আলোছায়া পর্ব ৭

আলোছায়া পর্ব ৭
ফারহানা কবীর মানাল

আশরাফুল মিরার জন্য এমন প্রেমময় চিঠি লিখেছে! মিরার যেন কথাটা বিশ্বাস হতে চায় না। আচ্ছা সেই অচেনা ছেলেটি এ চিঠি লেখেননি তো? মিরা নিজের হাতের দিকে তাকায়। পোড়া জায়গাটা বেশ শুকিয়ে এসেছে। এখন তেমন ব্যাথাও নেই। সামান্য যত্ন মানুষের মনের উপর কতটা প্রভাব ফেলে!

মিরার অচেনা ছেলেটার কথা ভাবতে বড্ড ভালো লাগে। কে হতে পারে লোকটা। মিরার হাতের চিঠিটা উল্টে পাল্টে দেখে, চিঠির পিছনে এক বছর আগের তারিখ লেখা রয়েছে । নিমেষেই মিরার মনের আকাশে কালো মেঘ জমা হতে থাকে। এই বুঝি চোখ দুটি থেকে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়বে।
কপলের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানির চিহ্নগুলো হাত দিয়ে মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। অতিরিক্ত আশা করতে নেই। মিনিট পাঁচেক পর আশরাফুল ফিরে আসে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” মিরা একটা চিঠি দেখেছো তুমি? এখানেই হয়তো ফেলে গেছি। ”
মিরা কেন জানি কথা বলতে পারে না। গলা আঁটকে আসে। তবুও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। তারপর চিঠিটা আশরাফুলের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
আশরাফুল মিরার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, ” যে নেই তার স্মৃতি রেখে কি লাভ! ভুলে যাওয়াই সব থেকে ভালো, তবুও কেন ভুলতে পারি না। ”

মিরার মনে নানান প্রশ্ন জমা হতে থাকে। তবে জানতে চাওয়ার ইচ্ছে হয় না। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকে। কয়েক পা সিঁড়ি দিয়ে নামলে আশরাফুল মিরার নাম ধরে ডাক দেয়। মিরা সামান্য অবাক হয়, সে-ই সাথে অদ্ভুত এক অনুভূতির সাক্ষী হয়। নিজের অনুভূতিকে নিজের ধিক্কার জানায় মিরা। তারপর পিছন ফিরে বলে,

–” কিছু বলবেন?”
–” আজ কি তোমার জন্মদিন? ”
মিরা বুঝতে পারে না কি জবাব দেওয়া উচিত। এমন সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও যেন বারবার থমকে যাচ্ছে। আজ কেন সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মিরার।

–” বলবে না আমাকে?”
–” হ্যাঁ, আজ আমার জন্মদিন। ”
আশরাফুলের চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। কি করে দুইটা মানুষের এতোটা মিল থাকতে পারে?
–” তোমার কি যমজ বোন আছে মিরা? ”
–” না আমার কোনো বোন নেই। আমি একা। ”

হতাশার ছাপ ফুটে ওঠে আশরাফুলের মুখে। সে কি কখনো তার প্রেয়সীকে খুঁজে পাবে না? হয়তো বা না। যে নিজের ইচ্ছার হারিয়ে যায় তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়? তাকে হয়তো খুঁজে বেড়ানোও অনুচিত। তবুও কেন তাকে খুঁজতেই মন ব্যাকুল হয়ে থাকে?
মিরা আর দাঁড়াতে পারছে না। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে। সারাদিন অনেক কাজ করেছে সে। এখন চাইলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করা সম্ভব না।

–” আপনি কি কিছু বলবেন? আসলে শরীরটা ভালো লাগছে না, বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ”
–” ওহ! আমি দুঃখিত। তুমি যাও।”
মিরা দ্রুত পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে যায়। তারপর মা’য়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে, রোজিনা রেণু দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ভালোই হয়েছে মিরার জন্য, না হলে রান্নাঘরের ঠান্ডা মেঝেতে ঘুমাতে হতো। বিছানায় শুয়ে নানান কথা ভাবতে থাকে মিরা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় খেয়ালই করে না।

সকালের সূর্য তখন পূর্ব আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। চারদিক সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। মিরার বেশ দেরিতে ঘুম ভাঙে। সারাদিন কাজ করার পর অতো রাত জেগে থাকলে কি সকাল সকাল ঘুম ভাঙে নাকি! মিরারও তো রক্ত মাংসে গড়া শরীর। রোবট তো নয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। না জানি আজ তাকে কোন অপমান সহ্য করতে হয়৷ আবার মা-ও আছে এখানে। নিজের উপরই রাগ হচ্ছে মিরার। কে কাল ছাঁদে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলো আশরাফুলের সাথে।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পায় রেশমা বানু প্লেট ধূয়ে সাজিয়ে রাখছেন। কাঁপা গলায় বলে, ” সকালে কি রান্না করবো? আমার উঠতে অনেক দেরী হয়ে গেছে, দুঃখিত। ”
রেশমা বানু কোনো উত্তর দেয় না। পিছন থেকে লাবণির কন্ঠ শোনা যায়। সে মিরার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে, ” তুমি ঘুম ছিলে বলেই ভাইয়া এতো সুন্দর একটা খাবার কিনে আনলো সবার জন্য। তুমি জেগে থাকলে তো রোজকার মতো ওইসব শাকপাতা খেতে হতো। ”

লাবণির কথায় মিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, ততো সময়ে রেশমা রেনুর থালাবাসন ধূয়ে রান্নাঘর থেকে চলে যায়। রোজিনা রেণু রেডি হয়ে বসে আছে। মিরার সাক্ষাৎ পেলে বাসার দিকে রওনা দিবে। মিরা বাচ্চাদের মতো গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে তারপর আহ্লাদী কন্ঠে বলে, ” আমাকে তোমার কাছে থাকতে খুব ভালো লাগে মা। আমাকে নিয়ে যাবে তুমি?”
রোজিনা রেণু মেয়ের ভালোবাসা দেখে একটু অবাক হয় না। ছোট থেকেই রোজিনা রেণুর সাথে এমন ব্যবহার করে মিরা।

–” মা তোমাকে সকালে কে খেতে ডেকেছিলো? ”
–” জামাই বাবা। বড্ড ভালো ছেলেটা। তুই ঘুম ছিলে বলে নিজে বাইরে গিয়ে খাবার নিয়ে এসেছে। আবার সবাইকে বলে গেছে আজ বাড়িতে রান্না করতে হবে না, বাইরে থেকে খাবার কিনে আনবে। ”

মিরা ব্যাপারটা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায় না। হয়তো বাইরে খাবার খেতে ইচ্ছে করেছে তাই কিনে এনেছে। সবকিছু নিজের মতো সাজিয়ে রঙিন করা উচিত নয়। পরে অনেক বেশি কষ্ট পেতে হয়। মিরা এ কষ্ট পেতে চায় না৷ রোজিনা রেণু তাড়াতাড়ি করে চলে যায়, বাড়ি গিয়ে তার অফিসে যেতে হবে। মিরা রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে মা’য়ের যাওয়ার দৃশ্য দেখে, চোখ কোণ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে মিরার। শুষ্ক মাটি নিমেষেই তা শুষে নেয়। মিরার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। কিছুই ভালো লাগছে না তার।

ঘরে গিয়ে জানালার আশেপাশে কিছু একটা দেখতে থাকে মিরা, মনে হচ্ছে কিছু খুঁজে চলেছে, কাঙ্ক্ষিত দুইটা কাগজের টুকরো দেখে ঠোটের কোনায় হাসি ফুটে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে কাগজ দুইটা হাতে তুলে নেয়।
তার একটাতে লেখা-
” নিজের যত্ন নিতে শেখো, শুধু রাত দুপুর বেলা ছাঁদে দাঁড়িয়ে তারা দেখলে হবে? সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে, গাছে পানি দিতে হবে। এতো এলোমেলো হলে কি করে হবে শুনি?”

মিরা বুঝতে পারে না লোকটা কে! কি করে তাকে দেখতে পায়! তবে কেন জানি বড্ড ভলো লাগে মিরার। কেউ একজন আছে যাকে মিরা নিজের ভালো লাগা বলতে পারে। লোকটাকে অবশ্য মিরা দেখেনি, তবুও তার থেকে চিঠি পেতে বেশ ভালো লাগছে। দ্বিতীয় চিঠিতে লেখা –
” তোমার চোখের পানি, আর তোমার পাশে দ্বিতীয় কোনো পুরুষ আমায় বড্ড পোড়ায়। কেন এতো হিংসে হয় বলতে পারো?”

মিরা চিঠিগুলো পড়ে লজ্জা লাল হয়ে যায়, সারা মুখে লজ্জা মিশ্রিত হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ে। দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ডাকে মিরা, এমন মনে হচ্ছে যেন কেউ তাকে সারাক্ষণ দেখেই চলেছে। কয়েক মুহুর্ত পরে নিজের কাজেই বিরক্ত হয় সে, চেনা নেই জানে নেই, অচেনা একটা লোকের এই তিনটা চিঠিতে এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। চিঠি দুইটা একটা খাতার ভাঁজে রেখে দুপুরের রান্না করতে চলে যায়।

মিরার সারাদিন কেটেছে চিঠি আর আশরাফুলের কথা মনে করে। আশরাফুলের অতীত জীবনের প্রেম কাহিনী বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে, সব থেকে বেশি অবাক হচ্ছে ওই মেয়েটাকে নিয়ে, কি করে এতো মিল থাকতে পারে ও-র চেহারার সাথে। আছে মা’য়ের কাছে শুনে দেখলে তো মন্দ হয় না। মোবাইল বের করে মা’কে কল দেয়। দুই বার রিং হওয়ার পর রোজিনা রেণু কল রিসিভ করে।

–” আসসালামু আলাইকুম মা, কেমন আছো? ”
–” ওয়ালাইকুম আসসালাম। এইতো মা আছি। তুমি কেমন আছো?”
–” আমি যেমন থাকি। দুপুরে খেয়েছিস মা?”
–” হুম মা। তুমি খেয়েছো?”
রোজিনা রেণু দুপুরে খায়নি। মেয়ের বাড়ি থেকে এসে আর রান্না করা হয়নি, তাই দুপুরে খাওয়া হয়নি। তবুও মুখে বলে, ” হুম। “.

–” মা একটা কথা জানতে চাইবো?”
–” হ্যাঁ মা বল, কি বলবি?”
–” আমার কি কোনো যমজ বোন আছে?”
–” না রে, আমার কাছে আছে। রাতে কথা বলি। ”

মিরা কল কেটে দেয়। মা তো বললো তার যমজ বোন নেই, তাহলে কি করে ওই মেয়েটার সাথে এতো মিল মিরার!
রাতের আকাশে তারা ফুটে উঠেছে। মিরা আজও ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। রহস্যময় মানুষটা এখন তাকে দেখছে নিশ্চয়ই। আশেপাশে উঁকি দিতে থাকে, কিন্তু তেমন কাউকে দেখতে পায় না। তবুও দাঁড়িয়ে থাকে, তার চোখজোড়া যেন কাউকে খুঁজে চলেছে, অচেনা অজানা এমন কেউ, যাকে মিরা বড্ড বেশি চিনতে চায়।

একবারের মতো এক পলক দেখতে চায়। দূরে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কিছু করছে, ছেলেটার মুখে মোবাইলের আলো পড়ে শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের ভিতর একটা ছায়া! এই কি তবে সে? মিরার কৌতূহল বেড়েই চলেছে। কিন্তু ছেলেটা অনেক দূরে, চাইলেও ডাক দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া মিরা তো তার নামও জানে না। এমনও নয় যে মিরা আর ছেলেটা পরিচিত। এ যদি অন্যকেউ হয় তবে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। মিরার চোখে মুখে হতাশার ছাপ ফুটে ওঠে।

নিচ থেকে কেউ মিরার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছাদে আসতে থাকে। কন্ঠ শুনে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় এটা আশরাফুল। আশরাফুল ছাঁদে এসে মিরার হাতে একটা ফুলের তোড়া ধরিয়ে দেয়। তারপর শান্ত গলায় বলে,” I am sorry for everything. ”

আলোছায়া পর্ব ৬

কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সেখানে, হনহন করে চলে যায়। মিতা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুল ইদানীং অদ্ভুত ব্যবহার করছে মিরার সাথে!

আলোছায়া পর্ব ৮