জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৫

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৫
ইফা আমহৃদ

চোখ ফুটলেও কোনো বস্তু নজরে আসছে না। যতদূর যায়, আঁধারে আবৃত সবকিছু। মনের ভেতরে দানা বেঁধে থাকা ভয় হুমকি দিয়ে চলেছে চিরস্থায়ী অন্ধ হয়ে থাকার। সময় তখন সকাল পেরিয়ে দুপুরের সন্ধানে নেমেছে। তন্দ্রা ব্যাঘাত ঘটেছে সবে। কাঁপতে থাকা শরীরে নিজের মাথা চেপে চ্যাঁচিয়ে বললাম, “মা, মামুনি। আমি চোখে দেখতে পারছি না।”

চোখজোড়া অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে এলেও গড়িয়ে পড়ার উপায় নেই। দু’চোখেই মোটা ব্যান্ডেজ। মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আরু, মা আমার। কাঁদিস না। তোর চোখে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। কয়েকদিন পর খুলে দিবে ডাক্তার।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“নাহ, আমার বিশ্বাস হয়না।” আমার চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল সবাই। বাধ্য হয়ে ডাক্তার আমার ডান চোখ খুলে দিলেন। বললেন, “ধীরে ধীরে তাকাও।”
ধীরে ধীরে পল্লব জোড়া উন্মোচন করতেই সবকিছু ঝাপসা লাগল। মিনিটের ব্যবধানে পরিষ্কার হয়ে গেল। মামুনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “দেখেছিস। কিছু হয়নি।”

আমি কেঁদে ফেললাম। ডাক্তার বললেন, “কেঁদে না, শান্ত হও। চোখে সমস্যা হবে।”
কিন্তু আমার কান্নার শব্দ যেন থামছেই না। বাজখাঁই গলায় কোনো কণ্ঠস্বর বেজে উঠল, “ওর চোখের ব্যান্ডেজ খুলেছেন কেন? বেশি বাড়াবাড়ি করলে রশি দিয়ে বেঁধে রাখতেন। ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।”

ঘাড় কাত করে এক চোখ দিয়ে অপূর্ব-কে দেখলাম। শুভ্র রঙের শার্ট ও কালো প্যান্ট পরনে তার। ঢুকে টেবিলের উপর রাখল কিছু ওষুধ। কাঁচুমাচু মুখ করে শুয়ে পড়লাম। সবাই মিটিমিটিয়ে হাসছে। মামুনি হাসতে হাসতে বললেন, “আমরা দুজন বাড়িতে যাই। তুই এখন আরুর কাছে থাক।”

“যাওয়া লাগবে না। ডাক্তারের সাথে আমার কথা হয়েছে, আরুকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি আমরা।” দৃঢ় কণ্ঠে বলে ক্যানেল খুলে ফেললেন। আমি আঁতকে উঠলাম। মা বিস্মিত হয়ে বলে, “কী বলছিস অপু, কাল রাতে নিয়ে এলাম। এখনই নিয়ে যাবো।”

“তোমার মেয়ে, তোমার ইচ্ছে। কেউ অ’পহ রণ করলে আমাকে তারজন্য দায়ি করো না কিন্তু।” অপূর্বের এমন কথায় মা চুপসে গেলেন। মামুনির সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন এবং সেখানে নার্স ঠিক করে দিবেন। অপূর্ব ভাই রিসেপশনে গেলেন বিল পরিশোধ করতে। মা মামুনি পাশের বেডে বসে আছেন। একা একা বাইরে তাকিয়ে আছি।

গতবার যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম, এবারও একই হাসপাতাল। টেবিলের উপর পানির গ্লাস নজরে আসতেই তেষ্টা পেল। একটু দূরত্বে রাখা। হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নেওয়ার চেষ্টা করতেই বিছানা থেকে নিচে পড়ল। কোনোমতে সামলে নিলাম নিজেকে। টেবিলের নিচে রাখা ইঁদুরের কল অদৃষ্টে ছিল। ধরে ধরে পানির গ্লাস হাতে নিলাম।

পায়ের পাতা একটু ভেতরের ইঁদুরের কলের উপর পড়ল। অবিলম্বে চোখমুখে কুঁচকে গেল। হাতের গ্লাস ছিটকে পড়ল একই পায়ের পাতার উপর। দ্বিতীয় আঘাতে চোখজোড়া ডাগর ডাগর হয়ে গেল। ঠোঁট উল্টে ডাক দিলাম, “মামুনি, ও মামুনি।”
মামুনি ছুটে এলো। দু’কাধে হাত দিয়ে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আরু? এখানে এলি কীভাবে?”

কেঁদে উঠলাম, “পানি খাবো।”
“আমাকে ডাকলেই পারতি। দিচ্ছি তুই বস।” মামুনি আমাকে টেনে বিছানায় বসালেন। পায়ের দিকে দৃষ্টি যেতেই মাথায় হাত তার। রক্ত চুইসে চুইসে ঝরছে। মামুনি নত হয়ে খুলতে লাগলেন। মা রীতিমতো ধমকে উঠলেন, “তোর কোনো কান্ড জ্ঞান নেই। এতবড় কল তোর চোখে পড়ছে না। আমাদের ডাকতে পারতি। ইচ্ছে করছে।”

মামুনি মাকে সামলে বললেন, “আপা থামো, মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে। তুমি শুরু করে দিলে কেঁদে ফেলবে।”
“অপুকে কী বলবে?”
“নার্স দিয়ে আগেই ব্যান্ডেজ করিয়ে নিবো। বলব, কালকে রাতেই মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে।” আমি হেসে উঠলাম। ঠোঁটে উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম,

“পানি খাবো।”
জগ থেকে পানি পান করলাম। পায়ের শব্দ শুনে মামুনি গ্লাসের টুকরো টেবিলের নিচে রেখে দিলেন। সাবধান হওয়ার পূর্বেই অপূর্ব ফিরে এলেন। নার্স নিয়ে এসেছেন। পা ঝুলিয়ে বসে বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখলাম পা। নার্সকে আদেশ দিলেন, “সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে যান। বাইরে গাড়ি রাখা আছে।
আরু ছোটো ছোটো পা ফেলে চল।”

হাত ধরে বিছানা থেকে নামালেন। যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে হাত খামচে ধরলাম। পুনরায় বসে পড়ল। আবদারের সুরে বললাম, “নেতা সাহেব, আমি যাবো না। মনটা আজ হাসপাতাল হাসপাতাল করছে। মনে হচ্ছে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার আগেই হাসপাতালে আসতে হবে।”

“পিঠের উপর দু গাঁ দিলে বাড়ি বাড়ি করবে, তখনই দৌড়ে চলে যাবি। তাড়াতাড়ি কর, তোর জন্য আমার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। খবরদার নাটক বাজি করবি না।”
তার শরীরেও যে ব্যান্ডেজ। কিন্তু পায়ের পাতায় ধর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। মা এগিয়ে এসে বললেন, “ওর পা ব্যান্ডেজ করে দাও আর স্টেচারের ব্যবস্থা করো।”

অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পা উঁচুতে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন। একদম থেঁতলে গেছে। তাজা রক্ত ঝরছে। অণুচক্রিকার কারণে জমাট বেঁধেছে। আলগোছে ছুয়ে দিয়ে বললেন, “কীভাবে হয়েছে?”

“জানি না, হঠাৎ পায়ে ব্যথা অনুভব করলাম। চেয়ে দেখি এই অবস্থা।” সৌজন্য হাসি দিয়ে সত্যিটা আড়াল করার চেষ্টা চালালাম। বেশ কয়েকবার মাথা নেড়ে জোরে পায়ে চাপ দিলেন। অণুচক্রিকার এতক্ষণের কাজ লণ্ডভণ্ড করে রক্ত বেরিয়ে পড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “কীভাবে হয়েছে? সত্যি বলবি নাকি আবার..

পা টেনে নিতে নিতে বললাম, “ইঁদুরের কলে। সত্যি বলছি। টেবিলের নিচে রাখা ছিল, দেখিনি।”
বিছানা থেকে টেবিলের দূরত্ব স্ক্যান করে নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “ওখানে কী করছিলি?”

“ইঁদুর খেতে গিয়েছিলাম।” অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। না বোঝার স্বরে বললেন, “কী খেতে, ইঁদুর?”
“না, না, না। পানি খেতে।”
নার্সকে ইশরা করলেন পা ব্যান্ডেজ করতে। অপূর্ব নিচে বসে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বলেন, “ইঁদুর তো দেখতে পারছি না? কোথায় ইঁদুর?”

নার্স কোনো কথা বললেন না। নিজের কাজ সেরে ছোটো আলমারির কাছে গেলেন। দরজা টেনে খুলে দিলেন। পরপর কয়েকটা ইঁদুর বেরিয়ে গেল আলমারি থেকে। পায়ের কাছে সুরসুরি লাগতেই একপায়ে ভর দিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের কোলে বসলাম। অস্পষ্ট কণ্ঠে বললাম, “আমি বাড়িতে যাবো।”

ব্যান্ডেজটা নিয়ে দু’চোখে একসাথে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম, “মামুনি দেখো না..
পরবর্তী বাক্যটি উচ্চারণ করার ক্ষমতা থাকলেও শব্দ হারিয়ে গেল। মোটা ব্যান্ডেজ অনুভব করলাম মুখে। আমার বাকশক্তি নিয়ে গেল। হাত দিয়ে থামানোর প্রচেষ্টা করলাম। ধমকে বললেন, “একটু নড়াচড়া করলে হাতও বেঁধে দিবো। চরম বিরক্তিকর। আমি জাস্ট পারি না একে সহ্য করতে।”
বলেই কোলে তুলে নিলেন। সবকিছু অনুভব করতে পারছি।

আধ ঘণ্টার মাথায় বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। মামাদের বাড়ির নিচতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ঘরে মেডিসিনের রাজত্ব চলছে। একজন নার্স পাশে বসে আছে। কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। ঘরে এসি চলছে। বেশ ঠান্ডা লাগছে।

মুখে কথার বলতে পারছি না যার দরুন হাতরে কম্বল খুঁজতে লাগলাম। পুরুষালি কণ্ঠে থেমে গেলাম, “আপু, আপনি বরং খেয়ে নিন। আমি বরং তাকে..
বাক্য শেষ না করেই ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন। মেয়েটি গেল কি-না জানা নেই। অপূর্ব পাশে বসলেন। কাঁচি দিয়ে মুখের ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলেন। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কাঁচি চালাতে চালাতে বললেন, “গাল কে’টে গেলে আমি কিছু জানি না, কেমন?”

মুখ ভার করে বসে আছি। অভিমান জমে আছে। খাবারে চামচ চালালেন। বলেন, “ডাক্তার এসময়ে খাবার না খেলে জোর করতে বারণ করেছেন। কিছু স্যালাইন দিয়েছেন। বলেছেন, এগুলো দিলেই হবে।”
নিজ থেকে ‘হা’ করলাম। খেতে খেতে অনুভব করলাম খিচুরি। আরেক চামচ তুলে দিয়ে বললেন, “নার্স মেয়েটাকে আমার ভালো লাগে না।”

“কেন?”
“কেন আবার দেখিস না, হাঁ করে কীভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।”
খাওয়া থামিয়ে বললাম, “কই, আমি তো দেখলাম না।”
“তুই দেখলে তো দেখবি। ইঁদুর খেয়ে জ্যোতি বাড়া। তখন অন্ধকারেও দেখবি ইঁদুর তোকে খুঁজছে।”

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৪

গল্প লেখার পর থেকেই বাধা পাচ্ছি লিখতে। গত দুইদিন প্রেকটিক্যাল পরীক্ষার কারণে দেওয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষে পরীক্ষা শেষ আজকে থেকে নিয়মিত পাবেন।

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৬