জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৩

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৩
ইফা আমহৃদ

“আরু যে বড্ড বিপদে তার অপূর্ব আহসান তাকে উদ্ধার করবে না? তার আরুসোনার বিপদে একটুও বুঝি কাঁপছে না বুক।”
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে ছেলেটি বলে। কাঁতরাতে কাঁতরাতে দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকে গেল। ফোন ব্যাগ হারিয়েছেন। আমাকে তাদের চোখ এড়ায় নি। ছুটে এলো আমার পানে। মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে দেয়ালের সাথে বেঁধে ফেলল। ব্যাগ হাতরে ফোন ছিনিয়ে নিল। অন্য ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে, “দেখ, মেসেজ করে ফেলেছে।”

উচ্চশব্দে গোঙানির আওয়াজ আসছে। আমার সামনেই ফোন করল অপূর্বকে। বিলম্বে রিসিভ হল। অপূর্ব ফোন নাম্বার চেক করে রিসিভ করল। মেসেজ চোখ এড়িয়েছে। থমথমে গলায় বলে, “হ্যালো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

স্পিকারে দিয়ে বলে, “মেসেজ দেখিসনি শা’লা। তোমার আরু আমাদের কাছে আছে। ভালো চাইলে তাড়াতাড়ি আয়।”
অপূর্ব অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। যেন কোনো হাসির গল্প তাকে শোনানো হয়েছে। অধর বাঁকিয়ে হেসে বলে, “আমার ব্যাপারে কোনো খবর না নিয়েই আরুকে অ;পহর:ণ করেছিস। তাহলে বলব, একটু খোঁজখবর নে। পাঁচ বছর হয়েছে আমরা আলাদা থাকি। উকিলি নোটিশ এসেছে ডিভোর্সের। এখন ওর বাঁচা-ম/রাতে আমার যায় আসেনা। ‘এম.এম.এস’ পাঠিয়ে দিচ্ছি কেমন? বাই।”

নিঃশব্দে কল বিচ্ছিন্ন হল। তাঁরা দৃষ্টি বিনিময় করতে লাগল। হঠাৎ স্ক্রিনে আলো জ্বলল। কিছুক্ষণ পূর্বের কাগজগুলো পাঠানো হয়েছে। ক্ষোভে ফেটে পড়ল। ছুড়ে ফেলল ফোন। মাথায় হাত দিয়ে বলে, “এবার একে কী করব?”
আরেকজন বলে, “ছেড়ে দেই, জানিস না শত্রুর শত্রু মিত্র হয়।”

তৃতীয় ছেলেটি রাগান্বিত স্বরে বলে, “ও মেয়ে। আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবেনা, অতএব মিত্র নয়। আমরা বরং তার সাথে একটু মাস্তি করে নেই।” বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। ভয়ে হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে‌। বাঁধ ভাঙল চোখের। বিকেলের রশ্মি পতিত হচ্ছে ভূপৃষ্ঠে। ধীরে ধীরে অন্ধকারের আগমন ঘটছে। নিয়ে আসছে আঁধারের সূচনা। ঘণ্টা খানেক পর চারজনে একসাথে ফিরে এলো। বাঁধন খুলে দিল। পানি ভর্তি গ্লাস এগিয়ে না দিয়ে নিজহাতে খাওয়াতে সাহায্য করল। শান্তভাবে বলে, “অপু ফোন করেছিল, তুমি তার প্রাপ্তন তাই সে তোমাকে বাঁচাতে আসবে না। অপু প্রেস কনফারেন্সে ব্যস্ত। তোমাকে আ:ঘাত করে আমাদের লাভ নেই তাই ছেড়ে দিতে চাইছি। কোথায় দিয়ে আসব?”

বামহাতের করতল মেলে দিয়ে নম্র ব্যবহারে বললাম, “ফোনটা পাওয়া যাবে?”
একে অপরের দিকে ইশারা করে ফোন ফিরিয়ে দিল। ‘রেকর্ড অপশন’ চালু করা। মাঝেমাঝে অনেক কিছু ভুলে যাই, তাই চালু রেখেছি। রেকর্ড শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বেদনাদায়ক যন্ত্রনা। আমার ক্ষতি হলে যদি তার কিছুই যায় না আসে তবে কেন তুলে এনেছিল? তার জবাব না নিয়ে ফিরে যাবো? ঢোক গিলে বললাম, “টিভিটা চালু করা যাবে?”

রিমোট টিপে টিভি চালু করল। সাংবাদিকরা বাড়িতে হামলে পড়েছে। ‘তার অসুস্থতার খবর, কারা গতকাল আঘাত করেছিল তার খবর, রাতে কোথায় ছিলেন’ – সব জানতে চাইছে। তাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে বললাম, “অপূর্ব আহসানের বাড়ি কোথায় বলতে পারেন?”
“হম। সেখানে সে থাকেনা। তবে বাড়ি গার্ড দিয়ে ভরা। আমরা যেতে পারব না, পুলিশ আমাদের ধরবে।”
“আমি সেখানে যাবো। একটা সিএনজি ডেকে দিবেন?”

ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সিএনজি হাজির। সিএনজিতে বসে অস্ফুট স্বরে বললাম, “ধন্যবাদ আপনাদের। আসি।” গাড়ি ছুটে চলল তার গন্তব্যে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সিটে হেলান দিলাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, বাড়ি ফেরা হবেনা। কিন্তু দেখো, বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।

গাড়ির থামল তার গন্তব্যে। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে ভিড়। নেতাকে দেখতে এসেছে বলে কথা। ভাড়া মেটাতে গিয়ে জানতে পারলাম, ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে। বাহ্! কত ভালো অপ;হর:ণকারী। ভেতরে ঢুকতেই অপূর্বের কথায় থেমে গেলাম। তিনি সবাইকে বলেছেন, “গরীব দুঃখীর সাহায্যে ছুটে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু খাবার হাতে পৌঁছে দিতে পারিনি। আমি ব্যর্থ হয়েছি। ক্ষমা চাইছি তাদের নিকট।

যারা আমাকে আক্র;মন করেছে তাঁরা অবশ্যই শাস্তি পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা কা-পু;রুষ। রাতের অন্ধকারে আমাকে আ:ঘাত করেছে। এই অপূর্ব আহসান তাঁদেরকে তুলে এনে জনসম্মুখে শাস্তি দিবে। আমি আশা করি, জনগনের প্রিয় নেতাকে আক্র;মণ করার শাস্তি জনগণ নিজেরাই দিতে চাইছেন।”

বাইরে থেকে চিৎকার করে বললাম, “আপনি একটা ভিতু নেতা সাহেব। পালিয়ে এসেছেন। আপনার হার্ট নেই, হৃদয় নেই। পাষাণ আপনি। জনগনের কথা এত ভাবছেন, আমি জনগন নই। তাহলে কেন আমাকে বাঁচাতে ছুটে যাননি।”
মিডিয়ার সবাই তখন আমার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ক্যামেরাও ঘুরেছে। অপূর্ব কিছু বললেন না। মেহেদী ভাইকে চোখের ইশারা করলেন। অবিলম্বে ছুটে যান তিনি। ঘিরে ধরে আমায় সবাই। উত্তেজিত হয়ে বলে, “কে আপনি আপু?”

কী জবাব দিবো? উত্তর নেই। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “আমি আপনাদের নেতা বউ। কালকে তিনি আমার সাথে ছিলেন। চরম পাল্টিবাজ একজন নেতা। বিদেশেও রাজনীতি করতেন। এজন্য তার বাবা মা এখানে এনেছেন। তিনি শুধরায় নি। বরং সমাজের উপকারের নামে ক্ষতি করে চলেছে। আমি..

বাক্য শেষ করার পূর্বেই হাত চেপে ধরল কেউ। অপূর্ব আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখজোড়া তীক্ষ্ণ। দাঁতে দাঁত চেপে আছেন। হাত ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। ব্যথায় থেমে গেলাম। হাত দেখিয়ে সবাইকে নির্দেশ দিলেন, “ক্যামেরা অফ করুন সবাই। আমি চাইনা, কোনো ভুল সংবাদ জনগনের নিকট পৌঁছাক। তাঁরা আমাকে ভুল বুঝুক।”

দ্বিগুন তেজ দেখিয়ে বললাম, কীসের ভুল? তাঁরা সঠিক অপূর্ব আহসানকে চিনবে। মুখোশ পড়া নেতাকে নয়।”‌
হাতটা আরও ব্যথিত হল। টান পড়ল একদফা। পা বাড়াল। টানতে টানতে নিয়ে গেল উপরে। গার্ডরা কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিল না। তার বড়োবড়ো পায়ের কাছে আমি তুচ্ছ। ঘরে এনে ছুড়ে ফেলে দিলেন বিছানায়। বহুদিন পর সেই পুরোনো বিছানা, পুরোনো ঘর, চিরচেনা সবকিছু। কিন্তু অশান্ত মন, পুরোনো আস্থা খুঁজে পাচ্ছিনা। বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এগিয়ে এলেন তিনি, ক্রমশ পিছিয়ে যেতে আরম্ভ করলাম। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের সবাইকে। তারা ভেতরের কিছুই দেখতে পারছে না। গাল চেপে বলে, “সমস্যা কী তোর আরু? আমার পাবলিসিটি নষ্ট করছিস কেন? ওরা তোকে এজন্য ছেড়ে দিয়েছে?”

“ওরা আপনার মতো এত নি;ষ্ঠুর নয়। তাই ছেড়ে দিয়েছে।” আমার কথায় তাল মিলিয়ে বলে, “আচ্ছা। তারপর?”
“তারপর কী? যেটা সত্যি, সেটাই বলেছি।”
“আমি কিন্তু এরচেয়ে বেশি নি;ষ্ঠুর। আরও নি;ষ্ঠুর হবো, যদি এখন তুই গিয়ে না বলিস্ এগুলো সব মিথ্যা।” চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললেন। মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “কখনোই নয়। আমি বলব না।”

“এবার যা হবে তারজন্য আমি প্রস্তুত নয়, তুই প্রস্তুত হ।” বলেই ওড়না টেনে নিলেন। দুহাত গ্ৰিলের সাথে বেঁধে দিলেন। কাঁধে মুখ গুজে দিলেন। চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকার ঘরের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রইল। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে বললাম, “আমি বলব, আমি বলব, হ্যাঁ আমি বলব। ছাড়ুন।”

“গুড গার্ল। লক্ষী মেয়ের মতো কাজ।” বলে গাল টেনে দিলেন। হাতের বাঁধন খুলে দিলেন। চোখজোড়া মুছিয়ে দিলেন। চুলগুলো পরিপাটি করে দিলেন হাতের সহায়তা। হাসি দিয়ে বলে, “এবার গিয়ে বলবি, কালকে যারা আমাকে আক্র;মন করেছিল। তাঁরাই তোকে বলেছে এইসব বলতে। যাতে আমার পাবলিসিটি নষ্ট হয়ে যায়। বাকিটা আমি বলব, তুই শুধু তালে তাল দিবি, মনে থাকবে?”

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ২

শেষের শব্দটা বেশ ধমকের সুরে বললেন। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। দরজা খুলে আগে চলে গেলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে গেলাম। কেন এমন করছেন তিনি? ভালোবাসার মানুষটির কি আদৌও এইসব প্রাপ্য?

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৪