আলোছায়া পর্ব ৬

আলোছায়া পর্ব ৬
ফারহানা কবীর মানাল

নিজের টাকা ছিলো না বলে স্বামী চলে গেছে মেয়ের বেলায় সে এই ভুল করবেন না। বড়লোক বাড়ি দেখেই বিয়ে দিবে। এরপর মিরার বিয়ে হয়ে যায় আশরাফুলের সাথে।
–” কি হলো মা? কি ভাবছো?”
মেয়ের কথায় হুঁশ ফিরে আসে রোজিনা রেণুর। নড়েচড়ে বসে বলেন, ” না কিছু না। এসব কি শুনেছিস তুই কে জানে! এসব সত্যি না। ”

মায়ের বিচলিত চেহারা বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা বলছে। মিরা আর দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে না। মা হয়তো তাকে সত্যিটা বলতে চাইছে না, কেউ যদি তোমাকে কোনো কথা বলতে না চায় তবে সে কথা না শোনাই সব থেকে ভালো।
রোজিনা রেণু মিরার চিবুক স্পর্শ করে বলে, ” মা তুই ভালো আছিস তো?”
মিরার মলিন হেসে বলে, ” এইতো মা আল্লাহ যেমন রেখেছে বেশ ভালোই। খাওয়ার চিন্তা নেই। এতো বড় বাড়িতে থাকতে পারছি। আর কি চাই বলো!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রোজিনা রেণু মুচকি হেসে বলেন, “মা আমি যা করেছি তোর ভালোর কথা ভেবেই করেছি। তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে দিনরাত পরিশ্রম করে তোকে বড় করে তুলেছি। বড়লোক পরিবার দেখে বিয়ে দিয়েছে যাতে তোর বাবার মতো লোভী হয়ে না যায়। তুই আমার উপর কোনো রাগ রাখিস না মা।”
মিরা কোনো উত্তর দিতে পারে না। জীবনের এমন বাঁকে দাঁড়িয়ে একজনকে পাশে পেতে বড্ড ইচ্ছে করে কিন্তু কে তার পাশে দাঁড়াবে? কে তাকে আগলে রাখবে? এমন কি কেউ নেই!

–” মা চলো, অনেক রাত হয়েছে খেয়ে নিবে। ”
রোজিনা রেণু মেয়ের কথা মতো খেতে চলে যায়। সকলে নিজের মতো খেয়ে নিয়েছে অনেকে বাড়িও চলে যাচ্ছে। রোজিনা রেণুও খেয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মিরা অনেকবার থাকতে বলেছিলো কিন্তু সে রাজি হয় না। পাছে মেয়েকে যদি কোনো অপমান সহ্য করতে হয়।

মিরা মন খারাপ করে ঘরে বসে আছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। কতদিন হয়ে গেলো মা’য়ের পাশে ঘুমায় না। মা একদিন থেকে গেলে কি এমন হতো! বড্ড অভিমান হয় মা’য়ের উপর। পরক্ষণেই মনে হয় মা চলে গিয়ে ভালোই করেছে, থাকলে হয়তো মিরার কষ্টগুলো চোখ পড়তো তার। কি দরকার শুধু শুধু মা’য়ের কষ্ট বাড়িয়ে। তাছাড়া এ বাড়ির কেউ তো মা’কে থাকতে বলেনি। এতো রাতে মা কি করে যাবে সে চিন্তাও কারো মাথায় আসেনি। সকলে নিজের মতো খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ছে। মিরা বা রোজিনা রেণু খেয়েছে কিনা সে খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি কারো কাছে, এ বাড়িতে মা না থেকেই বেশ ভালো করেছে।

মিনিট দশেক পর বাইরে ঘরে রোজিনা রেণুর গলা শোনা যায়। মিরা মনের ভুল মনে করে তেমন গায়ে লাগায় না, একমনে কিছু একটা চিন্তা করতে থাকে।
–” মিরা মা জামাই আজ যেতে দিলো না। মাঝ পথ থেকে নিয়ে এসেছে, এতো রাতে কিছুতেই একা যেতে দিলো না। ছেলেটা ”

রোজিনা রেণুর গলা পেয়ে মিরা চোখ তুলে তাকায়, আশরাফুল আর রোজিনা রেণু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মিরা চোখের ভুল মনে করে চোখ কচলে আবার তাকিয়ে একই দৃশ্য দেখতে পায়। আবেগে চোখ দিয়ে পানি আসতে চায়, তবে অজানা আবরণে অশ্রুকণা আঁটকে যায়। বিছানা গুছিয়ে মা’কে নিজের ঘরে ঘুমাতে বলে ছাঁদে চলে যায় মিরা। মা’য়ের পাশে ঘুমাতে বড্ড ইচ্ছে করছে তবে নিজের দাম্পত্য জীবনের কষ্ট মা’কে দেখাতে ইচ্ছে করছে না। সারাজীবন মা অনেক কষ্ট পেয়েছে, এখন না হয় মেয়ের দুঃখে কষ্ট না-ই বা পেলো।

রোজিনা রেণু বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়। কিছু সময় পর গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। মেয়ে হয়তো জামাইয়ের কাছে আছে, তাই আর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয় না তার।
নিস্তব্ধ রাত, অন্ধকার আকাশে কয়েকটা তারা নিজের মতো জ্বলে চলেছে। কিন্তু তাদের আলোয় পৃথিবী আলোকিত হচ্ছে না, বরং অন্ধকার আরো গাঢ়ো হয়ে ফুটে উঠেছে। মিরার রাতের অন্ধকারে তারার আলো দেখছে ব্যস্ত হয়ে আছে, আকাশ-পাতাল কিসব ভেবে চলেছে। তার পাশে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তা মিরার চোখে পড়েনি।
–” আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি এমনকি এখন দিয়ে চলেছি, তাই না মিরা?”

আশরাফুলের কন্ঠে মিরা চমকে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে আশেপাশে তাকায়, পাশে তাকাতেই দেখতে পায় আশরাফুল দাঁড়িয়ে আছে। বুকের সাথে হাত বেঁধে, আকাশের দিকে তাকিয়ে মিরার মতো তারা দেখছে। মিরা কোনো উত্তর দেয় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

–” নিরবতাকে কি আমি সম্মতি ধরে নিবো?”
মিরা তবুও জবাব দেয় না। কি জবাব দিবে সে। আশরাফুল তাকে মেনে নিলে হয়তো এতো কষ্ট সহ্য করতে হতো না মিরাকে, তবুও আশরাফুলকে সে দোষ দিতে পারে না। আশরাফুল তো তাকে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেনি, আজমল সাহেবের কথা রাখতে বিয়ে করেছে, তবুও দোষ তার। সে কি পারতো না নিজের বাবাকে বোঝাতে বা বিয়েটা না করতে কিন্তু সে তা করেনি। এমনি বিয়ে পরে কখনো মিরার কি প্রয়োজন বা মিরা কেমন আছে তা দেখতে যায়নি। তাহলে কি দোষটা তার না?

মিরা কথা ঘুরিয়ে বলে ওঠে, ” একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?”
আশরাফুল খানিকটা চমকে যায়। এতোদিনে মিরা কখনো তার কাছে কিছু জানতে চায়নি। যতটুকু যা কথা হয়েছে সবটাই কাজের প্রয়োজনে। তবুও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, আস্তে আস্তে বলে ওঠে, ” হুম বলো। ”
মিরার মাঝে সংকোচ কাজ করে, এবার ভাবে, না কিছুই জানতে চাইবে না। কি দরকার কারো কাছে কিছু জানতে চেয়ে, বলার হলে তো নিজে থেকেই বলতো। তবুও কৌতুহল কমে না। নিজের সাথে দন্দ কাটিয়ে প্রশ্ন করে, ” আপনার মানিব্যাগে আমার ছবি কেন?”

আশরাফুল শান্ত গলায় জবাব দেয়, “ছবিটা তোমার মতো দেখতে হলেও মানুষটা তুমি না। ”
মিরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মিরার মতো দেখতে! তার মানে মিরার মতো দেখতে আরো কেউ পৃথিবীতে আছে। কলেজে স্যারের কাছে শুনেছিলো একজনের মতো দেখতে নাকি অনেক মানুষ পৃথিবীতে থাকে। তাহলে এই ছবির মেয়েটা কি তেমনই একজন।

–” সত্যি! আমার মতো দেখতে অন্য কেউ এই পৃথিবীতে আছে? আমাকে তার সাথে একবার দেখা করিয়ে দিবেন?”
আশরাফুল মিরার কৌতুহল দেখে অবাক হয়। নিজের মতো দেখতে অন্য একজন আছে শুনে কারো মনে এতো কৌতুহল জাগতে পারে? একরাশ হতাশা নিয়ে আশরাফুল জবাবে বলে,
–” কি করে তোমার সাথে তার দেখা করাবো বলো, সে তো আমার জীবনেই নেই। হাসিখুশি ছেলেটাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে চলে গেছে। ”

–” আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে? ”
–” শুধু আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি। বরং মানুষের উপর আমার ভরসা বিশ্বাস এগুলোও নষ্ট করে দিয়ে গেছে। আমি চাইলেও নতুন করে কাউকে আমার জীবনে জড়াতে পারি না। বড্ড ভয় হয়। ”
–” সবাই তো সমান হয় না। একজন চলে গেছে মানে এমন তো না যে সবাই চলে যায়। ”
–” তোমার মতো আমিও এটাই ভাবতাম, তবে আমার বিশ্বাস একবার নয় দুইবার ভেঙে গেছে, ভেঙে যাওয়া গাছে নতুন পাতা গজাতে অনেকদিন সময় লাগে। আমি তো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মানুষ।”

মিরার কোনো কথা বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের জীবন-ই যখন এতো কিছু দেখিয়েছে তখন অন্যের জীবন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করছে না। তবুও বলে,
–” আমাদের জীবনে এমন একজন মানুষ অবশ্যই থাকে, যার কথা ভেবে আমরা শান্তি পাই। আমাদের তাঁকে নিয়ে ভাবতেও বড্ড ভালো লাগে। ”
–” তোমার জীবনে এমন কেউ আছে? যাকে নিয়ে ভাবতে তোমার ভালো লাগে?”

আশরাফুলের প্রশ্নের কি জবাব দিবে জানা নেই মিরার। তবে অচেনা কারো থেকে পাওয়া চিঠির কথাটা মনে পড়ে, কে চিঠিটা পাঠিয়েছে মিরা জানে না, তবে সে মিরাকে নিজের খেয়াল রাখতে বলেছে, এতটুকুই বা কে বলে ও-কে!
নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে মিরার। যা আশরাফুলের চোখ এড়ায়নি। আশরাফুল ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে,
–” তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললাম। দুঃখিত। ‘

কথাটা বলে আশরাফুল ছাঁদ থেকে চলে যায়। মিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। জীবন মানুষকে কত কিছুই না দেখায়! আজ আশরাফুল আর মিরার তো একটাই ব্যক্তিগত জীবন হওয়ার উচিত ছিলো। দুইজন একান্ত দু’জনের! তাঁরা যে স্বামী স্ত্রী। তবে এই সম্পর্কটা নেহাৎ কাগজে কলমে। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।

রাত বাড়তে থাকে, মিরা ঠিক করে মা’য়ের কাছেই ঘুমাবে। মা জানতে চাইলে বলবে তার কাছে ঘুমাতে ইচ্ছে করছিলো খুব। তা-ই চলে এসেছে। তাছাড়া এখন রাতও অনেক হয়েছে, মা নিশ্চয়ই ঘুম। মিরা ঘরের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ খেয়াল করে একটা কাগজের টুকরো পড়ে আছে। কৌতূহল বশত কাগজের টুকরো হাতে তুলে নেয়। তাতে লেখা-
“শুভ জন্মদিন প্রণয়ী। হে আমার প্রিয়তমা, তুমি আমার জীবনে না আসা পর্যন্ত আমি কখনই সুখ অনুভব করিনি। তুমি আমার জন্য এই পৃথিবীস্বরুপ। তোমার এই বিশেষ দিনে, আমি তোমার জীবনে ভালবাসা, আনন্দ, শান্তি এবং সুখের জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি।”

আলোছায়া পর্ব ৫

আজ মিরার জন্মদিন! মিরার নিজেরই মনে ছিলো না। কিন্তু এখানে এই কাগজটা কে রাখলো? আশরাফুল?

আলোছায়া পর্ব ৭