অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৬

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৬
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

চারপাশটা স্তব্ধ নীরব। কোন বারতি শব্দ নেই। কিছুক্ষণ আগেই এই ঘরটাতেই ঘটে গেছে এক নির্মম হ/ত্যাকাণ্ড। ঘরের এককোণে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে তনুজা। মাঝেমাঝে আড়চোখে ফ্লোরে তাকাচ্ছে। ফ্লোরটা দেখে বোঝার উপায় নেই কিছুক্ষণ আগেই জায়গাটা র/ক্তে ভেসে যাচ্ছিল। পড়ে ছিল সাব্বিরের ক্ষ/তবিক্ষ/ত নিষ্প্রাণ দেহ। কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতোনা সেদিকে। বর্তমানে জায়গাটা একদম পরিষ্কার। র/ক্তের একফোঁটা দাগও নেই। প্রিয়তার নির্দেশেই নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের সব চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে কিছু সময় পূর্বে।

চেয়ারে পাথরের মতো বসে আছে ইকবাল। চোখের সামনে সাব্বিরের অমন বিভৎস মৃ/ত্যু দেখে টু শব্দটাও করেনি আর। নিজের চোখে রুদ্রকে এরচেয়েও ভয়াবহ, নৃশংস খু/ন করতে দেখেছে ইকবাল। কিন্তু কখনও থমকায়নি। চমকায়ওনি। সেই ইকবাল আজ স্তব্ধ, হতভম্ব। প্রিয়তা এমনভাবে একটা প্রা/ণ নিল! যে মেয়েটাকে দেখলে মনে হতো মশা মারতেও হাত কাঁপবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে মেয়েটা কি-না একটি জলজ্যান্ত মানুষকে খু/ন করল! তাও এভাবে! এতো নির্মম, নৃশংস, জঘন্যভাবে!
না, এ সেই প্রিয়তা হতে পারেনা, যাকে ইকবাল দুবছর যাবত দেখে আসছে। যার স্পর্শে, হাসিতে, সবকিছু প্রাণ ফিরে পেতো। সে এভাবে প্রাণ নিতে পারে! সেই কোমল, প্রাণচ্ছল মেয়েটা কিনা এতো নিষ্ঠুর, হিংস্র! এতোটাও অভিনয় সম্ভব? নিজের আসল সত্তাকে এভাবেও আড়াল করা যায়?

কিছুক্ষণ আগে প্রিয়তাকে মোটেই সুস্থ-স্বাভাবিক মনে হয়নি ইকবালের। সম্পূর্ণ মানসিক রোগী বলেই মনে হচ্ছিলো।
প্রিয়তার দিকে এবার ভালোভাবে তাকাল ইকবাল। ওর ঠিক সামনের চেয়ারেই বসল প্রিয়তা। সারামুখে, গলায় র/ক্তের ছেটা। র/ক্তে লাল হয়ে আছে হাত, পোশাক। যেনো কোন হিংস্র প্রেতাত্মা ভর করেছে প্রিয়তা ওরফে রানি মীর্জার ওপর। যে নিজের র/ক্ত পিপাসা মিটিয়ে এখন শান্তভাবে বসে আছে। হাত বাড়াতেই প্রিয়তার দিকে একটা কাপড় এগিয়ে দিল তনুজা। নির্বিকারছন্দে শরীর থেকে র/ক্তগুলো মুছতে শুরু করল ও। যেন পানিতে ভেজা শরীর মুছছে। স্বাভাবিক, কিন্তু ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট এই দৃশ্য।

অনেকটা সাহস সঞ্চার করে মুখ খুলল ইকবাল, ‘আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে যে? পেনড্রাইভটার জন্যে?’
প্রিয়তা র/ক্ত মুছতে মুছতেই গম্ভীর, নির্বিকারভাবে বলল, ‘না।’
‘তবে? কোনভাবে যদি আমি মুক্ত হতে পারি, রুদ্রকে সত্যিটা জানানো থেকে কেউ আটকাতে পারবেনা আমাকে। সেটা এখনো বোঝনি?’

‘শুধুমাত্র সেকারণেই আপনি এখনো বন্দি আছেন ইকবাল ভাই।’ প্রিয়তার কন্ঠে একই নির্বিকারতা।
প্রিয়তার শান্তস্বরে বলা কথাটাতে অবাক হল ইকবাল। বলল, ‘মানে? তোমরা আমার কাছে পেনড্রাইভটা চাওনা?’
‘ওরা চায়, আমি না।’
‘তাহলে তুমি কী চাও?’

প্রিয়তার র/ক্ত মোছা শেষ হল। যদিও জামায় এখনো রক্তের দাগ বিদ্যমান। তোয়ালেটা নামিয়ে, শূণ্য দৃষ্টিতে তাকাল ন/গ্ন বাল্বের দিকে। চোখের পাতা অবধি কাঁপল না। লম্বা এক শ্বাস ফেলে স্থির কন্ঠে বলল, ‘আপনাকে আগেও বলেছি। আমার চাওয়াগুলো কখনই স্থির থাকেনা। তাই আমার চাওয়াগুলোই আমার সবচেয়ে বড় শত্রু।’

প্রিয়তার হেয়ালি এবারেও বুঝল না ইকবাল। সপ্রশ্ন চোখে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। ঘড়ি দেখল। দুপুর হয়ে আসছে। আমের ভিলায় ফিরতে হবে তাকে। তনুজার দিকে র/ক্তমাখা তোয়ালেটা ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘এদিকটা খেয়াল রেখো। আমি আসছি।’
বলে ভাবলেশহীনভাবে হেঁটে বেরিয়ে গেল প্রিয়তা। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইকবাল। পিছু ডাকল না। জানে ফিরে তাকাবেনা প্রিয়তা। কেবল দেখল, নিজের দেখা সবচেয়ে কোমল মেয়েটার ভয়ানক হিংস্র রূপ।

বিকেলটা বেশ শীতল। তেজহীন সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে। আমের ভিলাতে নীরবের জন্যে বরাদ্দকৃত ঘরটার বারান্দা বেশ বড়। বাইরের দৃশ্যপটও বেশ সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। পশ্চিম দিকে বারান্দা হওয়াতে দেখা যায় সূর্যাস্ত।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে নীরব। উদাস দৃষ্টি। ঠান্ডা শীতল বাতাসে মৃদু দুলছে লং লেন্থে কাটা বাদামি চুলগুলো। মন ভীষণ খারাপ ওর।

কাল ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। অথচ ওর বাবা-মা থাকবেনা ওর পাশে। নিজের মাকে ফোন করেছিল ও। ওনারা এখনো সেখানেই পড়ে আছেন। আজও সে একই কথা বলেছেন, কুহুকে বিয়ে করলে ঐ বাড়িতে পা দিতে পারবেনা নীরব। অনেক আশা নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল ও। কিন্তু ওকে হতাশ করে কথা বলতে রাজি হননি নাইমূর। ব্যপারটা ব্যথিত করেছে ওকে। তবে কী ওর ধারণা ভুল? সত্যিই কোনদিন ওর বাবা-মায়ের ধারণা বদলাবে না? মেনে নেবেনা তারা কুহুক‍ে? এতোটা ভুল চিনেছে ও নিজের জন্মদাতা এবং জন্মদাত্রিকে?

হঠাৎ পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল নীরব। দেখল কুহু দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ফিরিয়ে আবার নিস্তেজ সূর্যের দিয়ে তাকিয়ে থাকল নীরব। কাল ওদের বিয়ে। কিন্তু এখনো কুহুর ওপর থেকে অভিমান পুরোপুরি কমেনি। মেয়েটার বলা সেই কথাগুলো এখনো কষ্ট দেয় ওকে। এভাবে না বললেও হতো।

এসব ভাবনার মাঝেই নীরবের ঠিক পাশে বসল কুহু। নীরব কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নড়লোও না। কুহু আস্তে করে নীরবের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। চমকে উঠল নীরব। তাকাল কুহুর দিকে। কুহুর নিষ্পাপ মুখটা গভীর আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সে আকুতি উপেক্ষা করার সাহস নীরবের নেই। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলালো নীরব। কুহু ইশারা করে বলল, ‘মন খারাপ?’

মাথা নেড়ে না বোঝাল নীরব। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে আরো একটু শক্ত করে ধরল কুহু। নীরব যারপরনাই অবাক হল। কুহু আবার ইশারা করে বলল, ‘আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারবেন আপনি?’
বলে মুখভঙ্গি আরও অসহায় করে ফেলল। নীরব অভিমানি গলায় বলল, ‘পারবোনা জানো বলেই বুঝি এভাবে আঘাত করো?’
‘ভুল হয়ে গেছে।’
‘সেই।’

‘কাল আমাদের বিয়ে। আজও এরকম করবেন?’ চোখ ছলছল করছে কুহুর।
এবার দমল নীরব। মেয়েটাকে কাঁদাতে চায়না ও। কেন, কী অবস্থায় কুহু এসব বলেছে, ঐ পরিস্থিতিতে নিজে না পড়লে হয়তো বোঝা সম্ভব না। একটা মেয়ের জীবনের ভয়ংকরতম সময় পাড় করেছে ও। আজও ঘুমের ঘোরে ছটফট করে ওঠে, কেঁদে ওঠে কুহু। সে ভয়ংকর স্মৃতি স্বস্তি দেয়না ওকে। সেসব কথা জানে নীরব। বহু কষ্টে মেয়েটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে। আর কোন কষ্ট দিতে চায়না ওকে নীরব।

কুহুর চোখে জমা হওয়া অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই ওকে বুকে টেনে নিল নীরব। তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দিয়ে আলতো করে চোখের কোণ মুছে দিয়ে বলল, ‘এইযে মুছে দিলাম। আর কোনদিন কাঁদতে দেবনা তোমাকে।’
কুহুর সবার্ঙ্গে যেন প্রশান্তির ঢেউ ছেঁয়ে গেল। নীরবের স্পর্শে পরিপূর্ণ মনে হল নিজেকে। শান্ত শিশুর মতো মিশে রইল নীরবের বুকে। প্রায় অস্তমিত সূর্যও যেন এই স্বচ্ছ বন্ধনের সাক্ষী হয়ে ধন্য হল।
এভাবে কতটা সময় কেটে গেছে জানেনা ওরা। একসময় নিজেকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নিল কুহু। ইশারায় প্রশ্ন করল, ‘বললেনা মন খারাপ ছিল কেন?’

নীরবের প্রসন্ন মুখটায় আবারও আঁধার নামল। উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাকে ফোন করেছিলাম।’
একটু নড়েচড়ে বসল কুহু। কৌতহলী চোখে তাকিয়ে রইল নীরবের দিকে। নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছাড়ো এসব। এগুলো ভাবলে শুধু মন খারাপ হবে।’

কুহু বুঝল তারা এখনো নিজেদের সিদ্ধান্ত বদলায়নি। কথার বাণে হয়তো আবার কষ্ট দিয়েছে ছেলেটাকে। চাঁপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কুহুর ভেতর থেকেও। নীরব বলল, ‘তুমি ভয় পেওনা কুহু। আমি তোমাকে ছাড়বোনা। কোনকিছুর বিনিময়েই না।’

কুহু নীরবের চোখে চোখ রাখল। ধীরগতিতে ইশারায় বোঝাল, ‘আমার কলঙ্কগুলো এতোটা তুচ্ছ আপনার কাছ‍ে?’
নীরব মুচকি হেসে কুহুর হাতের পিঠে চুমু খেল। ধীর গলায় বলল, ‘যারা চাঁদকে ভালোবাসে, চাঁদের কলঙ্কে তাদের কিচ্ছু যায়আসেনা। আমি আমার নীরবতাকে ভালোবেসেছি। নীরব তার নীরবতাকে হাজারটা কলঙ্কের সাথেও গ্রহন করতে পারবে।’

আরও একবার নীরবের বুকে ঠাঁই নিল কুহু। মনে মনে ভাবল, একদিন না একদিন আপনার পরিবারকে আমি আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব নীরব। কথা দিচ্ছি।

ব্যবসায়ী আক্কাস বেপারীর ঘরের ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বসে চুইঙ্গাম চিবুচ্ছে উচ্ছ্বাস। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখছে বিলাশবহুল ফ্ল্যাটটা। দেখতে দেখতে পায়ে তাল দিচ্ছে সমানতালে। তাতে সাহায্য করছে ভেতর থেকে ভেসে আসা আক্কাসের মরণ চিৎকার। চিৎকারটাকে মিউজিক হিসেবে ব্যবহার করছে ও। ফ্ল্যাটটাতে একাই থাকে ইকবাল। বউবাচ্চা আপাতত দেশের বাইরে। এসব ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই পরিবার নিয়ে বিদেশে সেটেল হয়ে যায়। মাঝেমাঝে দেশে আসে ব্যবসায়ীক কাছে। এবারেও সেজন্যই সেজন্যই এসেছিল আক্কাস বেপারী। সেটাই তার কাল হল।

চিৎকার থামতেই পা দোলানো থামিয়ে দিল উচ্ছ্বাস। সবে চুইঙ্গামটা ফুলিয়েছিল। ফেঁটে গেল। বুঝল আক্কাসের ভবলীলা সাঙ্গ। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল ও। মনেমনে ভাবল, কী দরকার ছিল ভাই এমন ঘাড়ত্যাড়ামী করার? ভালোয় ভালোয় টাকা দিয়ে দিলেই হতো। এখন প্রাণটা কার গেল? তোর না আমার?’
হাতের রক্ত মুছতে মুছতে শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রুদ্র। উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কাজ শেষ?’
প্যান্টের পকেট থেকে একটা চেক বের করে দেখাল রুদ্র। তাতে আক্কাসের সই আছে। উচ্ছ্বাস হেসে বলল, ‘যাক! তবে একটা কথা। কাজটা কিন্তু আমিই করতে পারতাম।’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে পকেটে চেকটা ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘অলরেডি দুটো খু/ন করেছিস।’
কথাটা শুনে ফ্লোরের একপাশে তাকাল উচ্ছ্বাস। আক্কাসের দুজন দেহরক্ষীর লা/শ পড়েছে। খুন দুটো উচ্ছ্বাসই করেছে। তবে রুদ্রর মত অতো হিংস্রভাবে নয়। দুজনের মগজে দুটো বু/লে/ট খরচ করেছে ব্যস। উচ্ছ্বাস একটু আলসেমি ঝেড়ে বলল, ‘কী করব বল? একটু বেশিই তেরিংবেরিং করছিল।’

বাইরে দাঁড়ানো লোকেদের বলে লাশ সরানো এবং জায়গাটা পরিষ্কার করার হুকুম দিয়ে বেরিয়ে এলো রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। জিপে ওঠার পর উচ্ছ্বাস বলল, ‘বাড়ি যাবিতো এখন?’
‘ হ্যাঁ। রাতে কুহু আর নীরবকে হলুদ লাগাবে ওরা। কাল বিয়েরও অনেক কাজ আছে। তাই কাল অবধি বাকী কাজ স্থগিত।’ জিপ স্টার্ট দিয়ে বলল রুদ্র।
‘আমাকে একটু নাজিফাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যাস। ওকে নিয়ে যাবো।’

কিছুক্ষণ চুপ থাকল রুদ্র। তারপর বলল, ‘পরের বিয়েটা কিন্তু তোর। তৈরী থাকিস। আমি নাজিফার ডেলিভারির জন্যে অপেক্ষা করছি শুধু।’
উচ্ছ্বাস হতাশ কন্ঠে বলল, ‘তুই এখনো ওখানেই পরে আছিস?’
‘আমি ঠিক জায়গাতেই আছি।’
কিছু বলল না উচ্ছ্বাস। ঠোঁট ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেবল। এই ছেলে যখন বলেছে তখন ওর বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। তারমানে কী সত্যিই নাজিফা ওর হবে? নাজিফার সন্তান ওকে বাবা বলে ডাকবে? এতো সুখ কী সত্যিই ওর কপালে আছে?

নিজের ঘরে ঢুকে রুদ্র দেখল শাড়ি পড়ছে প্রিয়তা। লাল পেড়ে হলুদ শাড়ী। আঁচলটা বুকে নেই। কুঁচি ঠিক করতে ব্যস্ত মেয়েটা। চুলগুলো কাঠি দিয়ে আটকানো হলেও ছোট চুলগুলো ছড়িয়ে আছে মুখের সামনে। বেশ লাগছে দেখতে। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই দরজা বন্ধ করল রুদ্র। চমকে উঠল প্রিয়তা। রুদ্রকে দেখে স্বস্তি পেলেও দ্রুত আঁচলটা তুলে নিল নিজের বুকে। সেটা দেখে রুদ্র জ্যাকেটটা খুলতে খুলতে বলল, ‘এভাবে লজ্জা পেয়ে ঢেকে ফেলার কিছু নেই। সবকিছু আমার বেশ ভালোভাবেই দেখা। ইন ফ্যাক্ট ছোঁয়াও।’

মুখ কুঁচকে গেল প্রিয়তার, ‘ছিঃ! মুখে লাগাম নেই আপনার?’
রুদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে জ্যাকেটটা হ্যাঙারে ঝোলাতে ঝোলাতে বলল, ‘নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথেও যদি লাগাম টেনে কথা বলতে হয়, তাহলে সন্ন্যাসী হতে ক্ষতি কী?’

কথায় কথা বাড়বে। প্রিয়তা কথা বাড়াল না। কুঁচিটা গুঁজে আচল ঠিক করে নিল। সাজার জিনিসপত্র নিয়ে এখন কুহুর ঘরে যাবে। ওখানেই একসঙ্গে সাজবে ওরা। বের হতে গেলে রুদ্র বলে উঠল, ‘সকালে কোথায় গিয়েছিলে?’
থেমে গেল প্রিয়তা। নিশ্চয়ই রুদ্র জেনে গেছে প্রিয়তা মার্কেট থেকে বেরিয়েছিল। সেটা অবশ্যই জয়ের কাছে থাকা মাইক্রোফোনের মাধ্যমে। কিন্তু ততটাই জেনেছে, যতটা জানলে প্রিয়তার কোন ক্ষতি নেই। প্রিয়তা নিজেকে গম্ভীর রেখে বলল, ‘জানেনই যখন জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

রুদ্র এসে দাঁড়ালো প্রিয়তার সামনে। পকেটে হাত গুঁজে বলল, ‘কী বলেছিলাম আমি তোমাকে?’
‘আমার কাজ ছিল স্কুলে। তাই গিয়েছিলাম। আপনার সব কথা শুনবো এমন কোন প্রতিশ্রুতি আমি আপনাকে দেইনি।’
‘বাড়াবাড়িটা একটু বেশি করছো না?’
প্রিয়তা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘দেখুন, এখন এসব কথার সময় নেই। কুহুকে মেহেন্দি পড়াতে হবে। তারপর হলুদ। অনেক কাজ। এখন এসব নিয়ে ঝামেলা করবেন না প্লিজ। রাতে কথা হবে এটা নিয়ে।’

রুদ্র আর কথা বাড়াল না। পথ ছেড়ে দিল। প্রিয়তা কোনদিকে না তাকিয়ে দরজা খুলে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চাপল রুদ্র। রাতেই এর একটা কিনারা করতে হবে। অতিরিক্ত অবাধ্য মেয়েটা। এ
রপর কিছুক্ষণ পায়চারী করল রুমজুড়ে। ভ্রু কুঁচকে নিজের ফোনটা দেখল। সাব্বির কোন আপডেট দেয়নি এখনো। অথচ এতক্ষণে কিছু না কিছু জানানোর কথা। তারমানে সাব্বির ধরা পড়ে গেছে? মে/রে ফেলেছে ওরা সাব্বিরকে? মিলে ঢোকানোর সময় সবাইকে ভালোভাবে চেক করে ডার্ক নাইট। তাই সাব্বিরের কাছে কোন মাইক্রোফোন দিতে পারেনি রুদ্র। না হলে জানতে পারতো ঠিক কী ঘটেছে ওখানে।

কুহুর ঘরে বসেই মেহেন্দি পড়ানোর কাজটা সেড়ে ফেলছে ওরা। ছাদে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। কুহুকে প্রিয়তা মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। আর নাজিফাকে জ্যোতি। নাজিফা পড়তে চায়নি। জ্যোতি একপ্রকার জোর করে ধরে বেঁধেই পড়াচ্ছে ওকে। গরমে নাজিফার কষ্ট হচ্ছে বলে বারান্দায় বসে মেহেদী দিচ্ছে জ্যোতি।
কুহুকে জিজ্ঞেস না করেই খুব সুন্দরভাবে নীরবের নামটা কুহুর হাতে লিখে দিল প্রিয়তা। তাতে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল কুহুর গালদুটো। প্রিয়তা মিষ্টি হেসে লালচে গাল টিপে দিল।

মেহেদী দেওয়া এক ফাঁকেই নাজিফা জ্যোতিকে বলল, ‘আপনি এখনো সেটেল হওয়ার কথা ভাবছেন না কেন আপু?’
জ্যোতির হাত থেমে গেল। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে মেহেদী দেওয়ায় মনোযোগ দিয়ে বলল, ‘সেটেলইতো আছি।’
‘আমি বিয়ের কথা বলছি।’
‘বিয়ে না করলে জীবন চলেনা বুঝি?’

‘চলে। কেন চলবে না? কিন্তু জীবনে চলার পথে একজন সঙ্গী সবারই প্রয়োজন হয়। এইজন্যইতো সৃষ্টিকর্তা সবকিছু জোড়া সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকেরই জীবনে চলার পথে একজন সঙ্গী দরকার আপু।’
জ্যোতি কিছুক্ষণ চুপ থাকল। নীরবে কিছুক্ষণ মেহেদী দিয়ে গেল। চোখে জল এলোনা ওর। রাতের আঁধারে গোপনে কাঁদতে কাঁদতে অশ্রুও বোধ হয় শুকিয়ে গেছে। নাজিফা বলল, ‘আমার কথায় কষ্ট পেলেন?’

জ্যোতি মলিন একটুকরো হেসে বলল, ‘না। তবে একটা কথা কী বলোতো, জীবনে যেমন একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। ঠিক তেমনই সেই সঙ্গীকে ঠকানোটাও অন্যায়। আমার মন, মস্তিষ্ক, শরীর, চেতনা সবকিছুই রুদ্রর কাছে সমর্পিত হয়ে আছে নাজিফা। আমি অন্যকাউকে জীবনে কীভাবে জড়াবো বলো? তাকে দেওয়ার মতো যে আমার কাছে কিচ্ছু নেই। তাকে ঠকানো হবেনা? জেনেশুনে এতোবড় পাপ কীকরে করি বলো?’

‘চেষ্টা করেছিলেন?’
‘করেছিলাম। বহুবার করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। অন্যকাউকে মনের একাংশও দিতে পারিনি আমি। রাশেদ বাবা বলেছিলেন, “যদি কখনও মনে হয় কাউকে ভালোবাসতে পারবি। তাকে জীবনে জড়ালে ঠকানো হবেনা। তাহলে জীবনটা নতুন করে শুরু করিস।” কিন্তু সেরকম কিছুই আমার মনে হয়নি। কখনও হয়নি।’

‘কাউকে দেখেই হয়নি?’ কৌতূহলি হয়ে জানতে চাইল নাজিফা।
জ্যোতি ঠোঁটে সেই হাসিটুকু ধরে রেখেই বলল, ‘না। আমার অফিসের এক কলিগ, আজাদ ভাই। সে এখনো পরে আছে আমার পেছনে। দেখা হলেই প্রেম নিবেদন করে। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু আমার মন সেদিকে জায়না নাজিফা। সে যেন চিরকালের মতো বন্দি পড়ে আছে রুদ্রর কাছে। কিন্তু সে অন্যকারো স্বামী। তার বুকে অন্যকারো ঠাঁই। কথাটা ভাবলেই আমার দমবন্ধ হয়ে আসে জানো? মরে যেতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসার এতোটা যন্ত্রণা যেন খোদা আর কাউকে না দেন।’
বলতে বলতে গলা ধরে এলো জ্যোতির। নাজিফার চোখজোড়াও ছলছল করছে। একতরফাভাবে এভাবেও ভালোবাসা যায়! এতোটা স্বার্থহীন প্রেম হতে পারে। লম্বা শ্বাস ফেলে জ্যোতি বলল, ‘একটা কথা বলি?’

‘বলো?’ নিজেকে সামলে বলল নাজিফা।
‘তুমিও নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নাও নাজিফা। উচ্ছ্বাস এখনো অপেক্ষা করে তোমার জন্যে। ছেলেটাকে আর কষ্ট দিওনা। নিজেওতো কষ্ট পাচ্ছো বলো?’
‘এটা হয়না আপু।’

‘কেন হয়না? তুমি বিধবা বলে? তোমার গর্ভে অন্যকারো সন্তান আছে বলে? আচ্ছা, যদি উচ্ছ্বাস কোনভাবে পঙ্গু হয়ে যেতো? কিংবা অন্যকোন দুর্ঘটনা হতো ওর সাথে? তুমিও ওকে নিজের অযোগ্য ভাবতে? ছেড়ে দিতে ওকে? নিশ্চয়ই না। তাহলে উচ্ছ্বাসের ভালোবাসাকে কেন ছোট করছো?’

নাজিফা কিছু বলল না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নিচু করে বসে রইল। জ্যোতি নাজিফার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তুমিইতো বলেছিলে সবার একজন জীবনসঙ্গী প্রয়োজন। যাকে আমি ভালোবাসি সে অন্যকারো। তাকে না পাওয়ার দহনে আমি প্রতি নিয়ত পু/ড়ে ম/রছি। কিন্তু তুমি যাকে ভালোবাসো সে তোমারই নাজিফা। তাকে এভাবে দূরে ঠেলে দিওনা। নয়তো পড়ে আফসোস করেও কূল পাবেনা।’
নাজিফা পাথরের মতো বসে ভাবল জ্যোতির বলা কথাগুলো। কী করবে ও? কী করা উচিত? সিদ্ধান্ত নিতে সত্যিই বেশি দেরী করে ফেলবে নাতো?

খুবই ছোট আয়োজন করে হলেও বেশ আনন্দময় হল নীরব আর কুহুর পায়ে হলুদ। কিছুক্ষণের জন্যে আমের পরিবারের সকলে ভুলেই গেল সব বিষাদ, দুঃখ। প্রথমে নীরবের গায়ে হলুদ হয়। তারপর কুহুর। রুদ্র যখন নীরবকে হলুদ লাগাতে গেল। বেচারার মনে মনে সে কী ভয়! যেন সাক্ষাৎ বাঘ ছুঁয়ে দিচ্ছে ওকে।

কোন ঝামেলা ছাড়া সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয় ওদের গায়ে হলুদ। সব গোছগাছ করে যে যার যার ঘরে বিশ্রাম নিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখনই প্রিয়তার ফোনে মেসেজ টোন বেজে ওঠে। মেসেজটা দেখে চমকে ওঠে প্রিয়তা। চোখ বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। মেসেজটা তনুজার। জীভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অস্থিরভাবে চারদিকে তাকায় প্রিয়তা। জ্যোতিকে দেখতে পেয়ে সেদিকে ছুটে যায় ও। জ্যোতির সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘জ্যোতি আপু? ভাইকে দেখেছো?’
জ্যোতি বলল, ‘হ্যাঁ নাজিফাকে দিয়ে আসতে গেছে ও। কেন বলোতো?’

চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। তারপর বলল, ‘না, আসলে কিছু জিনিস রাখতে দিয়েছিলাম। সমস্যা নেই রাতে পেলেও চলবে।’
জ্যোতি মাথা নেড়ে চলে গেল নিজের ঘরে। প্রিয়তাও অস্থির মনে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

ঘরে গিয়েই অস্থিরভাবে পায়চারী শুরু করল প্রিয়তা। তনুজা মেসেজ করেছে, আজ রাতেই উ/চ্ছ্বা/সকে খুন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লান এক্সিকিউট করবে ওরা। শওকত, সম্রাট, শান, করিম, পলাশ মিলে সেভাবেই সব সাজিয়েছে। মেসেজটা দেখেই মাথায় রীতিমতো বজ্রপাত হয় প্রিয়তার। মাথা বিদ্যুৎ এর গতিতে ছুটছে। এই রাতে কোনভাবেই ওকে বাড়ি থেকে বের হতে দেবেনা রুদ্র। হাজারটা প্রশ্ন করবে। সবচেয়ে বড় কথা সন্দেহ করবে। যেটা প্রিয়তা কোনভাবেই হতে দিতে পারবেনা।

‘এভাবে ঘরজুড়ে পায়চারী করছো কেন? কী হয়েছে?’
রুদ্রর হঠাৎ ডাকে চমকে ওঠে প্রিয়তা। ঘুরে তাকায় রুদ্রর দিকে। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থাকলেও মগজে একটাই কথা দৌড়চ্ছে ওর। আটকাতে হবে। যেকোনভাবে হোক ব্যপারটা ওকে আটকাতে হবে।

অনুষ্ঠানের সব ঝামেলা শেষ করে নাজিফাকে বাড়ি দিয়ে আসার জন্যে বের হয় উচ্ছ্বাস। হঠাৎই ওরা দুজন কেমন চুপ হয়ে গেছে। দুজনেই গভীরভাবে ভাবছে তাদের আগত অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে। তাই পুরোটা সময় দুজনেই চুপ ছিল। মাঝেমাঝে আড়চোখে দেখেছে একে অপরকে। নাজিফাকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে, ওর মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে আসে উচ্ছ্বাস। গাড়িটা নাজিফাদের বাড়ির সামনেই রেখে যায়। কাল নাজিফাকে নিতে আসার সময় নিয়ে যাবে। মনটা ভালো নেই। তাই আজ পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। প্যান্টের পেছনে হাত দিয়ে চেক করে নিল নিজের পি/স্ত/লটা আছে কি-না। আত্মরক্ষার জন্যে প্রয়োজন।

তিনরাস্তার নীরব এক মোড়। আমের ভিলা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটারপথ। মানুষের আনাগোনা এখন একদমই নেই। মোটা গাছ আর পিলারের আড়ালে অবস্থান নিয়েছে ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোলের মোট আটজন। ফোনের ওপাশ থেকে তাদের লীডারকে নির্দেশনা দিচ্ছে সম্রাট।

পরিকল্পনা খুব পরিষ্কার। নাজিফাদের বাড়ির সামনে থাকা লোক খবর দিয়েছে উচ্ছ্বাস পায়ে হেঁটে আসছে। গাড়িতে আসলে প্রথম গু/লিটা করা হতো টায়ারে। নামতে বাধ্য করা হতো উচ্ছ্বাসকে। কিন্তু উচ্ছ্বাস হেঁটে আসছে। তাই পরিকল্পনা আরও সরল। মোড়ের ঠিক মাঝামাঝি আসার পরেই দুপাশে থাকা দুজন প্রায় একইসঙ্গে গু/লি করবে উচ্ছ্বাসের দুটো পায়ে। স্বভাবতই উচ্ছ্বাস নিজের পি/স্ত/ল বের করতে চাইবে। তখন গু/লি করা হবে হাতে। যখন উচ্ছ্বাস একদম অকেজো হয়ে যাবে। এরপর ওরা যাবে উচ্ছ্বাসের কাছে। ছু/রি, চা/পা/তি দিয়ে খুন করবে উচ্ছ্বাসকে। আর এই পরিকল্পনা মাথাতে রেখেই ওরা অপেক্ষা করছে উচ্ছ্বাসের আসার।

ওদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আসতে দেখা গেল উচ্ছ্বাসকে। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে অলস পায়ে এগিয়ে আসছে সে। সবাই ভালোভাবে নিজের পজিশন নিল। সম্রাটকে জানানো হলো আসছে উচ্ছ্বাস। অপাশ থেকে সম্রাটও উত্তেজিত হল। এবার তাহলে ম/রবে শালা!

ওদের লীডার ঠিকভাবে পজিশন নিয়ে পি/স্ত/ল তাক করল। আঙুল রাখল ট্রিগারে। উচ্ছ্বাসও হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলো মোড়টাতে। লীডার ট্রিগারে চাপ দেবে ঠিক তখনই উচ্চস্বরে কেউ ডেকে উঠল, ‘ভাই!’
থেমে গেলেন লীডার। মনোযোগ নষ্ট হল। চমকে উঠলেন বাকি সবাইও। তখনই ওখানে দেখা গেল প্রিয়তাকে। এগিয়ে আসছে উচ্ছ্বাসের দিকে। লীডারসহ বাকি সাতজনই ভালোভাবে চেনে প্রিয়তাকে। বোকার মতো তাকিয়ে রইল ওরা।
প্রিয়তাকে দেখে উচ্ছ্বাসও অবাক হল। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘বউমণি! এতোরাতে তুমি এখানে কী করছো?’

প্রিয়তা মুখ গোমড়া করল। অভিমান আর রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল, ‘তোমার ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে এসছি। ফিরে যাবো আমি আমার ফ্ল্যাটে। কী ভাবে কী ঐ লোকটা নিজেকে? সবকিছু ওনার কথাতে হবে?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। রিল্যাক্স! রুদ্র জানে তুমি বেরিয়ে এসেছো?’

‘এতক্ষণে জেনেছে নিশ্চয়ই।’
‘সেড়েছে! তোমার বর জীপ নিয়ে কতদূর যেন চলে এসেছে। চলো, চলো বাড়ি চলো। দেখ কাল বিয়ে। বিয়ের পর যেখানে খুশি যেও। এখন যেতে নেই।’
‘কিন্তু..’
‘নো মোর কিন্তু। কুহু কষ্ট পাবেতো। ঐ গাঁধা রুদ্রর জন্যে আবার কুহুকে কষ্ট দেবে তুমি? বোকা মেয়ে। চলো!’

অপাশ থেকে সম্রাট হুংকার দিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে কী? থেমে গেলি কেন তোরা?’
লীডার ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার গু/লি করতেই নিচ্ছিলাম কিন্তু.. রানি ম্যাডাম ওখানে চলে এসেছে।’
সম্রাট চমকে উঠল, ‘রানি!’

‘হ্যাঁ স্যার।’
রাগে দাঁতে দাঁত পিষল সম্রাট। এই ভয়টাই পাচ্ছিল ও। গজগজ করতে করতে বলল, ‘মিশন এবোট।’
বলে কলটা কেটে দিল সম্রাট। প্রচণ্ড রাগে আছড়ে ফেলল রমের এক কোণে। মেয়েটা এমন কেন করছে? হাতে চলে আসা খেলাটা বিগড়ে দিল। আসলে কী চাইছেটা কী রানি?

এদিকে দলের লীডার আরেকবার ওদিকে তাকিয়ে দেখল ফেরার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে উচ্ছ্বাস আর প্রিয়তা। এতক্ষণে উচ্ছ্বাস প্রিয়তাকে ফিরে যেতে রাজি করিয়ে ফেলেছে। হঠাৎই ঘাড় ঘুরিয়ে লীডারের দিকে তাকাল প্রিয়তা। চোখ দুটো হিংস্রতায় জ্বলজ্বল করছে। যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে লীডারকে। শুকনো ঢোক গিলল লীডার।

হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দিয়ে লীডারকে কে/টে পড়ার হুকুম দিল প্রিয়তা। কোনমতে বাকীদেরকে ‘মিশন এবোট’ জানিয়েছে কেটে পড়ল সবাই।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। ভাগ্যিস তনুজার ভাই অপুকে কৌশলে ডার্ক নাইটের চা-নাস্তা বানানোর কাজে ঢুকেছিলো ও। নয়তো আজ ভয়ংকর অঘটন ঘটে যেতো। ব্যপারটা আটকাতে পেরে আপাতত নিশ্চিন্ত হল ও।

এদিকে দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়েছে শওকত মীর্জার কপালে। কিছুক্ষণ আগেই প্রিয়তার নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিল তার ফোনে। যাতে লেখা আছে, ‘আজ রাত তিনটায় তোমরা পাঁচজনই ডার্ক নাইটের অফিসে থাকবে। যদি একজনও বাদ যায়, আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা। কথাটা মাথায় রেখো।’
বুঝল মেয়ে জেনে গেছে ব্যপারটা। কিন্তু রুদ্রর চোখে ধুলো দিয়ে এতো রাতে বের হবে কীকরে? তবে বলেছে যখন আসবে প্রিয়তা। এইটুকু চেনে সে নিজের মেয়েকে।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৫ শেষ অংশ

এবার কীকরে সামলাবে সেটাই ভাবছে শওকত। এমনিতেই পুরোনো কিছু ব্যপার নিয়ে মনে মনে ভয়ানক ক্ষেপে আছে প্রিয়তা। সময় আর পরিস্থিতির কারণে সেগুলো ভেতরে চেপে রেখেছে। তবে ওর চোখে সেসবের জন্যে সুপ্ত কিন্তু ধ্বংসাত্মক রাগ দেখতে পায় শওকত। এখন না জানি সব একেবারে বেরিয়ে আসে। যেভাবেই হোক ব্যপারটা সামলাতে হবে। নয়তো তার মনে জাগা সেই ভয়টা সত্যি হতে বেশি দেরী নেই।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৭

2 COMMENTS

  1. শুভ নববর্ষের অনেক শুভেচ্ছা। দীর্ঘ এক মাস অপেক্ষার অবসান ঘটলো আজ। শুধুমাত্র প্রিয়তার আসল সত্য জানার পর রুদ্র প্রতিক্রিয়া কেমন হয় সেটা জানার অপেক্ষায় আছি। প্রিয়তার মধ্যে এখনো অনেক রহস্য আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। লেখিকার কথা আর কি বলবো —- অসাধারণ একটি গল্প। আপনার গল্প লেখার
    এক অসামান্য গুন আছে, যা প্রতি পর্বে বোঝা যায়। পরের পর্ব একটু তাড়াতাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করবেন।

Comments are closed.