জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ২

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ২
ইফা আমহৃদ

“আমার ব্যথায় তুই কাঁদছিস কেন? উকিলি নোটিশ পাঠানোর সময় মনে ছিলনা?” নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন। ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসলাম। পলকহীন স্থির দৃষ্টি তার পানে। চোখজোড়া কখন লেগে এসেছে টের পাইনি। হাই তুলে উঠে বসলাম। অপূর্ব উঠে গেলেন। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “কী করছেন টা কী? আপনি অসুস্থ নেতা সাহেব। প্লীজ শুয়ে থাকুন।”

তিনি তোয়াক্কা করলেন না। হনহনিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন। বেরিয়ে পোশাক পাল্টে নিলেন। জামা পড়তে পড়তে চ্যাঁচিয়ে বললেন, “মেহেদী, মেহেদী।”
আমি শার্ট পড়তে সাহায্য করতে চাইলাম, তাতেও ঘোর আপত্তি। মেহেদী ভাই দরজায় টোকা দিলেন। আমি দরজা খুলে দিলাম। তিনি হুকুম করলেন, “তোর ভাবীকে ফুফুর বাড়িতে পোঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা কর আর কারা আমাদের অ্যাটাক্ট করেছিল, খবর নিয়েছিস?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জি ভাই। নিস্প্রভের লোকেরা। আমাদের যাওয়ার ব্যাপারটা লিক করেছে।”
“গাড়ি বের কর, আমি বের হবো।”
“আপনার শরীর ভালো নেই, কীভাবে বের হবেন নেতা?”
“ওকে আগে মাটিতে পুঁতে নেই, তারপরে শরীরের চিন্তা করব। গো ফাস্ট।”

মেহেদী যেতে গিয়ে থেমে গেল। ইতস্তত করে বলে, “নেতা উকিলকে ছেলেরা ধরে এনেছে, তার কী ব্যবস্থা করব?”
অপূর্ব থেমে গেলেন। ঘাড় কাত করে বললেন, “নিয়ে আয়, আমি আসছি।”
ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলেন। ততক্ষণে উকিল বাবুকে হাজির করেছেন। চিঠিটা তাঁর সামনেই ছিঁড়ে ফেললেন। উকিল বাবুর অবস্থা ভালো নয়, আঘা;তের কালচে দাগ ভেসে আছে মুখে। অপূর্ব টেবিল থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে আলতো করে মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টা করলেন। আদৌও কী মুছে ফেলা সম্ভব? শান্ত গলায় বললেন, “উকিল বাবু আমাকে চিনেছেন?”
ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেন, “জি নেতা। আপনি অপূর্ব আহসান। জনগনের চোখের মণি। সুন্দরনগরের উন্নয়নের পেছনে আপনার যথেষ্ট অবদান রয়েছে।”

থমথমে গলায় অপূর্ব বলেন, “তাহলে আমার জীবনটা আপনি কেন অনুন্নয়ন করছেন? এটা কী প্রতিদান উকিল বাবু?”
উকিল বাবু চুপ করে আছেন। অপূর্ব হাত বাড়িয়ে দিলেন। মেহেদী ভাই হাতের উপর রাখলেন কিছু কাগজপত্র। পৃষ্ঠা উল্টাতে ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আদালতে আরু আপিল করেছে, ডিভোর্সের ব্যাপারে। তার ফটোকপি আমার হাতে। লেখা আছে, আমি আরশি।‌

১৪ বছর বয়সে অপূর্ব আহসানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। বিগত বছরগুলোতে তিনি আমাকে মানসিক চাপ দিয়েছেন। শারীরিক আঘা;ত করেছেন। প্রচণ্ড মা;রধর করেছেন। আমি তার সাথে থাকতে চাইনা।
নিচে আরু স্বাক্ষর করেছে। ইভেন্ট সরকারি হাসপাতালে কিছু রিপোর্ট আছে, প্রেসক্রিপশন আছে। এর ভিত্তিতে আদালত থেকে আমাকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে,’ যেখানে লেখা আগামী ১৭ তারিখ আদালতে উপস্থিত থাকার’ আচ্ছা আরু, আমি তোকে কখনো এভাবে..

তিনি পরবর্তী বাক্য উচ্চারণ করলেন না। আমি এবার চুপ থাকতে পারলাম না। আমি শুধু সাদা কাগজে স্বাক্ষর করেছি। সেখানে এমন কিছু লেখা ছিল না। নতজানু হয়ে বললাম, “না নেতা সাহেব। আপনি এমন কিছু করেননি। আমি আপনার নামে এমন কলঙ্ক দিতে পারিনা।”

উকিল বাবু পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বললেন, “আসলে এমন কিছু না লিখলে ডিভোর্স হয়না। আমাদের এমন লিখতে হয়।”
“উকিল মানেই সে মিথ্যা বলতে হবে, এমন কিছু নয়‌। সত্য বলেও সমস্যা সমাধান করা যায়।
ওনাকে বাড়িতে পৌঁছে দে। তার আগে একটু মেডিসিন।” অপূর্ব হাতের ইশারা করল। বাড়িরা বুঝে গেল তাদের কাজ। লাল কাপড় বেঁধে দিল উকিল বাবুর চোখে। কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মিনিটের ব্যবধানে পরপর চারটা গাড়ি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।

আকাশে সূর্যি মামা রোদ্দুর ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার হালকা রোদে মনপাখি গান ধরেছে,
এই মেঘলা, দিনে একলা
ঘরে থাকেনা তো মন
কাছে যাবো, কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।।

ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ব্যস্ত রাস্তা অতিক্রম করছিলাম, পাশ দিয়ে দ্রুতগামী গাড়ি অতিক্রম করে গেল। এক দমকা হাওয়া স্পর্শ করল মুখমণ্ডল। ঘাড় কাত করে পেছনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই খানিকটা বিস্মিত হলাম। অপূর্ব তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে যাচ্ছে। উকিলকে নিশ্চয়ই বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। আটতলা কমপ্লেক্সের সামনে গাড়ি থামল। তাদের ‘নিস্প্রভ’ নামক ছেলেটার কাছে যাওয়ার কথা ছিল। এখানে কী করছেন? কৌতুহলবশত অগ্ৰসর হলাম সেদিকে। হনহনিয়ে উপরে উঠে গেল। আমিও যাওয়ার চেষ্টা করলে গার্ডরা বন্দি করে ফেললে। হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, “দেখি।”

বিব্রত বোধ করে বললাম, “কী?”
বিরক্তিকর কণ্ঠে গার্ড বলে, “কী আবার কার্ড। কার্ড ছাড়া ভেতরে যেতে দেওয়া হবেনা।”
কার্ড পাবো কোথায়? কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, অপূর্ব সোজা উপরে গেছেন। কোমল গলায় বললাম, “আমার কাছে কোনো কার্ড নেই। উপরে যাওয়ার খুব প্রয়োজন। প্লীজ ভেতরে যেতে দিন।”
“স্যরি কার্ড ছাড়া কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হবেনা।” সূর্যের রশ্মি তেমন তীর্যক হচ্ছে, আমার রাগের পাল্লাও ভারী হচ্ছে। ক্ষিপ্ত গলায় বললাম, “নেতা সাহেব যে গেলেন।”

“তিনি নেতা যেতেই পারেন, কিন্তু আপনি যেতে পারবেন না।” তার উত্তর কিছুটা বিরক্তিকর ভাব এলো। নরম গলায় বললাম, “আমি তার কাজিন।” কিন্তু তাতেও ভেতরে প্রবেশ আমার জন্য নিষিদ্ধ। একটা ছেলে পাশে এসে দাঁড়াল। গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চাইল সমস্যা। আমি বললাম, “ভেতরে আমার প্রয়োজন।” তিনি সাহায্য করলেন আমায়। আশ্বাস দিয়ে বললেন আমার নিয়ে যাবেন।

কার্ড এগিয়ে দিলেন গার্ডের দিকে। কার্ডের দিকে একপলক দেখলাম। চেনা চেনা লাগছে, কোথায় দেখেছি? কিছুক্ষণের মধ্যে মনে পড়ল ঘটনা। আমি যখন অপূর্বর সাথে একসাথে থাকতাম তখন। অপূর্ব কোথাও কাজ করতেন। একদিন ফোনে তিনি ‘বার’ বলেছিলেন। কার্ডও দেখেছিলাম, তখনকার। আমার ভাবনার মাঝেই ছেলেটি চলে গেল। আশেপাশে কারো উপস্থিতি ছিলনা। বেরিয়ে আসার প্রয়াস করতেই ছেলেটি ডেকে উঠে, “আপু, ভেতরে যাবেন না?”

লিফ্টে উঠে সেকেন্ড ফ্লোর প্রেস করলাম। ছেলেটি তখন আমার পাশে দাঁড়ান। হুট করেই টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ চেপে ধরল পেছন থেকে। বিশ্রী গন্ধ নাকে পৌঁছাতেই মাথা ঘুরে গেল। শ্বাস ভারী হল। কাতরাতে কাতরাতে অচেতন হয়ে পড়লাম। সবকিছু অন্ধকার হয়ে এলো। বুঝতে পারলাম জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি।

জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা বদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করলাম। একদল যুবক ‘তাস’ খেলছে। অ্যা:লকো:হল পান করছে। অস্পষ্ট কিছু কথা কানে এলো, “আমার মনে হয়, মেয়েটা অপূর্ব ভাইয়ের বউ।”
২য় ছেলেটি ১ম ছেলেটির গালে চ:ড় বসিয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই না শা লা বল। এই বারে আমাকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। মেয়েগুলোকে পা:চার করতে পারিনি, মুক্ত করে হিরো সেজেছিল। নেতা সেজেছে সবার কাছে। এবার দেখব নেতা কীভাবে তার বউকে বাঁচায়।”

৩য় ছেলেটি বিষণ্নতা নিয়ে বলে, “আমি শুনেছি অপূর্ব আর তার বউ আলাদা থাকে। এত ছোটো বুঝিনি। ডিভোর্স হয়ে গেছে বোধহয়।”
৪র্থ ছেলেটি ‘তাস’ ছুড়ে দিয়ে বলে, “অপূর্বকে ফোন করে ডেকে নে। শুনেছি কালকে গু লি – ছু রি একসাথে লেগেছে। বেশি শক্তি নেই। বউকে বাঁচাতে এলে নিজেই ফিরে যেতে পারবেনা।”

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ১

সবকিছু শুনতে পেলাম। হাত পা নড়ানোর শক্তি নেই। ওড়না দিয়ে হাত-পা একসাথে বাঁধা। হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে প্রচেষ্টা করলাম। সম্ভব নয়। কিছুটা দূরেই ব্যাগ পড়ে আছে। ধীরে ধীরে ব্যাগের দিকে এগিয়ে গেলাম। দাঁত দিয়ে চেইন খুলে ফোন বের করলাম। সর্বপ্রথম লোকেশন অন করলাম। ধীরে ধীরে ভয়েস টাইপ করলাম, “হেল্প।”
অতঃপর সেন্ড করলাম। সাইলেন্ট করে পাশে রাখলাম। উবুত হয়ে জ্ঞান হারানোর অভিনয় করলাম।

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৩