আলোছায়া পর্ব ৫

আলোছায়া পর্ব ৫
ফারহানা কবীর মানাল

আজমল সাহেব রোজিনা রেণুর হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। কপালে জমে থাকা ঘাম বিন্দু গুলো রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। রোজিনা রেণু দৌড়ে বেরিয়ে যায়। কুসুম বিবি দরজার পাশে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকে।
তারপর রোজিনা রেণুর কাছে যায়। রোজিনা রেণুর হাতে আঁচড়ের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। লাল হয়ে আছে।

–” আপা আমাকে এক গ্লাস পানি দেন। ‘
হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলে রোজিনা। কুসুম বিবি একগ্লাস পানি তার সামনে ধরে। কুসুম বিবির হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু শেষ করে ফেলে। তারপর মন মরা হয়ে বলে উঠে, ” আমি আর এই অফিসে চাকরি করবো না আপা। আপনার জানা শোনা কোন কাজ আছে। বেতন অল্প হলেও হবে। ”
–” কেন চাকরি করবা না কেন? এইটাই তো বেশ ভালো চাকরি, বেতনও ভালোই।”
–” আমার চাকরি লাগবে না, নিজের মানসম্মান সবার আগে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে রোজিনা রেণু। সে ভেবেছিলো কথাগুলো কুসুম বিবি শুনতে পায়নি। কিন্তু কথাগুলো ঠিকই কুসুম বিবির কর্ণগোচর হয়েছিল। পরের দিন আর অফিসে আসে না রোজিনা। বাড়িতে বসে থাকে। আজীবন নিজের সম্মান বাঁচিয়ে এসেছে, একা মেয়ে হওয়ার সবাই বারবার সুযোগ নিতে চেয়েছে। শকুনের নজর থেকে নিজেকে আগলে রেখেছে, সে-ই সাথে মেয়েকেও। জীবনে চলার পথে বারবার পড়ে গেছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার কেন পারবে না! এতোবার উঠে দাঁড়াতে পারলে এবারও নিশ্চয়ই পারবে।

ওদিকে অফিসে আজমল সাহেবের চিন্তার শেষ নেই। সারা অফিস জুড়ে কালকের গুঞ্জন! সত্যি কথার সাথে মিথ্যা কথা মিশিয়ে নানান গল্প। কেউ কেউ বলছে আজমল সাহেব নাকি রোজিনা রেণুকে ভোগ করে অনেক টাকা দিয়ে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। কারো মতে রোজিনা রেণু লজ্জায় আর অফিসে আসে না। কুসুম বিবি নাকি নিজের চোখে সব দেখছে।
সময় যাওয়ার সাথে সাথে সমালোচনার মাত্রাও বাড়তে থাকে। আজমল সাহেবের সামনে কেউ কিছু না বললেও পিছন থেকে সব কথাই কানে আসে।

–” শিউলি আপা শোনো, আমি ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দিবো, যে স্যারের নজর আয়ার উপর পড়তে পারে তার নজরে আমি পড়বো না এটা কি করে হতে পারে! ”
–” আরে কিসব বলছো চাকরি কেন ছাড়বে, বরং তোমার রূপের সুধা দিয়ে প্রমোশন করিয়ে ফেলো। ”
আজমল সাহেবের অগোচরে দুইজন মহিলা কর্মচারী কথোপকথন।

আজমল সাহেবের আড়ালের বলেছে কথাগুলো তবুও আজমল সাহেবের কানে এসে পৌঁছায়, সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না আজমল সাহেব। ওদের চোখ এড়িয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে বসে পড়ে। এমন চলতে থাকলে ওনার নিজের চাকরিও থাকবে না আর মানসম্মানের কথা না হয় না-ই বা বললাম। কোম্পানির মালিক বড্ড ভালো মানুষ। মেয়েদের অনেক বেশি সম্মান করে, কোনো ভাবে এ কথা তার কানে গেলে আজমল সাহেবকে চাকরি থেকে বের করে দিতে দ্বিধা বোধ করবেন না। অফিসে আজমল সাহেবের পদটা দখল করতে চায় এমন লোকেরও অভাব নেই। টেনশনে মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা তার।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আজমল সাহেব। নিজের লালসাকে বশ করতে পারলে আজ এইদিন দেখতে হতো না। অনেক বেশি ভাবছে তো সে। কিন্তু ভাবনাটা অস্বাভাবিক কিছু না। সেবার একজন তার নিম্নপদস্থ কর্মচারীকে খারাপ প্রস্তাব দিয়েছিলো। সে ঘটনা মালিকের কানে গেলে তাকে সাথে সাথে চাকরি থেকে বের করে দেয়।

কারো কোন কথা শোনেনি। সেই সাথে আজমল সাহেবকে কড়া হুকুম দেন, এসব কাজ দ্বিতীয়বার কেউ করলে যেন তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে সবাই নিজের যোগ্যতা দিয়ে কাজ করে, কেউ কারো লালসা হাসিল করার বস্তু নয়। এখন এই মালিক যদি জানতে পারে আজমল সাহেব অফিসের আয়ার সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলো তাহলে তার কি দশা করবে! ভাবতেই ভয়ে কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায় আজমল সাহেবর।

চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে থাকে, কি করে সব সামাল দেওয়া যায়। ব্যাপারটাকে এমনভাবে ধামাচাপা দিতে হবে যেন কারো কিছু বলার সাহস না থাকে। অনেক চিন্তা করে অফিসের দারোয়ানকে ডেকে পাঠায়।
–” স্যার ভিতরে আসবো?”
–‘ হুম আসো। আচ্ছা আমাদের অফিসের আয়া, কি যেন নাম ও-র? ”

বিদ্রুপে মুখ বেঁকে আসে নিরব মিয়ার। কাল বিকালে যার হাত ধরে টানাটানি করছিলো আজ তার নাম ভুলে গেছে। কত নাটক করতে পারে মানুষ! ইচ্ছে করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে তবুও চাকরির ভয়ে চুপ করে থাকে। মিনমিনে গলায় বলে, ” আয়ার নাম তো রোজিনা রেণু। কিন্তু সে তো আজ অফিসে আসে নাই স্যার। ”
–” ওহ, তাহলে ও-কে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ এই না-ও। কিছু খেয়ে নিও। আর ও-কে সাথে করে নিয়ে আসবে। কেমন? ”

নিরব মিয়ার দিকে এক হাজার টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় আজমল সাহেব। নিরব মিয়া হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে রোজিনা রেণুর বাড়ির পথ ধরে। নানান প্রশ্ন মনের মাঝে জেগে ওঠে তবুও নিজেকে শান্ত রাখে। কি দরকার এসব ঝামেলায় জড়িয়ে।

–” রোজিনা আপা, এদিকে শোনো তো। ”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়ে নিরব। রোজিনা তখন উনুনে ভাত চাপিয়েছে, মেয়েটা সকালে না খেয়ে কলেজে গেছে। এসে জানি গরম ভাত খেতে পারে। নিরব মিয়ার গলা শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে।
–” কিছু বলবে নিরব ভাই?”

-” বড় সাহেব তোমাকে ডেকেছে। এখনই চলো। আমাকে তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছে। ”
চোখমুখে ভয়ের ছায়া এসে ভীড় করে রোজিনা রেণুর। তবুও মুখে কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মাথা নেড়ে ঘরের ভিতর চলে যায়। মিনিট দশেক পরে বেরিয়ে এসে বলে, ” চলো নিরব ভাই। ”
নিরব মিয়া রোজিনা রেণুর পাশে হেঁটে চলেছে। বারবার আড়চোখে এই মহিলাকে দেখছে। মাঝে মাঝে তাকে বড্ড অসহায় মাঝে মাঝে বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। কিন্তু কারণগুলো নিবর মিয়া নিজেও ধরতে পারছে না।

–” স্যার রোজিনা আপাকে নিয়ে এসেছি। ‘
–” আচ্ছা তুই যা এখন।”
নিরব মাথা নেড়ে চলে যায়। রোজিনা রেণু মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের আঙ্গুলে কাপড় পেঁচিয়ে যাচ্ছে। কি জন্য তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে বুঝতে পারছে না। এখন মনে হচ্ছে না আসলেই ভালো হতো।

–” রোজিনা তোর মেয়ে আছে না একটা?”
–” হ্যাঁ, একটাই মেয়ে আমার। ”
–” কি করে তোর মেয়ে?”
–” এই তো কলেজে পড়ে। অনার্স ভর্তি হয়েছে এবার। ”
–” বিয়ে দিবি তোর মেয়েকে আমার ছেলের সাথে?”

রোজিনা রেণু অবাক দৃষ্টিতে আজমল সাহেবের দিকে তাকায়। কি করতে চায় এই লোকটা। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
–” আমার ছেলে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। তুই তো ও-কে দেখেছিস। ”
রোজিনা রেণুর কাছে আশরাফুল ছেলেটা অপরিচিত নয়। কয়েকবার বাবার অফিসে এসেছে। সে-ই সুবাদেই দেখা। আজমল সাহেব এই অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিলো ছেলেকে তবে ছেলে নাকি নিজের যোগ্যতায় চাকরি করবে, বাবার নাম ভাঙিয়ে চলবে না। তাই রাজি হয়নি। ছেলেটার কথা বলার ধরণ বেশ ভালো। ছোট বড় সবাইকে সালাম দিয়ে কথা বলে। আগেরবার রোজিনা রেণু আশরাফুলকে চা দিতে গেলে তাকেও সালাম দিয়েছে। দেখতেও সুন্দর!

–” কি রে কি ভাবিস? এতো ভাবনা ছেড়ে দে। তোর মেয়েকে দেখতে বেশ সুন্দর। আমার বেশ পছন্দ। আমার ছেলের সাথে বেশ সুখেই থাকবে। ”
রোজিনা রেণু ভেবে পায় না৷ ছেলে ভালো চাকরি করে, স্বভাব চরিত্র ভালো এমনই শুনছে। ছেলের বাপের চরিত্র যেমন ছেলে আবার তেমন না তো। ভয় হয় রোজিনা রেণুর তবুও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দেয়।
–” আজ বিকালে তোর মেয়েকে দেখতে যাবো। বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে আবার অফিসে আসবি কেমন?”
–” আচ্ছা ঠিক আছে। ”

সারাপথ চিন্তা করেও কোনো কূল পায় না রোজিনা। নিজের স্বামীর টাকার লোভে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সল্প বেতনে চাকরি করে এমন ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি নয় সে। এই প্রস্তাবটা বেশ ভালো। না করার দরকার হয় না। পুরুষ মানুষের একটু সমস্যা থাকতেই পারে, আর বাপের দোষ আছে বলে কি ছেলেরও দোষ থাকবে নাকি। তাছাড়া আজমল সাহেব এতো বছর বউকে নিয়ে সংসার করছে, কই তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে তো আর বিয়ে করেনি। মেয়ের বিয়ে সে এখানেই দিবে।

ছেলে ভালো চাকরি করে, দেখতে সুন্দর, বড় ঘর হলেই মেয়ে সুখে থাকবে। এমন চিন্তা ধারা আজকালকার ৯০% মানুষের ভিতর দেখা যায়। রোজিনা রেণুও তাদের ব্যতিক্রম নয়। হয়তো টাকাই সুখ দিতে পারে, না হলে তার স্বামী কেন তাকে ছেড়ে চলে যাবে! স্বামী চলে যাওয়ার পর থেকে রোজিনা রেণুর মনে গেঁথে গিয়েছে টাকাই জীবনে সুখ আনতে পারে, টাকা জীবনের সব। তা না হলে অমন সুখের সংসার ছেড়ে কি কেউ চলে যায় নাকি? নিজের টাকা ছিলো না বলে স্বামী চলে গেছে মেয়ের বেলায় সে এই ভুল করবেন না। বড়লোক বাড়ি দেখেই বিয়ে দিবে। এরপর মিরার বিয়ে হয়ে যায় আশরাফুলের সাথে।

আলোছায়া পর্ব ৪

–” কি হলো মা? কি ভাবছো?”
মেয়ের কথায় হুঁশ ফিরে আসে রোজিনা রেণুর। নড়েচড়ে বসে বলেন, ” না কিছু না। এসব কি শুনেছিস তুই কে জানে! এসব সত্যি না। ”

আলোছায়া পর্ব ৬

1 COMMENT

Comments are closed.