আলোছায়া পর্ব ৪

আলোছায়া পর্ব ৪
ফারহানা কবীর মানাল

মহিলা দুইজন উৎসুক হয়ে একে অপরের সাথে কথা বলছে। মিরা পা যেন ঘরের ভেতরে
যেতে চায় না। বড্ড জানতে ইচ্ছে করে কেন তাকে এই বাড়ির বউ করে এনেছে। কি এমন দোষ চাপা দিতে তার জীবনে এতো কষ্ট নেমে এসেছে।
মিরা ঘরে প্রবেশ করে না, বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। মহিলা দুইজন নিজেদের মতো কথা বলতে ব্যস্ত।

–” আমাদের স্যারের নাকি ওই আয়ার দিকে কুনজর ছিলো। একদিন ফাঁকা অফিসে স্যার ও-র সাথে খারাপ কিছু করতে যায়। কিন্তু আয়া রাজি হয় না, সবাইকে বলে দিতে চায়। পরে ওই আয়ার মুখ বন্ধ করতেই ওর মেয়েকে ছেলের বউ বানিয়ে এনেছে। যাতে ও-র মুখ বন্ধ থাকে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” কি রে এই ব্যাপার! আচ্ছা এতো বড় বাড়ি স্যারের এতো বড় পদে চাকরি কিন্তু একজন কাজের লোকও তো দেখলাম না রে। ”
–” পরের চাকরি করে, বেতন আমাদের থেকে বেশি হলেও কোম্পানির মালিক তো না। কোম্পানির মালিক বিদেশ থাকে। দেশের এই কোম্পানি উনি দেখাশোনা করে। ”

–” ওহ তাই বল। আমি তো ভাবলাম উনার নিজের কোম্পানি। ”
–” আরে না। এতো বড় কোম্পানির মালিক হলে তো রাজপ্রাসাদ বানাতো। দাসদাসী থাকতো। হা হা”
–” তবে যা-ই বলো, ভাব কিন্তু রাজাদের মতো। ”
মহিলা দুইজন হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে, কিন্তু মিরার চোখের পানি। মা’য়ের সম্পর্কে এমন কথা সে কখনো আশা করেনি। মা নিজের সম্মান বিক্রি করে তাকে বিয়ে দিয়েছে, ব্যাপারটা কিছুতে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।

মিরা ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। মুচকি হাসি দিয়ে উনাদের উদ্দেশ্যে বলে, ” আপনাদের জন্য নিয়ে এলাম। কিছু লাগলে বলবেন কিন্তু। আপনাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? ”
মহিলা দু’জন মুচকি মুচকি হাসছে, একজন অন্যজনকে চোখের ইশারায় কিছু বলছে। মিরাকে দেখতে বলছে। সেসব মিরার চোখ এড়ায়নি, তবে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মায়ের কাছে আজ সবকিছু জানতে হবে। সারাজীবন এই নরক যন্ত্রণা সহ্য করা থাকা নেহাৎ বোকামি।

বাড়িতে সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। রেশমা বানু, লাবণি আশরাফুল সকলের সাথে কথা বলছে। এরা কত সুন্দর সকলের সাথে হেসে হেসে কথা বলে, অথচ মিরার সাথে কখনো একটু হেসে কথা বলে না। ৩৫ জন মানুষের রান্না মিরা একার হাতে করেছে, একটু খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ৩৫ জন মানুষের রান্না কি কম কথা!

অল্প অল্প করে বারবার রান্না করেছে পাছে রান্না খারাপ হয়ে যায় যদি। এ বাড়িতে সব রান্না মিরা একার হাতে করলেও কখনো এতজন লোকের খাবার একসাথে রান্না করেনি। আগে বাড়িতে একজন সাহয্যকারী মহিলা ছিলো, মিরা আসার পর তাকেও বাদ দিয়ে দিয়েছে, মিরার খাওয়ার খরচ আছে, মহিলাকে বেতন দিলে নাকি টাকা কম পড়ে যাবে। হাস্যকর! মিরাও বুঝছে সে এ বাড়ির বিনা পয়সার কাজের লোক। বারবার এ জীবন থেকে চলে যেতে চেয়েছে, কিন্তু কার কাছে যাবে সে! মা’কে যতবার বলেছে আমি থাকতে চাই না। মায়ের একটাই উত্তর মানিয়ে নেও, ঠিক হয়ে যাবে।

একজন মানুষের একা ঘুরে দাঁড়াতে হলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যেতে হয়। নয়তো কারো পক্ষে একা ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। মচকে যাওয়া লতাকে যেমন ডালের সাহায্য সোজা করে দেওয়া যায়, মানুষের বেলায়ও একজন মানুষের প্রয়োজন হয়। যে তাকে বুঝতে পারে। ভেঙে যাওয়া গাছে তো নতুন করে পাতার জন্ম হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ একাই ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

–” মা আমার সাথে একটু ঘরে চলো না প্লিজ। কতদিন তোমার সাথে ভালো করে কথা বলি না। এদিকটা উনারা নিজেই দেখছে তোমার আমার প্রয়োজন হবে না। ”
রোজিনা রেণু মেয়ের কথা মতো মেয়ের সাথে যায়। মেয়ে ছাড়া যে কেউ নেই তার। আধা পুরনো চাদর বিছানো বিছানায় মা মেয়ে বসে আছে। মা’য়ের চোখে মুখে নিষ্প্রাণ, মলিনতার ছাপ! মেয়ের চোখে মুখে কৌতূহল, হাজার প্রশ্ন!

–” মা আমাকে এখানে বিয়ে কেন দিয়েছো?”
–” তোর ভালোর জন্য! আমার মেয়ে এতো বড় বাড়ির বউ হবে। সুখে সংসার করবে। কোন মা এমন চায় না বল?”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে মিরা। তারপর বলে উঠে, ” নিজের সম্মান বিক্রি করে মেয়েকে বিয়ে দিতে হলো মা? তোমার মেয়েকে কি কেউ বিয়ে করতো না? ”

রোজিনা রেণুর চোখ ছোট হয়ে যায়।তাড়াতাড়ি করে উত্তর দেয়, ” এসব কি বলছিস তুই? কেউ কি তোকে কিছু বলেছে?”
–” না আমাকে কেউ কিছু বলেনি। তবে শুনেছি। আমি যা শুনেছি তাই কি সত্যি মা?”
রোজিনা রেণু কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। কোনো এক অজানা ভাবনায় ডুবে যায়। ছেলেবেলায় বাবা শখ করে নাম দিয়েছিল রেণু, জীবনটাও তার রেণুর মতো কেটেছে, এক ফুল থেকে অন্য ফুলের খোঁজে, তার স্পর্শে ফুল থেকে ফল হয়েছে বটে তবে তার কোনো মূল্য হয়নি।

বিয়ের চার বছরের মাথায় তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে অন্য মেয়ের হাত ধরে। কারণটাও ছিলো বড্ড অদ্ভুত! বিয়ের চার বছর পর মিরার যখন বছর দুই বয়স তখন এক মহিলাকে বিয়ে করে তার স্বামী মানে মিরার বাবা। সুন্দরী মহিলার ছিলো অঢেল সম্পত্তি, তার স্বামী মারা যাওয়ার পর আর বিয়েও করেনি। একাই থেকেছে, কোনো সন্তানও ছিলো না তার। মিরার বাবা ওই মহিলার বাড়িতে দারোয়ানের চাকরি করতো, বেতন সামান্য হলেও ছোট সংসার বেশ ভালোই চলে যেতো তাদের। সুখের কোনো অভাব ছিলো না।

কিন্তু লোভ লালসা মানুষের মনে বাসা বাঁধলে সুখ জিনিসটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সুঠাম গঠনের অধিকারী মিরার বাবাকে দেখে কখনো দাওয়ান মনে হতো না। পেশিবহুল চেহারা, ফর্সা দেহ। যে কোনো রমনী তার সৌন্দর্য ছুঁয়ে দেখতো চাইবে। ওই মহিলারও এমন শখ জেগেছিলো। মিরার বাবাকে নিজের করে পাওয়ার।

সে বৈধ অবৈধ যে কোনো ভাবেই মিরার বাবাকে তার চাই। বারবার প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু কখনো মিরার বাবার মন গলাতে পারেনি। অবশেষে সম্পত্তির লোভ দেখানো শুরু করে, তাকে বিয়ে করলে সবকিছু লিখে দেবে মিরার বাবাকে, মিরা বাবাও যেন লোভ সামলাতে পারে না শেষ পর্যন্ত। এমন অঢেল সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করার সহজ উপায় আর কোথায় পাওয়া যায়, রোজিনা রেণুকে তালাক দিয়ে ও-ই মহিলাকে বিয়ে করে নেয়। সে-ই থেকেই জীবন তাকে স্রোতের সাথে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে!

–” কি এতো ভাবছো মা? আমার কথায় উত্তর দেও।”
মেয়ে কথায় নিজের অতীতের স্মৃতিচারণ বন্ধ করে সে। চোখ তুলে মিরার দিকে তাকায়। কৌতূহলী চোখে মিরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো উত্তর খুঁজে পায় না রোজিনা রেণু। চোখ বন্ধ করে রাখে। তবুও বন্ধ চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুৎসিত কালো এক দিন।

” সেদিনটি ছিলো চারদিক কালো মেঘে ঢাকা, থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। বিকাল চারটায় যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে ধরণীতে। অফিসের সবাই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে শুধু রোজিনা রেণু, আজমল সাহেব, দাওয়ান নিরব মিয়া আর কুসুম বিবি বাদে। আজমল সাহেবের কিসব কাজ তখনও বাকি। অফিসের বস কাজ শেষ করে বাড়িতে না যাওয়ার পর্যন্ত কি নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ছুটি মেলে নাকি! সে-ই জন্যই এরা তখনও অফিসে নিজের কাজ করছে।

এমন সময় আজমল সাহেব কুসুম বিবিকে ডাক দেয়।
–” আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যা তো। মাথাটা বড্ড ধরেছে। ”
কুসুম বিবি তখন দুই বছরের ছোট বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত। বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে বারো বছর বয়সি তামান্না ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে মা’য়ের কাছে এসেছে। কিছুতেই কান্না থামছে না ছেলেটার! ক্ষুধার জ্বালায় বড্ড কাঁদছে। ঘরে দুধ নেই বলে খাওয়াতেও পারেনি। অফিস থেকে ওদের বাড়ি দেখা যায় তাই তেমন সমস্যাও হয়নি। কুসুম বিবি ওই পাশে ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত তাই রোজিনা রেণুই চায়ের কাপ হাতে আজমল সাহেবের দরজার কড়া নাড়ে।

–” স্যার আসবো। ”
–” হ্যাঁ। ভেতরে আয়।
–” স্যার আপনার চা। ”
আজমল সাহেব চোখ তুলে তাকায়। রোজিনা টেবিলে চা রাখছে, গলার কাছে সামান্য খোলা, শরীর দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর ফর্সা গলা! কোমলতায় ভরা! মনের মাঝে হিংস্র সাপটা ফনা তুলে ওঠে আজমল সাহেবের। রোজিনা বেশ সুন্দরী। ফর্সা চেহারা, একদম মিরার মতো। দেখলেই কেমন লোভ জাগে। আজমল সাহেব খপ করে হাতটা ধরে ফেলে রোজিনা রেণুর।

-” একি স্যার কি করছেন আপনি? ”
–” তুই বেশ সুন্দর রে! আজ সন্ধ্যাতে তুই আমার সাথে থাক। টাকা পাবি সেই সাথে মজাও পাবি। শুনেছি তোর বর নেই বহু বছর। ”
–” নাহ আমি এসব করতে পারবো না, আপনি আমার হাত ছেড়ে দেন। ”
–” আহ্! শোন তো। এদিকে আয়। ”

আজমল সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে, তার একহাত তখনও রোজিনা রেণুর হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। রোজিনা রেণু তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আজমল সাহেব তাকে ছাড়তে চাইছে না। অপর হাত দিয়ে রোজিনা রেণুর আঁচল টান দেয়, শাড়ির আঁচল টান দিতেই রোজিনা চিৎকার দিয়ে উঠে, রোজিনার আঁচল ছেড়ে মুখ চেপে ধরে আজমল।
–” আমি তোরে অনেক টাকা দিবো। একটা সন্ধ্যাই তো মাত্র! না রাজি হলে তোর চাকরি খেয়ে নিবো কিন্তু! ”

–” না স্যার। চরিত্র বিক্রি করলে অনেক আগেই মেয়েকে নিয়ে ভালো থাকতো পারতাম। অফিসের বসদের শরীর দিলে বেশ সহজে চাকরি করতে পারতাম কিন্তু আমার কাছে চরিত্র আগে, আপনি আমাকে ছেড়ে দেয় আপনার চাকরি আমি করবো না। সবাইকে বলে দিবো আপনার অসভ্যতামির কথা। ”

আজমল সাহেবের মনের মাঝে জেগে ওঠা ফণা তোলা সাপ রোজিনা রেণুকে ছাড়তে চাইছে না। বিষাক্ত ছোবল বসিয়ে দিতে চাইছে। বহুদিন ধরে এ নারীকে দেখে চলেছে, অদ্ভুত সুন্দর তার শরীরের গঠন। দেখলেই বিষাক্ত মনে লালসা জেগে ওঠে। এমন সময় কুসুম বিবির গলা শোনা যায়।

আলোছায়া পর্ব ৩

–” স্যার ডেকেছিলেন আমাকে? ”
আজমল সাহেব রোজিনা রেণুর হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। কপালে জমে থাকা ঘাম বিন্দু গুলো রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। রোজিনা রেণু দৌড়ে বেরিয়ে যায়। কুসুম বিবি দরজার পাশে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকে।

আলোছায়া পর্ব ৫