আলোছায়া গল্পের লিংক || ফারহানা কবীর মানাল

আলোছায়া পর্ব ১
ফারহানা কবীর মানাল

আশরাফুলের মানিব্যাগে নিজের ছবি দেখে চমকে যায় মিরা। আশরাফুল সম্পর্কে মিরার স্বামী। নিজের স্বামীর মানিব্যাগে নিজের ছবি দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই তবুও মিরা ভিষণভাবে অবাক হচ্ছে। বিয়ের এক বছর পার হয়ে গেলো আজও আশরাফুল মিরাকে স্ত্রী বলে স্বীকার করেনি। ভালো করে দুটো কথা পর্যন্ত বলেনি। সেখানে ভালোবেসে মিরার ছবি মানিব্যাগে রাখবে এমনটা হতে পারে না।

–” আমার মানিব্যাগ নিয়ে তুমি কি করছো? দিন দিন তোমার সাহস বেড়েই চলেছে। হাজারবার তোমাকে বলেছি আমার জীবন থেকে চলে যাও। কিন্তু বেহায়ার মতো এখানেই পড়ে থাকো।”
কথাগুলো বলে আশরাফুল মিরার হাত থেকে মানিব্যাগটা কেড়ে নেয়। তারপর নিজের মতো করে চলে গেলো। মিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে পা বাড়ালো। এসব কথা নতুন কিছু নয় মিরার জন্য, রোজ রোজ সবার অপমান সহ্য করতে করতে এখন এগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে। তেমন একটা কষ্ট লাগে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” কি রে নবাবজাদি, এখন ঘুম ভাঙলো নাকি তোর? সকাল থেকে আমার মেয়েটা কাজ করে চলেছে আর তুই বরের সাথে সোহাগ করছিলি নাকি?”
–” আহ মা ভাইয়ের সাথে সোহাগ করার কপাল ও-র আছে নাকি, তুমি শুধু শুধু ও-কে কথা শুনিয়ে দিলে। এই শোনো আমার জন্য একটু পাস্তা রান্না করো তো। আজ সকালের নাস্তায় আমার পাস্তা খেতে ইচ্ছে করছে। ”

কথাগুলো বলে দুইজন দুইদিকে নিজের কাজে চলে গেলো। এতো সময় যারা মিরাকে কথা শোনালো তারা মিরার ননদ আর শাশুড়ি। শাশুড়ি ছেলের বউকে এমন বাজে কথা বলতে পারে বলে ধারনা ছিলো না মিরার। কিন্তু এখন এসব কথাই তাকে রোজ শুনতে হয়। বহুকাল ধরে প্রচলিত নিয়মে তারা বড্ড খারাপ ব্যবহার করে মিরার সাথে। আবার মিরাও ভালো মানুষের মতো মুখ বুঁজে সব সহ্য করে আসছে। লোক লজ্জার ভয়ে মা’য়ের মান সম্মানের দিকে তাকিয়ে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে চাইলেই মা’য়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে বারবার। ভয়ে আত্মা কেঁপে ওঠে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায় না।

চোখের কোণে জমে থাকা পানিকণাগুলো মুছে রান্নায় মন দিলো মিরা। কিন্তু মনটা কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। আশরাফুলের মানিব্যাগে নিজের ছবির কথাটা বারবার মনে পড়তে, কোথাও শুনেছিলো ছেলেরা যাকে ভালোবাসে তার ছবিই নিজের মানিব্যাগে রেখে দেয়। তনে কি আশরাফুল মিরাকে ভালোবাসে, মনের কোথাও যেন এক চিলতে আশার আলো দেখতে পায় মিরা। স্বামীর ভালোবাসা পেতে এ আশা জেগে উঠছে।

প্রতিটা মেয়েই স্বামীর ভালোবাসা পেতে চায়, নিজেকে স্বামীর মনের রাণীর আসনে বসাতে চায়। কিন্তু বাস্তবে ক’জনই বা এ সুখ পায়। কারো জীবন বাঁধা পড়ে সংসার নামক দায়িত্বে, কারো জীবন চলে রুটিনের মতো, নিতান্তই ভাগ্যবতী মেয়েরা স্বামীর ভালোবাসা পায়। মিরা হয়তো সেসব মেয়েদের ভিতর নেই। তা-ই তার জীবন বড্ড বিভীষিকাময়। নানান চিন্তার মধ্য দিয়ে সকালের রান্না শেষ করলো মিরা। সময়ের আগে খাবার গুছিয়ে দিতে না পারলে আবার নানান কথা শুনতে হবে।

বছরখানেক আগে মিরার বিয়ে হয় আশরাফুলের সাথে। আশরাফুল একটা কোম্পানিতে চাকরি করে, মিরা তখন কলেজে পড়তো, সবে মাত্র অনার্স ভর্তি হয়েছিলো। চোখে অপার স্বপ্ন তার, পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি করবে, মায়ের সাথে একটা সাজানো বাড়িতে থাকবে। রোজ রোজ মা’কে পরের বাড়িতে কাজ করতে যেতে হবে না। কারো অফিস মুছতে হবে না। কিন্তু সবার সব ইচ্ছে কি পূরণ হয়!

রোজকার মতো সেদিনও কলেজ শেষ করে বাড়িতে ফিরে দেখে মা সবকিছু গুছিয়ে রাখছে। মিরাকে দেখে হাসিমুখে বলেন,” তোর জন্য একটা ভালো কাজ এসেছে রে মা। ছেলে বড় কোম্পানিতে চাকরি করে, আমি যে অফিসে চাকরি করি ও-ই অফিসের বসের ছেলে। সন্ধ্যায় ওঁরা তোকে দেখতে আসবে। একটু ভালো করে রেডি হয়ে থাকবি। ওঁরা তুই যতদূর পড়তে চাস পড়াবে। কলেজ পাশ করলে ছেলের বাপের অফিসে চাকরিও দিয়ে দিবে। তুই আর না করিস না।

মিরার বিয়ে করার ইচ্ছে না থাকলেও মা’য়ের মুখে হাসি দেখে আর না বলতে পারে না। মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে ঘরে চলে যায়। সন্ধ্যায় আশরাফুলের পরিবার মিরাকে দেখতে আসে। লাবন্যময়ী মিরাকে দেখে হয়তো ওদের অপছন্দ হয়নি। তাই কয়েকদিন পরেই মিরার সাথে আশরাফুলের বিয়ে হয়ে যায়। খুব বেশি আড়ম্বর ছিলো না বিয়েতে, মিরার শশুর, শাশুড়ি, ননদ আর মিরার মা সাথে কয়েকজন লোক মিলে কাজী অফিসে বিয়ে হয়।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে শশুর বাড়িতে পা রাখে মিরা। মায়ের কিছুটা খরচ কমে গেলো ভেবে কিছুটা স্বস্তি পায়। ভেবেছিলো জীবনটা হয়তো নতুন রঙে সেজে উঠবে, কিন্তু সবার কি সব ভাবনা সত্যি হয়! বাসর রাতেই আশরাফুল মিরাকে জানিয়ে দেয় সে বাবার কথাতে বিয়ে করেছে, মিরাকে তার পছন্দ নয়। আর কখনোই সে মিরাকে বউ হিসাবে মেনে নিতে পারবে না। মিরার জন্য এটাই ভালো যেন মিরা এখান থেকে চলে যায়।

কিন্তু মিরা আর কোথাও যেতে পারেনি৷ মা বাবা ডিভোর্স হওয়ার পর মা’কে নানান কষ্ট করতে দেখেছে মিরা, বাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে দোকানে বসে আড্ডা দেওয়া লোকগুলোর চোখে পর্যন্ত লালসা দেখতে পেয়েছে। মাসের মাথায় বাড়ি পাল্টে ভিন্ন ভিন্ন জায়গাতে থাকতে দেখেছে। এসব যেন মিরার শৈশবের অংশ। তা-ই নিজের গায়ে ডিভোর্সী তকমা লাগাতে বড্ড ভয় পায়।

সকালে সবার খাওয়া শেষ হলে মিরা খেতে বসে, এ বাড়ির লোকদের সাথে বসে খাওয়ার অনুমতি তার নেই। বাড়ির কাজের লোকের সম্মানটুকুও তার নেই। কলেজে যাওয়া বেশ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, শশুর শাশুড়ির ঘোর আপত্তি মিরার পড়াশোনা নিয়ে এতো টাকা কে খরচ কবরে তার পিছনে! মা’কে অবশ্য প্রশ্ন করেছিলো মিরা।
মিরার মা রোজিনা রেণু সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন, ” বিয়ে হয়ে গেছে সংসার করো। পড়াশোনা করে কি লাভ?’
পড়াশোনা করে কি লাভ এ কথার উত্তর মিরা দিতে পারেনি। শুধু মনে হচ্ছিল নিজের মা’য়ের কাছেও বোধহয় সে বোঝা, না হলে মা কেন তাকে এমন করে বিয়ে দিয়ে দিলো।

খাওয়া শেষ করে থালা বাসন ধুয়ে রাখলো। দুপুরের রান্না বসাতে হবে। এমন সময় মিরার শাশুড়ি এসে বললো৷, ” আশরাফুলের আলমারিটা পরিষ্কার করে দিও তো। অনেক ময়লা হয়েছে নাকি, এটুকু তো খেয়াল রাখতেই পারো নাকি? সব কি আমাকে বলে দিতে হবে?”

মিরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। মুখে কোনো ভাষা খুঁজে পায় না। আশরাফুল এই সামান্য কথাটা কি মিরাকে বলতে পারতো না। হয়তো বলতে পারতো না। তা-ই বলেনি। রান্না চাপিয়ে আশরাফুলের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো, বাসর রাতের পর থেকেই মিরা আলাদা একটা ঘরে থাকে। আশরাফুল কখনো উঁকি দিয়েও মিরাকে দেখে না। এমন জীবন থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে চলে মিরা। কিন্তু কোথাও যেন কোনো রাস্তা খোলা নেই তার জন্য।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দেয় সে। সব কাপড়গুলো বের করে রোদে দিয়ে আসে। নানান জিনিসে আলমারি ভর্তি হয়ে আছে। সবকিছু মুছে গুছিয়ে রাখে, হঠাৎ তার নজর পড়ে একটা ডায়রির দিকে, ডায়রির উপরে প্রাক্তন লেখা, কৌতূহল বশত ডায়েরি খুলে নিজের ছবি দেখতে পায়, শুধু মাত্র মিরার ছবি নয়, সাথে আশরাফুল ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনটা বা দুইজন হাত ধরা। এমন পাঁচ -ছয়টা ছবি নজরে পড়ে মিরার। ডায়েরির কয়েকটা পাতা ছেঁড়া, কোথাও কিছু লেখা নেই। হয়তো বা কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে।

একটা ছবির পেছনে লেখা, ‘ তোকে কখনো ক্ষমা করবো না আমি। ‘
অজানা ভয় মিরাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। এ কি সেই আশরাফুল! না না এমনটা তো হতে পারে না। এলোমেলো হাতে জিনিসগুলো সাজিয়ে রাখে মিরা, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।
রান্নাঘরে থেকে মিরার শাশুড়ির চিৎকার শোনা যায়।

–” এই অলক্ষী মেয়েটা আমাদেরও ও-র মা’য়ের মতো ফকির বানিয়ে ছাড়বে। দেখো তো কতটা তরকারি পুড়িয়ে ফেলেছে। এই নবাবজাদি কোথায় গিয়ে হাওয়া খাচ্ছিস তুই? ”
–” এইতো মা আলমারি গুছিয়ে রাখছিলাম। দেখি কতটা তরকারি পুড়েছে। ”
মিরাকে আসতে দেখে রেশমা বানু( মিরার শাশুড়ি) রান্নাঘর থেকে চলে যায়। তরকারি খুব বেশি একটা পোড়েনি। সামান্য লেগে গেছিলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দেয়। তরকারি ঢালতে গিয়ে বেশ খানিকটা হাত পুড়ে যায়। হাতে বড্ড জ্বালা করছে, তাড়াতাড়ি করে ঠান্ডা পানিতে হাত চুবিয়ে রাখে। শরীরের যন্ত্রণা কিছুটা কমে বটে কিন্তু মনের ক্ষতগুলো নতুনের মতো কষ্ট দিতে থাকে।

দুপুরে খাওয়ার সময় মিরার শশুর অদ্ভুত একটা কথা বলে বসে। আশরাফুলের আবার বিয়ে দিতে চায়। ছেলের জীবন এমন করে নষ্ট করতে রাজি নয় সে। মিরা অবশ্য কিছুই বলে না। যার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই তার বিয়ে নিয়ে কিসের চিন্তা।
সবকাজ সেরে বিছানায় গিয়ে শরীরটা এলিয়ে দেয় মিরা। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। মিরার ঘরের জানালাটা বাইরের দিকে, ছোট একটা গলিপথ দেখা যায় জানালা খুলে দিলে। সামান্য বাতাসের আশায় জানাটা খুলে দেয়। নিজের জীবন নিয়েই বড্ড হতাশ সে!

আলোছায়া পর্ব ২