অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৪

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৪
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

গভীর রাত। শহরের জনবহুল রাস্তা পেরিয়ে এসেছে জিপটা। ফাঁকা রাস্তা, কনকনে শীত। কিছু জায়গা বাদে বাদে একটা করে ল্যাম্পপোস্ট। সামনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গাড়ি চালাচ্ছে রুদ্র। ওকে দেখে কমান্ড দেওয়া রোবট মনে হচ্ছে। এই মুহুর্তে যার একমাত্র কাজ গাড়ি চালানো। কিন্তু মনের মধ্যে কী চলছে, কে জানে?

ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাকাল রুদ্র। ব্যাকসিটে পড়ে আছে শান মীর্জার অজ্ঞান দেহ। মাঝে একবার জ্ঞান ফিরেছিল। ক্লোরোফোমের কৃপায় আবার জ্ঞান হারিয়েছে সে। ঘাড় ফিরিয়ে দৃষ্টি পুনরায় রাস্তায় ফেলল। গভীর কালো চোখদুটোকে এইমুহূর্তে বাজপাখির চোখের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুদ্র কেবল খু/নগুলো করছিল তাইনা। খু/নগুলো নিয়ে লোকে কী ভাবছে। পুলিশ কতদূর কী করেছে। সবটা খবর রাখছিল ও। নয়তো ওর অন্য উদ্দেশ্য পূরণ হতো না। খু/নগুলো করা ছাড়াও ওর ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। যা রুদ্র ছাড়া আর কেউ জানেনা। সেই সুত্রেই জানতে পেরেছে কেসটার তদন্ত করছেন ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদ। তারপরই তুহিন সম্পর্কে ছোটখাটো একটা রিসার্চ করেছে। আর তুহিন সম্পর্কে সব তথ্য জেনে বেশ সন্তুষ্ট-ই হয়েছে। অদ্ভুত শোনালেও এরকম একজনকেই চাইছিল ও। আর খবর কাগজে কমিশনারের বয়ান পড়েই ও বুঝে ফেলেছিল যে খু/নির খোঁজ পেয়ে গেছে তুহিন। যথেষ্ট প্রমাণ সহ।

ব্যপারটা বুঝতে পেরে প্রথমে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিল রুদ্র। ও তখনই চায়নি ব্যপারটা। আরেকটু সময় পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ সেসব নিয়ে আর ভাবেনা। যা ঘটে গেছে সেটা নিয়ে হা-হুতাশ করে সময়ের অপচয় বৈ কিছুই না। কিন্তু এতো কড়া পাহারার মধ্যে শানের কাছে পৌঁছনোর একটাই উপায় ছিল। শানের কাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওর নিজের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ব্যপারটা রিস্কি, কিন্তু একমাত্র উপায়।

সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজায় ও। শানকে যে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে তার আশেপাশে থাকার একটা জায়গা খোঁজে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। তাই অসম্পূর্ণ একটা ফাঁকা বিল্ডিং পেয়ে যায়। অনেক আগেই কোনকারণে কাজ বন্ধ ছিল হয়তো। তাই লোকজনও নেই ওখানে। সেটাকেই উপযুক্ত জায়গা মনে হয় ওর। তাই ওখানেই নিজের ঘাঁটি গেড়ে নেয়।
এরপর যোগাযোগ করে সেই ডাক্তার রতনের সঙ্গে। ঐ মুহূর্তে রুদ্রর কল পেয়ে অবাক হন ডাক্তার রতন। বলেন, ‘কী ব্যপার রুদ্র? কোথায় তুমি? মানে তোমরা কোথায়? শুনলাম আমের ভিলা সম্পূর্ণ ফাঁকা করে দিয়ে চলে গেছো তোমরা? কেনো?’

‘আমার আপনার সাহায্য দরকার চাচা।’ প্রথমেই কাজের কথা পাড়ল রুদ্র।
অবাক হলেন ডাক্তার। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, ‘রাশেদ ভাই আমার কাছে কী ছিল সেটা তুমি জানোনা রুদ্র। এইযে ডাক্তারি পড়ে, ডাক্তার হয়ে সম্মান নিয়ে গোটা জীবনটা পাড় করে দিলাম। তার পেছনে কার অবদান সেটা কেবল আমি জানি। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ার পর যে পড়াশোনা করতে পারব সেটাইতো ভাবিনি। সেখানে মেডিকেল! সারাজীবন তার ঋণ শোধ করার সুযোগ খুঁজেছি। জীবিত থাকতেতো মানুষটার জন্যে কিছু করতে পারিনি। তুমিতো সেই তেজস্বী মানুষটারই অংশ। তার প্রতিরূপ। তোমার জন্যে কিছু করতে পারলে সে সুযোগ লুফে নেব আমি।’

কিছুক্ষণ চুপ থাকল রুদ্র। মনে পড়ল বাবার কথা। সেই তেজ, দৃঢ় চলন, বজ্র কন্ঠ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, ‘ব্যপারটা একটু জটিল। কিছুটা আইন লঙ্ঘন করতে হবে আপনাকে।’
আরও কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন রতন ডাক্তার। তারপর বললেন, ‘আইনতো মানুষেরই তৈরী। মানুষের তৈরী আইন মানুষের জন্যে ভাঙাতে কোন অন্যায় আমি দেখছি না। যেই আইন মানুষরূপি জানোয়ারকে বাঁচিয়ে দিতে পারে সেই আইন মেনে কার কী লাভ? বলো কী প্রয়োজন?’

রুদ্র সাভারের সেই হসপিটাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। যেখানে শান ভর্তি ছিল। জানতে চাইল সেখানে তার ঘনিষ্ঠ কোন ডক্টর আছে কি-না। কিংবা এমন কেউ যে তাকে নির্দ্বিধায় যেকোন রকমের সহযোগিতা করবে। সেবারেও ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল রুদ্রর প্রতি। ডাক্তার রতন কিছু সেকেন্ড ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আছে। কিন্তু সাহায্য করতে পারবে কি-না সেটা সাহায্যের ধরণের ওপর ডিপেন্ড করবে। কাজটা কী?’

‘বেশি কিছুনা। দশ মিনিট। জাস্ট দশ মিনিটের জন্যে শান মীর্জার কেবিনের সামনে থেকে যেকোন একজন গার্ডকে সরাতে হবে।’
‘শুধু একজন?’
‘হ্যাঁ। কেবিনের বাইরে দুজন থাকবে। দুজন একসাথে কখনই সরবে না। আর একজনকে নিঃশব্দে সামলে নেব আমি।’
‘হসপিটালের বাইরে লোক আছেতো ওদের।’
‘তখন থাকবেনা।’

‘কেনো?’
‘আমার পেছনে দৌড়নোর জন্যে।’
‘মানে?’
‘পরে বলব চাচা। সময় নেই। বলো পারবে কাজটা?’
রতন ডাক্তার আরেকটু চুপ থেকে বললেন, ‘সে না হয় ব্যবস্থা করিয়ে দিলাম। আর কিছু?’
রুদ্র সঙ্গেসঙ্গেই বলল, ‘ হ্যাঁ! অ‍্যাম্বুলেন্স আর অ‍্যাপ্রোনের ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে?’
‘অ‍্যাপ্রোন না হয় বুঝতে পারছি। কিন্তু অ‍্যাম্বুলেন্স?’

‘হ্যাঁ। ওটাই সবচেয়ে বেশি দরকার হবে আমার। সম্ভব হবে চাচা?’
ডাক্তার ভাবুক হয়ে বললেন, ‘কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। আমি দেখছি। সব ব্যবস্থা করে জানাচ্ছি তোমাকে।’
‘একটু তাড়াতাড়ি চাচা। সময় নেই আমার হাতে।’
‘কিন্তু তুমি একা কীকরে সব সামলাবে?’
‘আমার সঙ্গে আছে একজন।’
‘কে সে?’

‘পরে বলব চাচা। তবে ওকে দেখেছেন আপনি। রাখছি এখন।’
সেদিন রাতেই ডাক্তার ফোন করে রুদ্রকে। ঐ হাসপাতালের একজন ডাক্তারের নাম্বার দেয়। সে কেবল ডাক্তারই না। সেই হাসপাতালের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি। এবং ডাক্তার রতনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রতন আশ্বাস দেন নিজের সামর্থ্যের মধ্যে সবরকম সাহায্য করবে সেই ডাক্তার। আসলেই তাই ঘটে। খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই রুদ্রর সব নির্দেশ শোনেন তিনি। এবং যথাসময়ে সে অনুযায়ী কাজ করার আশ্বাস দেন। পুরো ক্রেডিটটাই ডাক্তার রতনের। তার জন্যেই এরকম রিস্ক নিতে রাজি হয় সেই ডাক্তার।

আজকেই আশেপাশের লোকেদের কাছে ওর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে জানতে পারে রুদ্র। কারণ ও সেই বিল্ডিংয়ে বসে থাকলেও একজন ছিল যে সারাক্ষণ চারপাশে ঘুরঘুর করে সব খবর ওকে দিচ্ছিল। রুদ্র বুঝে যায় রাতের মধ্যেই ওকে ধরার চেষ্টা করা হবে। সেই সুযোগেরই সৎ ব্যবহার করতে চেয়েছে রুদ্র। পরিকল্পনা সাজিয়ে নেয় নিজের সঙ্গীর সাথে। তুহিন কখন আসছে। কী কী করছে বাইরে থেকে সে ইনফরমেশ আগেই রুদ্রর কাছে পাঠিয়ে দেয় ওর সঙ্গী।

চারতালাতে গু/লি গ্রে/নে/ট ছুড়ে সোজা দশ তালায় চলে যায় রুদ্র। ঐ ফ্লোরের বাঁ পাশ বরাবর ছিল হাসপাতালের একটা স্টোররুমের জানালা। পরিকল্পনা মোতাবেক বিল্ডিংয়ের পিলার আর হাসপাতালের স্টোররুমের খোলা জানালার সঙ্গে শক্ত রশি বেঁধে রেখেছিল ওর সঙ্গী। রুদ্রর জন্যে রশি বেয়ে হাসপাতালের স্টোররুমে পৌঁছে যাওয়াটা ছিল বাঁ হাতের খেল। কিন্তু ভয় ছিল নিচের পুলিশদের নিয়ে। কোনভাবে তাদের দৃষ্টি ওদিকে পড়লে সব ভেস্তে যেতো। কিন্তু রিস্ক নিয়েছিল রুদ্র। এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিলোনা। সৌভাগ্যবশত ভেতরের গু/লির আওয়াজ আর গ্রে/নে/ট ফাঁটার আওয়াজে তারা হতভম্ব হয়ে যায়। সেদিকে দৃষ্টি যায়না। অপরদিকে রেকর্ডেট গু/লির আওয়াজগুলোতে দিশেহারা তুহিন আর বাকি ফোর্সরা ভাবে যে রুদ্র এখনো ভেতরে।

কিন্তু ততক্ষণে রুদ্র পৌঁছে গেছে পাঁচতলায়। স্টোররুমে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল নার্সের পোশাক পড়া দুজন মহিলা। দুজন ওদেরই ঠিক করা। সেই মহিলা দুজনই নিয়ে আসে ওকে শানের কেবিনে। ডাক্তার নিজের কথামতো একজন গার্ডকে সরিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। বাকি একজনকে পেছন থেকে ক্লোরোফোম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে রুদ্র। অজ্ঞান গার্ডকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখে ঘুমোচ্ছে শান। শানকেও একইভাবে অজ্ঞান করে ফেলে নার্স। নার্সের সহায়তায় অজ্ঞান গার্ডকে বেডে শুইয়ে দিয়ে শানকে স্ট্রেচারে নিয়ে বেরিয়ে যায় ওরা। বেডে রেখে আসে আগে লিখে রাখা সেই চিঠিটা।

নিচে ওয়ার্ডবয় সেজে দাঁড়িয়ে ছিল রুদ্রর সেই সহযোগী। শানের অজ্ঞান দেহটাকে মৃতদেহ সাজিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে ওরা। হাসপাতালে এধরণের ঘটনা অহরহ। আর বাইরে পুলিশের বাড়তি কোন পাহারাও ছিলোনা। তাই কোনরকম সমস্যা হয়না।
বাইরে অ‍্যাম্বুলেন্সও রেডি ছিল। প্রস্তুত করে রেখেছিলেন ডাক্তার। অ‍্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার জানতো যে হাসপাতালের একটা ডেডবডি নিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে একমাত্র রতনের সেই বন্ধু ডাক্তারই জানতেন আসল সত্যিটা।

চাইলে অ‍্যাম্বুলেন্স ছাড়াও বেরিয়ে আসতে পারতো রুদ্র। কিন্তু অ‍্যাম্বুলেন্স নেওয়ার কারণ ছিল ভিন্ন। রুদ্র জানতো তুহিন সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে সব রোড ব্লক করবে। চেকপোস্টে খবর পাঠাবে। সে অবস্থায় শহর থেকে বেরিয়ে আসা কোনভাবেই সম্ভব হতোনা ওর পক্ষে। আর শহর ছাড়তে গিয়ে ব্যপারটা ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে রুদ্র।

সত্যিই চেকপোস্টে, রোডে সবজায়গায় চেকিং চলছিল। ওর ভয় ছিল অ‍্যামুলেন্সও না চেক করতে আসে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। অ‍্যাম্বুলেন্স কেবল বাইরে থেকে কোনরকম চোখ বুলিয়ে, চলমান অবস্থাতেই ছেড়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই রুদ্র যে অ‍্যাম্বুলেন্স নিয়ে পালাতে পারে এটা কারো মাথাতেও আসেনি। এমনকি তুহিনেরও না।

অ‍্যাম্বুলেন্স নিয়ে শহর ছাড়িয়ে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ায় ওরা। ঐ দুজন মহিলার বাড়ি সেটা। ওখান থেকেই বিদায় দেয় অ‍্যাম্বুলেন্সকে। সেখান থেকে ওর সঙ্গীকে তার কাজ বুঝিয়ে দেয়। তারপর জিপে করে জ্ঞানহীন শানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিজের গন্তব্যে।

একের পর এক কল রিসিভ করে যাচ্ছে তুহিন। কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হচ্ছে। রুদ্রর সেই চিঠিটা পড়ার পর আর অপেক্ষা করেনি তুহিন। এটা নিশ্চিত যে রুদ্র মাত্রই বেরিয়েছে। তাই সঙ্গেসঙ্গে হাসপাতালের চারপাশে সম্ভাব্য দূরত্বে রোড, চেকপোস্টে প্রতিটা জায়গায় চেকিং এর ব্যবস্থা করে। যাতে রুদ্র কিছুতেই নির্দিষ্ট গোন্ডির বাইরে বের হতে না পারে। সে অনুযায়ী কঠোরভাবে প্রতিটা গাড়ি, মানুষকে চেক করা হচ্ছে। কিন্তু প্রায় ভোর হতে চলল রুদ্র বা শানের টিকির খোঁজটাও কেউ দিতে পারছেনা।

সিটের ওপর নিজের ফোনটা প্রায় ছুড়ে মারল তুহিন। চাপা আওয়াজে বলর, ‘ড্যাম ইট!’
ফ্রন্ট সিট থেকে ঘাড় ফিরিয়ে তমাল বলল, ‘স্যার, আমার মনে হয় আমরা যেই সার্কেল ক্রিয়েট করেছি তার বাইরে বের হতে পারেনি রুদ্র। সবগুলো রোডে কড়া চেকিং চলছে স্যার।’
‘যদি বেরিয়ে গিয়ে থাকে?’

‘সম্ভবই না স্যার। কারণ সার্কেলটা আমরা হসপিটালকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট দূরত্বে তৈরী করেছি। অতো অল্প সময়ে সেই সার্কেল পাড় করা কোনভাবেই সম্ভব না। যত স্পিডেই গাড়ি চালাক।’
তুহিন কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, ‘চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে থাকলে? ভুলে যেওনা ও রুদ্র আমের।’
তমাল আবার সামনে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু হসপিটাল থেকে বের হলো কীকরে সেটাই বড় প্রশ্ন।’

জবাব দিলোনা তুহিন। ব্যপারটা ওর কাছেও ধোঁয়াশা। জিজ্ঞাসাবাদ করেও সন্তোষজনক কোন উত্তর পায়নি কারো কাছে। সেই দুজন পুলিশ গার্ডকে প্রশ্ন করেছিল কী ঘটেছে। যে অজ্ঞান ছিল সে কেবল বলতে পেরেছে পেছন থেকে কেউ মুখ চেপে ধরেছিল ওর। এরপর কিছু মনে নেই।

অপরজন বলল, একজন নার্স এসে বলে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ডাক্তার। শওকত মীর্জার কল। খুবই ইমার্জেন্সি। কিন্তু ডাক্তারের কেবিনে যেতে নিলে সেই নার্স বলে ডাক্তার কেবিনে নেই। এবং নার্সের সঙ্গে চারতলার কোনে কোথাও একটা নিয়ে যায়। ঠিক তখনই পেছন থেকে মুখে ব্যাগ জাতীয় কিছু পড়িয়ে বেধড়ক পেটায় কেউ ওকে। তারপর মাথায় মে/রে অজ্ঞান করে দেয়।

কিন্তু হাসপাতালের সকল নার্সকে জড়ো করা হলেও সেই নার্সকে আর পাওয়া গেলোনা। এমনকি হসপিটালের লিস্টেও সেই নার্সের কোন ডিটেইলস নেই।
ডাক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে সোজা বলে দেয় সে ডাকেইনি কাউকে।
দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগেনা তুহিনের। সব রহস্য সেই নার্সের মধ্যে। কিন্তু রুদ্র বের হল কীকরে? আর যাই হোক ওর পক্ষে একা সবটা করা সম্ভব হয়নি। সে ও যতো চতুরই হোক। কেউতো সাহায্য করছিল ওকে। সেটা কে?
তুহিনের এই ভাবনার মাঝে তমাল নিজেও বলে উঠল, ‘স্যার আমার মনে হচ্ছে রুদ্র একা নেই। কেউ একজনতো আছে ওর সঙ্গে।’

তুহিন জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরে তাকাল। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমারও।’
এরপর সিটে গা ছেড়ে দিল। জ্যাকেটের পকেট থেকে বার করল রুদ্রর রেখে যাওয়া চিঠিটা। আরও একবার পড়ল। চিঠির প্রতিটা শব্দ যেন বিদ্রুপ করছে ওকে। উপহাস করে বলছে, “এই তুমি তুখোড় ইনভেস্টিগেটর!” রুদ্রকে ধরতে না পাড়ায় বসও খুব একটা মধুরভাবে কথা বলেনি ওর সঙ্গে। কমিশনারও রেগে ব/ম্ব। যেন ওনারা থাকলে এতক্ষণে রুদ্রর ফাঁ/সির রায় হয়ে যেতো। রাগ হলো ওর। নিজের ওপর, সবার ওপর।

টিনের তৈরী একটা দুই রুমের ঘর। নিচে মাটি। মাটির ওপর খড় বেছানো। পাশের ঘরটাকে শানকে বেঁধে ফেলে রেখেছে। এঘরে বসে চুপচাপ সিগারেট ফুঁকছে রুদ্র। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল ওর। ভ্রু কুঁচকে অলস ভঙ্গিতে ফোনটা চেক করল। কিন্তু নাম্বারটা দেখে দ্রুত কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কেউ বলল, ‘রুদ্র ভাই। ভালো আছেন?’

রুদ্র স্বস্তি পেল। এটা একটা কোড। যদি পুলিশের সামনে বা ব/ন্দু/কের সামনে বাধ্য হয়ে ফোন না করে থাকে তাহলেই এই কথাটা বলার কথা। এটা বলেছে মানে ওদিকে সব ঠিক আছে। রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, ‘কী হয়েছে। এই ভোররাতে ফোন করেছো কেন নীরব?’
নীরব বলল, ‘অন্যসময় হলে রিস্ক হয়ে যেতো। এখন আশেপাশে কেউ নেই।’

‘কোথা থেকে বলছো?’
‘আপনি যেখান থেকে কল করতে বলেছিলেন সেখানেই।’
‘ওদিকে সব ঠিক আছে?’
‘না রুদ্র ভাই। জ্যোতি এখন পুলিশ কাস্টেডিতে। সন্ধ্যার দিকে কল করেছিল পুলিশ স্টেশনে বসে। সরাসরি বলতে না পারলেও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে।’

কিছুক্ষণ চুপ থাকল রুদ্র। তারপর বলল, ‘ভয় পেওনা। আমি চিনি ওকে। ওর মুখ থেকে এমন কোন তথ্য বের হবেনা যেটাতে আমি ধরা পড়ে যাব। আর তোমাদের ধরলেও কেবল জিজ্ঞাসাবাদের জন্যেই ধরবে। ঘাবড়ে যেওনা। যেভাবে বলেছি সেভাবে করে যাও। কোন সমস্যা হবেনা।’

‘জ্বি।’
রুদ্র এবার কিছুটা নরম গলায় বলল, ‘কুহু আর বাকিরা কেমন আছে?’
‘ঠিক আছে ভাই।’
‘বাচ্চাটার খেয়াল রেখো। নিউমোনিয়া হয়ে গেলে বিপদ হবে।’
‘জ্বি।’
‘রাখছি।’
‘ভাই_’

রুদ্র রাখতে গিয়েও থেমে গেল। আবার ফোনটা কানে নিল। নীরব খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘প্রিয়তা ভাবি নিরাপদে আছে তো?’
রুদ্র মুচকি হাসল। স্থির, গম্ভীর গলায় বলল, ‘আছে।’

ফোনটা রেখে দিল রুদ্র। হঠাৎ কেমন জ্বলে উঠল চোখদুটো। অদ্ভুত হিংস্রতা খেলে গেল মুখজুড়ে। পাশে তাকিয়ে দেখল পানির ক্যানটা। ওটা নিয়ে ওঠে দাঁড়াল। দৃঢ় পায়ে চলে গেল পাশের রুমে। গিয়ে দেখল খামের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা শানের শরীরটা ওভাবেই আছে। ক্যানে মুখটা খুলে সবটুকু পানি ঢেলে দিল শানের মুখে। ধরধরিয়ে নড়েচড়ে বসল শান। হাত পেছন মোড়া করে বাঁধা থাকায় পড়ে গেল।

মুখের মধ্যে কাপড় গুঁজে শক্ত করে বেঁধে রাখা। তাই শব্দ ও বের হলোনা। চারপাশের পরিস্থিতি বুঝে নিতে সময় লাগল কিছুক্ষণ। মনে পড়ে গেল মাঝে জ্ঞান ফিরে পেয়ে রুদ্রকে দেখেছিল ও। তারমানে_। বিষ্ফোরিত চোখে সামনে তাকিয়ে দেখল স্বয়ং যমদূত দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার পড়ে গেল। পা দুটোও বাঁধা। যখন বুঝল ও এখন সম্পূর্ণ অসহায়, ভয় প্রাণ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো শানের। মনে পড়ল পলাশের মৃ/ত্যু। বাকিদের মৃ/ত্যু।

রুদ্র খু/নে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শানের দিকে। শান অসহায়ের মতো ছটফট করছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। রুদ্র এক হাঁটু গেড়ে বসল শানের সামনে। চুলের মুঠি ধরে ঠাটিয়ে চ/ড় মারল। একটা মেরে থামল না। পরপর কয়েকটা চ/ড়ে অন্ধকার দেখিয়ে দিল শানকে। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল শানের। জোরে জোরে শ্বাস নিল। রুদ্র আরও জোরে টেনে ধরল চুলের মুঠি। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘কষ্ট হয় তাইনা? যখন কেউ এভাবে মারে, যন্ত্রণা দেয়। কিন্তু কোন শব্দ করা যায়না, চিৎকার করা যায়না। দমটা বন্ধ হয়ে আসে তখন। তোর হচ্ছে এরকম? মুক্তি চাই?’

শান চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সত্যিই দম বন্ধ হয়ে আসছে। রুদ্র প্রচন্ড জোরে ওর তলপেটে একটা ঘু/ষি মে/রে বলল, ‘অথচ নিষ্পাপ একটা মেয়ে। যার কি-না ব্যথা পেলে চিৎকার করার ক্ষমতাটুকুও নেই। তাকে একই কষ্টটা দিতে খুব মজা লাগে। নিজেকে বীরপুরুষ মনে হয় না?’
বলে আরও একটা ঘু/ষি বসালো তলপেটে। শান গুঙ্গিয়ে উঠল। অসহ্য যন্ত্রণায় মনে হল মা/রা যাবে ও। এক্ষুনি মারা যাবে।

পাওয়া যায়নি রুদ্রকে। সেই নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সবরকমভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছে ওরা। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। সেই হসপিটালেও জিজ্ঞাসাবাদ, নজরদারী করছে পুলিশ। বিশেষ কিছু পায়নি এখনো। কাল রাত থেকে পেটে কিছু পড়েনি। তারওপর সারারাত নির্ঘুম থেকে ছোটাছুটি করে গেছে। বেলা তখন অনেক হয়েছে। কিছু না খেলেই নয়। তাই উত্তরা পৌঁছেই তমালকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢোকে তুহিন। ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে।

কাজের বিষয়ে আলোচনা করতে করতেই খাচ্ছিল দুজন। হঠাৎ তুহিনের চোখ যায় অপরপাশের টেবিলে। ভালোভাবে তাকিয়ে বুঝতে পারে ইরা বসে আছে। দীর্ঘসময় পর নিজের ইরাবতীর দেখা পেয়ে হৃদয় শান্ত হয় তুহিনের। কিন্তু সেই শান্তি অশান্তিতে পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনা, যখন দেখে ইরার পাশে একজন ছেলে বসে আছে।

ব্যপারটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে তুহিন। তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে। ইরা ছেলেটার সঙ্গে সৌজন্যতার হাসি হেসেই কথা বলছে। বাড়াবাড়ি কিছু নেই। তবুও ভালো লাগেনা তুহিনের। এ কে? ইরার পরিচিত কেউ? ওতো চেনেনা! কোথা থেকে টপকালো? তখনই দুজনকে উঠে যেতে দেখে হুঁশ আসে তুহিনের। দেখে ওরা দুজন বেরিয়ে যাচ্ছে। তুহিন ব্যস্ত হয়ে তমালকে বলে, ‘আমার হয়ে গেছে। তুমি শেষ করে এসো। আমি বাইরে আছি।’

বলে নিজেও উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে আসে রেষ্টুরেন্ট থেকে। তমাল মুখে অর্ধেক স্যান্ডউইচ নিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে দেখে তুহিনের চলে যাওয়া। টেবিলে তাকিয়ে দেখে কফিটাও পুরো শেষ করেনি তুহিন। মাঝেমাঝে কী হয় লোকটার কে জানে? কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের খাওয়ায় মন দেয় তমাল। ওর মতে পেট ঠিক তো সব ঠিক।

তুহিন বাইরে এসে দেখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দুজন। তুহিন ধারণা করল ছেলেটা ইরাকে লিফট দিতে চাইছে। কিন্তু ইরা মানা করছে। ছেলেটা এবার ইরার হাত ধরে রিকোয়েস্ট করছে। তুহিনের মেজাজ খারাপ হল। মানা করছে যখন চলে যা-না ভাই। এতো বড় মেয়ে নিজে বাড়ি ফিরতে পারেনা না-কি? আর হাত ধরার কী আছে? তোকে থার্ড ডিগ্রী দেব শালা। ছাড়! নাটক করে মেয়ে পটানোর ধান্দা! স্টুপিডটা কী ভেবেছে? ওর ইরাবতীকে পটানো এতোই সহজ? নিজের ভাবনায় নিজেই চমকালো তুহিন। কী ভাবছে এসব? এধরণের চিন্তাভাবনা তো আগে কখনও আসেনি। ওকি জেলাস! সত্যিই! কই তিন বছরের দীর্ঘ এই সম্পর্কে এর আগেতো এমন অনুভূতি হয়নি। আর আজ যখন সব সম্পর্ক শেষ, তখন এসব অনুভব করছে?

তুহিন আবার সেদিকে তাকিয়ে দেখল ইরা বা ঐ ছেলেটা কেউই নেই। চারপাশে তাকিয়েও কোথাও পেলোনা ওদের। চলে গেছে। ইরা চলে গেছে সে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই তুহিনের। মেয়েটা একা চলাচলে অভ্যস্ত। আসল চিন্তা হচ্ছে, একা গেল না-কি ঐ ছেলেটা সাথে গেল।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৩

[ পর্বটা অর্ধেকেরও বেশি লেখার পর ডিলিট হয়ে গিয়েছিল। আবার লিখতে হয়েছে। তাই রি-চেক একদমই করিনি। ধৈর্য্য হয়নি।
আর নিউ ইয়ারে অনেক অনেক শুভেচ্ছা সবাইকে। নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে হলেও কষ্ট সবাই রিঅ্যাক্ট আর গঠনমূলক কমেন্ট করবেন প্লিজ। ভালোবাসা ❤]

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৫

1 COMMENT

  1. আপু, গল্পটা পড়ে খুবই ভালো লাগছে, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবটা। তবে গল্প এত দেরি করে আসার কারনে ধৈর্য ধরে থাকতে পারছি না।জানি ইচ্ছে করে আপনি দেরি করেন না।তবে আমাদের, পাঠকের স্বার্থের জন্য হলেও গল্পটা একটু তাড়াতাড়ি দেয়ার চেষ্টা করবেন। প্লিজ…….🙏🙏🙏

Comments are closed.