জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৬

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৬
ইফা আমহৃদ

হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছি বিছানা জুড়ে। যেন চিত হয়ে সাঁতার দেওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি। রাতদিন উভয়ই আমার কাছে সমান। সময় দেখার উপায় নেই। আমার ভাষ্যমতে, মাঝরাত তখন। আকাশ মেঘের ভেলা সাজিয়েছে। বৃষ্টি ঝরছে রাত থেকে। বর্ষাকাল বলে কথা।দূর-দূরান্তর থেকে উড়ে এসে জানালার উপর বয়স এক কাক।

তার কর্কট কণ্ঠ নিয়ে কা কা করে ডেকে উঠল। বিলম্বে তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটল। বেনুনি করা চুলগুলো পেছনে ঠেলে উঠে বসলাম। মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করে কাক ততক্ষণে বহুদূরে পাড়ি জমিয়েছেন। বালিশটা কোলের উপর তুলে মোলায়েম কণ্ঠে বললাম, “কাক এসেছিস? আজকাল কোথায় থাকিস তোরা? কত খুঁজেছি ধারণা আছে। আছিস না-কি চলে গেছিস?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গ্ৰিলে তিনটা ঠোঁকর দিয়ে জানান দিয়ে আমার ধারণা মিথ্যা, সে আছে। দাঁত ‘ই’ করে ঘুরিয়ে দেখালাম। উত্তেজিত হয়ে বললাম “দেখেছিস, আমার দাঁত? ছোটো বেলায় থেকে আমার এই দাঁতের প্রতি তোর হিংসা। আমার দাঁতটা দেখে ফেলেছিলি, তাই ছয়মাসেও দাঁত উঠেনি। মা বলেছিল, সাত ঘর ভিক্ষা করে সেই চাল দিয়ে চাপটি বানিয়ে তোর সাথে ভাগাভাগি করে নিলে দাঁত উঠবে। করলাম ভাগাভাগি। তবুও উঠল না। দুইবারের বেলায় উঠেছে।
তুই আবার নজর নিয়েছিস। এবার কী করলে দাঁত উঠবে বল?”

কাক ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে কা কা করে উঠল। বুঝতে পারলাম সে উড়ে যাচ্ছে। যা উড়ে যা, নতুন কোনো বার্তা নিয়ে আসিস।
দীর্ঘ বিরতির পর বিছানার গাঁ হেলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস করতেই বাঁধল কোনো শক্তপোক্ত দেহের সাথে। যখন শুয়ে ছিলাম তখন একাই ছিলাম। উচ্চ গলায় দুইবার ডাকলাম, “কে এখানে শুয়ে আছেন?”

জবাব নেই। অন্ধ লোকদের শ্রবণশক্তি প্রখর হয়। একটু ঝুঁকতেই অনুভব করলাম ভারী নিঃশ্বাস শব্দ। মানুষটি ঘুমে কাঁদা। ডাকলে ঘুম ভেঙে যাবে। স্পর্শ করে অনুভব করার প্রচেষ্টা করছি কে? চার আঙুল কপাল, খাড়া নাক। ডগায় চাপলে একদম নুয়ে যায়। নিচের ঠোঁট উপরের ঠোঁটের নিচে গুটিয়ে আছে। হাতটা আরেকটু নিচে নামল।

নিচে নামতেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঠেকল। কাঁটা দিয়ে উঠল দেহ। এযে আমার নেতা সাহেব। আরেকটু নিচে নামতেই তার প্রশস্ত কাঁধ, বুক স্পর্শ করলাম। পরনে টি শার্ট কিংবা শার্ট কিছুই নেই। বুকের লোমগুলো হাতে লাগতেই দিলাম টান।‌ নড়েচড়ে উঠলেন তিনি। নাক ডাকা বন্ধ করলেন। একটু নিচে মোটা ব্যান্ডেজ করা। দুহাতে স্পর্শ করলাম। ট্রাউজার পর্যন্ত নামতেই উঠে বসলেন তিনি। থমথমে গলায় বললেন, “প্যান্ট খুলবি? নে খুলে ফেল? কী হলো খুলছিস না কেন? আমি খুলে দিবো কি?”

বাড়িয়ে রাখা হাত স্থির করে গুটিয়ে বসে থাকলাম। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকলাম। জবাব না পেয়ে ধাক্কা দিলেন দুটো। পরক্ষণেই চুলে হাত রাখলেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “নেত্রী, তোর চুল লাল কেন?”
জমে গেলাম পুরোপুরি। ঘটনা পাল্টে দিতে হবে। অভিনয়ের বসবর্তি হয়ে স্থির থেকে নেমে গেলাম। বিছানা থেকে ধীরে ধীরে নেমে দাঁড়ালাম। ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম, “হ্যাঁ স্যার। আমার লেখা শেষ। খাতা জমা দিতে আসছি।”

অতঃপর ধীরে ধীরে পা ফেললাম। পায়ে ব্যথা লাগল। অপূর্ব এসে ধরে ফেললেন। গালে চপল দিয়ে বললেন, “তুই ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভ্যাস করে ফেলেছিস। কীভাবে জ্ঞান ফেরাব, দাঁড়া পানির ছিটা দেই।”
আমাকে ধরে বিছানায় বসালেন। পানির ঝাপটা দিলে পরপর। ব্যান্ডেজের নিমিত্তে চোখে পড়ল না ফোঁটা। হাতের করতলে পানি নিয়ে মাথার তালুতে দিয়ে বললেন, “জ্ঞান ফিরেছে?”

হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে চট করে বলে ফেললাম, “চোখে ব্যান্ডেজ দেখছ না? একফোঁটা পানিও চোখে লাগছে না। জ্ঞান ফিরবে কীভাবে, আশ্চর্য!”
হাত গিয়ে ঠেকল মুখে। প্রশস্ত হল অধর। নক খুঁটতে খুঁটতে বললাম, “ঘুম আসছিল না-তো তাই।”
গম্ভীর গলায় বললেন, “আমার ঘুমকে বিদায় দিয়েছিস, এখন তোর ঘুম আসবে?”

“একা একা ভালো লাগছিল না যে।” মন খারাপ করে বললাম। নিরবতা গ্ৰাস করল কিছু অপ্রিয় প্রহর। বাদ্য যন্ত্র ছন্দ তুলে বেজে চলেছে। আবেগ মাখানো গলায় বললেন, “ছাদে যাবি?”
“চোখে দেখতে পাইনা, ছাদে গিয়ে কী করব শুনি।” মনের আকাশের তার ছবি ভেসে উঠল। দেহের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললেন, “আমি আছি তো।”

পাঁজাকোলা করে ছাদে চললেন। ছাদের দরজা খুলে পা রাখতেই দমকা হাওয়া নাড়িয়ে দিল দেহের প্রতিটি লোমকূপ। ছাদের কিনারায় দাড় করিয়ে দিলেন। জলীয় বাষ্প উচ্চমাত্রায় পৌঁছে বরফে পরিণত হয়েছে। বরফ কুচি শিলা রুপে পতিত হচ্ছে। হাত দিয়ে ধরে বললাম, “জানেন, কতদিন পর বৃষ্টিতে ভিজছি। ছোটো বেলায় যখন বৃষ্টি পড়ত, তখন বেয়ারিং দিয়ে গাড়ি বাড়িয়ে দিতো। পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে চালাতাম। জামা কাপড়ে কাঁদায় মাখো মাখো হতো। মা দুইবেলা খেতে দিতো না। বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে বিরিয়ানি দিয়ে যেত।”

অপূর্বর কোনো কথা নেই। সন্দিহান গলায় বললাম, “আপনি আছেন নেতা সাহেব।” বৃষ্টির ভেতরে ফেলা পায়ের শব্দে অনুভব করলাম তিনি আছেন। ডান হাতটা নিঃশব্দে ধরে একটি প্লাস্টিকের বস্তার উপর রাখলেন। তাড়া দিয়ে বললেন, “আযান হতে ঘণ্টা খানিকের মতো সময় রয়েছে। এটার উপরে বস তাড়াতাড়ি।”
“কেন? রাতের আঁধারে আপনি কি বস্তায় ভরে ফেলে দিবেন নেতা সাহেব?” সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে ব্যাপক রেগে গেলেন তিনি। রাগান্বিত স্বরে বললেন, “যেটা বলেছি, সেটা কর দ্রুত। নতুবা এখানে একা রেখে যাবো না, বুড়িগঙ্গার পঁচা পানির নিচে রেখে আসব।”

হাতরে দ্রুত বস্তার উপর উঠলাম। হাত দুটো দড়ির উপর রেখে দিলেন। আমি শক্ত করে ধরলাম। সর্বশক্তি দিয়ে ছুটলেন তিনি। বুঝতে পারলাম ছোটো বেলায় ফিরে পেয়েছি। আনন্দের বাঁধ ভেঙে গেল। খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম আমি।
মেঘলা দিনে, একলা ঘরে
থাকেনা তো মন।
কাছে যাবো, কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।

বিরামহীন ধারায় ঝরছে জলধারা। মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। সঙ্গে ঝরছে শিলা। জানালার ধারে বসে ঠকঠক করে কাঁপছি শীতে। চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে পেটানো। জানালার পাশে স্টিলের গ্লাস রাখা। স্টিলের গ্লাসে বরফের কুচি শব্দ করে জমা হচ্ছে। চায়ের সাথে বরফ পান করা অন্যরকম অনুভূতি। অপূর্ব ওয়াশরুমে আছেন। ঘরেই জামাকাপড় পাল্টে নিয়েছি আমি। দরজা খোলার শব্দ পেলাম। অমনি গ্লাসে চুমুক দিলাম। আগ বাড়িয়ে জানালা বন্ধ করে দিলেন। বলেন, “নানুর কাছে শুনেছি, ‘শিলা থেকে জোঁক হয়।’ শিলা যে খাচ্ছিস, দেখা যাবে পেটের ভেতরে ঝোঁক। নাক, মুখ, চোখ কিংবা শরীরের অন্য কোনো অংশ দিয়ে বেরিয়ে এলো। পেট কে/টে জোঁক বের করতে হবে তখন।”

চিবুতে লাগলাম বরফ কুচি। হাত ছিটকে মেঝেতে পড়ল গ্লাস। হাত চলে গেল পেটে। ভীত হল। তবুও উড়িয়ে দিয়ে বললাম, “মোটেও জোঁক হবেনা। ছোটো বেলায় কত শুনেছি, ‘বিচি খেলে গাছ হয়’ কই হয়েছে বুঝি?”

“হয়েছে তো। খবর রেখেছিস? ২৮ বছর বয়সী এক রাশিয়ানের পেটে ৫ সে.মি গাছ পাওয়া যায়। তার কিছুদিন পর ৭৫ বছর বয়সী আমেরিকার বাসিন্দা রণ নামের এক বৃদ্ধর পেটে ২ সে.মি মটরের বীচ পাওয়া যায়। বিশ্বাস না হলে গুগল সার্চ করতে পারিস। সারাদিন বোকাসোকা সেজে থাকলেই হবে?” বলেই অপূর্ব চলে গেলেন।

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৫

এক মুহূর্তেই শীত ভাব দূর হয়ে গেল। উষ্ণ হল দেহ। প্রায়ই শিলা খেয়ে থাকি। এতদিনে পেটে নিশ্চয় জোঁক বাসা বেঁধেছে আমার। বালিশের পাশ হাতরে দ্রুত ফোন নিয়ে বসলাম। ভয়সের সাহায্যে গুগলে সার্চ দিল। সত্যি তো, তিনি মিথ্যা বলেননি।

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ৭