে শান বলল, ‘তুই ছিলি আমের ভিলায়। ওখানে সরাসরি তোর সঙ্গে যোগাযোগ করাটা রিস্কি হয়ে যেতোনা? সময়ও যথেষ্ট কম ছিল আমাদের হাতে। তাই আমরা চাইছিলাম..’
শানের কথা শেষ হওয়ার আগেই সম্রাট বলে উঠল, ‘সোলার সিস্টেম এবং রুদ্র আমেরের ধ্বংস। সেটাই তো আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাইনা রানি? সেকারণেই তুমি ঐ বাড়িতে গিয়েছিলে। ঐ জানোয়ারটার সাথে সংসার করেছো। জীবনের দুটো বছর নষ্ট করেছো। লক্ষ্যের এতো কাছে এসে কেন এমন উল্টাপাল্টা কাজ করছো, কেন সব ঘেঁটে দিচ্ছো আমি বুঝতে পারছিনা!’$

প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। ঠান্ডা গলাতেই বলল, ‘এতোগুলো বছর আন্ডারওয়ার্ল্ডের জগতে রাজত্ব্য করেছে সোলার সিস্টেম। রুদ্র কিংবা বাবার তোমাদের কাউকে মা/রার প্রয়োজন পড়েনি কিন্তু। না-তো ছলনার প্রয়োজন পড়েছে। নিজেদের যোগ্যতা বুঝতে পারছো?’

চোয়াল শক্ত করে, ক্রোধ ভরে প্রিয়তার দিকে তাকাল সম্রাট। শান ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তুই আমাদের দলে কাজ করছিস নাকি সোলার সিস্টেমে?’
‘সেটা পয়েন্ট না। পয়েন্ট হলো তোমরা সবগুলো ইউজলেস। কাজের কাজ তোমাদের কারো দ্বারা হয়না। এইজন্যই রুদ্রর কাছে বারবার নাকানিচোবানী চেয়েছো। ইউ গাইজ আর গুড ফর নাথিং!

অপমানের থমথমে হয়ে গেল সকলে। মুখ খুলল শওকত, ‘রুদ্র যে আমাদের কোনরকম কোন ক্ষতি না করেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে রাজত্ব্য করে গেছে তা কিন্তু না। আমার কাঠের বাঁ পাটা দেখে তোমার সেটা মনে পড়া উচিত।’
চোখ ঘুরিয়ে শওকতের দিকে তাকাল প্রিয়তা। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আগের মতোই অবিচল শান্ত গলায় বলল, ‘মেইন পয়েন্ট এড়িয়ে যাচ্ছো তোমরা।

আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি আমি। আমায় কেন জানানো হলোনা?’
শান ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমিতো বললাম তোর সঙ্গে যোগাযোগ করাটা সেফ ছিলোনা। বলা গেলে বলতাম না না-কি?’
টেবিলে দু হাত রেখে হালকা ঝুঁকলো প্রিয়তা। গভীর চোখদুটো যেন জ্বলে ওঠল অদ্ভুত আক্রোশে। অস্বাভাবিক শীতল গলায় বলল, ‘আমাকে না জানিয়ে কাজ করার ব্যপারটা বেশ আগে থেকেই ঘটছে।

সেই কক্সবাজার ট্রিপের সময় থেকেই অনেক কিছু করছো তোমরা। আমাকে না জানিয়ে, আমার সঙ্গে আলোচনা না করে। সময়, পরিস্থিতির জন্যে আমি চুপ করে ছিলাম, আছি। কিন্তু এখনতো দেখছি আমার চুপ থাকাটাকে তোমরা আমার দুর্বলতা ভেবে নিয়েছো। পুরোনো কোনকিছুই কিন্তু ভুলে যাইনি আমি। আমায় বিগড়ে দিওনা।’
করিম তাজওয়ার বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমাকে জানালে কী লাভ হতো? রাজি হতে? সব যে ভেস্তে দিতে তার প্রমাণতো আজ দিয়েই দিলে।’

‘আমি চাইলে এখনো সব ভেস্তে দিতে পারি।’ কর্কশ হয়ে উঠল প্রিয়তার গলা।
শওকত মীর্জা মধ্যে এতক্ষণে রাগের লক্ষণ দেখা গেল। সেই রাগ প্রকাশ পেল কন্ঠস্বরেও, ‘সবকিছু তোমার অনুমতি নিয়ে তবে করব? ভুলে যেওনা এটা একটা টিম ওয়ার্ক। আর টিম ওয়ার্কে বহুমত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। তোমার একার চাওয়া না চাওয়াতে কোন সিদ্ধান্ত বদলানো হবে, এমনটা আশা করা কী স্বৈরাচারীতা নয়?’

প্রিয়তা সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিল, ‘না, নয়। বরং একা আমার সাজানো পরিকল্পনা ধরে, টানা দুটো বছর আমার দেওয়া ইনফরমেশনের ওপর নির্ভরশীল থেকে, সম্পূর্ণ আমার সাহায্যে এতোদূর আসার পর আমাকেই না জানিয়ে কোন সিদ্ধান্তের নেওয়াটাই স্বৈরাচারীতা।’

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল প্রিয়তা। খানিকটা দমে গেল সবাই। কিন্তু দমল না করিম। ‘সেসব আমরা করেছি একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে। তোমার একার খামখেয়ালীর জন্যে সেই উদ্দেশ্য থেকে আমরা কেউ সরে আসব না।’
প্রিয়তা ভয়ানক রেগে গেল। সশব্দে উঠে দাঁড়াল। চড়া গলায় বলল, ‘আপনাদের এতো অযথা কথা শুনতে এখানে আসিনি আমি। সাবধান করতে এসেছি। আজ যা হয়েছে, হয়েছে। এরপর আমার অ‍্যাপ্রুভাল ছাড়া যদি কোন সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। ভীষণ পস্তাতে হবে আপনাদের। সুযোগে আমি করে দিয়েছি। সে সুযোগ কেড়ে নিতে আমার বেশিক্ষণ লাগবেনা। আর এটা আমার শেষ সাবধানবাণী।’

সকলেই ভীষণ ক্ষুব্ধ হল প্রিয়তার কথায়। কিন্তু প্রকাশ করল না। রেগে গেলে এই মেয়ের ব্যবহার বিশ্রী রকমের খারাপ হয়ে যায়। সম্রাট তীক্ষ্ম চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুমকি দিচ্ছো?’
‘হুমকি ধরে নিলেই বেশি খুশি হব আমি।’

উঠে দাঁড়াল সম্রাটও। এবার সেও গলা চড়িয়ে বলল, ‘বাড়াবাড়িটা বেশি হচ্ছে কিন্তু রানি। ভুলে যেওনা আমি তোমার হবু স্বামী। আর আমার বাবা তোমার শশুর। ঠিকঠাকভাবে কথা বলতে শেখো। পরিস্থিতি এমন বেসামাল করে দিচ্ছো কেন? কী চাইছো কী তুমি? আমরা সবাই রুদ্রর হাতে মা/রা যাই?’

প্রিয়তা শক্ত চোখে তাকাল সম্রাটের দিকে। এগিয়ে গিয়ে একদম সামনাসামনি দাঁড়াল। চোখেচোখ রাখল সম্রাটের। লালচে হয়ে উঠেছে প্রিয়তার চোখ। অতিরিক্ত রাগে ফোনা তোলা সাপের মতো হিশহিশ করল কিছুক্ষণ।
‘আবার বলছি, পুরোনো কথা ভুলিনি আমি। ব্যপারটা তুলছিনা বলেযে ভুলে গেছি তা কিন্তু না। আমায় তাঁতিও না। তুমি অস্বীকার করলেও আমার সন্দেহের তীর কিন্তু এখনো তোমার দিকেই আছে। শুধু প্রমাণের অপেক্ষায় আছি। একবার জানতে পারি যে কাজটা তুমিই করেছো। রুদ্র কিছু করুক বা না করুক। আমার হাত থেকে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’ ভীষণ রাগে হিসহিসিয়ে উঠল প্রিয়তার গলা।

সম্রাট দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত চোখে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার চোখে। ক্রোধের দাপটে একটা শব্দও উচ্চারিত হলোনা মুখ দিয়ে। উপস্থিত সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। একসময় ওদের গদগদ প্রেমের সাক্ষী ছিল তারা। আজ ওদের অন্তর্নিহিত বিদ্বেষেরও সাক্ষী। কখনও কী ভেবেছিল এই দিনও আসবে? যে দুজনের প্রণয়ের পরিণয় ঘটানোর জন্যে এই দুই শত্রুদল এক হয়েছিল। আজ সেই দুজনই একে অপরের শত্রু হয়ে উঠছে।

আপাতত সকলেই চুপ রইল। সম্রাট আর প্রিয়তা দুজনেই ভীষণ রেগে আছে। এই মুহূর্তে ওদের উস্কালে ভয়াবহ গন্ডগোল বেঁধে যাবে। হঠাৎই শওকত মীর্জার দিকে চোখ গেল প্রিয়তার। প্রিয়তার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই শওকত নিজের চশমা ঠিক করল। এক আঙুল দিয়ে বাঁ পাশের ভ্রু হালকা চুলকে নিল। কিছুক্ষণ শওকতের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল প্রিয়তা। অনিয়মিত শ্বাস নিতে নিতে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। কপালে দু আঙ্গুল চেপে ধরে বসে রইল মিনিট দুইয়ের মতো। টেবিলের ওপর থেকে টেনে নিল একটা সিগারেটের প্যাকেট। অস্থিরহাতে একটা সিগারেটে নিয়ে চেপে ধরল ঠোঁটের মাঝে। লাইটার দিয়ে সেটা ধরিয়ে ঠোঁটের মাঝে রাখা অবস্থাতেই বলল, ‘টাকা শোধ হওয়ার আগ পর্যন্ত রুদ্রকে আটকে রাখতে চাইছো। এই তো?’

বলে ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল প্রিয়তা। তবে চোখেমুখে তৃপ্তির কোন লক্ষণ নেই। ‘পারবেনা। সময়ের আগে রুদ্র টাকা শোধ করতে পারবেনা। সেটা আমি এশিওর করব। তবে আমের ভিলার কোন মানুষেরও যেন কোন ক্ষতি না হয়। আর যদি হয়, আমার মনে হয়না আমাকে শত্রু হিসেবে পেতে তোমাদের খুব একটা ভালো লাগবে।’
কথাটা বলে আরও একটা টান দিল সিগারেটে। মুখ কুঁচকে সদ্য জ্বালানো সিগারেটটা গুঁজে রাখল অ‍্যাশট্রেতে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমাকে যেতে হবে। আশা করি আমার বলা কথাগুলো কেউ ভুলে যাবে না।’

কথাটা বলে সম্রাট আর করিমের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল প্রিয়তা। তারপর দৃঢ় চলনে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
প্রিয়তা বের হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে আবার কিছুক্ষণের জন্যে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো ঘরটাতে। সে নীরবতা কাটিয়ে করিম শওকতকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনার মেয়ে আপনারই সামনে এতোটা ঔদ্ধত্য দেখায় কীকরে?’
‘ঠিক যেভাবে আপনার ছেলে দেখায়।’ অকপটে জবাব দিল শওকত।

কিছু বলতে পারল না করিম। শুধু কটমটে চোখে একবার তাকাল নিজের সুপুত্রের দিকে। সম্রাটের সেদিকে খেয়াল নেই। প্রিয়তার বলা কথাগুলো এখনো মাথায় ভনভন করে ঘুরছে। রাগে সারা শরীর শক্ত হয়ে আছে ওর। শওকত হাঁক ছেড়ে ডাকল ডার্ক নাইটের বিশ্বস্ত এক সদস্য সুজনকে। সুজন এসে উপস্থিত হতেই প্রশ্ন ছুড়লো, ‘ইকবালের কী খবর?’
‘ঠিক আছে স্যার।’

‘রুদ্র আমেরের দিকে আড়াল থেকে নজর রাখ। কোথায় যাচ্ছে, কী করছে জানা প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ বেশি কাছ থেকে নজর রাখবি না। শেয়ালের চেয়েও বেশি ধূর্ত ঐ ছোঁকরা। সাজ্জাদ কই?’
‘ও দেশের বাইরে আছে আপাতত।’
‘ঐ এক পাঠা। এতোদিন যাবত দলে আছে। এখনো রুদ্রকে দেখলে চিনবে না। যাক গে, নছীব আছেতো? ওকেসহ কয়েকজন মিলে পালাক্রোমে নজর রাখবি। একজন বেশিক্ষণ থাকবি না।’
‘জি স্যার।’

কাজ বুঝে নিয়ে সুজন চলে গেল ঘর থেকে। তখন পলাশ বলল, ‘কিন্তু রানি চাইছেটা কী? আমের পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে ওর কী লাভ?’
শওকত গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসল। ‘সবকিছুতে লাভ লোকসান খুঁজিস কেন? টানা দুবছর ঐ বাড়িতে ছিল। হয়তো মায়া পড়ে গেছে।’

করিম তাজওয়ার ব্যঙ্গ করে বলল, ‘মায়া! তাও আবার রানি মীর্জার মধ্যে? মজা করছো আমার সঙ্গে? ব্রিটেনে থাকাকালীন তোমার মেয়ের সব নৃশংসতার কাহিনী জানা আমার। ঐ মেয়ের মধ্যে আর যাই থাক মায়া থাকতে পারেনা।’
কিছু বলল না শওকত।

এই মুহূর্তে সে কী ভয়ানক দুঃশ্চিন্তায় আছে কেবল সেই জানে। এখানো চোখে ভাসে স্ত্রীর সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীর। প্রিয়তার ঠোঁটের সেই পৈশাচিক হাসি।শানের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ে আছে। মুখ খুলল সম্রাট। শান্ত, ধীর কন্ঠে বলল, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যেস, ভালোলাগা, স্বভাব সব বদলাতে পারে বাবা। খেয়াল করেছো? যে রানি একবসাতে দুই-তিনটে সিগারেট শেষ করে ফেলতো সে এখন এক দু টানের বেশি দিতে পারেনা।’

‘ওটা হয়তো অভ্যেস নেই বলে।’
‘সেটাই বললাম। সময়ের এবং পরিস্থিতি অনেক কিছুই বদলে দেয়।’

ছদ্মবেশেই আমের ভিলায় ঢুকলো প্রিয়তা। যেভাবে বেরিয়েছিল। জয় ওরফে রাজু সঙ্গে থাকায় প্রহরীরাও কোনরকম ঝামেলা করল না। দরজার বাইরে থেকে জয়কে ওর জায়গায় পাঠিয়ে বাড়িতে ঢুকল প্রিয়তা। হলরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ওপরে।

এই দৃশ্য করিডরের পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখল আমের ভিলার পুরোনো কাজের লোক নার্গিস। প্রিয়তাকে বেরিয়ে যেতেও দেখেছে সে। সেজন্যই নজর রাখছিল এতক্ষণে। এই মেয়ে কোথায় গিয়েছিল, কখন ফেরে জানা প্রয়োজন।
করিডর পাড় হওয়ার সময় হঠাৎ থেমে গেল প্রিয়তা। ঠোঁটে ফুঁটে উঠল মৃদু, ধূর্ত বাঁকা হাসি। উল্টো ঘুরে ধীর, দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল যেই পিলারের আড়ালে নার্গিস দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ভয় পেয়ে গেল নার্গিস। গলা শুকিয়ে গেল তার। চমকে একদম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তীব্র শীতেও কপালে জমল বিন্দু বিন্দু ঘাম। প্রিয়তা নার্গিসের দিকে না তাকিয়েই স্বাভাবিক, নরম গলায় বলল, ‘আপনি কিছু দেখেননি খালা।’

আরও একবার চমকালো নার্গিস। শুকনো ঢোক গিলল। প্রিয়তা আবার বলল, ‘যদি প্রাণের মায়া থাকে। তাহলে ভুলে যান আজ রাতে আপনি কিছু দেখেছেন।’
কথাটা বলে আর দাঁড়ালোনা প্রিয়তা। এগিয়ে গেল নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে। নার্গিস উপলব্ধি করল সাড়া শরীর থরথর করে কাঁপছে তার।

স্টোররুম থেকে চেঞ্জ করে প্রিয়তার বেশ নিয়ে তবেই ঘরে ঢুকল প্রিয়তা। আস্তে করে লাগিয়ে দিল দরজাটা। বিছানায় তাকিয়ে দেখল উপোড় হয়ে ঘুমোচ্ছে রুদ্র। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, ট্রাউজার। এলোমেলো চুলগুলো কিছু ছড়িয়ে আছে কপালজুড়ে। গায়ের কম্বলটা অনেক নিচে নেমে এসেছে। ফলে ঠান্ডা লাগছে রুদ্রর। তবে গভীর ঘুমে থাকায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না।

প্রিয়তা এগিয়ে গিয়ে বসল রুদ্রর পাশে। ভালোভাবে কম্বলটা জড়িয়ে দিল রুদ্রর গায়ে। একধ্যাতে তাকিয়ে রইল ওর মুখটার দিকে। যেন নিষ্পাপ শিশু। বোঝার উপায় নেই এই লোকটাই এতোটা হিংস্র, পাষাণ, লাশের পর লাশ ফেলে দেয় মুহুর্তের মধ্যে। প্রিয়তা মুচকি হাসে।

মাঝেমাঝেই মাঝরাতে জেগে উঠতো প্রিয়তা। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতো নিজের শ্যামবর্ণের সুদর্শন অর্ধাঙ্গের দিকে। আলতো করে চুমু খেতো রুদ্রর কপালে। মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলতো, ‘আমার শ্যামপুরুষ।’
কথাগুলো ভেবে প্রিয়তার ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হল। আজও আলতো করে চুমু খেল রুদ্রর কপালে। সোফায় গেলোনা আর। চুপচাপ ঢুকে গেল রুদ্রর কম্বলের ভেতর। কিছুটা দূরত্ব রেখে শুয়ে নিজের শ্যামপুরুষকে দেখতে দেখতে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৬

নার্গিস সেমুহূর্তে ভয় পেলেও পরমুহূর্তেই মুখ বাঁকিয়ে নিল। প্রিয়তা ভয় দেখালেও ততটা ভয় সে পায়নি। সে জানে, বড়লোকের বউদের এমন অনেক কেচ্ছা থাকে। এই মেয়েরও নিশ্চয়ই আছে। নইলে মাঝরাতে চোরের মতো বের হবে কেন? সেই কেচ্ছাটাই জানতে হবে। তারপর সুযোগ বুঝে চেপে ধরতে হবে। বড়লোকের বউ। নিশ্চয়ই অনেক টাকা হাতানো যাবে।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৮