অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৬

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৬
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

তীব্র শীতেও ভ্যাঁপসা গরম অনুভব করছে রুদ্র। বোধ হচ্ছে কোন ধূ ধূ মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে ও। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কিচ্ছু নেই, শূণ্য। আছে কেবল হতাশা আর মরিচিকা। সেই হতাশার সাগরে রুদ্র তলিয়ে যাচ্ছে, হাবুডুবু খাচ্ছে। অস্থির হয়ে পদচারণ করছে হাসপাতালের করিডরে। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ভয়ংকর দৃশ্য। সিঁড়ির নিচে ব্যথায় কীভাবে ছটফট করছিল প্রিয়তমা স্ত্রী। সেই র/ক্ত, সেই আর্তনাদ। ওর উপস্থিতিতেই এমন ভয়ানক এক ঘটনা ঘটে গেল। অথচ রুদ্র কিচ্ছু করতে পারেনি। নিজের আরও এক ব্যর্থতার যন্ত্রণা ভেতর থেকে পু/ড়িয়ে মারছে ওকে। নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

তখন হুঁশ ফিরতেই চমকে ওঠে রুদ্র। বাকি সিঁড়িটা দৌড়ে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে প্রিয়তার পাশে। দুহাতে জড়িয়ে নেয় আহত প্রেয়সীকে। প্রিয়তা দুহাতে রুদ্রর গলা পেঁচিয়ে ধরে আর্তনাদ করে বলেছিল, ‘আমার বাচ্চা.. আমার বাচ্চা..’
এইটুকু বলেই জ্ঞান হারায় প্রিয়তা। রুদ্র হতভম্ব হয়ে প্রিয়তাকে জড়িয়ে বসে থাকে কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎই পাশ থেকে এক মাঝবয়সী মহিলা বলে ওঠে, ‘আহারে! পোয়াতি ছিল মনে হয় মাইয়াডা। ইশ্ বাচ্চাডা গেল।’
চমকে ওঠে রুদ্র। সপ্রশ্ন চোখে একবার প্রিয়তার চেতনাহীন শরীরে চোখ বুলিয়ে নেয়। নিজেকে শক্ত করে কোলে তুলে নেয়। ওর মাথায় তখন একটাই কথা ঘুরছিল। নিজের স্ত্রী, সন্তানকে বাঁচাতে হবে ওকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উচ্ছ্বাস পাশেই একটা বেঞ্চে দু হাতে মুখ চেপে ধরে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই দৌড়াদৌড়ি করে প্রিয়তার জন্যে র/ক্তের ব্যবস্থা করতে হয়েছে ওকে। ভেতরে মেয়েটা কেমন আছে সে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে ওরও। র/ক্তপাত আর আ/ঘাতের ধরণ দেখেই ওদের বোঝা হয়ে গেছে যে বাচ্চাটা হয়তো আর নেই। কিন্তু মন মানতে চাইছেনা। বারবার মনে হচ্ছে একটা চমৎকার হোক। মা আর বাচ্চা দুজনেই সুস্থ থাক। কিন্তু নিয়তির কাছে যে মনের ইচ্ছে বড্ড অবহেলিত।
আমের ভিলা থেকে রুদ্র বাদে কেবল উচ্ছ্বাসই এসেছে হাসপাতালে। জ্যোতি আসছে। কুহুকে একা রেখে আসতে পারেনি নীরব। জাফর বেশ দূরে আছেন বলে পৌঁছতে পারেনি এখনো। তবে সেও আসবে।

কাঁধে হাতের স্পর্শ পেতেই থেমে যায় রুদ্র। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখে জ্যোতি এসেছে। রুদ্র পাঁচ সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। নিজের হাত দিয়ে ওর হাত সরিয়ে দিল খুব ধীরে।
জ্যোতি গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে রুদ্রকে। উস্কোখুস্কো চুল, লালচে চোখ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ নাকের ডগাটাও লাল হয়ে আছে। রুদ্র আমের কারো সামনে কাঁদেনা। না হলে নিশ্চয়ই কেঁদে ফেলতো। এখনই কেঁদে ফেলতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। নরম গলায় বলল, ‘একটু বসো। এভাবে করিডরময় পায়চারী করলেতো কোন লাভ হবেনা।’

রুদ্র কিছু বলল না। কয়েক কদম ফেলে এগিয়ে গেল খানিকটা দূরের আরেক বেঞ্চে। উঁবু হয়ে বসল তাতে। দু হাত একত্রিত করে রাখল থুতনির নিচে। দেখে মনে হচ্ছে যেন আবার হারিয়ে গেছে ভাবনার অন্তরীক্ষে।
জ্যোতি অসহায় চোখে সেদিকে দেখল কিছুক্ষণ। গিয়ে বসল উচ্ছ্বাসের পাশে। উদাস গলায় বলল, ‘কী অবস্থা?’
‘বাচ্চাটা বোধ হয় নেই।’ থমথমে গলায় উত্তর দিল উচ্ছ্বাস।
জ্যোতি শুকনো দুটো ঢোক গিলল। নাক টেনে নিয়ন্ত্রণ করল অশ্রুকে। কিছু বলল না। শূণ্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল কেবল।

রুদ্রর মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা মনে হচ্ছে। বারবার প্রিয়তার বলা কথাগুলো বাজছে ওর কানে। শেষ সময়েও বলে ওঠা, “আমার বাচ্চা” বাক্যটা যেন গলা চেপে ধরেছে ওর। এখনো মনে পড়ে, কোন এক গভীর রাতে রুদ্রর বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিল প্রিয়তা। নিজেদের অনাগত সন্তানের নাম কী হবে সে নিয়েই কথা হচ্ছিলো দুজনের মধ্যে। কোনভাবেই যখন কোননামে দুজন একমত হতে পারছিলোনা তখন প্রিয়তা বলেছিল, ‘আমি আমার বাচ্চাকে পুচকু সোনা বলে ডাকবো।’
রুদ্র অবাক হয়ে বলেছিল, ‘পুচকু সোনা? এটা কেমন নাম?’

‘সুন্দর নাম। আমিতো ওকে এই নামেই ডাকবো।’
‘লোকে হাসবে প্রিয়।’
‘হাসলে হাসুক। আমার বাচ্চার প্রতি ভালোবাসা কী আমি অন্যকারো কথা ভেবে দেখাবো না-কি, আজব! তাছাড়া ওরতো ভালো নাম থাকবেই। এই নামেতো শুধু আমরা ডাকবো। আপনার অপছন্দ হলে ডাকবেন না আপনি। জোর কে করেছে?’ মুখ গোমড়া করে বলে প্রিয়তা।

রুদ্র হেসে ফেলে। প্রিয়তার মাথায় চুমু খেয়ে বলে, ‘আমার প্রিয়র যেটা প্রিয়। সেটা আমার অপ্রিয় হয় কীকরে?’
সেই সুখময় স্মৃতিগুলো এই মুহুর্তে বিন্দুমাত্র সুখ দিচ্ছেনা রুদ্রকে। এই পরম সুখের মুহুর্তগুলোই যেন ওকে জ্ব/লন্ত আগুনে পু/ড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
এরই মধ্যে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন মহিলা ডক্টর। তাকে দেখেই সেকেন্ডের মধ্যে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। দাঁড়াল উচ্ছ্বাস আর জ্যোতিও। রুদ্র দ্রুত কদমে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘কেমন আছে, প্রিয়?’

ডক্টর একবার তাকালেন রুদ্রর দিকে। বললেন, ‘আপনি মিস্টার আমের তাইতো? মিসেস প্রিয়তার হাজবেন্ট।’
‘কেমন আছে ও?’ শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল রুদ্র। ততক্ষণে উচ্ছ্বাস আর জ্যোতিও এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে।
ডক্টর বললেন, ‘উনি এখন আউট অফ ডেঞ্জার। কিছুক্ষণ পরেই কেবিনে দেওয়া হবে। একটা দিন অভজারভেশনে রাখতে চাইছি আমরা। কিন্তু..’
‘কিন্তু?’ ভয়ানক শান্ত শোনালো রুদ্রর গলার স্বর।
‘সরি মিস্টার আমের। বেবীটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। কিছু করার ছিল না আমাদের।’

গালে সজোরে থা/প্পড় পড়ায় অপমানে মাথা নুইয়ে ফেলল সম্রাট। দাঁতে দাঁত পিষে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নেহাত নিজের বাবা তাই। নয়তো ঐ হাত এতক্ষণে গুড়িয়ে ফেলতো সে। তীব্র ক্ষোভে ফেঁটে পড়ে তাজওয়ার বলল, ‘গাধার বাচ্চা। এতো ডেস্পারেট তুই? কী দরকার ছিল এখনই এসব করার? রাশেদের মৃ/ত্যুতে যে আগুন জ্ব/লেছিল, সেই আগুনে রীতিমতো ঘি ঢেলে দিয়েছিস তুই। এই ছিল তোর প্লান? আমি ভাবতে পারছিনা।’

সম্রাট হাতের আঙুল দিয়ে গালটা সামান্য ঘষে নিল। থমথমে গলায় বলল, ‘তোমার এতোটা উত্তেজিত হওয়ার কারণটা আমি বুঝতে পারছিনা। কাজটা করার আগে সম্রাট মীর্জার সঙ্গে কথা বলেছি আমি। উনি সম্পূর্ণ সম্মতি দিয়েছিলেন এতে।’
বিষ্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলেন করিম তাজওয়ার। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। শওকত মীর্জা লোকটা অমানুষ সেটা তার জানা। কিন্তু সে-যে সাক্ষাৎ নরপিশাচ সেটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে এখন। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। রুমাল বের করে কপালটা মুছে নিলো করিম তাজওয়ার। মাথা সামান্য দুলিয়ে বলল, ‘কাজটা ঠিক হয়নি। এইমুহুর্তে এটা জাস্ট একটা ব্লান্ডার হয়েছে।’

সম্রাট হাসল। এগিয়ে চেয়ারে বসে পা দু দুটো তুলে দিল টেবিলের ওপর। মাথার পেছনে দু হাত নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘অযথাই ভয় পাচ্ছো তুমি। খেলাটা এখনো আমাদের ফেবারেই আছে। রুদ্রর বি/ষদাঁত অনেক আগেই ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। যাই করিনা কেন। ও এখন কেবল ফোঁসফোঁস-ই করতে পারবে। ছোবল মারার ক্ষমতা ওর নেই।’

আরেকটা চেয়ার ধরে নিজেও বসে পড়ল করিম। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘শত্রুকে দুর্বল ভাবাটাই পতনের প্রথম পদক্ষেপ। তোমাকে আগেও বলেছি। রুদ্র ছোটখাটো কোন বিষাক্ত সাপ না। সোজা গিলে খাবে। এখনো ও নিজেদের গোছাতে ব্যস্ত আছে। তাই নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারছো। যখন আমাদের কুত্তার মতো দৌড় করিয়ে মা/রা শুরু করবেনা। পালনোর পথ পাবোনা আমরা কেউ। এখন মনে হচ্ছে আমাদের শুরুর ধারণাটাই ঠিক ছিল। প্লান বি-তে সোলার সিস্টেমের বিনাশ যেমন নিশ্চিত। তেমন এটাও সত্যি যে আমরাও কেউ অবশিষ্ট থাকবোনা।’
‘বেশিই ভাবছো।’

করিম হুংকার দিয়ে বলল, ‘অনেক কমই ভেবেছি। রুদ্রকেতো তাঁতিয়ে দিয়েছোই। এখন ভুল করেও যেন ও টের না পায়না যে কাজটা তুমি করেছো। তখন দুদিকের আ/ঘাত সামলাতে হবে তোমাকে। পালানোর পথ পাবোনা কেউ।’
সম্রাটের কপালে এবার ভাঁজ পড়ল। খুব বেশি ভুল বলেনি করিম তাজওয়ার। আসল উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তত গোপন রাখতে হবে যে রুদ্রর অনাগত বাচ্চার হ/ত্যা ও-ই করিয়েছে।

কেবিনের বেডের হেডরেষ্টে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে প্রিয়তা। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের ধবধবে সাদা দেয়ালটার দিকে। প্রানহীন দৃষ্টি। অনুভূতিহীন চেহারা। এখন ওকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কাল রাতেও চিৎকারে করে কেঁদেছিল মেয়েটা। পাগলের মতো ছটফট করছিল।

গতকাল সন্ধ্যার পর জ্ঞান ফেরে প্রিয়তার। যখন বুঝতে পারে ওর মধ্যে ধীরে ধীরে বেরে ওঠা সেই প্রাণটা আর নেই। যেই ছোট্ট জীবনটাকে নিয়ে ও হাজারটা স্বপ্ন সাজিয়েছিল। সেই সব স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। যেই সন্তানের আসার অপেক্ষায় ও প্রতি মুহূর্ত প্রহর গুনছিল। সে চলে গেছে। আর কোনদিন আসবেনা। তখনই কেমন পাগল পাগল ব্যবহার করছিল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছিল না বাচ্চাটা আর নেই। টেনে হাতের ক্যানেল খুলে ফেলেছিল। উত্তেজিত হয়ে খাট থেকে নামতে গিয়েও ব্যথায় পেট আকড়ে ধরে বসে পড়ে আবার। কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছিলো না তাকে। জ্যোতি আর নার্স মিলেও পারছিল না প্রিয়তাকে সামলাতে। আরেকজন নার্স ছুটে যায় ডক্টরকে ডাকতে। চেঁচামেচি শুনে বাইরে থেকে ভেতরে চলে আসে উচ্ছ্বাস। প্রিয়তার অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে যায় ও নিজেও।

রুদ্র বাইরে ছিল। প্রিয়তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস হচ্ছিলো না। নিজের অনাগত সন্তানের মৃত্যুর জন্যে নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছিলো ওর। প্রিয়তা বলেছিল, ওদের সন্তানের কিছু হলে প্রিয়তা ক্ষমা করবেনা রুদ্রকে। আর আজ কোন না কোনভাবে প্রিয়তার আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। সত্যিই আজ ওদের সন্তান আর নেই। রুদ্র-প্রিয়তার স্বপ্নের সেই পুচকু সোনা সত্যিই আর নেই। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই চলে গেছে সে ওদের ছেড়ে। হঠাৎই প্রিয়তার কেবিন থেকে হন্তদন্ত হয়ে নার্সকে বের হতে দেখে চমকে ওঠে রুদ্র। আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। প্রায় দৌড়ে যায় প্রিয়তার কেবিনের দিকে।

কেবিনে ঢুকেই রুদ্রর পা থেমে যায়। দেখল প্রিয়তা বেডের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ছটফট করে বারবার উঠে দাঁড়াতে চাইছে কিন্তু জ্যোতি আর নার্স মিলে ধরে রেখে ওকে। শরীরের ব্যথায় বারবার মুখ কুঁচকে যাচ্ছে প্রিয়তার। কিন্তু তবুও থামছেনা ও। উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসছিল কেবিন থেকে। কিন্তু রুদ্রকে দেখে থেমে গেল। হয়তো রুদ্রকে ডাকতেই যাচ্ছিল।
প্রিয়তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল রুদ্র।

আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়াল প্রিয়তার সামনে। রুদ্রকে দেখে জ্যোতি আর নার্স দুজনেই প্রিয়তাকে ছেড়ে সরে দাঁড়াল। প্রিয়তার পাগলামোও থেমে গেল রুদ্রকে দেখে। শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখল রুদ্রকে। রুদ্রও দেখল প্রিয়তার এলোমেলো চুল, বিধ্বস্ত মুখ। প্রিয়তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যথা সহ্য করে রুদ্র কলারে ভর দিয়ে দাঁড়াল। ক্লান্ত, অসহায় গলায় বলল, ‘আমা্ আমার বাচ্চা কোথায় রুদ্র? ওরা সবাই বলছে আমার বাচ্চাটা আর নেই। আপনিই বলুন এটা হতে পারে? কখনও হতে পারে? আমাদের পুচকু সোনার কিছু হতে পারে? ওতো আপনার অংশ তাইনা? আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন ওর কিচ্ছু হতে দেবেন না। তারপরেও ওর কিছু হওয়া সম্ভব আপনি বলুন? বলুননা!’

রুদ্র নিরুত্তর হয়ে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার মুখের দিকে। চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতর মারাত্মক ঝড় চলছে ওর। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। কীকরে বলবে সে তার প্রিয়কে যে, আমাদের পুচকু সোনা আর নেই। আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। বাঁচাতে পারিনি আমি আমার পুচকুকে, আমার বাচ্চাকে। কীকরে বলবে? রুদ্রর নীরবতা প্রিয়তার হৃদয়কে দুমড়েমুচড়ে দেয়। শরীরে আর মনের প্রচন্ড ব্যথায় চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। আরও শক্ত করে রুদ্রর কলার চেপে ধরে বলে, ‘আমার বাচ্চাকে এনে দিন রুদ্র। আমার বাচ্চা আমাকে এনে দিন।

আমার আর কিচ্ছু প্রয়োজন নেই। শুধু বাচ্চাকে এনে দিন আমায়। আমি হাত জোর করছি আপনার কাছে। আমার পুচকুকে এনে দিন না। প্লিজ..’
কথাগুলো বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেল প্রিয়তা। পড়ে যেতে নিলে ধরে ফেলল রুদ্র। প্রিয়তা আবার বলতে শুরু করল। কিন্তু ওর কোন কথা বোঝা গেলোনা। কেবল অস্পষ্ট শব্দই শোনা গেল। ডক্টরও তখনই এসে হাজির হলেন। নার্সের সহায়তায় রুদ্রর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বেডে শুইয়ে দেওয়া হলো প্রিয়তাকে। অতিরিক্ত দুর্বলতায় বাঁধা দিতে পারল না প্রিয়তা।

ইনজেকশনের প্রভাবে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল। যতক্ষণ ঘুমোবে ততক্ষণই মুক্ত থাকবে এই নারকীয় যন্ত্রণা থেকে। প্রিয়তাকে ঘুম পারিয়ে ডক্টর রুদ্রর কাছে এসে বললেন, ‘এই মুমেন্টটা যেকোন মেয়ের কাছেই ক্রাইসিস মুমেন্ট। ব্যপারটা মেনে নেওয়াটা কারো জন্যে সহজ নয়। ওনাকে সবরকমের মানসিক প্রেশার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবেন। খুশি রাখার চেষ্টা করবেন। কোনভাবেই যাতে উত্তেজিত না হয়। আর হ্যাঁ, কয়েকদিন অবশ্যই চোখে চোখে রাখবেন ওনাকে।’
রুদ্র ঢোক গিলে নিয়ন্ত্রণ করল নিজের আবেগকে। জাফরও বাইরে থেকে এসেছে ততক্ষণে। উনি রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘নিজেকে সামলে রাখ। বাইরের দিকটা আমি আর উচ্ছ্বাস দেখে নেব। তুই কয়েকদিন ওকে সময় দে। ওর এখন তোকে প্রয়োজন।’

রাতে জাফর আর জ্যোতিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সকালে জ্যোতি আসবে আবার। প্রিয়তাকে নিয়ে একবারেই বাড়ি যাবে। হাসতপাতালে থেকে যায় রুদ্র আর উচ্ছ্বাস।
কিন্তু সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই খুব শান্ত দেখায় প্রিয়তাকে। কারো দিকে তাকায় না। কথাও বলেনা। জ্যোতি এসে খাবার খাইয়ে দিলে সেটাও খেয়ে নেয় চুপচাপ। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস রিসিপশনে সব ফর্মালিটিস্ কম্প্লিট করতে গেছে। জ্যোতিই এখন বসে আছে প্রিয়তার কাছে।

প্রিয়তাকে এমন অদ্ভুত শান্ত থাকতে দেখে অস্থির লাগছে জ্যোতির। অতি শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়। প্রিয়তার ক্ষেত্রেও কী তাই হলো? জ্যোতি আস্তে করে হাত রাখে প্রিয়তার হাতের ওপর। নরম গলায় বলে, ‘এভাবে গুমরে থেকোনা প্রিয়তা। কষ্ট বাড়বে। ভাগ্যকে কে বদলাতে পারে বলো? খোদা হয়তো বাচ্চাটার জন্ম লিখে রাখেননি। ওর জীবনকাল এইটুকুই ছিল হয়তো। নিজেকে এভাবে আর কষ্ট দিওনা। আমরা আছিতো তোমার সাথে।’

প্রিয়তা উত্তর দিলোনা। একইভাবে তাকিয়ে থাকল শূণ্য দৃষ্টিতে। জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস চাপল।
রিশিপশন থেকে সব ফর্মালিটিস্ শেষ করে কেবিনে ঢুকলো রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। সব গোছানোই ছিল। এখন কেবল প্রিয়তাকে নিয়ে গেলেই হবে। উচ্ছ্বাস জ্যোতিকে ইশারা করতেই জ্যোতি মাথা নাড়ল। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওঠো। বাড়ি যাবো আমরা।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৫

বিনা বাক্যব্যয়ে উঠতে গেল প্রিয়তা। কিন্তু দাঁড়াতে গিয়ে পেটের ব্যথায় বসে পড়ল আবার। রুদ্র দ্রুত এগিয়ে এলো। প্রিয়তাকে ধরতে গেলেই ঘটল অদ্ভুত কান্ড। ঝটকা দিয়ে রুদ্রর হাত সরিয়ে দিল প্রিয়তা। কিন্তু ফিরেও তাকাল না রুদ্রর দিকে। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল, ‘আমাকে একটু উঠতে সাহায্য করবে আপু।’
প্রিয়তার আচরণে থমকে গেল রুদ্র। অবাক হল জ্যোতি আর উচ্ছ্বাসও।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৭