জ্বালাতে রং মশাল ২ গল্পের লিংক || ইফা আমহৃদ

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ১
ইফা আমহৃদ

“আমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠানোর সাহস হয় কী করে তোর? বেড়ি খুলে দিয়েছি তারমানে এই না বহুদূরে চলে যাবি।” অপূর্বর ক্ষিপ্ত কণ্ঠে কেঁপে উঠলাম। দৃষ্টি ঝাপসা থাকলেও মানুষটি আমার চেনা। মাথা নিচু করে ওড়না চেপে বসে রইলাম। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে একদল তরুণ অ;পহ:রণ করে এনেছে।

পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে আমরা আলাদা হয়েছি। তবে ডিভোর্স কার্যকর হয়নি। আঠার বছরের প্রতিক্ষায় ছিলাম। অপূর্ব ভাই আর অপূর্ব ভাই নেই। তিনি অপূর্ব আহসান। জনগনের নেতা। পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। সামনে নির্বাচন। উন্নয়ন করে জনগনের কাছে ভালোবাসার পাত্র। নত গলায় বললাম, “নেতা সাহেব, আপনি আমাকে অ’পহ;রণ করতে পারলেন? আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। ভেবেছি কে না কে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ঐ নামে একদম ডাকবি না।” বাক্য শেষ হওয়ার পূর্বেই চ্যাঁচিয়ে উঠলেন। বিগত বছরগুলোতে তাকে অপূর্ব ভাই ডাকা যায়নি। অপারেশনের পর থেকে আমি আরু নেই, নিজেকে অন্য কেউ আবিষ্কার করেছি। জোরে কথা বললে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। তা অজানা নয় অপূর্ব ভাইয়ের। সমাবেশ-সম্মেলনে উৎকণ্ঠা হয়ে বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি সর্বদা উচ্চ শব্দে কথা বলেন। আমার বিষয় মাথায় রেখে মোলায়েম কণ্ঠে বলেন, “নেতার বউকে তুলে নিয়ে যাবে, এত সহজ। সাহস হবে কারো? আস্তো থাকবে সে?”

পাশ ঘেঁষে বসলেন। ঘোমটা টেনে দিয়ে বললেন, “ক্ষুধা লেগেছে?”
প্রত্যুত্তর না করে নিশ্চুপ হয়ে থাকলাম। তখনই দরজায় টোকা পড়ল। অপূর্ব আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ভেতরে এসো।”
ছেলেটা ভেতরে প্রবেশ করল। নতজানু হয়ে সালাম বিনিময় করল। অতঃপর বলে, “নেতা, ট্রাক ভর্তি খাদ্য শস্য হাজির। বিতরণ করতে যাবেন বলেছিলেন। আপনি ভাবীকে রেখে যাবেন? না-কি আমরা যাবো? না-কি কাল সকালে যাবেন।”

অপূর্ব অধর চেপে ঘনঘন পলক ফেললেন। বিতরণের কথা সে ভুলেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। সিলভার রঙের হাত ঘড়ির পানে চেয়ে সময় দেখলেন। চিন্তিত হয়ে বলেন, “গাড়ি বের কর, আমি যাবো। বন্যায় অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে, খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। খাবারের অভাবে জনগণ অসুস্থ হয়ে যাবে। নেতা হয়ে কীভাবে মেনে নেই?”

বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ছেলেটা চঞ্চল পায়ে প্রস্থান করল। একবারও আমার দিকে তাকায়নি। গম্ভীর হয়ে থাকায় আমায় কাছে টেনে নিলেন। চুমু খেলেন ললাটে। আশ্বাস দিয়ে বললেন, “মন খা;রাপ করিস না। জনগনের ভালো মন্দ দেখা আমার দায়িত্ব। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।”

তার প্রতি সম্মান বেড়ে গেল। ভালোবাসা দৃঢ় হল। মুখে বলা হয়ে উঠেনি ভালোবাসি। দু’জন কর্মীকে ডাকলেন। খাবার নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। খাবার দিয়ে গেল। অপূর্ব খাবার মেখে এগিয়ে দিলেন। ‘খাবার না খাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা’ নিয়ে বসে আছি। তিনি তোয়াক্কা করলেন না। দু’বার সুন্দর করে বললেন, “নে খেয়ে নে।”
টোল পড়া হাসিটা মুগ্ধ করল আমায়। এক ধ্যানে দেখতে লাগল। পরক্ষণেই চ্যাঁচিয়ে উঠলেন, “মুখে নে। মেজাজ বিগড়ে দিস না।”

কানে হাত দিয়ে খাবার মুখে নিলাম। পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। কিছুক্ষণের মধ্যে সব খাবার শেষ করে ফেললাম। তিনি বিশ্বজয় করা হাসি হাসলেন। হাত ধুয়ে নিলেন। জানালা লক করলেন। বারান্দার দরজা বন্ধ করলেন। আলমারি থেকে দুটো একশ টাকার বান্ডিল নিলেন। রেইনকোট পড়তে পড়তে বললেন, “দরজা খোলার দরকার নেই। কখন কী হবে বলা যায়না। তোর ফোন তোর ব্যাগে আছে। তাছাড়া আলমারির নিচের তাকে একটা বাটন ফোন আছে। অতি প্রয়োজন পড়লে ওটা ব্যবহার করবি। কেমন। গুড নাইট।”

বলেই বেরিয়ে গেলেন তিনি। আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নেতার বাড়ি বলে গার্ডদের অভাব নেই। শো শো করে তিনটা গাড়ি চলে গেল। বাইরে তখন অবিরাম ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। মাঝেমাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে বুক কেঁপে উঠছে। নেতাদের সারাজীবন অন্যদের উপকারে ব্যয় করতে হয়। সময় চ্যাক করে ঘুমিয়ে গেলাম। মাঝরাতে দরজায় টোকা পড়ল। হাই তুলে উঠে বসলাম। তখনও অবিরাম ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। দরজার কাছে গিয়ে ধীর গলায় বললাম, “কে?”

বাইরে থেকে অচেনা গলায় এক তরুণ বলে, “ভাবী দরজা খুলুন। আমি মেহেদী।” মেহেদী অপূর্বর পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। একসাথে ত্রান বিতরণ করতে গিয়েছিল। আমি দ্রুত দরজা খুলে দিলাম। অপূর্বকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মেহেদী। হাত ব্যান্ডেজ করা। উত্তেজিত হলাম।
“মেহেদী ভাই, নেতা সাহেবের কী হয়েছে? ওনার হাতে ব্যান্ডেজ কেন?”

আমি একপাশে দাঁড়ালাম। ভেতরে ঢুকলেন তিনি। বিছানায় শুইয়ে রেখে তিনি বললেন, “চিন্তার কিছু নেই। নেতার গু লি লেগেছে। বিরোধী দলের লোকজন নেতাকে মা রার সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল ভাবী। ডাক্তার গুলি বের করে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। আপনি একটু ওনার যত্ন নিয়েন।”

বলেই চলে গেলেন তিনি। আমি মাথায় কাছে বসলাম। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুনতে পেলাম ‘পানি’ বলে আওড়াচ্ছেন তিনি। মাথা উঁচু করে গ্লাস দিয়ে পানি গলিয়ে দিলাম মুখে। শরীর গরম হয়ে উঠেছে। জ্বর পট্টি দিতে হবে। ওড়না ভিজিয়ে মাথায় পট্টি দিতে বসলাম। এইতো সেদিনের কথা, আমি তখন অপারেশন করতে রাজি হয়েছিলাম। বাড়ি থেকে সবাই গিয়েছিল ফুফুর বাড়িতে। অপারেশন ঠিকভাবে সম্পন্ন হলেও বিপত্তি বাঁধল অন্য জায়গায়।

পাকস্থলীর টিউমার ক্যান্সারের রুপ নিয়েছিল সবে। ডাক্তার অপারেশন করে টিউমারের থলে বের করে। অপারেশনের পর অপূর্ব নামক মানবটি ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল। রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাস দুই পর জানতে পারলাম আমি কখনো মা হতে পারব না। অপারেশনের পর বন্ধ্যাত্বে পরিণত হয়েছি।

সবকিছু ছেড়েছুড়ে পুনরায় ফুপুদের বাড়িতে চলে গেছিলাম। বুঝতে পারলাম, আমাকে মেনে নিতে তার ঘোর আপত্তি। আশ্চর্যের বিষয় হল, যখন জানতে পারলেন আমি মা হতে চলেছি। তখন ছেড়ে দিলেন। যখন জানতে পারলেন, মা হতে পারব না। তখনও ছেড়ে দিলেন।
এখনও সেখানেই আছি। মাঝেমাঝে বাড়িতে ফিরে দুই একদিন থেকে চলে যাই। আমার বন্ধ্যাত্বের কথা মা বাবা সবার থেকে লুকিয়েছেন।

ফোনের রিংটোনের শব্দ শুনতে পেলাম। আলমারি থেকে আসছে। আলমারি খুলে ফোন হাতে নিলাম। মামুনি ফোন করেছেন। রিসিভ করলাম জড়তা নিয়ে। এতক্ষণের দুর্ঘটনার সংবাদ নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে। রিসিভ করে কানে ধরলাম। মামুনি অস্থিরতা নিয়ে বলছেন, “হ্যালো অপু। কোথায় তুই বাবা? টিভিতে কীসব দেখাচ্ছে।”
মামুনির আর্তনাদ শুনে ধীরে ধীরে বললাম, “মামুনি উনি বাসায় আছে।”
মামুনি চমকে বললেন, “কে আরু?”

“হম।”
“তুই অপুর কাছে?”
“জি মামুনি। তোমরা চিন্তা করোনা, আমি আছি।”
মামুনি কেঁদে উঠলেন। বললেন, “চিন্তা কী সাধে করি মা? কতবার বললাম এই রাজনীতি ছাড়। ছেলেটা কথাই শুনেনা। রাজনীতির জন্য দেশে ফিরেছি। কোনো লাভ হলনা।
তা অপূর্ব কিছু খেয়েছে?”

ততক্ষণে মনে হল, তিনি খেয়ে বের হয়নি। জবাব দেওয়ার ভাষা নেই। ‘রাখি’ বলে ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করলাম। রিমোট টিপে টিভি অন করলাম। সংবাদ চলছে। মেয়েটি বলছে, “সুন্দরনগরের নেতা অপূর্ব আহসানের হাতে গু লি লেগেছে। ছু রি দিয়ে পেটে আঘা:ত করা হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে দলবল নিয়ে পালিয়েছেন। জানা গেছে, বন্যার্তদের সাহায্য করতে গিয়েছিলেন। পরবর্তী আপডেট পাওয়া গেলে জানানো হবে। সাথেই থাকুন।”

দ্রুত অপূর্বর কাছে গেলাম। শার্টের বোতাম খুলতেই চোখ ছানাবড়া। পেটেও ব্যান্ডেজ করা। হাত স্পর্শ করলাম। নড়েচড়ে উঠলেন তিনি। কতটা আঘা:ত পেয়েছেন। কিন্তু মেহেদী বলেছিল, শুধু হাতে। সিরিয়াস কিছু হয়ে যায়নি তো।
রান্নাঘরে গেলাম। ঘেঁটে ম্যাগি স্যুপের দুই পাতা পেলাম। স্যুপ বানিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।
আস্তে আস্তে ডাক দিলাম। হুশ নেই। স্যুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম। কখনো কাউকে খাইয়ে দেইনি। তাই জানা নেই। মাথার নিচে হাত দিয়ে খাওয়ানোর চেয়ে করলাম। চোখের বাঁধ ভাঙল। বিরতিহীন ধারায় ঝরছে অশ্রু।

সিজন ১ এর সকল পর্বের লিংক 

রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। রেসপন্সের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী পর্ব দেওয়া হবে।
গতকাল দেওয়ার কথা থাকলেও রাত ৮:৩০ দিকে ঘুম ভেঙেছে। খেলা দেখে ঘুমিয়ে ছিলাম। তখন ৫০০ শব্দ লেখা ছিল মাত্র। তাই দেওয়া হয়নি। কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।

জ্বালাতে রং মশাল ২ পর্ব ২