অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৫

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৫
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

ঢাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাটে পায়চারী করছে শওকত মীর্জা। সকালেই বাংলাদেশে ল্যান্ড করেছে সে। নিজের ছেলের অপহরণের সংবাদ অস্থির করে তুলেছে তাকে। রুদ্র নিয়ে গেছে শানকে। ঘটনাটা আরও একটা অর্থ বহন করে। শানের আশা চিরকালের মতো ত্যাগ করতে হবে তাকে। ব্যপারটা চিন্তা করতেই কলিজা শুকিয়ে আসছে তার। নিজের একমাত্র ছেলের নিশ্চিত মৃ/ত্যু জােনেও কোন পিতা স্থির থাকতে পারেনা। আরও একটা বিষয় হচ্ছে শান তার ডানহাত। পলাশের মৃ/ত্যুতে ইতিমধ্যে নিজের বাঁ হাত হারিয়ে ফেলেছে। শানকে হারালে একপ্রকার পঙ্গু হয়ে যাবে সে।

ক’দিন পর নির্বাচন। নমিশন পাচ্ছে এবার। এসময় এধরণের বিপদ মেনে নেওয়া যায়! কমিশনারের সঙ্গে এই নিয়ে বেশ হম্বিতম্বি করেছে। কেমন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে তারা যে পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে তার ছেলেকে তুলে নিয়ে গেলো রুদ্র? কেউ কিচ্ছু করতে পারল না!
ভাবনায় ছেদ ঘটল ফোন বেজে ওঠার আওয়াজে। কোন খবর আছে ভেবে দ্রুত ফোন রিসিভ করল। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘হ্যালো?’
‘দিনকাল কেমন যাচ্ছে মীর্জা?’
চমকে উঠলেন শওকত। প্রথমে বিস্ময়, পরে ভীতি, তারপরে ক্রোধের অনুভূতি খেলে গেল তার চোখেমুখে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘শান কোথায়?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। তাকাল সামনে হাত-পা বেঁধে পড়ে থাকা আ/হত শানের দিকে। শান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রুদ্র কৌতুকপূর্ণ স্বরে বলল, ‘সময়ের চক্র কী অদ্ভুত, তাইনা মীর্জা? একদিন ঠিক আমিও আপনার কাছে এরকমই একটা প্রশ্ন করেছিলাম। আর আপনি আমার সঙ্গে বিনিময় করেছিলেন। আমার বোনের পরিবর্তে অনেক বড় মূল্য নিয়েছিলেন আপনি।’
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শওকত। থমথমে গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী চাই তোমার?’
‘আপনাকে।’ অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল রুদ্র।

ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন শওকত। শব্দ করে হেসে উঠলো রুদ্র, ‘ভয় পেলেন? এখনই ভয় পাবেন না। পলাশ মীর্জার মতো শানের আর্তনাদ শোনাবো না আপনাকে। কথা দিচ্ছি, নিজের চোখে নিজের ছেলের মৃ/ত্যু দেখবেন আপনি।’
‘রুদ্র!’
‘শশ্। আওয়াজ নিচে মীর্জা। আপনার চিৎকার করার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। এখন আমি কিছু শোনাচ্ছি, সেটা শুনুন।’
একটানে শানের মুখের ভেতরে গোজা কাপড়টা টেনে খুলে ফেলল রুদ্র। শান কোনমতে লম্বা শ্বাস টানতে টানতে বলল, ‘বা-বাবাহ্। বাবা।’
উত্তেজিত হয়ে উঠলেন শওকত। ব্যস্ত কন্ঠে বললেন, ‘শান! শান! কোথায় তুই? জানোয়ারটা কী করেছে তোর সাথে?’
‘বাবা আ-আমি_’

আর কিছু বলার আগেই আবার ওর মুখে কাপড়টা গুজে দিল রুদ্র। ফোনটা নিজের কানে ধরে বলল, ‘আপাতত আমাদের আলোচনা এইটুকুই ছিলো মীর্জা। চিন্তা করবেন না। খুব শীঘ্রই আপনার ছেলের সঙ্গে দেখা হবে আপনার। আমি নিজে ঠিকানা দেব আপনাকে। তবে একটু অপেক্ষা করতে হবে‍। ততক্ষণ চিন্তায় থাকুন। মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করুন। নিজের সন্তানকে হারানোর ভয়, যন্ত্রণা সবটাই পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করাবো আমি আপনাকে। কথা দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, আপনার গতিবিধির ওপর সম্পূর্ণ নজর আছে আমার। আশা করছি আমাদের এই মিনি-মিটিং টার কথা পুলিশ জানবে না। জানলেও অবশ্য বিশেষ কোন লাভ হবেনা। কিন্তু যদি জানে। আপনার ছেলের মৃ/ত্যু প্রহর এগিয়ে আসবে। আপনি বা আমি কেউই সেটা চাইনা।’

লাইন কেটে গেল। বার কয়েক ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ বলে চিৎকার করেও কোন সাড়া পেলোনা শওকত। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা সোফার ওপর ফেলল। নিজেও গিয়ে বসল। দু হাতে খামচে ধরল কাঁচাপাকা চুলগুলো। রুদ্র হুমকি না দিলেও পুলিশকে কিছুই ঠিকভাবে খুলে বলতে পারবে না সে। ঐ জিনিসটা হাতে পাওয়ার আগেতো না-ই। তাতে নিজেরাই ফেঁসে যাবে। নির্বাচনের আগে অন্তত ব্যপারটা ঘটতে দেওয়া যাবেনা। সেটা রুদ্রও জানে। তাই হয়তো এতো সাহস দেখাচ্ছে। বুঝলেন এবার তাকেই আটঘাট বেঁধে নামতে হবে।

নিজের কেবিনে চেয়ারে গা হেলান দিয়ে বসে আছে তুহিন। দু হাতের আঙুলগুলো একত্রিত করে নাচাচ্ছে তাদের। মাঝেমাঝে তাকাচ্ছে টেবিলে পড়ে থাকা ফোনের দিকে।
নানারকমের ভাবনা আসছে মাথায়। এতোগুলো খু/ন, সাজ্জাদ, সুজন, পলাশ, শান। খু/নিকে চেনে ও। কিন্তু ধরতে পারছেনা। পরপর দু’বার নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেছে সে। শেষবারতো সোজা ভিক্টিমকে নিয়েই গায়েব হয়ে গেল। এরকম ব্যর্থতা তুহিনের ক্যারিয়ারে প্রথম।

রুদ্র আমের! এক বিষ্ময়কর চরিত্র। নাকানিচুবানি খেতে হলেও প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে পছন্দ হয়েছে তুহিনের। বহুদিন পর সত্যি সত্যিই কোন ইনভেস্টিগেশনে আছে বলে মনে হচ্ছে ওর। এই কেসের একদম শেষ অবধি দেখা ওর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। অফিসে আসতে না আসতেই একটা মেসেজ আসে ওর ফোনে। মেসেজটা ছিল এরকম,

‘আগেই বলেছি, প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে পছন্দ হয়েছে আপনাকে আমার। তাই আমি চাইনা আপনার সময় নষ্ট হোক। আপনি যেই সার্কেল তৈরী করেছেন সেই সার্কেলের অনেক বাইরে আমি। তাই সারাদিন খুঁজে বেরালেও ঐ গণ্ডির মধ্যে আমাকে পাবেন না। ভাববেন না গুল দিচ্ছি। আপনার সময় নষ্ট করতে চাইনা বলেই ইনফরমেশনটুকু দিয়ে রাখলাম। বিশ্বাস করবেন কী না সেটা আপনার ওপর নির্ভর করছে। তবে এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করবেন না। একটু বেশিই আনপ্রোফেশনাল হয়ে যাবে ব্যপারটা।

আরেকটা কথা, আশা করছি নাম্বার ট্রাক বা লোকেশন ট্রাক করার মতো বোকামি আপনি অন্তত করবেন না। তাতে যে কোন লাভ হবেনা সেটা আপনার অন্তত বোঝার কথা। হ্যাভ আ গুড ডে!
রুদ্র।’

মেসেজটা পড়ে চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ বসে ছিল তুহিন। রুদ্র যে ওকে চ্যালেঞ্জ করছে সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছ‍ে ও। মিলছে না কেবল একটা জিনিস। কেন? রুদ্র সম্পর্কে তুহিন যতটুকু শুনেছে বা জেনেছে তাতে অযথা সময় নষ্ট করার ছেলে সে নয়। তাহলে সেই চিঠি, আজকের মেসেজ এসব করে অযথা সময় নষ্ট কেন করছে? কী চাইছে আসলে রুদ্র? শুধুমাত্র শান আর শওকত মীর্জার হ/ত্যাই ওর একমাত্র উদ্দেশ্য? নাকি আরও গভীর, ভয়ংকর, বিষাক্ত কিছু লুকিয়ে আছে এর মধ্যে।‍ যা তুহিন জানেনা।

আমের ভিলা, আমের ভিলার সকল রহস্য। কে ছিল যে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিলো গোটা পরিবারটাকে? সে যেই হোক, আমের পরিবারের খুব কাছের কেউ সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
শুরু থেকে শুরু করা যাক। ঘটনার সুত্রপাত হয় কুহুর কিডন্যাপিং আর রে/প থেকে। নীরবকে মাঝরাস্তায় দেরী করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তারমানে ওরা জানতো নীরব আসছে কুহুর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু কীকরে জানলো? এটাতো বাইরের কারো জানার কথা না। জানার কথা শুধুমাত্র ঘরের লোকেদের। সেটাও তাদের, যাদের কেবলমাত্র কুহু বা নীরব বলেছে। আর সেটা ঘরের কেউ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। কিন্তু কে?
সেদিন আমের ভিলাতে সায়ানাইড খেয়ে যে মারা গেল সে কেন এসেছিল আমের ভিলায়? কী খুঁজতে?

রাশেদ আমের! তার মৃ/ত্যুটাও স্বাভাবিক না। সেই ফটো অ‍্যালবামে পাওয়া বি/ষের কথা মনে পড়ল তুহিনের। চায়ের কাপ উল্টেই পড়েছিল অ‍্যালবামের ওপর। আর সেখানে বি/ষ পাওয়া যাওয়া মানে বিষটা চায়ের কাপে ছিল। কে দিয়েছিল বি/ষটা? জ্যোতির ভাষ্যমতে রান্নাঘরে গিয়ে ও দেখেছিল অর্ধেক চা বানিয়ে ফেলেছে নার্গিস। এরপর বাকি চা-টা বানানো থেকে শুরু করে রাশেদ আমেরের টেবিল পর্যন্ত জ্যোতিই নিয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ এই দুজন আর রাশেদ আমের ছাড়া সেই চা বা চায়ের কাপের কাছে কেউ আসেনি।

যার মানে দাঁড়ায় কাজটা জ্যোতি বা নার্গিসের মধ্যকার কেউ একজন করেছে। তারমানে কী নার্গিস-ই করেছে কাজটা? কিন্তু কেন? এতোবছর যাবত কাজ করছিল ঐ বাড়িতে। এতবড় ঘটনা ঘটানোর সাহস পেল? আর যদি নার্গিস কাজটা না করে থাকে তবে আর একজনই আছে যে কাজটা করতে পারে। জ্যোতি!
ফোনের রিংটোনে ধ্যান ভঙ্গ হয় তুহিনের। স্ক্রিনে আননোউন নাম্বার ভাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। কয়েক সেকেন্ড নাম্বারটা পর্যবেক্ষণ করে রিসিভ করে, ‘হ্যালো?’

‘শওকত মীর্জা বলছি।’
একটু নড়েচড়ে বসে তুহিন। সামান্য গলা ঝেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ বলুন?’
‘খবর নিয়ে জানলাম শানের কেসটা আপনিই দেখছেন?’
‘একটু কারেক্ট করে দিতে চাইছিলাম। আমি যে কেসটা দেখছিলাম তাতে শান মীর্জা জড়িয়ে গেছেন।’
একটু চুপ থাকল শওকত। তারপর কঠোর গলায় বলল, ‘সে যাই হোক। একজন জাত ক্রি/মি/নাল আপনার নাকের ডগা দিয়ে আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে গেল কীকরে? কী করছিলেন টা কী আপনি?’

তুহিনের মেজাজ খারাপ হল। চোরের মায়ের বড় গলা! তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ‘আর যাই করি। দুবাইয়ের বাংলোতে ঘুমোচ্ছিলাম না তখন। এইটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি আপনাকে।’
তেঁতে উঠল শওকত। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘একেতো ব্যর্থ হয়েছেন। তার ওপর বড়বড় কথা বলছেন? লজ্জা করছেনা?’
‘লজ্জা করার মতো কিছু ঘটেনি মিস্টার মীর্জা। আমার মতে নিজের সারাজীবনের ক্রা/ইম যখন নিজের দিকেই ফিরে আসে তখন অন্যকাউকে জাত ক্রি/মি/নাল বলাটাই চরম নির্লজ্জতা।’

‘অফিসার! ভুলে যেওনা কার সঙ্গে কথা বলছো।’ হুংকার দিয়ে উঠর শওকত।
তুহিন চোয়াল শক্ত রেখে বলল, ‘ভুলিনি। খুব ভালো করেই জানি কার সঙ্গে কথা বলছি। জানি বলেই যা বলেছি তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। যাই হোক, শান মীর্জাকে খোঁজার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আমরা। আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা উদ্ধার করব তাকে।’

শওকত থমথমে গলায় বলল, ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি। এড্রেসটা তুলে নিন।’
‘অফিসের এড্রেসটা আপনার জানার কথা। টাইমটা ইনফর্ম করে চলে আসুন। নিশ্চয়ই দেখা করব। এখন রাখছি। কাজ আছে আমার।’

বলে একটু অপেক্ষা করল তুহিন। ওপাশ থেকে শওকত মীর্জার কোন সাড়া না পেয়ে রেখে দিল ফোনটা। লোকটার সঙ্গে আগে কখনও কথা হয়নি। তবুও তীব্র বিতৃষ্ণা কাজ করছিল কথা বলার সময়। ব্যপারটার ব্যাখ্যা খুঁজতে যাচ্ছিল তখনই দরজা থেকে তমাল বলে উঠল, ‘আসব স্যার?’
তমালের ডাকে সোজা হয়ে বসতে বসতে অলস ভঙ্গিতে বলে, ‘এসো।’
তমাল ভেতরে এসে বলে, ‘রুদ্রর কোন খবর এখনো অবধি পাওয়া যায়নি স্যার। পুরো সার্কেলটা চিরুনী তল্লাশি চলছে।’
‘আমের ভিলার বাকিদের কোন খোঁজ?’
‘জি-না স্যার।’

তুহিন নিজের ফোনটা তুলে নিয়ে বলল, ‘একটা নাম্বার দিচ্ছি। টুকে নাও।’
টুকে নিল তমাল। তমাল কোন প্রশ্ন করার আগেই বলল, ‘এই নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছিল আমার ফোনে। এখন যদিও ফোনটা বন্ধ আছে। নাম্বারটা লাস্ট কোথায় এক্টিভ ছিল বের করো।’
‘জি স্যার। স্যার, হাসপাতালর সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হয়েছে। পাহাড়ায় থাকা অফিসার দুজন চিহ্নিত করতে পেরেছেন নার্স দুজনকে। তবে দুজনের একজনও হসপিটালে চাকরি করেনা। দুজন আদোও নার্স কি-না তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
তুহিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, ‘তাহলে আর অপেক্ষা কীসের? চেহারা যখন পাওয়া গেছে মানুষকেও পাওয়া যাবে। খোঁজ করা শুরু করে দাও। আমিও তো জানি দুজন কোন নার্সিং কলেজ থেকে পাশ করেছে।’

তমাল মুচকি হেসে বলল, ‘ইয়েস স্যার।’
তমাল চলে যাওয়ার পরেই তুহিন আবার ভাবনায় মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। আপাতত মস্তিষ্ক সেসব নিয়ে আর ভাবতে চাইল না। গা-টা হালকা করে ছেড়ে দিল তুহিন। মনে পড়ল ইরার কথা। কতদিন কথা হয়না মেয়েটার সাথে। কতদিন সময় অসময়ে ‘ইরাবতী’ নামটা ভেসে ওঠেনা ফোনের স্ক্রিনে। মিষ্টি কন্ঠের সেই শাসন, যত্ন, অভিযোগ,

অভিমানগুলো খুব বেশি কর‍ে মনে পড়ছে। চোখের দেখাটাওতো আজ দেখল কতদিন পর। হঠাৎই সকালে ইরার সঙ্গে থাকা ছেলেটার কথা মনে পড়ল ওর। কে ছিল ছেলেটা? কী করছিল ইরার সঙ্গে? আবার সোজা হয়ে বসল তুহিন। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে হাঁসফাঁস করল কিছুক্ষণ। মন আর মস্তিষ্কের ভয়ানক যু/দ্ধ আরও কিছুক্ষণ চলল। অবশেষে আর না পেরে ইরার নাম্বারে ডায়াল করেই ফেলল।

প্রথমবার বেজে বেজে কেটে গেল ফোনটা। তুহিন ভাবল আর কল দেবেনা। কিন্তু তা হলোনা। কোন এক অদৃশ্য আর্কষণে দ্বিতীয়বার কল করে ফেলল। এবার রিসিভ হলো ফোনটা। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলোনা। তুহিন নিজেই মৃদু কন্ঠে বলল, ‘ইরা?’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ হল। থমথমে গলায় ইরা বলল, ‘হঠাৎ কী মনে করে?’
‘কেন কল করতে পারিনা?’

‘না, যখন আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল, তখনতো তোমার একটা কল পাওয়ার জন্যে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতাম। কিন্তু তোমার সময় হতো না। আমিই নিজে থেকে কল করে বিরক্ত করতাম তোমাকে। এখন আমাদের মধ্যে তেমন কোন সম্পর্কই নেই। অথচ আমাকে কল করতে গিয়ে তোমার ইগো হার্ট হলোনা। ব্যপারটায় একটু অবাক হলাম আরকি।’
‘খোঁচা দিচ্ছো?’
‘জেনুইন কথা বললাম। সম্পর্কটা যে আর নেই সেটাতো সত্যি।’

‘আমাদের সম্পর্কটা কী সত্যিই এতোটা ঠুনকো ছিল ইরা? যা এতো সহজেই “নেই” বলে দেওয়া যায়।’
ইরা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর স্থির কন্ঠে বলল, ‘হয়তো ছিল। তাইতো এতো সহজে “আছে” থেকে “ছিল” আর “ইরাবতী” থেকে “ইরা” হতে পারলাম। কিন্তু এখন কী এসব কথার আর কোন মানে হয় তুহিন?’
তুহিন উত্তর দিতে পারল না। বরং নিজেকেও একই প্রশ্ন করল। সত্যিই কী এখন এসব কথার কোন মানে হয়? ওর ভাবনার মাঝেই ইরা বলে উঠল, ‘এসব ছাড়ো। কেন কল কেন করেছো সেটাই বলো।’

‘আজ সকালে তোমাকে দেখলাম রেস্টুরেন্টে।’
‘হ্যাঁ গিয়েছিলাম। বাবা পাঠিয়েছিলেন একটা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। কেন বলোতো?’
‘ন-না আসলে ছেলেটাকে আগে কখনও দেখিনিতো তাই। তা কেন দেখা করছিলে? তোমার কোন আত্মীয়?’
‘সেটা জেনে তুমি করবে?’ গম্ভীর গলায় বলল ইরা।
ইতস্তত করতে শুরু করল তুহিন। ইরার প্রশ্নের কোন জবাব নেই ওর কাছে। তুহিনের উত্তর না পেয়ে ইরা বলল, ‘এটা জিজ্ঞেস করতেই ফোন করেছিলে?’

চমকে উঠল তুহিন। অস্থিরভাবে ওর চোখজোড়া ঘুরে এলো গোটা রুম জুড়ে। তারপর কোনমতে বলল. ‘না আসলে।’
‘দেখো তুহিন, যদি সত্যিই কিছু বলার থাকে, বলে ফোনটা রাখো। হাতে অফুরন্ত সময় নিয়ে বসে নেই আমি।’
তুহিন থমকে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘রা-রাখছি আমি।’

ফোনটা কেটে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। ছোট্ট একটা ঘটনা কতটা দূরত্ব তৈরী করতে পারে! যে ইরাবতীর কোলে মাথা রেখে তুহিন নিজের মনের সমস্ত কথা নিঃসংকোচে বলে ফেলতো। আজ তার সাথে মন খুলে একটা বাক্য ব্যয় করতেও ওকে ভাবতে হচ্ছে। যে ইরা সময় পেলেই ওকে কল করতো, ওর একটা কল পাওয়ার জন্যে ছটফট করতো। ওর সঙ্গে কথা বলার জন্যে, সময় কাটানোর জন্যে পাগলের মতো করতো। সে বলছে, ফোন রাখতে। তার সময় নেই। ওদের সম্পর্কটাতো এমন ছিলোনা। কত সুন্দর, মিষ্টি মুহূর্ত ছিল তিন বছরের। এমন কেন হল?

সত্যিই কী অবহেলার পরিমাণটা এতো বেশি হয়ে গিয়েছিল? তুহিন ভেবেই নিয়েছিল ওর ইরাবতী সারাজীবন ওরই থাকবে। সে যাই হয়ে যাক না কেন। তাই হয়তো মেয়েটাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড ভেবে বসেছিল। ভুলেই গিয়েছিল সবকিছুই একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই ঠিক থাকে। সম্পর্কে অবহেলা নামক স্রোতের তীব্রতা যখন সীমা লঙ্ঘন করে, তখন ধৈর্যের বাধ যত দৃঢ়ই হোক না কেন, ভেঙ্গে পড়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনা। ভেসে যাওয়া তখন অনিবার্য। আজ তুহিনেরও মনে হচ্ছে ভেসে যাচ্ছে। সত্যিই সবকিছুই ভেসে যাচ্ছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু নড়েচড়ে বসল তুহিন। বেল চেপে কড়া এক কাপ কফি দিয়ে যেতে বলল ইন্ট্রোগেশন রুমে। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে ওর। কিন্তু বিশ্রাম করার সময় নেই। জ্যোতির সঙ্গে কথা বলতে হবে ওকে।

কফির মগ থেকে ওঠা ধোঁয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জ্যোতি। কিছুক্ষণ আগেই ওর সামনাসামনি এসে বসেছে ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদ। জ্যোতির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তুহিন বলল, ‘ব্রেকফাস্ট করেছেন?’
জ্যোতি নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকাল তুহিনের দিকে। শান্ত গলায় বলল, ‘যেতে দিন আমাকে।’
‘আপনাকে আটকে রেখে বিশেষ কোন লাভ নেই আমাদের জ্যোতি। শুধু আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো ঠিকঠাকভাবে দিন। ছেড়ে দেব আপনাকে।’

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল জ্যোতি। অসহায় কন্ঠে বলল, ‘আর কী জানতে চান?’
তুহিন জ্যোতির চোখের চোখ রেখ‍ে বলল, ‘আমের ভিলার বাকিরা কোথায়?’
‘দেখা করতে চান? বললে নিয়ে যেতে পারি।’
তুহিন কফির মগটা হাতে তুলে নিল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ। কুহুকে সেদিন নীরবের সঙ্গে দেখা করতে যাবে সেটা আপনি জানতেন?’
‘জানতাম।’
‘আর কে কে জানতো?’

‘কুহু আমাকে বলেছিল। আমি ছাড়া আর কাউকে কিছু বলেছিল কি-না আমি জানিনা।’
মাথা ঝাঁকাল তুহিন। কফির মগে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর আবার জ্যোতির দিকে তাকেই বলল, ‘রাশেদ আমেরের মৃত্যুর পর কী হয়েছিল? সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলো কেন আপনাদের?’
জ্যোতির মুখভঙ্গি পরিবর্তন হল। নির্বিকার চেহারায় এসে ভর করল একরাশ বিষাদ। শীতের মধ্যেও ঘেমে একাকার হয়ে গেল মুখমণ্ডল। যেন আরও দুঃখের, আরও যন্ত্রণার বিষাক্ত স্মৃতি তীব্রভাবে আ/ঘা/ত করেছে মনকে। শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিল জিভ দিয়ে। কাঁপা গলায় বলল, ‘শোনাটা খুব জরুরি?’
‘খুব।’ সঙ্গেসঙ্গেই বলল তুহিন।
হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি।

প্রায় মাঝরাত করে বাড়ি ফিরল রুদ্র। রুমে ঢুকেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। প্রিয়তা বিছানায় নেই। তারমানে নিশ্চয়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। হনহনে পায়ে বারান্দায় গিয়ে দেখল ওর ধারণাই সত্যি। প্রিয়তা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এতো ঠান্ডার মধ্যেও গায়ে চাদর অবধি নেই। তারওপর এতো রাত অবধি জেগে আছে। মেয়েটা গর্ভবতী। ওর মধ্যে আরেকটা প্রাণ আছে। এতোটা খামখেয়ালির মানে কী!

রুদ্র বারান্দায় এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘সমস্যা কী তোমার প্রিয়? কতবার বলেছি এতো রাত জাগবে না। আর এই ঠাণ্ডার মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? প্রিয়তা তুমি এখন একা নও। এই এক কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।’
প্রিয়তা কোন জবাব দিলো না। স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইল। রুদ্র লম্বা শ্বাস ফেলল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘রুমে চলো।’

এবারও প্রিয়তার কাছ থেকে কোনরকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলোনা। রুদ্রর মেজাজ এবার সত্যিই সত্যিই খারাপ হল। এগিয়ে গিয়ে প্রিয়তার বাঁ হাতের বাহু ধরে ঘোরালো নিজের দিকে। ঝাঝালো গলায় বলল, ‘তোমায় কিছু বলছি আমি।’
প্রিয়তা এবার তাকাল রুদ্রর দিকে। অনিন্দ সুন্দর চোখদুটো ঠান্ডায় লাল হয়ে গেছে। নিচের ঠোঁটগুলো কাঁপছে মেয়েটার। রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তোমার মনে হচ্ছেনা বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে এবার? কদিন যাবতই দেখছি। কেন করছো এরকম? ঠিকমতো নিজের যত্ন নিচ্ছোনা, ঘুমোচ্ছোনা, কথা বলছো না। এতে শুধুমাত্র তোমার না, আমাদের বাচ্চাটারও ক্ষতি হচ্ছে। সেটা কী সত্যিই বুঝতে পারছো না তুমি?’

প্রিয়তা রুদ্রর চোখে চোখ রেখে স্থির গলায় বলল, ‘তাতে কী আপনার সত্যিই কিছু যায় আসে রুদ্র?’
রুদ্র অবাক হল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘মানে?’
প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘যদিও সত্যিই আপনি আমার বা আমার বাচ্চার চিন্তা করতেন তাহলে আমার কথাটা শুনতেন। পরপর দুটো দু/র্ঘটনা ঘটে গেছে বাড়িতে রুদ্র। বাড়ির যেকোন সদস্য যখন বাইরে থাকে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসে আমার। দমবন্ধ লাগে। এই বুঝি কোন খারাপ খবর এলো। নিজেরও কোন কাজে বের হতে ভয় লাগে। এই বুঝি আমার বাচ্চাটার কোন ক্ষতি হয়ে গেল। এতো এতো মানসিক অশান্তি নিয়ে বাঁচা যায়না। আমি পারছিনা বাঁচতে। কিন্তু আপনার কী তাতে কিচ্ছু যায় আসে? আপনি তো সেই আপনার জেদ নিয়েই বসে আছেন।’

বলতে বলতে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল প্রিয়তার চোখ দিয়ে। রুদ্র ঢোক গিলল। প্রেয়সীকে যন্ত্রণা দিয়ে ওর নিজের ভেতরটাও ক্ষ/তবিক্ষ/ত হয়ে যাচ্ছে। ও নিজেও এখন একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের লোভে যে ও নিজেও পড়েছে। কিন্তু তার আগেযে কিছু কাজ করতে হবে ওকে। সেগুলো না করে চাইলেও যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেনা ও। ততদিন যে প্রিয়তাকে ধৈর্য্য ধরতেই হবে। ও প্রিয়তার চোখের জলটা মুছতে গেলেই ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল প্রিয়তা। কান্নামিশ্রিত গলায় বলল, ‘বুঝবেন না। এখন বুঝবেন না আপনি। আপনার এই জেদের কারণে যখন আমায় চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলবেন, সেদিন বুঝবেন। কিন্তু সেদিন আপনার করার কিছু থাকবেনা। হারিয়ে যাব আমি। চিরকালের মতো হারিয়ে যাব।’

কথাটা বলে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল প্রিয়তা। রুদ্র কিছুক্ষণের জন্যে থমকে গেল প্রিয়তার কথায়। প্রিয়তার কথাগুলো যেন ওর বুকে ছু/রির মতো বিঁধল। দম বন্ধ হয়ে এলো। প্রিয়কে ছাড়াতো ও নিজের একটা মুহুর্তও ভাবতে পারেনা। সেখানে মেয়েটা হারিয়ে গেলে কীকরে বাঁচবে ও? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অস্থির হয়ে উঠল রুদ্র। দ্রত পায়ে রুমে যেতে যেতে ডাকল ‘প্রিয়! প্রিয়!’

‘প্রিয়!’ বলে ডেকে ঝট করে চোখ মেলল রুদ্র। হতবুদ্ধি হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক স্বাভাবিক হল। মনে পড়ল সবটা। শানকে নিয়ে শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে আছে ও। সেই টিনের ঘরটায়। গতরাতে ঘুম হয়নি। তাই খামে হেলান দিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর স্বপ্নে এসে হানা দিল সেই অতিতের একখণ্ড বিষাক্ত ঘটনা। শুধু কী একখণ্ড? এরপর যা যা হয়েছে সবটুকুই যে বি/ষে পরিপূর্ণ। প্রতিটা মুহূর্তে বিষাদে ভরপুর। সেসব স্মৃতি মনে পড়লেও বুক কাঁপে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে ভেতরটা। ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় গোটা সময়টা।

অতীত~
রাশেদ আমেরের মৃ/ত্যুর পর সুখে পরিপূর্ণ আমের ভিলা আক্ষরিক অর্থেই বিষাদপুরীতে পরিণত হল। বাড়ির প্রতিটা সদস্য যেন হারিয়ে ফেলল প্রাণবায়ু। সেই গম্ভীর, বজ্রকন্ঠ নিভে যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে অপ্রয়োজনীয় আওয়াজ হইয়াই বন্ধ হয়ে গেল। সেই দৃঢ় চলন থেমে যাওয়ার পর থেকে ওদের সকলের চলন হয়ে গেল নিষ্প্রাণ। তারপর ঘটে গেল আরেক অপ্রত্যাশিত দু/র্ঘটনা। আবার ভেঙ্গে পড়ল আমের ভিলা। যেন বাঁচতে হবে বলেই বেঁচে আছে ওরা। শ্বাস নিতে হবে বলেই শ্বাস নিচ্ছে।

রুদ্র আর উচ্ছ্বাস বেশিরভাগ সময়টা বাইরেই কাটাচ্ছে। তারমধ্যে রুদ্রকে বাড়িতে দেখা যায় না বললেই চলে। কেমন প্রাণহীন যন্ত্রের মতো চলন হয়ে গেছে ওর। আপাতত আমের ফাউন্ডেশনের যেটুকু বেঁচে আছে সেটুকুকেই ঠিকভাবে দাঁড় করানোর চেষ্টায় আছে ও। ও এখন যা করতে চাইছে তার জন্যে ভীষণ প্রয়োজন সেটা।

কুহু এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। নীরব প্রায় সারাক্ষণ লেগে থাকে মেয়েটার সাথে। মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে ওকে ভালো রাখার, স্বাভাবিক রাখার। কিন্তু কুহু সেটা চায়না। ও জানে নীরবের পরিবার ওকে এখনো মানতে পারেনি। আর সেকারণে নীরব ওর পরিবারকে ছেড়ে চলে এসেছে কুহুর কাছে। যা কুহুকে একদমই খুশি করেনি। ও বারবার নীরবকে বলেছে চলে যেতে। ও নিজেকে সামলে নেবে। কাউকে প্রয়োজন নেই ওর। কিন্তু নীরব শোনেনি। শেষে ভীষণ খাবার ব্যবহারও করেছে কুহু নীরবের সঙ্গে, তীব্র অবহেলায় ক্ষ/তবিক্ষ/ত করেছে। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি। নীরব কোন কিছুর বিনিময়েই ছাড়েনি তার নীরবতাকে।

নাজিফা মাঝেমাঝেই আসে দেখা করতে। ডেলিভারির ডেইট সামনের মাসেই। চলাফেরা করতে একটু কষ্ট হলেও আমের ভিলায় আসা বন্ধ করতে পারেনি ও। সেই পরিবারের প্রতিটা মানুষকেই বড্ড বেশি ভালোবাসে ও। আর উচ্ছ্বাসের প্রতি নিজের অপার প্রেমের ব্যাখা নাই বা করল। মাঝে মাঝে দেখা হয় উচ্ছ্বাস-নাজিফার। কথাও হয় টুকটাক। কিন্তু বেশিরভাগ কথাই রয়ে যায় অব্যক্ত। চোখে চোখেই নিজের সেই অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশ করে যায় ওরা। নিয়তি যে ওদের সঙ্গ লেখেনি।

জাফর দুদিকেই যথেষ্ট সময় দিচ্ছে। এই মুহূর্তে একমাত্র উনিই আছেন যাকে সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়। আমের পরিবারের এই দুঃসময়ে প্রকৃত পিতার মতোই আগলে ধরেছেন গোটা পরিবারটাকে।
আর এতোসবকিছুর মধ্যে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে একমাত্র জ্যোতি। সকলেই যদি বিষাদের পাহারে চাপা পড়ে যায় তাহলে পরিবারটাকে সামলাবে কে?
হলরুমের সোফায় বসে চা খাচ্ছিলেন জাফর। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ওপর থেকে নেমে এলো উচ্ছ্বাস। সোজা সোফাতে বসে বলল, ‘আজ বের হবে কাকা?’

জাফর চায়ের কাপটা নামিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ রে বাবা। তবে একটু দেরীতে। তুই কোথায় যাবি?’
‘আমাদের দুজন এক্স বিজনেস পার্টনারের সঙ্গে আলাপ করে আসি। দেখি কিছু করা যায় কি-না।’
জাফর একবার ওপরের দিকে তাকি নিরস গলায় বলল, ‘রুদ্রকে দেখেছিস?’
‘না। রুমে আছে বোধ হয়।’

এরমধ্যেই আরেক কাপ চা নিয়ে এলো জ্যোতি। উচ্ছ্বাসের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘একাই বের হবে? রুদ্র যাবেনা?’
‘বলল তো একাই কোথাও একটা যাবে।’
জ্যোতি শব্দ করে শ্বাস ফেলল। জাফর বলল, ‘প্রিয়তা মার সঙ্গে কথা হয়েছে তোদের কারো?’
উচ্ছ্বাস চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, ‘কাল রাতে কল করেছিল আমায়। আকারে-ইঙ্গিতে রুদ্রর খবর ঠিকই নিল।’

জাফর হতাশ হলেন। ব্যথিত কন্ঠে বললেন, ‘নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। ছেলেটাকেও কষ্ট দিচ্ছে। যা ঘটে গেছে সেটা নিয়ে নিজেদের জীবনটা এতোটা জটিল করার কী খুব প্রয়োজন ছিল?’
জ্যোতি সিঙ্গেল সোফাটায় বসে বলল, ‘মেয়েটার আঘাতটাও তো কম নয় কাকা। একটু সময় দাও ওকে। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাফর। মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আর ঠিক।’
এরমধ্যেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো রুদ্র। জ্যোতি উঠে দাঁড়াচ্ছিল চা দেওয়ার জন্যে। কিন্তু রুদ্র দাঁড়াল না। কারো দিকে তাকালো অবধি না। হনহনে পায়ে বেরিয়ে গেল সদর দরজা দিয়ে। জ্যোতি আবার বসে পড়ল। তিনজনের চোখে-মুখেই হতাশার ছাপ। কিছুই ঠিক হচ্ছেনা। সবকিছুই ক্রমশ আরও বেশি জটিল হচ্ছে। এর শেষ কোথায়?
রাশেদ আমেরের মৃত্যুর দু সপ্তাহ পরের কথা। রুদ্র আর প্রিয়তার সম্পর্ক এমনিতে স্বাভাবিক থাকলেও দুজনের মধ্যে মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়েছিল অনেকটাই। এতোকিছুর পরেও রুদ্রর এই অন্ধকার জগতে জড়িয়ে থাকাটা মেনে নিতে পারছিল না প্রিয়তা। আর রুদ্রও এখনই সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবতে পারছিল না। যার ফলসরূপ দুজনের মধ্যকার মনমালিন্য প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা ছিল।

আগের হঠাৎই কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রিয়তা। যদিও তা কিছুক্ষণের জন্যে ছিল। তবে সেটা চিন্তায় ফেলে দেয় রুদ্রকে। তাই পরেরদিন সকালেই প্রিয়তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ছোটে রুদ্র। প্রিয়তা যেতে চাইছিল না। কিন্তু রুদ্রর জেদের কাছে হার মানতে হয় ওকে। এমনিতেও এতো স্ট্রেস গেছে গত একমাসে। একটা চেকআপ করিয়ে আসা সত্যিই জরুরি। তাই আর বেশি আপত্তি করেনি প্রিয়তা।

বেশ কিছু চেকআপ করার পর রিপোর্ট দেখতে দেখতে ডাক্তার বললেন, ‘খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, ঔষধ খাওয়া কোনটাই নিয়মিত করেন না সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এমন করলেতো হবেনা মিস প্রিয়তা। বাচ্চাটাতো আপনার। তার খেয়ালতো আপনাকেই রাখতে হবে। তাইনা?’
রুদ্র গম্ভীর মুখে একবার তাকাল প্রিয়তার দিকে। সেটা দেখে ডাক্তার মুচকি হেসে বললেন, ‘দেখুন, শুধু বাচ্চাকে না বাচ্চার বাবাকেও কী পরিমাণ স্ট্রেস দিচ্ছেন আপনি। মুখ শুকিয়ে গেছে লোকটার।’

প্রিয়তা একবার তাকার রুদ্রর গম্ভীর মুখের দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। হঠাৎই ভীষণ মন খারাপ হল ওর। সত্যিই জেদের বসে অনিয়ম করাটা ঠিক হয়নি ওর। বাচ্চাটার কথা অন্তত ভাবা উচিত ছিল।
ডাক্তার কিছু ঔষধ চেঞ্জ করে একটা ডায়াট চার্ট ধরিয়ে দিয়ে বিদায় দিল দুজনকে।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই রুদ্র হাঁটার গতি বাড়াল। চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট সে। প্রিয়তা গোমড়া মুখ করে আসছে পেছন পেছন। হাসপাতালের সিঁড়ির দিকটাতে ওয়াশরুম। সেদিকেই গেল ওরা। ওখানে গিয়ে থামতেই প্রিয়তা বলল, ‘শুনুন?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকাল প্রিয়তার দিকে। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করল, ‘কী?’
প্রিয়তা খানিক ইতস্তত করল। তারপর আস্তে করে বলল, ‘সরি। আমার এমনটা করা উচিত হয়নি।’
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র। মাথাটা হালকা দুলিয়ে বলল, ‘যাক! আমার শাস্তি আমার বাচ্চাটাকে দেওয়ার প্রচেষ্টাটা বন্ধ করলেই আমি খুশি।’

‘এভাবে বলছেন কেন? ক্ষমা চাইছি তো।’ কাঁদোকাঁদো গলায় বলল প্রিয়তা।
রুদ্র দুকদম এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে। একহাত প্রিয়তার কাঁধে, আরেকহাত প্রিয়তার পেটের ওপর রেখে বলল, ‘আমি তোমার ওপর রেগে নেই প্রিয়। কিন্তু আমাদের সন্তানের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই তাইনা? আমাদের ভেঙ্গে পড়া পরিবারটার একমাত্র আশার আলো ও। তাই তোমাকে ওর খেয়াল রাখতে হবে। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।’

মাথা নেড়ে রুদ্রর হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিল প্রিয়তা। চলে গেল ফ্রেশ হতে। প্রিয়তা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসার পর প্রিয়তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে মেল ওয়াশরুমটার দিকে এগোলো রুদ্র। প্রিয়তা অপেক্ষা করল করিডরে দাঁড়িয়ে।
মিনিট খানেক পরেই মাথাটা হালকা ঘুরে উঠল প্রিয়তার। এমন মাঝেমাঝেই হয়। তাই টাল সামলানোর জন্যে এগিয়ে সিঁড়ির ওপরের রেলিংএর পিলারটা ধরে দাঁড়াল ও। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিতে নিতে অপেক্ষা করল শরীরটা ঠিক হওয়ার।

তখনই একটা লোক পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নাম করে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মারল প্রিয়তাকে। চিৎকার করে উঠল প্রিয়তা। সিঁড়ির ওপর উঁবো হয়ে পড়ে খুব বাজেভাবে আঘাত লাগল তলপেটে। মা/রণ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতেও ভুলে গেল মেয়েটা। গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পের‍ে সিঁড়ি দিয়ে সবেগে গড়িয়ে নিচে পড়ল প্রিয়তা। উপলব্ধি করল ও নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। সাড়া শরীরের ব্যথার মাঝে হঠাৎ চাড়া দিয়ে উঠল পেটের তীব্র ব্যথা। কোনমতে একটা হাত পেটে রেখে আর্তনাদ করে উঠল ও। ধাক্কা দেওয়া ব্যক্তি ততক্ষণে চলে গেছে দৃষ্টির আড়ালে। প্রিয়তার চিৎকারে ভীড় হয়ে গেল মুহুর্তেই।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৪

চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে দ্রুত বেরিয়ে এলো রুদ্র। প্রায় দৌড়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই পা থমকে গেল ওর। হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সিঁড়ির নিচে পড়ে থাকা প্রিয়তা আর তার আশেপাশের ভীড়কে। দুহাতে পেট ধরে প্রচন্ড শব্দে আর্তনাদ করছে প্রিয়তা। কপাল কে/টে র/ক্ত গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। চেষ্টা করেও পায়ের গতি বাড়ছেনা রুদ্রর। ধীরপায়ে নামতে নামতে হতভম্ব দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে তার প্রিয়কে। গোটা দুনিয়া যেন থমকে গেল এই কয়েক মুহূর্তেই।আবার পা থমকে গেল রুদ্রর, হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল, নিঃশ্বাস আটকে এলো। যখন দেখল প্রিয়তার সাদা স্যালোয়ার বেয়ে নেমে যাচ্ছে কালচে লাল র/ক্ত।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৬