অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬০

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬০
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

ঘরে কোথাও কুহুকে খুঁজে না পেয়ে থমকে গেল নীরব। ওয়াশরুমের দরজাটা সটান করে খোলা। হঠাৎ বারান্দার দরজায় চোখ পড়তেই সেদিকে ছুটল। বারান্দার দরজার কাছে পৌঁছতেই থেমে গেল পা জোড়া। কারো দর্শনমাত্রই এতোটা তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব এর আগে তা জানতো না নীরব। গায়ে চাঁদর জড়িয়ে কুয়াশাঘেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা কুহুকে দেখে স্বস্তি পেল ও। মেয়েটা ঠিক আছে।

ধীরপায়ে দুকদম এগিয়ে গেল নীরব। নরম গলায় ডাকল, ‘কুহু?’
কুহুর কেঁপে ওঠা বাইরে থেকেও টের পাওয়া গেল। ঝট করে ঘুরে তাকাল ও। দুচোখ ভর্তি বিস্ময়। যেন নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নীরবও যেন স্থির হয়ে গেল। কী অবস্থা হয়েছে মেয়েটার! চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, বাচ্চাসুলভ মুখটা কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। ক’দিনে যেন আরও রুগ্ন হয়ে গেছে কুহু। অপরাধবোধ আরও গভীরভাবে গ্রাস করল নীরবকে। অনুতাপের আগুনে যেন অন্তরাত্মাসহ ঝলসে গেল। নিমেষেই দুচোখে এসে ভীড় করল অশ্রুকণা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ক্ষণিকের জন্যে থমকে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আগের মতোই নির্বিকার হয়ে গেল কুহুর চেহারা। মুখ ঘুরিয়ে রেলিং এ হাত রাখল। পুনরায় দৃষ্টি ছুড়ল আকাশের অসীমতায়। নীরব একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলালো। কম্পিত পায়ে দু’কদম এগিয়ে গেল। মৃদু গলায় বলল, ‘সরি।’

কিন্তু কুহু ফিরে তাকাল না। অনিয়মিত শ্বাস নিচ্ছে কেবল। নীরব আরেকটু এগিয়ে গেল। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল কুহুর দিকে। কিছুক্ষণ কেঁটে গেল অস্থির নীরবতা আর ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে। নীরবতা ভেঙ্গে নীরব বলল, ‘ক্ষমা করবেনা আমায়? তাকাবেনা আমার দিকে?’

নীরবের কন্ঠে রাজ্যের অসহায়ত্ব। কুহু শক্ত করে রেলিং আকড়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। এতক্ষণ আটকে রাখা চোখের জল ছিটকে বেরিয়ে এলো। তবুও তাকাল না। নীরব এবার কুহুর কনুই ধরে ঘোরালো নিজের দিকে। কুহু ছাড়াতে চাইলে আরও শক্ত করে ধরল। অপর হাত কুহুর গালে রেখে নিজের দিকে ঘোরালো মুখটা। অধৈর্য গলায় বলল, ‘এই মেয়ে সরি বলছিতো। এই দেখো কান ধরছি।’

সত্যি সত্যিই নীরব দুকান ধরে বসল। কুহু ছলছল চোখে তাকাল নীরবের অশ্রুসিক্ত চোখে। গত দুবছরে কুহু যতবার রাগ-অভিমান করেছে। নীরব ঠিক এভাবেই কানে হাত দিয়ে কুহুকে মানিয়েছে। আজও কত সহজ সাবলীলভাবে সেটাই করছে। যেন কুহুর সঙ্গে ঘটা দুর্ঘটনা, নীরবের হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াটা অন্যসব কিছুর মতো সাধারণ সমস্যার মতোই একটা সমস্যা।

যা চাইলেই ঠিক করে নেওয়া যায়। সত্যিই কী নীরবের কাছে ব্যপারটা এতোটাই তুচ্ছ! এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও নীরব আগের সেই দৃষ্টিতেই কুহুকে দেখছে! দেখতে পারছে! নাকি এটা নীরবের উদারতা? করুনা করছে নীরব কুহুকে? কথাটা মনে পড়তেই কুহু নীরবকে কিছু বলতে চাইল।

কিন্তু ওর হাত চলল না। ব্যবহার করতে পারল না নিজের সাংকেতিক ভাষা। সব কেমন গুলিয়ে গেল। কান্নাগুলো যেন দলা পাকিয়ে আটকে আছে গলাতেই। কিন্তু কোন এক দৈববলে নীরব নিজেই বুঝতে পারল কুহু কী বলতে চায়। সে করুণ গলায় বলল, ‘তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে করুণা করছি?’

উত্তরে কুহু অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নীরবের দিকে। যার অর্থ, এতোদিন তবে কেন আসেন নি? আমাকে এমন অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে গিয়েছিলেন কেন? কেন কোন খোঁজ নেননি। কুহুর চোখের সেই ভাষা পড়তেও বিন্দুমাত্র কষ্ট হলোনা নীরবের। কিন্তু ওর পরিবারের অবস্থাটা এখন কুহুকে বলতে চায়না নীরব। এমনিতেই মেয়েটা ডিপ্রেশনে ভুগছে। এসব শুনলে মানসিকভাবে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পরবে।

‘করুণা ভেবে আমার ভালোবাসাটাকে ছোট করোনা কুহু। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা আমি। পারিও নি।’
কুহু আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। দু-চোখ দিয়ে বিরতিহীনভাবে জল পড়ছে। নীরব নিজের কান্না আটকে বলল, ‘এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিওনা প্লিজ। দেখো, সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে চলে এসেছি। নীরবের যে নীরবতা বড্ড প্রিয়। তাইতো সবস্ত কোলাহল ছেড়ে নীরব তার নীরবতার কাছে চলে এসেছে। আমাকে ফিরিয়ে দিওনা, কুহু। নীরবতা ছাড়া নীরবের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আই নিড ইউ। আই নিড ইউ ব্যাডলি।’

প্রচন্ড কান্নায় ঝাঁকি খেয়ে উঠল কুহুর শরীর। চোখ-মুখ খিচে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নীরব চুপচাপ কিছুক্ষণ দেখল কুহুকে। যখন দেখল কুহুর কান্না নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকা দায় হচ্ছে। তখন আর দাঁড়াল না। এগিয়ে গিয়ে জোর করে নিজের দিকে ঘোরালো কুহুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিজের সাথে। কুহু ছাড়িয়ে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না। নীরব আরও শক্ত করে ধরে রাখল।

কয়েক সেকেন্ড শব্দহীন ধস্তাধস্তি হলো দুজনের মধ্যে। এরপর কুহু থেমে গেল। ক্লান্ত হয়ে নিজের ভার ছেড়ে দিল নীরবের ওপর। কান্নায় এখনো কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীর। নীরব শক্ত করে কুহুকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রেখে কান্নাভেজা গলায় বলল, ‘সরিতো! কাঁদেনা লক্ষ্মী। ভুল হয়ে গেছে আমার। এই দেখো চলে এসেছিতো আমি। আর কখনও যাবনা। আই প্রমিস।’

ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরী হয়েছে আজ আবদুল হামিদের।কুহুর ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট হেড। ফ্রেশ হয়ে এসে অলস ভঙ্গিতে বসল কাউচে। সপ্তাহখানেক হল নিজের এই ফ্ল্যাটে উঠেছেন। এটার সম্পর্কে ওনার খুব ঘনিষ্ঠ লোক ছাড়া অন্যকেউ জানেনা। আর বর্তমানে বাংলাদেশে ওনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা কেউ নেই বললেই চলে। মাসখানেক হলো ওনার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ডেনমার্ক গেছে।

তার শ্বশুরবাড়ি ওখানেই। সুতরাং নিশ্চিন্তে গা ঢাকা দেওয়া যায় এখানে থাকে। গরম পানিতে গোসল সেড়ে অলস ভঙ্গিতে নিজের কাউচে এসে বসলেন হামিদ। সামনের টি-টেবিলে স্যান্ডউইচ, মাংস ভাজা, ফ্ল্যাক্সে রাখা গরম কফি সাজানো। কাজের মেয়েটা নিজের কাজ করে বেরিয়ে গেছে তবে। সন্তুষ্ট চিত্তে একটা স্যান্ডউইচে কামড় বসালেন তিনি। ওপর হাতে রিমোটটা নিয়ে টিভি অন করে নিউজ চ্যানেলে গেলেন। দেরীতে ওঠা নিয়ে মাথাব্যথা নেই তার। আরামেই কাটছে দিনকাল। ইউনিভার্সিটি যাওয়ার ঝামেলা নেই, কাজ নেই।

বিশ পঁচিশদিন আগের কথা। শওকত মীর্জা এবং তার ছেলে শান মীর্জা নিজে এলেন আবদুল হামিদের বাড়িতে। বললেন রাশেদ আমেরের মেয়েকে ভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে তুলে নেওয়া হবে। আর সেটা সম্ভব হবে যদি হামিদ সাহায্য করে। এবং অবশ্যই সে কাজটা বিনা পয়সায় করতে হবেনা তাকে। বেশ লোভনীয় অংকের টাকা দেওয়া হবে। টাকার অংকটা শুনে লোভে পড়লেও সবার আগের রাশেদ আমেরের ভয়টাই সবার আগে এলো তার মনে।

তখন স্বয়ং শওকত মীর্জা তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘বাঘ যত হিংস্র পশুই হোক, শিকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে সে বেড়ালের চেয়েও তুচ্ছ। রাশেদ আমেরের সব শক্তির উৎস আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার দাপট। সোলার সিস্টেমের ক্ষমতা, সূত্র, ব্যবসায়ীক সংযোগ আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেক দলকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাই তারাও সোলার সিস্টেমকে মাথায় করে রাখছে। আর সেই সুবিধাগুলো যখন পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে তখন মাথা থেকে আছাড় মেরে ফেলতেও দু’বার ভাববে না কেউ।’

কথাটার তাৎপর্য শুরুতে বুঝতে পারেনি হামিদ। নিজের স্বার্থেই সবটা ব্যাখ্যা করল শওকত। তাদের অ/বৈধ অ/স্ত্র ব্যবসা, সোলার সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ তথ্য সংগ্রহ করা, সেগুলোর সাহায্যে তাদের ব্যবসায়ীক সম্পর্কেগুলো নষ্ট করা এবং রুদ্রর গোটা ব্যপারটা বুঝে যাওয়া অবধি সবটাই বলল। এটাও বলল, এখন শুধু যেকোনভাবে রাশেদ আমেরকে বাধ্য করতে হবে বিদেশী বিক্রেতাদের সঙ্গে তার সমস্ত চুক্তি বাতিল করে দিতে। তবেই তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। আর সেটা করার জন্যে কিছু সময়ের জন্যে হলেও কুহুকে প্রয়োজন।

দ্বিধাগ্রস্ত হামিদ জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু সোলার সিস্টেমের ভেতরকার তথ্য আপনারা কীভাবে জানলেন? এতোবড় আন্ডারওয়ার্ল্ডের দলের সিকিউরিটি সিস্টেম এতো দুর্বল?’
উত্তরে শান এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, ‘গেম ডেভলপারের মাইন্ড রীড করা গেলে হ্যাকিং এর কী প্রয়োজন স্যার?’
এই কথাটার অর্থও বুঝতে পারল না হামিদ। ঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই হালকা থমকে শানকে থামিয়ে দিল শওকত।

সোলার সিস্টেমের বর্তমান অবস্থার কথা বুঝে দ্বিধা কিছুটা কেটে গেলেও কিছুটা সময় চেয়ে নিল সে। কিছু সময় পর আবার ফোন আসে সম্রাটের। ততক্ষণে সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে হামিদ। পরিস্থিতি যা বুঝেছে তাতে প্রস্তাবটা মেনে নেওয়াই ওনার জন্যে সবচেয়ে বেশি লাভজনক।

তাই আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে হ্যাঁ বলে দিল। তার উত্তর শুনে বিজয়ের হাসি হাসল সম্রাট। তাকে বুঝিয়ে দিল নিজেদের পরিকল্পনা। সবটা শুনে হামিদও এদিক থেকে নিজের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিল। দুজন কিডন্যাপারকে ছদ্মবেশে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া, পুকুরপাড়টা খালি রাখা, ময়লার বস্তুা নিয়ে যাওয়ার নাম করে তাদের বের হওয়ার ব্যবস্থা করা সবটাই হামিদ করেছে। যদিও কয়েকজনের সাহায্য নিয়েছিল তিনি। কিন্তু তারা কেউই আসল ঘটনা জানতে বা বুঝতে পারেনি।

কথাগুলো চিন্তা করতে করতে স্যান্ডউইচগুলো শেষ করে ফেলল সে। মুরগী ভাজায় কামড় বসালো হামিদ। খবর নিয়ে জেনেছে মেয়েটাকে নাকি রে/প করা হয়েছে। কথাটা শুনে মনে মনে ছোট্ট একটা ধাক্কা খেয়েছে হামিদ। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে নিষ্পাপ শিশুর মতো মুখটা। যেন সদ্য ফোটা ফুল। ফুলের মতোই কোমল, সুন্দর ব্যবহার। রে/প! এতোটা চিন্তা করেনি সে। ভেতর থেকে আত্মগ্লানি গ্রাস করতে চাইছিল। কিন্তু চকচকে নগন ক্যাশগুলোর কথা মনে পড়তেই সেসব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিয়েছে সে।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে কেবল কফি আর ম্যাগাজিনটা নিয়ে বসেছিল হামিদ। কলিংবেলের আওয়াজে চমকে উঠল সে। এখানকার ঠিকানাতো বাইরের কেউ জানেনা। রান্নার মেয়েটারও আসার কথা না। দুপুরের খাবার নিয়ে ড্রাইভারের আসার কথা। তাও যখন সে আনতে বলবে তখন। তাছাড়া রান্নার মেয়েটার কাছে ঘরের চাবি আছে। তবে? কে এলো?

আবার কলিং বেলের আওয়াজ! কফি ভেজা গলায় একটা ঢোক গিলল হামিদ। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা ভিঁজিয়ে নিলো। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। এই ফ্ল্যাটের দরজায় ডোরহোল না রাখায় নিজেকে ভয়ানক তিরস্কার করল সে। কে এসেছে দেখতেও পাবেনা। এসব ভাবতে ভাবতে আবারও বেজে উঠল কলিংবেল। এবার এই শীতের মাঝেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমা হল হামিদের। গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, ‘কে?’

‘আমি স্যার।’
নিজের ড্রাইভারের গলার আওয়াজ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল হামিদ। দরজা খুলে দেখল ড্রাইভার যুবক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হামিদ জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে? কল না করে ভেতরে এলে কেন? কী বলেছিলাম তোমা_’

বাক্য সম্পূর্ণ করার আগেই থমকে গেল আবদুল হামিদ। কারণ এতক্ষণে ড্রাইভারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং রাশেদ আমের। আচমকা রাশেদ আমেরের উপস্থিতিতে পাথরের মতো জমে গেছে হামিদ। ঠোঁটে হালকা কিন্তু অদ্ভুত এক হাসি ফুটিয়ে তুললেন রাশেদ। ইশারা করতেই মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল ড্রাইভার। রাশেদ হামিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভেতরে আসতে বলবে না, হামিদ?’

কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না হামিদ। কিন্তু হুঁশ ফিরতেই জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা ঠিক হলোনা। বিকৃত হয়ে গেল মুখটা। আটকে যাওয়া গলায় বলল, ‘আমের সাহেব! আপনি? মানে এখানে কী-করে?’
‘ভেতরে ডাকবেনা?’ শান্ত কিন্তু বজ্র রাশেদের কন্ঠস্বর।

‘হ্যাঁ? হ্যাঁ, হ্যাঁ আসুন আসুন।’
তীব্র অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাশেদকে ঢুকতে দিতে হল তার। ধীর, দৃঢ় পায়ে ভেতরে ঢুকলেন রাশেদ। অনুমতির তোয়াক্কা না করে সিঙ্গেল সোফাটা দখল করে নিলেন। পায়ে পা তুলে সোফায় গা এলিয়ে বললেন, ‘ব্রেকফাস্ট করছিলে বুঝি?’
আড়ষ্ট হেসে বড় সোফাটায় বসল হামিদ। বলল, ‘ব্রেকফাস্ট বা কফি?’
রাশেদ একটা ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘হুঁ? ব্রেকফাস্ট আমি খেয়েই এসেছি। কফি চলতে পারে।’
‘অবশ্যই।’

বলে ব্যস্ত হাতে কফি মগে কফি ঢালল হামিদ। হাত থরথর করে কাঁপছে তার। কম্পমান হাতেই কফির মগটা এগিয়ে দিল রাশেদের দিকে। পুরোটা সময় কাঁপতে থাকা হাতটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেন রাশেদ। রাশেদ মগটা নিতেই হামিদ ইতস্তত করে বলল, ‘আপনি এখানকার ঠিকানা কীকরে জানলেন, মানে_’

আবার ছোট্ট করে হাসল রাশেদ। সকৌতুকে বললেন, ‘কী ব্যপার হামিদ? আমার এখানে আসাটা বোধ হয় তুমি পছন্দ করোনি।’
‘না, না কী যে বলেন। তেমন কিছু না। আসলে হঠাৎ আসলেন তো তাই আরকি।’

আর কিছু বলার সাহস পেলোনা হামিদ। কুহুর ব্যপারটা নিয়েও আগ বাড়িয়ে কিছু বলার সাহস হলোনা তার। দরদর করে ঘামছে সে এখন। বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুরি পেটাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে একদম। স্পষ্ট বুঝতে রাশেদ আমের একা আসেন নি। সঙ্গে স্বয়ং আজরাইলকে নিয়ে এসেছেন। কী করবে বুঝতে পারছে না। সাধারণ মানুষ সে। খু/ন/খারাবির মধ্যে থাকেনা। অতিরিক্ত টাকার লোভ সামলাতে না পেরে করে ফেলেছে কাজটা।

কিন্তু এখন কী হবে? তাকে কে বাঁচাবে? ঝাঁপিয়ে পড়বে রাশেদের ওপর? পারবে? ওর বয়স পয়তাল্লিশ। বুড়োটার বয়স ষাটের কাছাকাছিই হবে। তবুও সুঠামদেহী দৃঢ় রাশেদকে দেখে সব আত্মবিশ্বাস কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে। তারওপর রাশেদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি গলা আরও শুকিয়ে দিচ্ছে তার। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। যেন চোখ দিয়ে হামিদের মন মস্তিষ্ক সব পড়ে ফেলছে। নীরবতা ভেঙ্গে রাশেদ বলল, ‘কিছু কিছু জিনিস হঠাৎই আসে হামিদ। তারমধ্যে বিপদ অন্যতম। কুহুর ব্যাপারে কিছু শোন নি? শুনলাম ভার্সিটিতে যাচ্ছোনা। ছুটিতে আছো।’

হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল যেন হামিদের। কোনরকমে বলল, ‘হ-হ্যাঁ কানাঘুষায় শুনলাম আরকি। আমার বিশ্বাস হচ্ছেন। সত্যিই এমন হয়েছে আমের সাহেব?’
হঠাৎই তিক্ত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল রাশেদের ঠোঁটে। শীতল চাহনী দিল হামিদের দিকে। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল হামিদের। হঠাৎই ছুটে পালাতে মনে চাইল।

কারো সাহায্য পেতে ইচ্ছে করল। চিৎকার করতে ইচ্ছে করল, বাঁচাও। কিন্তু একচুলও নড়ার ক্ষমতা রইল না হামিদের। কোন এক অদৃশ্য বেষ্টনী যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। রাশেদ কফির মগটা টি-টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ‘পতঙ্গ চেনো নিশ্চয়ই? জ্বলন্ত আগুনের উজ্জ্বল আলো ছোটছোট পতঙ্গগুলোকে এতোটাই আকৃষ্ট হয় যে নিয়ন্ত্রণহীন যানের মতো ছুটে চলে যায়। বুঝতেই পারেনা চাকচিক্যের আকর্ষণে ঝাপ দিচ্ছে স্বয়ং মৃত্যুকূপে। যতক্ষণে বুঝতে পারে ততক্ষণে দেরী হয়ে যায়।’

পাঞ্জাবীর পেছন থেকে চিকন ফলার লম্বা একটা ছু/রি বের করলেন রাশেদ। আরও ধীর গলায় বললেন, ‘অনেক দেরী।’
বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলল হামিদ। কথা বলার বা নড়ার ক্ষমতা নেই তার মধ্যে। বিদ্যুৎ গতিতে উঠে ছু/রিটা হামিদের গ/লার শ্বাসনালী বরাবর গেঁথে ফেললেন রাশেদ। চোখ দুটো ভয়ংকর লাগছে তার। নিষ্ঠুর মুখভঙ্গী। হামিদের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। মুখটা বিকৃত ভঙ্গিতে হা হয়ে গেল। রাশেদ দাঁতে দাঁত চেপে বজ্রের মতো শক্ত ভারী গলায় বলল, ‘তুমিও দেরী করে ফেলেছো হামিদ। তোমার লোভের দাম আমার মেয়েকে সারাজীবন বয়ে বেরাতে হবে। তোমার আগে পৃথিবী ছেড়ে শান্তি পেতাম না আমি।’

বলে ছু/রিটা ধরে নিচের দিকে টেনে দিল। এরপর বের করে আনল সেটা। বিস্ফোরিত খোলা চোখ নিয়েই সোফায় ঢলে পড়ল হামিদ। হা করা মুখ দিয়ে ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। প্রায় দুভাগ হয়ে যাওয়া গলা দিয়ে গরগর করে র/ক্ত বের হচ্ছে। গ/লা কা/টা মুরগীর মতো ছটফট করছে হামিদ। স্হির চোখে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখল রাশেদ। একবারও পলক ফেলল না।

আমের ভিলার হলরুমে গম্ভীর মুখে বসে আছে রুদ্র। ওর সামনে কিছুটা দূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নীরব। রুদ্রকে এমনিতেই ভয় পায় নীরব। তারওপর অপরাধবোধ। চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা ছেলেটা। কিন্তু রুদ্র ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ আগে নীরবকে প্রায় মা/রতেই যাচ্ছিল রুদ্র। কিন্তু উচ্ছ্বাস আর জ্যোতি মিলে কোনরকমে আটকেছে।

তখন কাঁদতে কাঁদতে নীরবের বুকেই জ্ঞান হারায় কুহু। নীরব প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে বুঝতে পারে যে দুর্বলতার কারণেই এমনটা হয়েছে। সবাই মিলে হাওয়া বাতাস করে জ্ঞান ফেরায়। কিছু খাইয়ে দেওয়ার পর আবার ঘুমিয়ে পড়ে কুহু। শারীরিক, মানসিক উভয় দিক থেকেই ভীষণ ক্লান্ত মেয়েটা।

দুপুরের লাঞ্চ টাইমের কিছুক্ষণ পর আমের ভিলায় এসে উপস্থিত হয় রুদ্র আমের। হলরুমে নীরব, জ্যোতি, নাজিফাকে একসঙ্গে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। নাজিফার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি কখন এসেছো?’
‘সকালে এসেছিলাম,,রুদ্র ভাই।’ মিনমিনে গলায় বলল নাজিফা।

নাজিফা কুহুকে দেখতে এলেও বেশিক্ষণ থাকেনা। আজ এতক্ষণ থেকেছে শুনে অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলেনা রুদ্র। ইতিমধ্যেই নাজিফার স্বামীর মৃত্যু সম্পর্কে আমের পরিবারের সবাই জানে। কিন্তু তিনজনের মধ্যেই খানিকটা আড়ষ্ট ভাব দেখল রুদ্র। যেন ভয়ে আছে। ও কিছু বলার আগেই জ্যোতি বলল, ‘তুমি খাবেতো এখন। দেব?’
রুদ্র চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘প্রিয়তা আসেনি এখনো?’

‘না, এখনো তো এলোনা।’
‘কুহু কী করছে?’
আরও একবার সকলের মধ্যে সেই একই আড়ষ্টতা দেখল রুদ্র। জ্যোতি কোনমতে বলল, ‘খাইয়ে দিয়েছি। এখন ঘুমোচ্ছে।’
ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলল রুদ্র। কিন্তু সিঁড়ির দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেল ওর। নীরব নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রুদ্রর। গর্জে উঠে বলল, ‘ও এখানে কী করছে?’

রুদ্রর হুংকারে সিঁড়ির শেষ মাথাতে এসে পা থমকে গেল নীরবের। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। রুদ্র রেগে গেল। ধমকের সুরে বলল, ‘ও এখানে কী করছে? ওকে আমের ভিলায় ঢুকতে কে দিয়েছে? কী করছিল ওপরে?’

কেউ কোন উত্তর না দেওয়াতে রুদ্র হুংকার দিয়ে বলল, ‘আমি জিজ্ঞেস করছি কী করছিল ও ওখানে?’
নীরব চোরা চোখে একবার তাকাল রুদ্রর দিকে। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘কুহুর কাছে গিয়েছিলাম, রুদ্র ভা-‘
আর কিছু বলার আগেই রুদ্র তেড়ে গেল নীরবের দিকে। নীরব থমকে গেল। উচ্ছ্বাস দ্রুত গিয়ে দুহাতে ধরে আটকালো রুদ্রকে। বলল, ‘শান্ত হ। মাথা ঠান্ডা কর। পুরোটা শোন আগে।’

রুদ্র ক্ষিপ্ত চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাতেই উচ্ছ্বাস চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলল। রুদ্র লম্বা শ্বাস ফেলে পেশিতে ঢিল দিল। নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে।
এতক্ষণ সোফায় বসে চুপচাপ পুরো ব্যপারটা শুনলো রুদ্র। নীরব কিছু বলার সাহস পায়নি। পুরো ব্যপারটাই ব্যাখ্যা করল উচ্ছ্বাস। সবটা শুনে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে নীরবকে কিছুক্ষণ দেখল রুদ্র। বেচারা একদম গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙ্গে রুদ্র বলল, ‘গাধা! মিনিমান কমনসেন্স নেই তোমার মধ্যে? এরকম একটা ব্লান্ডার কীকরে করলে তুমি? এরমধ্যে যা খুশি হতে পারতো। কুহু সু/ই/সাইড এটেমড করতে পারতো, ওর কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো, কিংবা আরও মারাত্মক কিছু হতে পারতো। সামান্য ব্যপারটা মাথায় ঢুকলো না তোমার?’

রুদ্রর ধমক খেয়ে আরও চুপসে গেল নীরব। কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। রুদ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘কথা হয়েছে কুহুর সাথে?’
বাধ্য ছেলের মতো ওপরনীচ মাথা ঝাঁকাল নীরব।

‘ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছো তো? একটা কথা মাথায় রেখ। ইতিমধ্যে জীবনের ভয়ংকরতম কষ্টটা পেয়েছে আমার বোন। যদি তোমার কারণে আবার ও কোনরকম কষ্ট পায়, তোমাকে নিজের হাতে খু/ন করব আমি। তাই এখনই তোমাকে অপশন দিচ্ছি। যদি সারাজীবনের জন্যে ওর পাশে থাকার সাহস থাকে তবেই থাকো। নয়তো দরজা খোলা আছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর যদি কোনরকম ঝামেলা কর। রুদ্র আমেরের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম রূপটা দেখবে তুমি।’
‘আমি কথা দিচ্ছি।’ অদ্ভুত প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল নীরব।

বিকেলের দিকে গোটা হলরুম নিস্তব্ধ করে দিয়ে হাজির হল রাশেদ আমের আর জাফর আমের। তখনও ওর সবাই হলরুমে। রাশেদকে দেখে রুদ্র আর উচ্ছ্বাস পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। রাশেদের দৃষ্টি নীরবের ওপর পড়তেই তার পা জোড়া থেমে গেল। স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমি?’
জাফরও হুংকার ছেড়ে বলল, ‘এই ছেলে এখানে কী করছে?’
নীরব খানিকটা এগিয়ে এলো। নরম গলায় সালাম দিল। গম্ভীর আওয়াজেই সালামের জবাব দিলেন রাশেদ। আবার প্রশ্ন করলেন, ‘এখানে কী করছো?’

নীরব শুকনো এক ঢোক গিলল। সাহস জুগিয়ে বলল, ‘আমার আপনার সঙ্গে কিছু বলার আছে আঙ্কেল। কিছুক্ষণ সময় দেবেন আমাকে?’
রাশেদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নীরবের দিকে। এরপর বলল, ‘আমার ঘরে এসো।’
রাশেদ আমের আর নীরব ভেতরে যাওয়ার কিছু সময় পর প্রিয়তা ফিরে এলো। ড্রয়িংরুমে সকলে জড়ো হয়ে আছে। কিন্তু কোন খেয়াল নেই ওর। অন্যমনস্কভাবে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। সবাই একটু অবাকই হলো। জ্যোতি এগিয়ে গিয়ে প্রিয়তার এক হাতে ধরে ডাকল, ‘প্রিয়তা!’

চমকে উঠল প্রিয়তা। কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। তারপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। যেন এইমাত্র বুঝতে পারল ও ঘরে ঢুকে গেছে। জীভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘তোমরা সবাই এখানে বসে আছো? কিছু হয়েছে?’

‘নীরব এসেছে।’ মৃদু কন্ঠে জবাব দিলো জ্যোতি।
অবাক হল প্রিয়তা। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও হঠাৎ গা-টা গুলিয়ে উঠল। সোফার হাতল ধরে নিজেকে সামলাল। নাজিফা ভারী শরীরটা নিয়েও খানিকটা এগিয়ে এলো। জ্যোতি দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে প্রিয়তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তোমাকে অসুস্থ লাগছে। এ অবস্থায় আজ কেন বের হলে বলোতো?’

জাফর বলল, ‘রুদ্র আমার মনে হয় প্রিয়তা মাকে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিলে ভালো হয়। পরপর যেসব ঘটনা ঘটল। সব ঠিকঠাক আছে কি-না দেখে নেওয়া জরুরি। খুব খারাপ লাগছে মা?’
প্রিয়তা কিছু না বলে পানির গ্লাসটা ধরল। রুদ্র এতক্ষণ তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে দেখছিলো প্রিয়তাকে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘রুমে এসো। এক্ষুনি।’
বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে ওপরে চলে গেল রুদ্র।

‘নিজের বাবা-মার কথা এভাবে উপেক্ষা করে চলে আসাটা তোমার উচিত হয়নি নীরব।’
রাশেদের তিরস্কারে মাথা নিচু করে ফেলল নীরব। নিজে ইজি চেয়ারেই গা ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন রাশেদ। নীরব কিছুটা দূরত্ব রেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ বসতে বলেছিলেন কিন্তু বসেনি ও।

‘আমি অনেকভাবে চেষ্টা করেছি আঙ্কেল। এই মুহূর্তে ব্যপারটা ওনারা মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু বেশিদিন ওনারা রেগে থাকবেন না। আমি চিনি ওনাদের। শুধু একটাই অনুরোধ আঙ্কেল। ততদিন আপনার মেয়ের পাশে আমাকে থাকতে দিন। আমি মাস্টার্স কম্প্লিট করেছি। ইন্ডিয়া থেকে দুবছরের একটা কোর্সও করে এসেছি। চাকরি পেতে খুব বেশি সময় লাগবেনা আমার।’

রাশেদ নিজের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন নীরবের দিকে। না, ছেলেটার কথায় শুধুমাত্র আবেগ নেই। তারসঙ্গে আত্মবিশ্বাস, ওনার মেয়ের প্রতি ভালোবাসা সবটাই আছে। ভেতর থেকে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিন্তু তবুও নিজের কন্ঠস্বর গম্ভীর রেখে বললেন, ‘এসব তুমি তোমার আবেগের কথা বলছো, নীরব।’

নীরব হার মানল না। নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে বলল, ‘নিজের ছেলে ভেবে একবার ভরসা করে দেখতে পারেন।’
‘তুমি জানো যে আমার এবং আমের ভিলার পুরুষদের আসল পেশা কী?’
‘নিশ্চিতভাবে না। কিন্তু এই ঘটনার পর কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি। কিন্তু তার সঙ্গে কুহুর যে কোনরকম সম্পর্ক নেই সেটাও বুঝেছি। আর আমার কাছে কুহুই গুরুত্বপূর্ণ। বাকি সত্যি যাই হোক, আমার কিছু যায় আসেনা।’

এতক্ষণে তৃপ্তির মৃদু হাসি ফুটে উঠল রাশেদের ঠোঁটে। হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে ডাকলেন নীরবকে। নীরব ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। রাশেদ হাত বাড়িয়ে একটা হাত ধরল নীরবের। সেই বজ্র, দৃঢ় কন্ঠস্বর যেন খাদে নেমে এলো। নরম গলায় বললেন, ‘আমার আর রুদ্রর ব্যক্তিগত জীবনের অন্ধকার, হিং/স্র/তার ছায়াটাও কুহুর ওপর পড়তে দেইনি।

অন্ধকার রাজ্যের এই আলোকিত অন্দরমহলে সযত্নে আগলে রেখেছিলাম ওকে। সব নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষা করে এসেছি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে পারিনি। পারিনি মেয়েটাকে আগলে রাখতে। এ জগতে সবাইকেই একদিন ধ্বংস হতে হয়। কিন্তু আমার ধ্বংসের প্রথম প্র/হার যে আমার মেয়েকে সহ্য করতে হবে সেটা কল্পণাও করিনি। এখনো অবধি আমার মেয়ের চোখে চোখ রাখার সাহস করে উঠতে পারিনি আমি। জীবনে এই একটা জায়গাতেই হেরে গেছি আমি। জঘন্যভাবে হেরে গেছি।’

নীরবের বুকের ভেতরটা কেমন হুঁ হুঁ করে উঠল। রাশেদ আমেরকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে ও। তার সেই তেজস্বী ব্যক্তিত্বে আপনাআপনিই সম্মানে মাথা নিচু হয়ে আসে নীরবের। সেখানে লোকটাকে ভেতর এমন বিধ্বস্ত দেখে বুক ভার লাগছে। অপর হাত দিয়ে রাশেদের হাতটা চেপে ধরল ও।

রাশেদ আবার বলল, ‘কখনও কারো কাছে কোন অনুরোধ করিনি আমি। সেটা আমার ব্যক্তিত্বের বিপরীত। কিন্তু তুমি কিছুক্ষণ আগেই নিজেকে আমার ছেলে বলেছো। ছেলে হিসেবেই তোমার কাছে প্রথম এবং শেষ একটা অনুরোধ করছি। চিরকাল আমার মেয়েটাকে আগলে রেখো।’
অকারণেই এক ফোঁটা চোখের জল ফেলল নীরব। ধরা গলায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলল, ‘রাখব।’

প্রিয়তা ঘরে ঢুকে দেখল রুদ্র বসে আছে বিছানায়। পু দুটো নামিয়ে বসেছে। গম্ভীরভাবে ভেবে চলেছে কী যেন। দরজা লাগানোর শব্দে চোখ তুলে তাকাল রুদ্র। প্রিয়তা কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামাতে নামাতে বলল, ‘জরুরি কথা ছিল? এভাবে ডাকলেন যে?’
‘ফ্রেশ হয়ে এসো।’ কন্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল রুদ্র।

প্রিয়তা ব্যাগটা কাবার্ডে রেখে নরম কাপড়ের কুর্তি আর ঢোলা পাজামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। বেশি সময় নষ্ট না করে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। রুদ্র তখনও সেভাবেই বসে আছে। প্রিয়তা রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থেকেই হাতমুখ মুছল। তোয়ালেটা রেখে বলল, ‘নিচে থেকে সবটা শুনে এলাম জানেন। আমার আগেই মনে হয়েছিল নীরব ফিরে আসবে। অনেকটা হালকা লাগছে আজ। এবার দেখবেন কুহুও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।’
রুদ্র প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভার্সিটিতে এতক্ষণ কী কাজ ছিল?’

প্রিয়তা খানিকটা ইতস্তত করল। রুদ্র তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা বলল, ‘নীরবের বাড়িতে গিয়েছিলাম একটু। কোনভাবে ওকে বোঝানো যায় কি-না ভেবে। কিন্তু _’
‘কিন্তু?’ রুদ্রর কন্ঠস্বর শান্ত।
‘ওখানেতো নীরবকে পেলাম না। ওর বাবা-মাও কিছু বলল না। এখানে এসে জানলাম যে ও এখানে এসেছে।’
‘ওর বাবা-মা নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কথা বলেছে তোমাকে?’

চুপ হয়ে গেল প্রিয়তা। এই ভয়টাই পাচ্ছিল ও। এইজন্যই লুকোচ্ছিল সবটা। রেগে গেল রুদ্র। উঠে দাঁড়িয়ে প্রিয়তার একটা হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বলল, ‘তোমাকে কে বলেছিল ওখানে যেতে? আমি বলেছিলাম? কার কাছে জিজ্ঞেস করে গেছো?’

রুদ্রর ধমকে মৃদু কেঁপে উঠল প্রিয়তা। প্রায় তুতলে গিয়ে বলল, ‘গার্ড ছিলোতো।’
‘শাট আপ! এখানকার পরিস্থিতি কী কিছুই বুঝতে পারছ না তুমি? যেকোনো সময় আমাদের যেকারো সাথে যা খুশি হয়ে যেতে পারে। আর ওরা সবার আগে আমার দুর্বল জায়গা গুলোতেই আঘাত করবে। সেই হিসেব করলে পরের টার্গেট হবে তুমি। আর তুমি একা নও। আমার সন্তান আছে তোমার গর্ভে। সেটা ওরাও জানে।’
প্রিয়তা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রাগে ফুঁসছে রুদ্র। তাই দু হাতে জড়িয়ে ধরল রুদ্রকে। নরম গলায় বলল,

‘সরি।’
‘ইউ শুড বি।’
রুদ্রর রাগ কমেনি এখনো।

রাতের খাবার শেষে রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফরকে নিজের ঘরে ডেকে নিলেন রাশেদ। আপাতত রাশেদের ঘরে বসে আছে ওরা। রাশেদ বরাবরের মতোই নিজের ইজি চেয়ারে বসে আছেন। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস পাশাপাশি বিছানায় বসেছে। জাফর একটা চেয়ারে।

জাফর বলল, ‘ওদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে চেষ্টা করেও কোনরকম ধারণা পাওয়া যাচ্ছেনা ভাইজান। এদিকে ক্লাইন্টদের একদল টাকা চাইছে, অপরদল মাল। অথচ কোনটাই পর্যাপ্ত নেই আমাদের কাছে। অ/স্ত্র পাওয়া সম্ভব না কারণ চুক্তি বাতিল করে দিয়েছি আমরা। এমন খামখেয়ালির পর নতুন কোন চুক্তি করবেনা তারা আমাদের সাথে। আর আপনার কথামতো ফান্ড, ব্যাংক থেকে সমস্তটাই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে কেবল ইন্ডিয়া আর দুবাই একাংশ শোধ করা গেছে। কিন্তু আফ্রিকায় দেনা অনেক। চেষ্টা করে বাকিগুলো শোধ করা যদি যায়ও ওদের আ/ক্রোশ মিটবেনা।’

উচ্ছ্বাস বলল, ‘লেনদেন বন্ধ হওয়ার আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাকি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা তৈরী হচ্ছে। যদি একবার টের পেয়ে যায় ভেতরকার অবস্থা। দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে দুবার ভাববে না। কিন্তু আমি ভাবছি ব্লাক হোল বা ডার্ক নাইট কী করতে চাইছে সেটাই ভাবছি।’

জাফর বলল, ‘শুধু আমাদের ফাঁদে ফেলে ওরা নিশ্চিন্তে বসে থাকবে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নিশ্চয়ই আরও ভ/য়া/নক কিছু ভাবছে ওরা। এই নিস্তব্ধতা সেই ঝড়েরই পূর্বাভাস।’
রুদ্র খেয়াল করে দেখল রাশেদকে। অবস্থাটা গুরুতর। কিন্তু সে বিষয়ে ওনার কোন মাথাব্যথাই নেই যেন। ইজি চেয়ারে গা ছেড়ে, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে সিলিংএর দিকে তাকিয়ে আছেন। অনেকক্ষণ যাবতই আলোচনা চলছে। কিন্তু নিশ্চুপ ছিলেন রাশেদ আমের। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘তোর বউ, সন্তান তোর কাছ থেকে দূরে। তারজন্যে দায়ী হয়তো আমি। তাইনা জাফর?’

থতমত খেয়ে গেল জাফর। উচ্ছ্বাস এমনকি রুদ্রও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তে, এত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে হঠাৎ এ কথা, তাও রাশেদের মুখে আশা করেনি ওরা। জাফর হতভম্ব গলায় বলল, ‘ভাইজান!’
রাশেদ সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘তোকে আটকে না রাখলেও কখনও যেতেও বলিনি আমি। সেই হিসেবে আমি অবশ্যই দোষী। তবে আজ বলছি, যদি চাস তো ওরা যা চায় করতে পারিস। আমার কথা ভাবার প্রয়োজন নেই।’

‘হঠাৎ এসব কথার কী দরকার ভাইজান?’ জাফর বোকা বনে গেছে।
‘জীবন থেকে মৃত্যু সবকিছুই হঠাৎই আসে। ভবিষ্যতে কী হবে কেউ জানেনা। এটাই নিয়ম। আমার কথাগুলো ভেবে দেখিস। জীবন একটাই।’

উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আজ সন্ধ্যায় ওকে বসিয়ে কত কথা বলেছে রাশেদ। একান্তে ওর সঙ্গে এতো কথা এর আগে কোনদিন বলেনি রাশেদ। রুদ্র নির্বিকারভাবে পলকহীন চোখে দেখে চলেছে রাশেদকে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে।

রাশেদ সিগারেট অ‍্যাশট্রেতে গুজে রাখতে রাখতে বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে। তোমরা এখন এসো।’
একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা তিনজন। প্রথমে জাফর, এর উচ্ছ্বাস বেরিয়ে গেল। রাশেদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দেখল সেটা। রুদ্র সেটাও দেখল। এরপর একটা শ্বাস ফেলে উঠতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে বসে পড়ল। রাশেদের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক আছে, বাবা?’

‘হুঁ? হ্যাঁ আমার কী হবে?’ কন্ঠে ঝাঁঝ আনার চেষ্টা করলেও, এলোনা।
‘হামিদের ব্যবস্থাটা আমিই করতে পারতাম, বাবা। প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলাম। আপনি শুধুশুধুই_’
‘বাকি কাজটা তোমাকেই করতে হবে। চিন্তা করোনা।’

রুদ্র তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। রাশেদ আবার বলল, ‘আমাদের কাজের অনেক নিয়মনীতি আছে। আঘা/ত প্রতিঘা/ত সেই নিয়মের অংশ। কিন্তু সেই ঘা/ত, প্রতিঘা/তেরও কিছু নিয়ম থাকে। সেই নিয়ম যদি কেউ ভঙ্গ করে তখন সেটা অন্যায়। কুরুক্ষেত্রের যু/দ্ধের কথা জানো নিশ্চয়ই? যুদ্ধের বারোতম দিন অবধি কৌরব, পাণ্ডব উভয়ই নিয়ম পালন করেছে। কিন্তু তেরোতম দিনে কৌরবরা যু/দ্ধের নিয়ম ভেঙে সকল মহারথী মিলে অন্যায়ভাবে নিরস্ত্র বালক অভিমন্যূকে হ/ত্যা করে। আর তারপর, বাকি পাঁচদিন কী ঘটেছিল মনে আছে?’

‘আছে। দুই পক্ষ আর কোন নিয়ম মানেনি। সকল নিয়মের উর্ধ্বে গিয়ে মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল।’
হঠাৎ চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রাশেদের। শক্ত গলায় বললেন, ‘এবার তুমিও সেটাই কর। সকল নিয়ম ভুলে যাও। ভুলে যাও সব কৌশল। শুধু তিনটে শব্দ মনে রাখো। সংহার, সংহার এবং সংহার।’

এরপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলল রুদ্র রাশেদ। কিছু অবিশ্বাস্য নির্দেশ দিল। যা শুনে অবাক হল রুদ্র। কিছুক্ষণ চুপ থাকল। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল রাশেদকে। ওর বাবা সুন্দর সেটা জানে ও। বয়স প্রায় ষাট ছোঁয়া কী অদ্ভুত তার জৌলুস, সুঠাম দৃঢ় শরীর। ভারী, বজ্র কন্ঠ। যে আওয়াজে রুদ্র আমেরের পাথরসম হৃদয়ও কেঁপে ওঠে। তেজস্বী সেই মুখটার তেজ যেন আজ হঠাৎই আরও বেড়ে গেছে। রুদ্র ধীর পায়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই রাশেদ বলে উঠল, ‘রাজা?’

রুদ্রর বুকের মাঝে কেমন করে উঠল। এই নামে কতবছর পর ডাকল রাশেদ ওকে। রুদ্রর মনে পড়ে ওর ডাকনাম রাজা ছিল। ওর মা ওকে রাজা বলে ডাকতো। রাশেদও ডাকতো। মাঝেমাঝে। আজ কতবছর পর! রুদ্র আস্তে করে পেছন ফিরল। রাশেদ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কোমল দৃষ্টি। ধীরপায়ে গিয়ে রাশেদের পায়ের কাছে ফ্লোরে বসল রুদ্র। নিজের অজান্তেই।

‘আমি তোর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি অন্যায় করেছি, তাইনা?’
কেমন বদলে গেছে রাশেদের কন্ঠস্বর। রুদ্র রাশেদের কোলের ওপর দুই হাত রেখে বলল, ‘এভাবে কেন বলছো বাবা?’
‘মা মারা যাওয়ার পর একজন বাবার দায়িত্ব থাকে সন্তানকে দুজনের ভালোবাসা দেওয়া সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কিন্তু আমি তা করিনি। বরং আরও কঠোর হয়েছি। আঘাত করে করে শক্ত পাথর বানিয়েছি তোকে। নিজের সন্তান নয়, অ/স্ত্র বানিয়েছি।’
‘তুমি আমাকে ভালোবাসাও দিয়েছো বাবা।’

রাশেদ মৃদু হেসে বলল, ‘সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের সত্যি সম্পর্কে অবগত আমি।’
রুদ্র বলার মতো কিছু খুঁজে পেলোনা। রাশেদ বলে চলেছে, ‘তোর মায়ের সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হয় তখন ও জানতো না আমাদের গোপন কাজ সম্পর্কে। যখন জানতে পারে তখন তুই ওর গর্ভে ছিলি। প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিল মেয়েটা। কিন্তু ভীষণ ভিতু ছিল, স্বামী ভক্তি ছিল প্রচুর। তাই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সাহস হয়নি।

শুধু অনুরোধ করতো আমি যাতে এসব ছেড়ে দেই। আমিও বারবার বলতাম, ছেড়ে দিয়েছি, ছেড়ে দেব। বলার জন্যেই বলা আরকি। বংশগতভাবে চলে আসা কাজ ছাড়ার কথা ভাবেও নি আমার তরুণ মন-মস্তিষ্ক।একসময় ও নিজেই চুপ হয়ে গেল। বুঝতে পেরেছিল হয়তো আমি শুনবো না। কয়েক বছর কেটে গেল। কিন্তু যখন কুহুর জন্ম হলো। তখন কেন জানি আমার ইচ্ছে করেছিল সব ছেড়ে দিতে। পূর্ণ সংসারী হতে। সত্যি বলতে সবরকম প্রস্তুতি নিয়েও ফেলেছিলাম। কিন্তু সেইমুহূর্তেই তোর মায়ের মৃ/ত্যু হল। সবাই জানে সেটা স্বাভাবিক মৃ/ত্যু। সন্তান জন্মদানের পর অসুস্থতার কারণে মারা গেছে। কিন্তু আসল সত্যি হল, ওকে বি/ষ দেওয়া হয়েছিল।’

রুদ্র চমকে উঠল। এ কথা জানতো না ও। রুদ্রর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে রাশেদ বলল, ‘তখনকার এক শত্রুদলের কাজ। বাড়িতে কাজের লোক সাজিয়ে পাঠিয়েছিল একটা মেয়েকে। চায়ের মধ্যে বি/ষ মিশিয়ে দিয়েছিল। যদিও চা টা আমার জন্যে ছিল। কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে নিজে খেয়ে নিয়েছিল। ওরা যদি জানতো আমি এসব ছেড়ে দিচ্ছি তাহলে হয়তো এসব করতো না। কিন্তু ছাড়ার আগেই_’

বলে থামল রাশেদ। রুদ্রও চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাশেদ আবার শুরু করল, ‘জেদ চেপে গেল মাথায়। যে জগত ছাড়ার কথা ভাবছিলাম, সেই জগতেই রাজত্ব করব বলে ঠিক করলাম। এই জগতে রাজ করার জন্যে পাথরের চেয়েও শক্ত, নিষ্ঠুর হৃদয় দরকার হয়। তাই নিজের একমাত্র ছেলের হৃদয়টাকেই সেভাবে তৈরী করলাম। কাঁদাতে, কাঁদাতে তোকে কাঁদতে ভুলিয়ে দিলাম। তোর চোখের সামনে তোর সব সব প্রিয় জিনিস নষ্ট করে, মায়া, পিছুটানহীন নিষ্ঠুর বানালাম। বদমেজাজি তৈরী করলাম। যার ফলে জীবন্ত মানুষকে টুকরো টুকরো করে কা/ট/তেও আজ তোর হাত কাঁপেনা। নিজেরই ছেলেকে নিজের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য অ/স্ত্র বানালাম। এমন হয়তো কোন বাবাই করবেনা। তাইনা? পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বাবা আমি।’

‘এখন এসব কথা থাক না বাবা। অনেক রাত হয়েছে। আপনার ঘুমানো দরকার।’ আড়ষ্ট গলায় বলল রুদ্র।
কিন্তু রাশেদ থামলেন না। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি জানি বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ। তবে আমার মা/র খেয়ে যখন তোমার জ্বর চলে আসতো। রাতে তোমার সেই কাঁপতে থাকা শরীরটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাতাম আমি। তোমার ক্ষ/ত জায়গায় নিজের হাতে মলম লাগাতাম।

তুমি টের পেতেনা। তাতে তোমার দোষ নেই। আমি টের পেতে দিতাম না। আমি চাইতাম না তুমি স্নেহের স্পর্শ অনুভব কর। তোমার হৃদয়ে কোন কোমলতা থাক। কিন্তু এসবের মাঝে আমি ভুলেই গেলাম, যার মৃ/ত‍্যুতে জেদ করে আমি এসব করলাম। তার ইচ্ছে ছিল তার ছেলে অন্তত তার স্বামীর মতো ক্রি/মি/নাল হবেনা। মানুষের মতো মানুষ হবে। কিন্তু আমি নিজেই তার ছেলেকে ক্রি/মি/নাল জগতের সবচেয়ে ভয়ানক ক্রি/মি/নালে পরিণত করেছি। আজ খুব মনে পড়ছে ওর কথা। আমি ওর সবচেয়ে বড় অপরাধী।’

রুদ্র কিছু বলছে না। কেমন একটা লাগছে ওর। এমন অনুভূতি এর আগে কোনদিন হয়নি। রাশেদের অকপট স্বীকারোক্তিগুলো ওর বুকে আ/ঘা/ত করছে। রাশেদ হঠাৎ নিজের পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢোকাল। হাত বের করতেই রুদ্র তার হাতে একটা লকেট দেখল। চমকে উঠল ও। রাশেদ ঠোঁটে মলিন একটু হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘চিনতে পেরেছো?’
চেনেনি মানে! বলা যায় লকেটটা কোনদিন ভোলেনি রুদ্র। এটা ওর মায়ের সেই লকেট। যেটা রাশেদ ছোট্ট রুদ্রর চোখের সামনে ভেঙে ফেলেছিল। এটা জুড়ল কে?

‘ভাঙার পরপরই জুড়েছিলাম। তোমাকে দেইনি। দিতে চাইনি আরকি। তোমার জিনিস আজ তোমাকেই ফিরিয়ে দিলাম।’
বলতে বলতে রুদ্রর হাতে ধরিয়ে দিল রাশেদ। রুদ্র হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল ওটাকে। রাশেদ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘তবে একটা সত্যি কী জানো রুদ্র? তুমি যতবার জ/খম নিয়ে বাড়ি ফিরতে আমার কষ্ট হতো। যতবার কোন মিশনে বের হতে আমি তোমার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হতাম। তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় চাতক পাখির মতোই অপেক্ষা করতাম।’ রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দুর্বল হাসি হেসে বলল, ‘হাসি পাচ্ছে তাইনা? বিশ্বাস হচ্ছেনা?’

‘কথাগুলো আমার জানা, বাবা। আপনি না বললেও আমি বুঝতে পারতাম।’
‘সত্যি?’ অনেকটা ছেলেমানুষদের মতোই বলল রাশেদ।
‘সত্যি।’ খানিকটা কেঁপে গেল রুদ্রর গলা।

রাশেদ চুপ করে গেল। রুদ্রও চুপচাপ বসে রইল রাশেদের পায়ের কাছে। কিছুক্ষণ বাদে রাশেদ সিগারেটের প্যাকেটটা নিল। রুদ্র অ‍্যাশট্রের দিকে তাকিয়ে দেখল সিগারেটের পোড়া শেষ অংশ ভর্তি হয়ে আছে। রাশেদ সিগারেট বের করতেই রুদ্র বাঁধা দিয়ে বলল, ‘আজ থাকনা বাবা।’
ছেলের কথা মেনে নিলেন রাশেদ। রেখে দিলেন সিগারেটটা প্যাকেটের মধ্যে। বললেন, ‘ঘরে যাও। প্রিয়তা একা আছে নিশ্চয়ই। সময় দাও নিজের স্ত্রীকে।’

রুদ্রর আজ যেতে ইচ্ছে করছেনা। বলতে ইচ্ছে করছে থেকে যাইনা আজ এই ঘরে। ছোটবেলার মতো তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমালে তুমি রাগ করবে বাবা? কিন্তু কিছু বলতে পারল না। চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। রাশেদ এখনো চেয়ারের হেলান দিয়ে বসে আছে। রুদ্র বুক ভারী লাগল। ধীরপায়ে বেরিয়ে যেতে নিল তখনই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল প্রিয়তা। রুদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রিয়তা বলল, ‘বাবার রাতের ঔষধ খাওয়া হয়নি বোধ হয়। সেটাই দেখতে এসেছি।’

রোজ রাতেই প্রিয়তা এসে দেখে যায়। রাদেশ ঔষধ খেয়েছে কি-না। না খেলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়ে দিয়ে যায়। তাই রুদ্র বলল, ‘আমি রুমে যাচ্ছি। তুমি দেখে এসো।’
প্রিয়তা মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকল। রুদ্র যাচ্ছি বলল ঠিকই। কিন্তু দরজার কাছে যেতেই পা থেমে গেল। যেতে ইচ্ছা হলোনা। প্রিয়তা রাশেদের দিকে তাকিয়ে দেখল চোখ বন্ধ করে বসে আছে মানুষটা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঔষধের বাক্সটা দেখল। খায়নি। প্রিয়তা মৃদু গলায় ডাকল, ‘বাবা?’

চোখ খুলল রাশেদ। প্রিয়তাকে দেখে বলল, ‘কী ব্যপার?’
‘আপনার ঔষধ খাওয়া হয়নি। খেয়ে নিন।’
‘খাইনি না? দাও।’

বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন রাশেদ। প্রিয়তা সযত্নে ঔষধগুলো খুলে দিল রাশেদকে। পানি এগিয়ে দিল। ঔষধ খাওয়ানো হলে বাক্সটা গুছিয়ে রেখে দেখল রাশেদ আবার চেয়ারে গা ছেড়ে চোখ বুজে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল প্রিয়তা। অনুরোধের স্বরে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়ুন বাবা। রাত হয়েছে।’

বলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে নিলেই হঠাৎ রাশেদ বলে উঠল, ‘প্রিয়তা? একটু আমার কাছে বসবি মা?’
প্রিয়তা কেঁপে উঠল। দরজার ওপাশ থেকে নড়ে উঠল রুদ্রও। প্রিয়তা করুণ চোখে ঘুরে তাকাল রাশেদের দিকে। অকারণেই দুচোখে জল জমা হয়ে গেল। কান্না আটকাতে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল প্রিয়তা।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৯

[ আমার গল্প লেখার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পর্ব দিয়েছি আজ। পাঁচ হাজার প্লাস শব্দ। তাই আর রি-চেইক করা হয়নি।
আর অনির কলমে আদ্রিয়ান তিন/চার দিন পর দেব। রিল্যাক্স মাইন্ড ছাড়া ওটা লিখতে পারিনা আমি। আরেকটু ধৈর্য্য রাখুন। ]

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬১