জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৪

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৪
ইফা আমহৃদ

“আমি আরু, অপূর্ব আহসানের স্ত্রী। ডিভোর্সের জন্য আপিল করেছি, সেটা বিরোধী পক্ষ জানাতে পেরে আমাকে গতকাল অ’পহ রণ করেছে। এইসব কথা না বললে আমাকে মেরে ফেলবে। তাই বাধ্য হয়ে মিথ্যা বলেছি।” নতজানু হয়ে দৃঢ় গলায় বললাম। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন অপূর্ব। দেহে এক অদ্ভুত শিহরণ জানান দিল।

সেই মাতাল করা অনুভূতি উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই। মিনিট খানেক সময় স্থির থেকে নিজেকে সামলে নিলাম। কদম ফেলার প্রয়াস করতেই অনুভব করলাম পুরুষালি বলিষ্ঠ হাত ওড়না ভেদ করে জড়িয়ে আছে উদর। তার স্পর্শকে উপেক্ষা করে নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিলাম। ধারালো নক দিয়ে খামচে ধরলাম তার হাত। মৃদু ও ঝাঁজালো স্বরে বললাম, “হাতটা সরান, আপনাকে আবার চেনা হয়েছে গেছে। মুখে এক, অন্তরে আরেক।”
হাতটা স্থির রইল। মুখে মিথ্যা হাসির প্রলেপ দেওয়া। নিজেকে একটু সামলে দ্বিগুণ তীক্ষ্ণ গলায় বলে, “স্যরি ম্যাম, এবার ভেতরে যান।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নতজানু হয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাবা মা মামা মামুনি তুর বসে ছিল ড্রয়িং রুমে। আমাকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়াল। তাদের মুখে হাসির রেখা। মা উত্তেজিত হয়ে মমতায় আবদ্ধ করে নিলেন। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, তুই এসেছিস। কত চিন্তা হচ্ছিল আমাদের।”
ভ্রু কুঁচকে গেল। অপূর্ব জানে শুধু, বাড়ির সবাই কীভাবে জানল? কৌতুহল মেশান গলায় বললাম, “তোমরা জানলে কীভাবে?”

লোম দাঁড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গের। রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম, “কাউকে বিপদ থেকে মুক্ত করতে পারবেনা, অথচ অন্যদের চিন্তায় ফেলতে তোমাদের ছেলে ঢের পারে। বিরক্তিকর।”
তুর আগ বাড়িয়ে বলে, “ভাই তোর ভালোর জন্য এমন করেছে, তুই বুঝতে পারছিস না।”
“হ্যাঁ। তোর ভাই সব ভালো আমার সাথেই করে। তোদের নয় ছয় বুঝিয়ে, ভালো সেজেছে।”

শেষের বাক্যটি মনে মনে উচ্চারণ করলাম। আমি যতই বলি না কেন, আমার কথা কোনো কালেই বিশ্বাস যোগ্য হয়ে উঠেনি তাদের। ব্যাগ আঁকড়ে ধরে উপরের দিকে অগ্রসর হলাম। দরজা বন্ধ করে জানালার কাছে গেলাম। থাইয়ের অভ্যন্তরীণ থেকে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সাংবাদিকরা চলে যাচ্ছে। অপূর্ব এবার নির্ঘাত এদিকেই আসবে। কী করব আমি? বিছানার নিচে লুকিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর দরজার কড়া নড়ে উঠল। এই যা, বিস্মৃতি হয়েছে দরজা খুলতে। নির্ঘাত ধরেছে ভেতরে কারো অবস্থান। বাইরে থেকে চ্যাঁচিয়ে বলেন, “আরু, তুই কি দরজা খুলবি?”

আমি নিশ্চুপ হয়ে লেপ্টে রইলাম বিছানার নিচে। পরক্ষণেই কঠিন গলায় বলেন, “শেষ বার জিজ্ঞেস করছি, খুলবি কি-না? নতুবা দরজা ভেঙে ফেলব।”

ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে থেকে কারো চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে না, অর্থাৎ তিনি চলে গেছেন। উল্টোভাবে কদম ফেলে বিছানায় বসতে যাওয়ার প্রয়াস করলাম। ধাক্কা খেলাম মাথায়। পেছনে তাকাতেই নেত্রযুগল চড়কগাছ। পায়ের উপর পা তুলে অপূর্ব আয়াশ ভঙ্গিতে বলে আছেন। ভ্রু জোড়া কুঁচকে আছেন। বারান্দার দরজা লাগাতে ভুলে গেছি। তিনি বিদ্রুপ করে বললেন, “তুই আগের চেয়ে অনেক চালাক হয়ে গেছিস, বোকাসোকা নেই। তবে অল্প বিদ্যা যেমন ভয়ংকর তেমনি অল্প চালাকও ভয়ংকর।”

ওষ্ঠদ্বয় চেপে দৃষ্টি নিম্নে। কাবার্ড হাতরে মলম নিয়ে এলেন। হাতের করতল মেলে দিয়ে বললেন, “হাত দেখি।”
পেছন হাত লুকিয়ে অভিযোগের গলায় বললাম, “লাগবে না।”
কর্ণপাত করলেন না। ব্যথা হাত টেনে কোলে বসিয়ে নিলেন। ধীরে ধীরে মলম লাগিয়ে দিলেন। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম। ফুঁ দিয়ে বললেন, “আমার জীবন দোটানায়। এই রাস্তায় থাকলে যেমন মৃত্যু, চলে গেলেও মৃত্যু। আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকলে তোরও একই খাতায় নাম উঠবে। তুই আমার স্ত্রী জানত বলেই, তারা তোকে অ’পহ রণ করেছিল। যখন জানল কেউ না, তখন ছেড়ে দিল। এমনকি ভাড়াও দিয়ে দিল‌। এবার তুই বল, আমি ভুল কিছু বলেছি?”
সত্যি তো। কিছু করেনি। তবুও কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। কৌতুহলী হয়ে বললাম, “আপনার সাথে তাদের কী সমস্যা নেতা সাহেব?”

অদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে হাসলেন। মারাত্মক সে হাসি। তার অভিমানের পাল্লা নেমে গেছে। বক্ষের বাম পাশে হাত রেখে টেনে টেনে বললেন, “নেতা সাহেব – নামটা শুনলেই হৃৎপিণ্ড বলে উঠে নেত্রী ভালোবাসে।”
সংগোপনে লজ্জা মিশ্রিত হলাম, প্রকাশ করলাম না। ভেংচি দিয়ে বললাম, “একদম কথা ঘুরাবেন না। বলুন।”
“তোর সাথে তখন আমার বিয়ে হয়েছিল। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলাম। উপার্জন করতে একটা বারে কাজ করতাম। মনে আছে, প্রায় রাত্রিরে ম;দ্যপান করে বাড়িতে ফিরতাম। ওরাও আমার সাথে কাজ করত। বারে আসা মেয়েদের পা:চার করে দিতো। প্রায় পঞ্চাশটা মেয়েকে একদিন পা:চার করে দিচ্ছিল। পুলিশ ডেকে আমি তাদের রক্ষা করি। একদফা জনগণের ভালোবাসা তখন পাই। তখনই ইরেকশনে অংশগ্রহণ করি।”

“কবে হয়েছিল এইসব?”
“তুই তখন ফুপুদের বাড়িতে ছিলি।”
অনুশোচনায় পূর্ণ হলাম। “আমি যে আপনার নামে বদনাম করলাম।”
অপূর্ব ভাই আলতো চুমু খেয়ে বললেন, “সমস্যা নেই, আমি সামলে নিয়েছি। তবে একটু চালাক হ। নতুবা আগের মতো বোকা হয়ে যা।

সারাদিন তো না খেয়ে আছিস। তুরকে পাঠাচ্ছি। খেয়ে দু’জনে আড্ডা দে। আমি কাজ সেরে আসছি। কেমন।”
স্মিত হাসি দিয়ে অপূর্ব চলে গেলেন। বিলম্বে তুর হাজির হল খাবার নিয়ে। আমি ওকে টেনে বিছানায় বসলাম। আড্ডায় মেতে উঠলাম দু’জনে। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করলাম তুর বারবার ওড়না টানছে। বিরক্ত নিয়ে ওড়না টেনে খুলে ফেললাম। বিস্মিত হলাম। ওমা! তার কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলো মাঝে মাঝে সাদা। কী কিউট দেখতে। রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম, “তুর তুই এটা আমার থেকে লুকাতে পারলি? তোর সাথে আমার কথা নেই।”

মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। তুর গাল টেনে দিয়ে বলে, “তোর সাথে দেখাই হল আজ। আগে দেখাব কীভাবে? দুইটা কিনেছিলাম, বাড়িতে বসে নিজেই কালার করেছি।”
“চুল কালার করেছিস খুলে রাখবি, ঢেকে রাখছিস কেন?”
চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে তুর, “কারণ ভাইয়া। কালার করার আগেই বাড়িতে জানিয়েছিলাম। ভাইয়া জেনে গেছিল। আমাকে ধমকে বারণ করেছে। কিছুদিন চোখে চোখে রেখেছিল, যাতে পার্লারে না যাই। কিন্তু আমি তো তোর মতো বোকা নই, বুদ্ধি খাটিয়ে কালার কিনে ঘরে বসে করেছি।”

উত্তেজিত হয়ে বললাম, “আমাকে করে দিবি?”
চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, “ভাইয়া কিছু বললে।”
“জানবেই না, চুল ঢেকে রাখব। শীতকাল। কানটুপি দিয়ে ঢেকে রাখব। তাছাড়া দু’দিন পর চলেই যাবো ফুপুদের বাড়িতে।” আমার প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করল তুর। সুন্দর করে লাগাতে লাগল সে। মনের ভেতরে একটু ভয় কাজ করছে। কারণ আমার সামনে একটা দাঁত নেই। কোক খেতে গিয়ে দাঁত ফেলে দিয়েছিলাম। হাসতে ফাঁকা হয়ে থাকে।

রাত তখন গভীর। দূরে অস্পষ্ট শেয়াল ডেকে যাচ্ছে। এক ফালি চাঁদ আকাশ জুড়ে ফুটে আছে। তাকে কেন্দ্র করে তাঁরারা খেলছে। তলপেটে ব্যথা অনুভব করল। কয়েক সেকেন্ড স্থির থেকে উঠে বসলাম। এই শীতকালে পানির সংস্পর্শে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর কাজ আমার মতে। ওড়না জড়িয়ে উঠে বসলাম। অগ্ৰসর হলাম ওয়াশরুমে দিকে।

ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ করে আলো বন্ধ হয়ে গেল। সেকেন্ডের ব্যবধানে বাতি বা;স্ট করল। চোখে এসে পড়ল আমার। চিৎকার করে চোখ ধরলাম। পিছাতে গিয়ে মাথায় দেয়ালের সাথে ধাক্কা লাগল। রেগে গেলে মাথায় আঘা;ত করা আমার অভ্যাস। এবার সামান্য আ:ঘাতেই মাথা ঘুরছে। অন্ধকারে প্রচণ্ড ভয় করছে। দরজা ধাক্কা দিলাম। চ্যাঁচিয়ে ডাকলাম, “তুর, এই তুর।”

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৩

হাতরে ছিটকিনি খুলতে গেলাম। কিন্তু ছিটকিনি কোন দিকে বুঝতে পারছি না। বাম চোখ থেকে তরল পদার্থ পড়ছে। ডানচোখ ফাঁকা। তবে কী র;ক্ত? ভীত হলাম তৎক্ষণাৎ। সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলাম দরজায়। একফোঁটা আলোর দেখা নেই। একটি দাঁতের পর কি আরও একটি চোখ হারিয়ে ফেলব।

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৫