আলোছায়া পর্ব ২

আলোছায়া পর্ব ২
ফারহানা কবীর মানাল

সবকাজ সেরে বিছানায় গিয়ে শরীরটা এলিয়ে দেয় মিরা। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। মিরার ঘরের জানালাটা বাইরের দিকে, ছোট একটা গলিপথ দেখা যায় জানালা খুলে দিলে। সামান্য বাতাসের আশায় জানাটা খুলে দেয়। নিজের জীবন নিয়েই বড্ড হতাশ সে! সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে আসে। হাতের পোড়া জায়গায় বেশ জ্বালা করছে কিন্তু কোনো ধরনের ঔষধ মিরার কাছে নেই। কারো কাছে ঔষধ চাইতে গেলে আবার নতুন করে অপমানিত হতে হবে, কি দরকার কারো কথা শোনার! একটু কষ্ট করে যন্ত্রণা সহ্য করলে আর অপমানিত হতে হবে না। শরীরের কষ্টের থেকে যে মনের কষ্টটাই বেশি পোড়ায় মিরাকে।

–” নবাবজাদি সন্ধ্যাবেলা আমাদের নাস্তা না দিয়ে শুয়ে আছে। ফ্রী খাবার পেলে এরা মাথায় ওঠে। ”
শাশুড়ি মা’য়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় মিরার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। অনেক দেরি হয়ে গেছে, সকলের জন্য নাস্তা বানাতে হবে। কোনো রকম চোখে মুখে পানি দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। তাড়াতাড়ি করে নুডলস রান্না করে, সে-ই সাথে চা বানায়। এ-র থেকে বেশি কিছু করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” কি রে নবাবজাদি সন্ধ্যাবেলা কি আর নাস্তা জুটবে না? নাকি একবারে রাতের খাবার খেতে হবে?”
রাতের খাবারের নাম শুনে মনের মাঝে ভয় জড় হতে থাকে মিরার। সত্যি বলতে রাতের জন্য কিছুই রান্না করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রাখে, রাতের জন্য রান্না বসাতে হবে। শাশুড়ি আর ননদকে নাস্তা দেওয়ার সময় আশরাফুল বাড়িতে আসে। মিরার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
–” ছেলেটা কত কষ্ট করে এলো, এই যা তো ও-র ঘরে নাস্তা দিয়ে আয়। আর শোন একটা ডিম অমলেট করে নিয়ে যাবি। ”

মিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে আসে। আশরাফুলের জন্য নাস্তা তৈরি করে ও-র ঘরের দিকে পা বাড়ায়। এই ঘরে যেতে গেলে মিরার কেমন একটা অদ্ভুত কষ্ট হয়, কত আশা করে এ বাড়িতে এসেছিল জীবনটা নতুন করে সাজাতে। ও-ই ঘরটাতে তো মিরার থাকা উচিত ছিলো। সব জিনিসে মিরার ভাগ পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু ভাগ্যদোষে মিরা ঘরের কোনো জিনিসে হাত দেওয়ারও অনুমতি পায় না। নানান কথা ভাবতে ভাবতে আশরাফুলের ঘরের সামনে চলে আসে। কিন্তু বিনাঅনুমতিতে কি কারো ঘরে ঢোকা উচিত হবে?

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ে মিরা। আশরাফুলের বুঝতে বাকি থাকে দরজার বাইরে মিরা দাঁড়িয়ে আছে। এক মাত্র মিরা আসলেই এমন কড়া নাড়ে, অন্যকেউ তো আশরাফুলকে ডাকতে ডাকতে ঘরের ভিতর চলে আসে।
–” কিছু কি বলার ছিলো? ”
আশরাফুলের গলা শুনে মিরা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আস্তে করে বলে, ” আপনার নাস্তা। ”

আশরাফুল এগিয়ে এসে দরজা খুলে দেয়, মিরা নাস্তার প্লেটটা জায়গা মতো রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। অথচ এই ঘরেরই মিরার থাকার কথা ছিলো, এই মানুষটাকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু তা আর হলো কোথায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। রাতের রান্না তখনও বাকি যে। মিরার এ বাড়িতে একটা সুবিধা আছে, তা হলো নিজের পছন্দ মতো রান্না করা। রেশমা বানু কখনো কি রান্না করতে হবে বলতে আসে না। তবে রান্নার ভুল ধরেন ঠিকই। প্রথম প্রথম মিরার বেশ অসুবিধা হতো। কখন কি রান্না করবে বুঝতে পারতো না। নানান কথাও শুনতে হতো। এখন অবশ্য মিরা কিছুটা বুঝতে পারে এদের কেমন রান্না পছন্দ।

তিন চার রকমের সবজি একসাথে ভাজি করে, সাথে কয়েকটা চিংড়িমাছ। লাউ দিয়ে ডাল, সাদা ভাত আর মাছ ভাজি। এর থেকে বেশি কিছু রান্না করতে গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে।
রাতে খাওয়ার সময় মাছ দেখে মিরার ননদ রাগারাগি শুরু করে। সে মাছ খায় না। তবে ডাল আর ভাজি তার পছন্দের খাবার। তবুও-

–” আম্মু দেখো এই ছোট লোকটা কিসব রান্না করছে। আমি কি মাছ খাই বলো? এখন আমি কি দিয়ে ভাত খাবো? ”
রেশমা বানু মেয়ের সাথে তাল দিয়ে বলে উঠেন, ” ঠিকই তো। মেয়েটা এখন কি দিয়ে ভাত খাবো। তোকে কি আমরা বিনা পয়সায় চাকর রেখেছি যে ইচ্ছে মতো সব করবি?”
টেবিলের পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মিরা। কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না। বিনা পয়সায় চাকরই তো মিরা, জীবনটা কেমন হয়ে গেছে তার। রান্না আগে যদি প্রশ্ন করতো কি রান্না করবো তাহলেও তাঁকে কথা শুনতে হতো আর এখনও।

–” আচ্ছা থাক মা, বাদ দে। এই ছোটলোক এসব অখাদ্য খেয়ে বড় হয়েছে তাই ভালো কিছু রান্না করতে জানে না। আমি বরং তোমার বাবাকে বলি তোমার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে আসতে। কি বলো মামনি?’
মায়ের কথায় খুশি নেচে উঠে লাবণি। লাবণি সম্পর্কে মিরার ননদ। তবে এসব সম্পর্ক যেন দূর থেকে মিরাকে উপহাস করে আর মিরার জায়গা যে কাজের লোকের মতো তা বুঝিয়ে দেয়।

এতো সময় আশরাফুল চুপ করে খাবার খাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ কি ভেবে বলে উঠে, ” আচ্ছা মা তোমরা তো আগে দিয়ে বলে দিতে পারো কে কি খাবে, কি রান্না হবে বাড়িতে। শুধু শুধু রোজ এই অশান্তির মানে কি? আর এগুলোকে অখাদ্য বলছো কেন? খাবারকে সম্মান করতে শেখো নয়তো পরে খাবার না-ও জুটতে পারে। ”
ছেলের কথায় কপাল কুঁচকে আসে রেশমা বানুর। ছেলেটা কি বউ পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? পরক্ষণেই মনে পড়ে মিরাকে আশরাফুল কখনো মেনে নেয়নি। তাহলে কেন ও-র পক্ষ হয়ে কথা বললো। নানান চিন্তা মাথার ভিতর জট পাকিয়ে যেতে থাকে।

–” আম্মু আব্বুকে কল দিয়ে বলো বিরিয়ানি আনতে। ”
কোনো এক অজনা চিন্তায় ডুবে ছিলেন রেশমা বানু। মেয়ের কথা চমকে উঠলেন।
–” হুম মা বলে দিচ্ছি। এই মেয়ে এভাবে সং সেজে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা নিজের কাজে যা। ”

মিরা মাথা নিচু করে স্থান ত্যাগ করে। মাঝে মাঝে মনে হয় মাথাটা বড্ড নিচু করা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একার ভরসা হয় না মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, রান্নাঘরে বসে কোনো রকমভাবে রাতের খাওয়া শেষ করে, থালাবাসন ধুয়ে সাজিয়ে রাখে। হাতের পোড়া জায়গাটা বেশ জ্বালা করছে। রাতের রান্না সময় আবারও একটু ছ্যাঁকা লেগেছে। ব্যাথা জায়গাতে হয়তো বেশি ব্যাথা পাওয়া যায়।

নিস্তব্ধ রাত, শহরের অলিগলিতে কোথাও কোনো আওয়াজ শোনা যায় না। আকাশে চাঁদ নেই, তবে কয়েকটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। মিরার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, কেন জীবনটা এমন হলো তার। সে কি মা বাবার সাথে সুন্দর একটা জীবন পেতে পারতো না? যেমনটা লাবণি পেয়েছে। হয়তো মা বাবা একসাথে থাকলে তার জীবনটাও এমন গোছানো হতো কিন্তু সেসব আর পাওয়া হলো কোথায়! মিরার চোখের পানি যেন থামতে চাইছে না। হাতে বড্ড জ্বালা করছে, মনের মাঝেও বড্ড পুড়ছে।

এমনভাবে সময় পার হতে হতে কখন যেন চোখের পাতায় ঘুম চলে আসে মিরার। সব কষ্ট থেকে একটু মুক্তি মেলে তার।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয় মিরার। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারেনি। তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নেয়। চুলায় রান্না বসিয়ে বাড়ির সামনের দিকে ছুট লাগায়, কয়েকটা ফুলগাছ আছে বাড়ির সামনে, মিরা নিজেই লাগিয়েছে।

ছাঁদের উপর বেশ বড় ফুলের বাগান আছে আশরাফুলের, সেখান থেকেই ফেলে দেওয়া গাছগুলো যত্ন করে বড় করে তুলেছে, এই বাড়িতে আপন বলতে এই গাছগুলোই। ঘরের পাশেই গাছগুলো লাগাতে চেয়েছিলো মিরা যাতে গাছগুলোকে নিয়ে একটু সময় কাটাতে পারে কিন্তু শাশুড়ি মা’য়ের ঘোর আপত্তি ছিলো বলে বাড়ির সামনেই লাগাতে হয়েছে। সারাদিন রাস্তায় লোকজন থাকে বলে খুব একটা যাওয়া হয় না সেখানে৷ শুধু সকাল-বিকাল গাছে পানি দিয়ে আসে।
গাছে পানি দিয়ে এসে সকালের সব কাজগুলো একে একে শেষ করতে থাকে৷ লাবণির জন্য পাস্তা রান্না করে, মেয়েটা সকালবেলা পাস্তা পেলে আর কোনো কথা বলে না।

রান্না শেষ করতে করতে প্রায় নয়টা বেজে আসে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়৷ সকাল সকাল কারো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না আজ। হাতটা বড্ড বেশি কষ্ট দিচ্ছে, পানি লেগে হয়তো বেশি জ্বালা করছে।
ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে পড়ে, কাজ করে ক্লান্ত লাগছে শরীরটা, ক্ষুধাও লেগেছে একটু একটু। হঠাৎ চোখ পড়ে জানালার দিকে, জানালার পাশে কিছু একটা রাখা মনে হচ্ছে, সকালবেলা জানালাটা খুলে রেখেছিলো মিরা, কে কি রেখে গেছে কে জানে। মিরা কাছে গিয়ে দেখতে পায় একটা মলম, এক পাতা নাপা টেবলেট আর একটা চিরকুট। তাতে সাজানো অক্ষরে লেখা রয়েছে, –” নিজের যত্ন নিতে শেখো। ”

বড্ড অবাক হয় মিরা, কে করতে পারে এমন কাজ। হঠাৎ মনে পড়ে সকালে গাছে পানি দেওয়ার সময় একটা ছেলেকে মিরাকে লক্ষ্য করছিলো বারবার, কয়েকবার মিরার হাতের দিকেও তাকিয়েছে, মিরা দেখতে পেয়ে ওড়না দিয়ে হাতটা ঢেকে ফেলেছিলো তখন। তাহলে কি সে-ই ছেলেটা এ কাজ করছে? ভাবতেই মিরার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে৷ কেমন অস্থির লাগছে যেন। তবুও হাতে ঔষধটা লাগিয়ে নেয়। যদি কিছুটা কষ্ট লাঘব হয় এই আশায়।

আলোছায়া পর্ব ১

–” এই মিরা এদিকে শোন তো।”
রেশমা বানুর গলা পেয়ে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ায় মিরা। দূর থেকে একজোড়া চোখের মালিক মিরা কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছিলো। সে কথা মিরার অজানাই থেকে যায়।

আলোছায়া পর্ব ৩