অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬১

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬১
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

রাশেদ আমেরের করুণ অনুরোধ অবজ্ঞা করার ক্ষমতা নেই প্রিয়তার। ভারী নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। যে মানুষটার দৃঢ়, বজ্র কন্ঠস্বরে গোটা আমের ভিলা কেঁপে ওঠে। যার প্রতিটা শব্দ, আমের পরিবারের কাছে আদেশ। সে এমন আকুল কন্ঠে অনুরোধ করছে? সময়ের চক্র এ কোন জায়গায় এনে দাঁড় করালো ওদের!

প্রিয়তা এগিয়ে গেল রাশেদের দিকে। রাশেদের পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙ্গে বসল। কিছু না বলে তাকিয়ে রইল। রাশেদ এখনো চোখ বন্ধ করে আছেন। চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, ‘এখন শরীর কেমন আছে তোমার?’
‘ভালো বাবা।’
‘ভালো থাকতেই হবে। তোমার মধ্যে আমের পরিবারের বংশধর বড় হচ্ছে। সেটা মাথায় রেখো। ওকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনার দায়িত্ব তোমার।’
‘জ্বী।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাশেদ চুপ করে গেলেন। প্রিয়তাও নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। কিন্তু মনের মধ্যে ঝড় চলছে ওর। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। অস্বস্তিকর একটু নীরবতার পর রাশেদ বললেন, ‘জানিস রুদ্র যখন ওর মায়ের গর্ভে ছিল। ওর মা সবসময় ভয়ে থাকতো। আমাকে বারবার বলতো তার নাকি মনে হয় সে ডেলিভারীর সময় মারা যাবে।’

হঠাৎ সম্বোধনটা পাল্টে ফেলল রাশেদ। একটু হাসলেন। চোখ মেলে তাকালেন। সিলিং এর দিকে শূণ্য দৃষ্টি ফেলে বললেন, ‘কিন্তু কুহুর সময় ঠিক উল্টোটা ছিল। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিল সে তখন। কিন্তু অঘটনটা কুহুর জন্মের পরেই ঘটল।’
বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। প্রিয়তা তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। কেবল শুনে যেতে ইচ্ছে করছে। রাশেদ বলতে শুরু করলেন, ‘রুদ্র ওর মাকে ভীষণ ভালোবাসতো।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়তো ও ওর মাকে বেসেছিল। প্রচন্ত দুষ্টু, প্রাণবন্ত ছিল ও। সম্পূর্ণ স্বভাবজুড়ে মায়ের কোমলতাটুকুই ছিল। ওর মা বেশ খুশি হয়ে বলতো, দেখবেন আমার ছেলেই আপনাদের বংশ পরম্পরার চলে আসা এই পাপকাজ ঘোচাবে। কিন্তু ওর মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ওর মধ্যকার সমস্ত কোমলতা নষ্ট হয়ে গেল। সঙ্গে ওর মায়ের স্বপ্ন। তাতে আমার ভূমিকাটাই ছিল মূখ্য। সদ্য মা হারা কোমল হৃদয়ে যেই বারুদ জন্মেছিল। তাতে আগুন জ্বালানোর কাজটা আমিই করেছিলাম।’

বলে থামলেন রাশেদ। যেন একটু জিরিয়ে নিলেন। তারপর আবার কথার খেই ধরে বললেন, ‘কিন্তু আমার তৈরী করা শক্ত সেই বলয়কে ভেদ তুই করেছিলি। তোর অনুপস্থিতিতে রুদ্র ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়ল। প্রথমবার। অবাক হয়েছিলাম আমি। রাশেদ আমেরের তৈরী করা বলয় ভেদ করে যে রুদ্রর হৃদয়ে যে পৌঁছতে পেরেছে, সে সাধারণ কেউ হতে পারেনা। আর সবটা বিবেচনা করেই আমি তোকে রুদ্রর জীবনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কেন জানিস?’

প্রিয়তা এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। শেষ প্রশ্নটা শুনে হুশ ফিরল। একহাতে চোখ মুছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল রাশেদের দিকে। রাশেদ বললেন, ‘রুদ্রর মায়ের পর তুই একমাত্র নারী যে ওকে প্রভাবিত করতে পেরেছে এবং পারে। তোর সঙ্গে প্রথমবার দেখা করে মনে হয়েছিল তুই রুদ্রর জন্যেই তৈরী। আর তাই রুদ্রর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোকে রুদ্রর জীবনে নিয়ে এসেছিলাম আমি। কিন্তু আজ রুদ্রর ভয়টাই সত্যি হচ্ছে। আজ আমের ভিলার প্রত্যেকটা মানুষের প্রাণ সংকটে।

যেকোন মূহুর্তে যেকারো ওপর আঘাত আসতে পারে। তোর আর তোর অনাগত সন্তানের ওপরেও। সে হিসেবে আমি তোরও অপরাধী। আমি না চাইলে তোকে এই অভিশপ্ত জীবনে আসতে হতোনা। আমায় ক্ষমা করতে পারবি?’
প্রিয়তা নিজের অজান্তেই রাশেদের কোলের ওপর রাখা হাতটার ওপরে নিজের দুটো হাত রাখল। কান্নাভেজা গলায় বলল, ‘আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করবেন না বাবা। সবকিছুর জন্যে নিজেকে এভাবে দায়ী করবেন না। সৃষ্টিকর্তার তৈরী নিয়তির বেড়াজালে আমরা সকলেই আবদ্ধ। কে, কখন, কোথায় গিয়ে পড়বে, কে কার জীবনে কী নিয়ে আসবে সেটাতে স্বয়ং ওপরওয়ালা ঠিক করেন। আমরাতো নিমিত্ত মাত্র। আমার আপনার ছেলের জীবনে আসা, এ বাড়িতে বউ হয়ে আসাটাই হয়তো নিয়তি ছিল। আপনার ক্ষমা চাওয়ায় কোন কারণ নেই।’

লম্বা একটা শ্বাস ফেললেন রাশেদ। আবার চোখজোড়া বুজে নিয়ে বললেন, ‘ঘরে যাও। এসময়ে রাতজাগা ঠিক নয়।’
‘আপনারও এখন ঘুমানো উচিৎ বাবা। শুয়ে পড়ুন।’
‘আমি ঠিক সময়ে শুয়ে পড়ব। তুমি যাও।’ আবার সেই ভারী বজ্র কন্ঠস্বর।

প্রিয়তা আর কিছু বলল না। ওভাবেই বসে থেকে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। রাশেদ চোখ বন্ধ করে, গায়ে ঢিল দিয়ে দিয়েছেন। প্রিয়তার চোখ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। চোখ মুছে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। প্রিয়তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে রুদ্র আর দাঁড়াল না। নিজেকে সামলে দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেল। আরও কয়েক সেকেন্ড রাশেদের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকাল। অবাধ্য চোখের জলগুলো আবার ভীড় করল দুচোখে। শুধু পা দুটো নয়। গোটা জীবনটা ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে।

ঘরে ঢুকে প্রিয়তা দেখল রুদ্র বিছানার হেডরেস্টে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। এক হাত উল্টো করে কপালের ওপর রাখা। প্রিয়তা স্থির হয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর আস্তে আস্তে রুমে গিয়ে বসল রুদ্রর পাশে। কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কফি আনব?’

রুদ্র চোখ খুলে তাকাল প্রিয়তার দিকে। মেয়েটা অদ্ভুতভাবে বোঝে ওকে। ঠিক বুঝতে পেরেছে আজ রুদ্র কিছুতেই ঘুমাবেনা। কিন্তু কফি খাওয়ার ইচ্ছাটাও নেই আজ রুদ্রর। তাই না বোধক মাথা নাড়ল। প্রিয়তা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎই রুদ্র প্রিয়তার পেটের দিকে ঝুঁকে সময় নিয়ে একটা চুমু খেল। পেটের ওপর মুখ গুঁজে বসে রইল অনেকটা সময়। প্রিয়তা আল্তো করে হাত রাখল ওর মাথায়। কিছু সময় পর রুদ্র আবার উঠে বসল নিজের জায়গায়। প্রিয়তার একমুহূর্তর জন্যেও চোখ সরালোনা রুদ্রর দিক থেকে। আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘বাবাকে খুব ভালোবাসেন তাইনা?’

রুদ্র তাকাল প্রিয়তার দিকে। চেহারায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও প্রিয়তা বুঝল ঝড় চলছে রুদ্রর মনে। রুদ্র প্রিয়তার থেকে চোখ সরিয়ে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘মা চলে যাওয়ার পর আমার একমাত্র অবলম্বন, আস্থা, ভরসার জায়গা ছিলেন আমার বাবা। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর হঠাৎই বাবার রুক্ষ ব্যবহারে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সকলের বলা কথাটাই সত্যি মনে হল। মা মারা গেলে বাবা বদলে যায়। কথাটায় বিশ্বাস হতে লাগল।

দিনের পর দিন বাবার কঠোরতা যত বাড়ছিল। ওনার ওপর আমার চাপা রাগ ততটাই বাড়ছিল। খুব রাগ হতো বাবার ওপর। মনে হতো ভালোবাসেনা উনি আমায়। একদম না। একদিন বাবা একটু বেশিই মা/রলেন আমাকে। স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে মা/রামা/রি করে আঘা/ত পেয়ে এসেছিলাম বলে। আমাকে অন্যেরা মারার সুযোগ কেন পেল? এতোটা দুর্বলতা আমায় মানায় না। মা/র খেয়ে সেদিন প্রচন্ড জ্বর চলে এলো আমার। কিন্তু বাবা দেখতেও এলেননা। রাগটা আরও বাড়ল। বাড়তেই থাকল। ভেবে নিলাম কোনদিন ঐ লোকটাকে আর বাবা বলে ডাকব না।

কিন্তু সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর খেয়াল করলাম কেউ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। লোকটা কে জানো? আমার বাবা। সেইরাতে খুব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম বাবাকে। ওনার চোখের পাপড়ি ভেজা ছিল। মানে কাঁদছিল। আমার ক্ষ/তে মলম লাগানো ছিল। সেদিন বুঝেছিলাম বাহির থেকে এই তীব্র কঠোর রাশেদ আমের ভেতরে ঠিক কতোটা কোমলতা পুষে রেখেছেন আমার জন্যে। বিশ্বাস করো, সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম ওনার ভালোবাসা। আর এটাও বুঝেছিলাম যে, আমিও ভালোবাসি আমার বাবাকে। ভীষণ ভালোবাসি। যদিও কোনদিন বলিনি ওনাকে। তবে এটা সত্যি। ওনার একটা কথায় যেমন আমি প্রাণ নিতে পারি। ঠিক সেভাবেই ওনার জন্যে প্রাণ দিতেও পারি।’

এইটুকু বলে থামল রুদ্র। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, ‘সেই শক্ত, দৃঢ়, বজ্রকন্ঠি মানুষটাকে আজ এভাবে দেখতে হবে কল্পণাও করিনি আমি প্রিয়। আমার ভেতরটা প্রচন্ড ভারী লাগছে। রাশেদ আমের এভাবে গুড়িয়ে যেতে পারেন না।’
প্রিয়তা নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। কেমন একটা দমবন্ধকর পরিবেশ।

মনে হচ্ছে একফোঁটাও প্রাণবায়ু নেই কোথাও। অকারণ যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল প্রিয়তা। কাতর কন্ঠে বলল, ‘আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন? আমি অসুস্থ বোধ করছি।’
রুদ্র ভালো করে তাকাল প্রিয়তার দিকে। তারপর টেনে এনে জড়িয়ে ধরল নিজের বুকে। এসময় এমনিতেই নানারকম অসুস্থতা দেখা দেয়। তারওপর রীতিমতো ঝড় বইছে মেয়েটার আশেপাশে।
ওর নিজেরও কিছু ভালো লাগছেনা। আজ আর দলীয় বিষয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করছেনা। পরিকল্পনা সাজানোয় মস্তিষ্ক কাজ করছেনা। মন-মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল একজনের চিন্তাই ঘুরছে। বাবা।

ঘুম নেই আজ উচ্ছ্বাসের চোখেও। ব্যালকনির ফ্লোরের নিচে বসে। শূণ্য দৃষ্টি। হাতে জ্বলন্ত সিগারেটে লম্বা ছাই জমে আছে। অনেকক্ষণ টানা হচ্ছেনা। ফোনের রিংটোনে ভাবনায় ছেদ ঘটল উচ্ছ্বাসের। হাতে নিয়ে দেখল নাজিফার কল। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল। ধরবে কি-না ভাবতে ভাবতে কেটে গেল কলটা। উচ্ছ্বাস তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের দিকে। আবার বাজল। উচ্ছ্বাস সিগারেটে জমা ছাইটা ঝেড়ে রিসিভ করল কলটা। সংযোগ স্থাপন হলেও কেউ কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দই শোনা গেল কেবল। উচ্ছ্বাস নিজেই বলল, ‘কিছু বলবে?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাজিফা। একটা সময় ছিল অকারণে ছুটে চলে আসতো একে অপরকে দেখতে। অপ্রয়োজনীয় কত কথায় গোটা রাত পাড় হয়ে যেতো। অথচ আজ একটা কল করতেও কারণের প্রয়োজন! সত্যিই কী বিচ্ছেদ এতোটাই দূরে সরিয়ে দেয় প্রিয় মানুষটাকে নিজের কাছ থেকে?
‘নাজিফা?’

উচ্ছ্বাসের ডাকে হুঁশ এলো নাজিফার। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ওদিকের অবস্থা কেমন?’
‘সেটা জ্যোতি বা বউমণিকে কল করেও জানা যেতো।’
নাজিফা কষ্ট পেল। উচ্ছ্বাস ওকে এড়িয়ে চলতে চায়। সেটা বোঝে ও। মলিন হেসে বলল, ‘বেশ। আর করব না। এবার বল, কী অবস্থা?’

‘অতিরিক্ত শান্ত। কোনকিছুই ভালো মনে হচ্ছেনা আমার। নীরব আসায় কুহুর জন্যে চিন্তা কিছুটা কমলেও আরও কিছু ব্যপার ভেতরটাকে যেন কামড়ে ধরছে।’
‘রাশেদ বাবার কথা বলছো তাইনা?’
‘হুম।’

‘আজকে রাশেদ বাবাকে কেন জানি আমার অদ্ভুত লেগেছে উচ্ছ্বাস। মানুষটাকে এরকম কোনদিন দেখিনি আমি।’
‘আমিও। আজ সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে নিয়ে অনেক্ষণ কথা বলল। এতো কথা শেষ কবে আমার সাথে বলেছিল আমার নিজের ও মনে নেই।’
‘কী বলল?’

চুপ হয়ে গেল উচ্ছ্বাস। মনে করল সন্ধ্যায় রাশেদের বলা কথাগুলো। হঠাৎ ওকে ঘরে ডাকলেন রাশেদ। তখন চা খাচ্ছিলেন উনি। ওকে বসতে বলে প্রথমে কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বললেন। কেমন আছে, এতো রাতে বাড়ি কেন ফেরে, নেশা করা কমাচ্ছেনা কেন ইত্যাদি। অবশেষে বললেন, ‘বয়সতো কম হলোনা। বিয়ের ব্যপারে কী ভাবছিস?’
চমকে উঠল উচ্ছ্বাস। কিন্তু কিন্তু বলল না। ওকে চুপ থাকতে দেখে রাশেদ আবার বললেন, ‘নাজিফাকে খুব ভালোবাসতি।তাইনা?’

দ্বিতীয়দফা চমকে উঠল উচ্ছ্বাস। এবার চেষ্টা করেও কথা বলতে পারল না। রাশেদ বাবা এসব জানতেন! রাশেদ মৃদু হেসে বলল, ‘যাকে কোলেপিঠে করে বড় করলাম। তার এইটুকু খোঁজ রাখব না। প্রেমটাতো রাস্তার চায়ের দোকান আর পার্কের মতো খোলা জায়গাতেই করতি।’

উচ্ছ্বাস খানিকটা লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে ফেলল। রাশেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কী অদ্ভুত দেখতো। নিজের পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের জীবনটা দুর্বিষহ করে দেওয়ার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরক্ষভাবে আমিই দায়ী। রুদ্রর প্রিয় মানুষটাকে ওর জীবনে এনে দিতে পারলেও তোকে এনে দিতে পারিনি। কারণ দুজনের পরিস্থিতিটা ভিন্ন ছিল। আমায় ভুল বুঝিসনা।’

উচ্ছ্বাস হতভম্ব হয়ে গেল। রাশেদ আমেরের মুখে এধরণের কথা প্রত্যাশিত নয়। ও অবাক হয়েই বলল, ‘এসব কেন বলছেন রাশেদ বাবা! আপনি_’
হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় রাশেদ ওকে। আজ যেন নিজের জীবনের সব অব্যক্ত কথাগুলো বলতে চান উনি। বললেন, ‘তুই দলে থাকাকালীন নাজিফা তোকে বিয়ে করতো না। আর আমি এটাও জানি আমাকে ছেড়ে নাজিফাকে বেছে নেওয়ার কথা ভাবতিনা তুই। আমি জোর করলেও না। তাই ইচ্ছে করেই নীরব ছিলাম।’

উচ্ছ্বাস একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে, ‘এসব নিয়ে আমি আর ভাবিনা রাশেদ বাবা। আমি ঠিক আছি। ওগুলো সব অতীত।’
রাশেদ আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে কোমল কন্ঠে বললেন, ‘নাজিফা মেয়েটা বড্ড একা। অসহায়। অল্প বয়সের ভীষণ কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। তুই যদি সব ছেড়ে দিয়ে আবার ওর কাছে ফিরতে চাস। আমার মনে হয়না ও তোকে ফেরাবে। জীবনে সুখে থাকার অধিকার সবার আছে। ঐ মেয়েটারও আছে। আর তোরও। তাই বলছি, আমার দিক থেকে তুই সম্পূর্ণ মুক্ত।’
উচ্ছ্বাস কিছু বলেনি। কারণ ও জানে এটা সম্ভব না। জীবন থাকতে না ও ওর রাশেদ বাবাকে ছাড়তে পারবে। আর না নাজিফার জীবনে ফিরতে পারবে। এধরণের অসম্ভব কল্পনা করে আর দুঃখ পেতে চায়না উচ্ছ্বাস।

‘বললে না কী বলল?’
নাজিফার কথায় চমকে উঠল উচ্ছ্বাস। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘সে অনেক কথা।’
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা চলল। হঠাৎ চাপা কন্ঠে নাজিফা বলল, ‘আবারও বলছি, এবার বিয়ে করে জীবনটা গুছিয়ে নাও উচ্ছ্বাস। এভাবে আর কত?’
উচ্ছ্বাস দম কেমন বন্ধ হয়ে এলো। তবুও কন্ঠে কৌতুক ঢেলে বলল, ‘কী ব্যপার বলোতো? আবার আমার গলায় ঝোলার শখ হয়েছে না-কি? বিয়ে করবে আমায়?’

নাজিফার অবস্থাও ব্যতিক্রম হল না। বুকের ভেতর যেন কেউ হাতুরির আ/ঘাত করল। কিন্তু নিজেও কৌতুক করতে ছাড়ল না। একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘লজ্জা করেনা! একজন গর্ভবতী মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছো?’
দুজনেই একসঙ্গে শব্দ করে হেসে উঠল। হাসি যেন থামতে চায় না। হাসতে হাসতে কখন দুজনের চোখেই জল চলে এসেছে। টের পেলনা ওরা। হাসি থামিয়ে হঠাৎ উচ্ছ্বাস বলল, ‘খবর নিতে ফোন করেছিলে, নেওয়া হয়ে গেছে। এবার রাখি?’
‘ভালো থেকো।’

‘তুমিও।’
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বুকের মধ্যে তীব্র চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল নাজিফা। কী অসহ্য ব্যথা। এরকম ব্যথা নিয়েও বেঁচে থাকা যায় সেটা আগে জানতো না ও। নিজের পেটে হাত রেখে আর দু ফোঁটা চোখের জল ফেলল ও। এতো দুঃখের মাঝে এই সুখটুকুই হয়তো বাঁচিয়ে রেখেছে ওকে।

চোখ মুছে আরও একটা সিগারেট জ্বালাল উচ্ছ্বাস। সিগারেট টানার অভ্যাস আগেও ছিল। কিন্তু নাজিফার সঙ্গে সেই হৃদয়বিদারক বিচ্ছেদের পর যখন আবার সিগারেট খাওয়া শুরু করল, অভ্যাসটা যেন ভয়ানক রূপ নিল। চেইনস্মোকারে পরিণত হয়ে গেছে ও। সিগারেটের ধোঁয়ায় যন্ত্রণাগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি-না জানেনা। কিন্তু যতক্ষণ বি/ষাক্ত ধোঁয়াগুলো ভেতরে যায় স্বস্তিবোধ করে ও। আজ ভয়ানক ফাঁকা অনুভব করছে উচ্ছ্বাস। নাজিফার সঙ্গে বিচ্ছেদ সহ্য করেছে, কুহুকে ঐ অবস্থায় দেখেও ধৈর্য্য হারায়নি, দলের এমন বিপদের সময় সাহস বজায় রেখেছে। কিন্তু নিজের পিতার আসনে যাকে বসিয়েছে। সেই শক্ত মানুষটার ভেঙ্গে পড়া মেনে নিতে পারছেনা উচ্ছ্বাস। কোনভাবেই না।

সেইরাতে আমের পরিবারের কারো চোখেই ঘুম ধরা দিলোনা। অসহ্য এক অস্থিরতায় কেটে গেল গোটা একটা রাত। ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পর গায়ে একটা শাল জড়িয়ে জ্যোতি এলো রান্নাঘরে। রাশেদের জন্যে চা করে নিয়ে যাবে। আগে এ কাজটা প্রিয়তা করতো। কিন্তু প্রিয়তা গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে এতো সকালে ওর ওঠা বারণ। তাই কাজটা জ্যোতি করে। মাঝেমাঝে নার্গিস বেগমও করেন।

রান্নাঘরে ঢুকেই আবছা অন্ধকারে কাউকে দেখে মৃদু চমকে উঠল জ্যোতি। নার্গিসকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, ‘তুমি এখানে কী করছো?’
নার্গিসও চমকেছে জ্যোতিকে দেখে। সেও নিজেকে সামলে বলল, ‘চা করছিলাম বড় সাহেবের জন্যে।’
জ্যোতি দেখল সত্যি চা বসিয়ে দিয়েছে। ও ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘তো এভাবে অন্ধকারে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?’
‘ভেবেছিলাম সবাই ঘুমে তাই আলো না জালানোই ভালো।’

‘আচ্ছা, তুমি যাও এখন। বাকিটা আমি করছি।’
‘আমি পারব আপা। হয়ে গেছেতো।’
‘বললাম না যাও! আমি করে দিচ্ছিতো।’
জ্যোতির ধমকে আর কিছু বলার সাহস পেলোনা নার্গিস। চুপচাপ বেরিয়ে গেল। জ্যোতি সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিল। চা হয়েই গেছে কেবল দুধ আর সুগার ফ্রি মেশানো বাকি।

রাশেদের ঘরের কাছে গিয়ে উঁকি দিল জ্যোতি। বিছানায় নেই রাশেদ আমের। আরেকটু উঁকি দিয়ে দেখল বরাবরের মতোই চেয়ারে গা ছেড়ে বসে আছেন উনি। তবে হাতে সিগারেট নেই। তার বদলে আছে একটা ফটো অ‍্যালবাম। চোখ খোলা। দু হাত অ‍্যালবামের ওপর একত্রিত করে তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে। জ্যোতি কিছু বলার আগেই রাশেদ বলে উঠল, ‘ভেতরে আয়।’
জ্যোতি মাথা নিচু করে ভেতরে গেল। টি-টেবিলের ওপরে চায়ের কাপটা রেখে বলল, ‘রাশেদ বাবা, আপনার চা। রেখে গেলাম। আর কিছু লাগবে?’

‘বোস।’
অবাক হল জ্যোতি। কিন্তু কিছু না বলে চুপচাপ বসল। সাথেসাথেই কিছু বললেন না রাশেদ। জ্যোতিও অপেক্ষা করল। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাশেদ বলল, ‘নিজের সিদ্ধান্তে তুই এখনো অটল?’
জ্যোতি প্রথমে বুঝল না। কয়েক সেকেন্ডের চিন্তা করেই বুঝল রাশেদ কী বিষয়ে কথা বলছেন। মলিন হেসে বলল, ‘বিয়ে ছাড়াওতো মানুষ বেঁচে থাকে, রাশেদ বাবা। আমি না হয় তাদেরই একজন হলাম।’

‘কিন্তু তোর মা অনেক ভরসা করে তোকে আমার কাছে ছেড়ে গেছেন। তোর জীবনটা গুছিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য ছিল।’
‘গুছিয়ে দিয়েছেন তো। পড়াশোনা করিয়েছেন, চাকরি করছি। শুধুমাত্র বিয়েটাই কী জীবন গোছানোর একমাত্র উপায়, রাশেদ বাবা?’

রাশেদ হাসলেন। বললেন, ‘তা ঠিক। তবে একটা কথা বলছি মা, ভালোবাসলেই পাওয়া যায়না এটা যেমন সত্যি। তেমন না পাওয়া ভালোবাসাকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করাটাও পাপ না। যদি কখনও কাউকে দেখে মনে হয়, সংসার করতে পারবি। ভালোবাসতে পারবি। তাকে বিয়ে করলে ঠকানো হবেনা। তাহলে জীবনকে দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিস।’
জ্যোতি ভেতরটা কেমন ধক করে উঠল। ও জানতো এই মানুষটা সব খবর রাখে। কিন্তু ওর মনের খবরটাও জানতো সেটা ভাবতে পারেনি জ্যোতি। তবে এ বিষয়ে কিছু বলল না। যাওয়ার আগে নরম গলায় বলল, ‘চা ঠান্ডা হয়ে যাবে রাশেদ বাবা। খেয়ে নেবেন।’

প্রায় দুই ঘন্টা পড়ের কথা। ভোরের আলো ফুটেছে আরও অনেকক্ষণ আগেই। কিন্তু গাঢ় কুয়াশার কারণে সূর্য উদয় হলেও দেখা যাচ্ছেনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুয়াশাঘেরা ধূসর দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্র। সারারাতে ঘুম হয়নি ওর। প্রিয়তাও প্রায় গোটা রাত জেগে ছিল। শরীরটা খুব খারাপ ছিল মেয়েটার। সারারাত কষ্টে ছটফট করে। শেষ রাতে মাথায় বিলি কেটে অনেকটা জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। সেটাও হয়তো শরীরের সাথে পেরে উঠতে পারেনি বলেই ঘুমিয়েছে।
ওর মনটা ভীষণ ছটফট করছে। সেই ছটফটানী বেড়েই চলেছে ক্রমাগত।

কিছুতেই সামলে রাখতে পারছেনা নিজেকে। না, আজ থেকে আবার নতুনভাবে কাজে হাত লাগাতে হবে। রাশেদ যাই বলুক। কোনভাবেই বাকিসব পার্টনারদের বুঝতে দেওয়া যাবেনা এদিকের সমস্যাটা। তার আগেই ওদের প্রফিটের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? রাশেদের সঙ্গেও এ বিষয়ে এখন কথা বলতে চায়না ও। লোকটা ভেতরে ভেতরে গুমরে গেছে। তাকে এবার একটু বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন।

অস্থিরভাবে রুমে এসে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল রুদ্র। সাড়ে সাতটা বাজে। বিছানায় তাকিয়ে দেখল প্রিয়তা ঘুমোচ্ছে। কপাল কুঁচকে আছে মেয়েটার। ঘুমের মধ্যেও যেন অদৃশ্য কোন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মেয়েটা। এগিয়ে গিয়ে প্রিয়তার মাথায় হাত বুলালো রুদ্র। রাশেদকে একবার দেখে আসা উচিত। কাল রাতে বলা রাশেদের বলা প্রতিটা শব্দ এখনো কানে বাজে ওর। বুক ভার হয়ে আসে।

রাশেদের রুমে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়াল রুদ্র। দরজাটা চাপিয়ে রাখা। আলতো করে ধাক্কা দিয়ে উঁকি দিল রুদ্র। চিরন্তন নিয়মের মতোই ইজি চেয়ারে গা ছেড়ে বসে আছেন রাশেদ। চোখ জোড়া বন্ধ। এই দৃশ্য প্রায় দেখা যায়। অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ সময়ে ঘুমান না রাশেদ। নিশ্চয়ই এমনিই চোখ বুজে আছে। সবসময়ের মতো। এক্ষুনি গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠবে, ভেতরে আয়। কিন্তু রুদ্র ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে কোন ডাক এলোনা। একটু অবাক হল রুদ্র। মৃদু গলা ঝেড়ে বলল, ‘আসব বাবা?’

কিন্তু না। কোন সাড়া নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে না-কি! এইসময়! এইভাবে চেয়ারে? পরে ভাবল শরীর মন কোনটাই ভালো নেই রাশেদের। তাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল থেকে অদ্ভুত অনেককিছুই করছে সে। রুদ্র ফিরে যাবে ভেবেও গেলোনা। ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। কেমন নিষ্পাপ শিশুর মতো দেখাচ্ছে তাকে। চেহারা থেকে যেন জ্যোতি ছিটকে বের হচ্ছে। মৃদু হাসল রুদ্র। ভাবল একটা চাদর দিয়ে দেবে গায়ে।

বিছানার দিকে এগোনোর সময় টি-টেবিলে চোখ পড়তেই থেমে গেল ওর পা। টেবিলের ওপর খোলা অ‍্যালবাম, চায়ের কাপটা কাত হয়ে পড়েছে ঠিক অ‍্যালবামের ওপরে। যেই পৃষ্ঠায় পড়েছে তাতে প্রিয়তার ছবি আটকানো, ওপরের অনেকটা অংশ ভিজে শুকিয়েও গেছে প্রায়। এতক্ষণে রুদ্র খেয়াল করল রাশেদের একটা হাত চেয়ারের হাতলের ওপর দিয়ে টেবিলের ওপরই ঝুঁকে আছে। গলাটা কেমন শুকিয়ে এলো রুদ্রর। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে ভালোভাবে তাকাল রাশেদের দিকে। এবার যেটা খেয়াল করল তাতে দম বন্ধ হয়ে এলো ওর। স্বাভাবিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে রাশেদের বুক ওঠানামা করছে না। অর্থাৎ সে শ্বাস নিচ্ছেনা!

রুদ্র দ্রুত হাঁটু ভেঙে বসল রাশেদের পাশে। একটা হাত ধরে চমকে উঠল। ঠান্ডা হয়ে গেছে শরীর। এবার সত্যিই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হল রুদ্রর। ঠান্ডা হাতটা ঝাঁকিয়ে অনেক কষ্টে বলল, ‘বাবা? বাবা শুনতে পাচ্ছেন?’
রাশেদ সাড়া দিলেন না। নড়লেও না। রুদ্র লম্বা করে শ্বাস নিল। কিন্তু ফুসফুসে কোন বাসাত গেলোনা বোধহয়। ও আবার ঝাঁকাল রাশেদের নিষ্প্রাণ হাতটা। কেঁপে ওঠা গলায় ডাকল, ‘বাবা! কথা আছে আপনার সাথে। শুনবেন না?’

রাশেদ সাড়া পাওয়া গেলোনা। রুদ্রর বুঝতে বাকি নেই রাশেদ সাড়া দেবেন না। শুধু এখন কেন, কোনদিন দেবেন না। অনেকক্ষণ আগেই রাশেদের দেহ প্রাণত্যাগ করেছে। এখন ওর সামনে পড়ে আছে কেবল প্রাণহীন এক দেহ। কেবলই দেহ। এই হৃদয়গ্রাসী, নিষ্ঠুর, কঠোর সত্যিটা রুদ্র বুঝতে পারলেও মানতে পারল না। সারাঘরময় ঘুরে এলো ওর এলোমেলো দৃষ্টি। কোনদিন যা হয়নি তাই হল। প্রায় কেঁদে ফেলল রুদ্র। আবারও রাশেদের শরীরটা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ওঠোনা বাবা! আমার অনেক কথা আছে তোমার সাথে। কালতো শুধু নিজের কথাগুলো বললে। আমার কথাগুলো না শুনেই চলে গেলে। এমন অন্যায় রাশেদ আমের কাছে আশা করা যায়না। বাবা, ওঠো!’

রাশেদের হাতে মাথা ঠেকিয়ে দুবার কেঁপে উঠল রুদ্র। কিন্তু প্রকৃতির সেই কঠোর, অপরিবর্তিত নিয়ম ভেঙ্গে সাড়া দিতে পারলেন না রাশেদ। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন তিনি। চলে গেছেন অনেক দূরে। সেখান থেকে ফিরে এসে রুদ্রর ডাকে সাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। কঠোর হলেও সত্যি যে, দৃঢ়, তেজস্বী ব্যক্তিত্বের এই পুরুষের প্রাণ তার সুঠামদেহ ত্যাগ করেছে চিরকালের মতো। সেই বজ্রকন্ঠ আর গমগম করবেনা আমের ভিলায়। সেই অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী চিরবিদায় জানিয়েছেন সকলকে। রাশেদ আমের আর নেই।

আমের ভিলার গার্ডেন এড়িয়ার বিশাল ফাঁকা জায়গায় শোয়ানো হয়েছে রাশেদে আমেরকে। লোকজনে গিজগিজ করছে চারপাশ। অনেক অনাথ শিশুদের জন্যে যে অনাথ আশ্রম গড়েছেন, অসহায়দের দুহাত তুলে দান করেছেন, আমের ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সকলের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছে সেখানে। তাদের রাশেদ বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে।

যারা রাশেদকে চেনেন, জানেন সকলের চোখেই জলভর্তি। কেউ কেউতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে। মৃদু কান্নার গুঞ্জনে কী অসহনীয় পরিবেশ! বিষাদের বিশাল পাহাড় এসে পড়েছে যেন আমের ভিলায়।
রাশেদের খাটিয়া থেকে কিছুটা দূরে ইট সিমেন্টের তৈরী দুই ফুট উঁচু পিলারটার ওপরে বসে আছে রুদ্র। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশেদের লাশটার দিকে। দু চোখ লাল হয়ে আছে ওর। সাড়া শরীর শক্ত হয়ে আছে। পাথর হৃদয়ের রুদ্র আমেরের দেহও যেন পাথর হয়ে গেছে আজ।

উচ্ছ্বাসও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা কোথাও। বারবার ঠোঁট কামড়ে ধরে, চুল একহাতে উল্টে ধরে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কী থেকে কী হয়ে গেল! কিছুতেই মানাতে পারছেনা নিজেকে ও। যতবার রাশেদের মৃত দেহের দিকে চোখ পড়ছে, বুকের ভেতরে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে।

উচ্ছ্বাসের খানিকটা পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে নীরব। প্রচন্ড অসহায় লাগছে নিজেকে ওর। গোটা ব্যপারটা দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে ওর। ভেতরে কুহুর অবস্থা কেমন কে জানে! এখান থেকেও যেতে পারছেনা। একবার রুদ্রকে দেখছে তো আরেকবার উচ্ছ্বাসকে। কাউকে গিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার সাহসও পাচ্ছেনা। কী বলবে! যেখানে ও নিজেই গোটা ব্যপারটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা এখনো। মনে হচ্ছে খুব কাছের কেউ হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো। যেখানে ওর নিজেরই এ অবস্থা। বাকিদের যন্ত্রণাতো কল্পনাতিত।

জাফর একবার রুদ্রর কাছে যাচ্ছে তো আরেকবার উচ্ছ্বাসের। মাঝেমাঝে ‘ভাইজান’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠছে। পাগল পাগল লাগছে তাকে।
রাশেদের মৃত্যু সংবাদ শুনে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর আজিজও। সঙ্গে এসআই ফরহাদ। আজ সাদা পোশাকে এসেছেন ওনারা। এসেই কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন রাশেদের মৃত মুখটার দিকে। তেজস্বী সেই মুখটার তেজ কমেনি, যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। বরাবরের মতোই শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে আসতে চাইল তার। শেষবার! দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে পারলেন না। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, শক্ত পাথরের মতো বসে আছে। দ্বিতীয়বার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আজিজ।

রাশেদের মৃত দেহ দেখার পরেই জ্ঞান হারিয়েছে কুহু। এরপর থেকে কিছুক্ষণ পরপরই জ্ঞান হারাচ্ছে মেয়েটা। যতক্ষণ জ্ঞানে থাকছে তীব্র নিঃশব্দ কান্নায় অসম্ভব ঝাঁকি খেয়ে উঠছে ওর শরীর। কিছুদিন আগে এমন ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে ওর সঙ্গে। তারওপর বাবার আকস্মিক মৃত্যুর অসম্ভব যন্ত্রণায় ছটফট করে চলেছে ও। বারবার রাশেদের কাছে যাওয়ার জন্যে জেদ ধরছে। কিন্তু কুহুকে নিজের বুকে শক্ত করে ধরে রেখেছে প্রিয়তা। আবার জ্ঞান হারিয়েছে ও।

পাশে ফ্লোরে বসে প্রায় চিৎকার করে কাঁদছে জ্যোতি। রাশেদ আর নেই, কথাটা শোনার পর থেকেই বিলাপ করে যাচ্ছে মেয়েটা। ছোটবেলা থেকে মনেপ্রাণে বাবা মেনেছে তাকে। কীকরে সামলাবে! নার্গিস আর আরেকজন কাজের মেয়ে মিলেও ওকে সামলাতে পারছেনা।

এমন ভয়ানক দুর্ঘটনার কথা শুনে নাজিফাও বসে থাকতে পারেনি। এই অবস্থাতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। কিন্তু এসে অন্যকে কী সামলাবে? চরম শোকে ঢুবে থাকা এই অসহ্যকর পরিবেশে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে চুপচাপ। সকলের এই হৃদয়বিদারক কান্না দেখে নিজেও কেঁদে ফেলেছে।

প্রিয়তার দুচোখ দিয়ে বিরতিহীনভাবে জল পড়ছে। কুহুকে বুকে জড়িয়ে রেখেই কিছুক্ষণ পরপর ফুঁপিয়ে উঠছে ও। পৃথিবীটাকে ছোটখাটো নরক মনে হচ্ছে ওর। অসহ্য যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। “একটু আমার কাছে বসবি মা?” বাক্যটা বারবার কানে বেজে অসহ্য পীড়া দিচ্ছে ওকে।

উদাস, বিধ্বস্ত মুখ নিয়ে ভেতরে এলো নীরব। কুহুর জ্ঞান ফিরেছে। কান্নার দমকে ঝাঁকি খেয়ে উঠছে ওর শরীর। প্রিয়তা, জ্যোতি, নাজিফার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ও বলল, ‘রাশেদ বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।’
কথাটা বলতে দেরী হল কিন্তু জ্যোতির সকলকে ছাড়িয়ে উঠে ছুটতে দেরী হলোনা। কুহুকে নীরব ধরে নিয়ে গেল। পেছন পেছন আস্তে আস্তে এলো প্রিয়তা আর নাজিফা।

নার্গিস জ্যোতিকে আটকে রাখল রাশেদের লাশের বেশি কাছে যাওয়ার থেকে। ছটফট করতে করতে পাগলের মতো বিলাপ করল জ্যোতি। কুহুকে নিজের সঙ্গে জাপটে ধরে রেখে একধ্যানে রাশেদের নিষ্প্রাণ মুখের দিকে তাকিয়ে রইল প্রিয়তা। এই তেজে পূর্ণ মুখটা আর দেখতে পাবেনা কেউ! দুচোখের পানি বাঁধ মানছেনা কিছুতেই। রাশেদের বলা শেষ কথাগুলো বারবার কানে বাজছে ওর।

রুদ্র, উচ্ছ্বাস, নীরব আর জাফর রাশেদ আমেরের খাটিয়া তুলে নিল। রুদ্রকে ভালোভাবে খেয়াল করল প্রিয়তা। পাথর বললে ভুল বলা হবেনা। স্বামীর এমন অবস্থা দেখে কান্নার গতি আর বেড়ে গেল ওর।
নিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে কেঁদে উঠল জ্যোতি। বসে পড়ল মাটির ওপর। ওকে ধরে রাখলেন নার্গিস। প্রিয়তার বাহু বন্ধন থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইল কুহু। কিন্তু পারল না। বুকে পাথর চেপে কুহুকে শক্ত করে ধরে রাখল প্রিয়তা। চারপাশে অবুঝের মতো চোখ বুলিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল ও নিজেও।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাশেদ আমেরের যাওয়ার দিকে। ওরা মেইন গেইট পাড় হতেই নিজেও শব্দ করে কেঁদে ফেলল প্রিয়তা। রাশেদের সঙ্গে দুবছরের হলেও সম্পর্কটা বাবা-মেয়ের চেয়ে কম মধুর ছিলোনা।

চিরকালের মতো আমের ভিলা ত্যাগ করলেন রাশেদ আমের। আমের পরিবারের মাথার ওপর থেকে সরে গেল তার সবচেয়ে বড় ছায়া। আর কোনদিন ফিরবেন না তিনি। কোনদিন না।

রাশেদ আমেরের জানাজার নামাজে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হলো। পছন্দের, ভালোবাসার মানুষটার চলে যাওয়ার ব্যথিত হলেন সকলেই।
সকল নিয়ম মেনে সুষ্ঠুভাবে দাফন করা হল রাশেদ আমেরকে। দাফনের পর সকলে মিলে দোয়া করল। যখন ফিরে আসার সময় হল, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রুদ্র। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাশেদ আমেরের কবরটার দিকে। ধীরে ধীরে সকলে চলে গেলেও রুদ্র নড়ল না। উচ্ছ্বাস, নীরব আর জাফরও দাঁড়িয়ে রইল রুদ্রর সঙ্গে। উচ্ছ্বাস নিজেকে সামলে এসে দাঁড়াল রুদ্রর পাশে। রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে ধরা গলায় বলল, ‘নিজের কাছের মানুষের মৃত্যুতে কাঁদাকে কাপুরুষতা বলেনা।’

রুদ্রর মনে পড়ল ওর বাবাকে বলা শেষ কথাগুলো। ছোট বেলা থেকে আজ অবধি করে যাওয়া গোপন, নীরব স্নেহগুলো। অনুভব করল, সেই বজ্র কন্ঠে কেউ আর ওকে আদেশ করবেনা। কেউ আর ওকে শাসন করবেনা। পৃথিবীতে এমন আর কেউ নেই যাকে ও ভয় পায়। পিতা নামক সেই বটবৃক্ষ হারিয়ে গেছে ওর জীবন থেকে। চিরকালের মতো। দুচোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল রুদ্রর। আরও কিছুক্ষণ কবরটার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ মুছে ফেলল। হনহনে পায়ে বেরিয়ে এলো। ওর পেছন পেছন উচ্ছ্বাস, নীরব আর জাফরও এগোলো।

কিছুটা এগোতেই রুদ্র খেয়াল করল দাঁড়িয়ে আছেন ইন্সপেক্টর আজিজ। তার পাশে আছে ফারুকও। ওনারাও উপস্থিত ছিলেন জানাজায়। রুদ্র পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই আজিজ বলে উঠলেন, ‘তুমি যতই বল। আমের সাহেবের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু। আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। কিছু লুকাচ্ছো তুমি। এখনো বলছি স্যারেন্ডার করে কোঅপারেট কর। নয়তো সব ধ্বং/স হয়ে যাবে।’

রুদ্র ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল আজিজের দিকে। কেঁপে উঠলেন আজিজ। চমৎকার, গভীর ঐ চোখদুটো দিয়ে যেন র/ক্ত উঠে আসবে। স্পষ্ট বুঝলেন অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে রুদ্রর মধ্যে। তান্ডব আসন্ন। রুদ্র অতিরিক্ত শান্ত গলায় বলল, ‘আর সেই ধ্বং/স আপনি আর আটকাতে পারবেন না স্যার।’

বলে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এলো রুদ্র। পা দুটো ভীষণ ভারী মনে হলেও পায়ের গতি কমল না। পেছন থেকে উচ্ছ্বাস, নীরব ডাকল। কিন্তু রুদ্র একবারও ফিরে তাকালো না। জানে, পেছন ফিরলে আর যেতে পারবে না ও। যত পেছনে তাকাবে ততই মনে পড়বে, নরম বিছানা আর আরামদায়ক ইজি চেয়ারে গা এলানো যায় অভ্যাস।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬০

তাকে শক্ত মাটিতে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। আলোকিত ভবনের রাজাকে রেখে এসেছে নিঃছিদ্র অন্ধকারে। আমের ভিলাকে আলোয় ভরিয়ে রাখা সেই ঝলমলে সূর্য আজ চির অস্তমিত হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে আমের পরিবারের ছত্রছায়া। আর কোনদিন কাউকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারবেনা ও। সেই বজ্রকন্ঠে ‘রুদ্র’ ডাক শোনা হবে না আর। কোমল কন্ঠে আর কেউ কোনদিন ‘রাজা’ বলে ডাকবে না। কোনদিন না। জীবনের উপন্যাসে রাশেদ আমের নামক সেই দৃঢ়, তেজস্বী চরিত্রের এখানেই সমাপ্তি।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬২