আলোছায়া পর্ব ৩

আলোছায়া পর্ব ৩
ফারহানা কবীর মানাল

রেশমা বানুর গলা পেয়ে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ায় মিরা। দূর থেকে একজোড়া চোখের মালিক মিরা কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছিলো। সে কথা মিরার অজানাই থেকে যায়।
খাবার টেবিলে মিরার শশুর, শাশুড়ি, লাবণি আর আশরাফুল বসে আছে। সকলে নিজেদের মতো খাবার খাচ্ছে, মিরা ওদের কার কি প্রয়োজন লক্ষ্য করছে, কেন যে এরা মিরাকে বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিলো ভেবে পায় না সে। মাঝে মাঝে মা’য়ের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, এদের সবাইকেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, অসহায় বলে কি যা খুশি করবে আমার সাথে কিন্তু কথাগুলো বারবার গলার কাছে এসে আঁটকে যায়।

নিজের মা’ই যখন মেয়ের কথা শুনতে চায় না, কষ্ট বুঝতে চায় না সেখানে অন্য মানুষ কেন-ই বা এসব করবে।
খাবার মুখে দিতে দিতে রেশমা বানু বলেন, ” সন্ধ্যায় ওদের বাবার অফিস থেকে কয়েকজন লোক আসবে, সবকিছু গুছিয়ে ভালো কিছু রান্না করে রাখবে। ওদের যেন কোনো অসম্মান বা অযত্ন না হয়। ”
আজমল সাহেবের অফিসের লোকজন আসবে শুনে মিরার চোখ আশায় জ্বলজ্বল করে ওঠে৷ আবেগের বশে বলে ফেলে, ” মা-ও কি আসবে? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিরার কথাটা যেন এখানের কেউ আশা করেনি। লাবণি মুখে পাস্তা পুরতে পুরতে বলে, ” তোমার মা বাবার অফিসে কি চাকরি করে? ওহ হ্যাঁ আয়ার কাজ করে, তাকে কেন আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করে আনতে যাবো? থার্ডক্লাশ লোকজন!”
–” তাহলে সেই থার্ডক্লাশ লোকের মেয়েকে কেন এ বাড়ির বউ করে এনেছো? ফ্রী-তে কাজের লোক হিসাবে? যখন নিজে এমন পরিস্থিতিতে যাবে তখন শুধু লোকের অফিস নয় লোকের পায়ের জুতোও মুছবে। ”
মিরার কথায় সকলে চমকে যায়। মিরা এমন জবাব দিতে পারে কেউ আশা করেনি। রেশমা বানু কর্কশ গলায় বলে ওঠে, ” এই মেয়ে তুই ভদ্রতা জানিস না? আমার মেয়েকে এভাবে অভিশাপ দিচ্ছিস। তোর মা তো তোকে কিছুই শেখায়নি দেখছি। ”

মা’য়ের নামে কোনো প্রকার বাজে কথা মিরার সহ্য হয় না। যে মা একা হাতে ও-কে মানুষ করেছেন তাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে কাউকে ছেড়ে কথা বলার মেয়ে মিরা নয়। অসহায় হতে পারে তবে বোবা তো নয়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আশরাফুল বলে ওঠে, ” মা অন্যের মেয়েকে শিক্ষা না দিয়ে নিজের মেয়েকে ভদ্রতা শেখাও, কাজে লাগবে। ”

মিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আশরাফুলের দিকে, এই লোকটা কখনো কখনো বড্ড বেশি সাপোর্ট করে মিরাকে, কারণটা খুঁজে পায় না মিরা। তবে বেশ ভালো লাগে। মনে কোনো আশার আলো ফুটে ওঠে, কিন্তু পরে কোনো এক দমকা হওয়ার মাঝে আলোটাও হারিয়ে যায়।
আজমল সাহেব সচারাচর মিরার ব্যাপারে কথা হলে কিছু বলেন না। আজ কি মনে করে বললেন, ” ও-র মা-ও আসবে। সবাইকেই বলেছি। সবকিছু রেডি রেখো। ”

মিরার চোখে আজ খুশির অশ্রু, কতদিন বাদে মা’কে দেখতে পাবে। বিয়ের পরে মাত্র কয়েকবার মা’য়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছে। বহুদিন পর মা’কে দেখতে পাবে। আজ মা আসলে তার কাছে প্রশ্ন করবে কেন বিয়ে দিয়েছিলো তাকে। কি জন্য এতো কষ্ট তার জীবনে!
চোখ কোণে জমে থাকা পানিটা মুছে নিজের কাজে মন দেয় সে। হাতে সামান্য ব্যাথা করছে তবুও রেশমা বানুর কাছে কি কি রান্না হবে জিজ্ঞেস করতে যায়। লাবণি আর রেশমা বানু তখন সন্ধ্যায় কে কি পরবে তাই নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে আছে। দরজার কড়া লাড়ে মিরা।

–” কি কি রান্না করবো? আর কতজন লোক আসবে যদি একটু বলতেন গুছিয়ে রাখতাম।”
–“দেখেছো মা নিজের মা আসবে বলে কাজের কত তাড়া এই মেয়ের!”
–” তোর মা তোর কাছে আসলে কি তুই কিছু করতি না?”

আশরাফুলের কথায় সবাই বেশ চমকে যায়। বেশ কয়েকদিন ধরে ছেলের মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে রেশমা বানু। ছেলে কথায় কথায় এই মেয়েকে সাপোর্ট করছে। ব্যাপারটা খুব বেশি ভালো লাগছে না তার। পুরুষ মানুষের মন সুন্দরী মেয়ে দেখলে তো গলেই যাবে। বলা বাহুল্য মিরা যথেষ্ট সুন্দরী। সুন্দরী না হলে আশরাফুলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব কখনোই পেতো না। আজকাল লোকজন সাদা চামড়ার কাছে বড্ড দূর্বল। মুখে যা-ই বলুক বা নিজে দেখতে যেমনই হোক না কেন, তাদের পছন্দ লম্বা ফর্সা মেয়ে। আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম নয়।

–” আশরাফুল! তুমি আজ-কাল এই মেয়ের হয়ে কথা বলছো যে? তোমার থেকে আমি এসব আশা করি না। ”
রেশমা বানুর কথা আশরাফুলের দিকে চোখ তুলে তাকায় মিরা। আশরাফুল শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে কোনো হিংস্রতা নেই। সে শান্ত গলায় বললো, ” তাহলে কি আশা করো তুমি মা? আমি ও-কে কথায় কথায় অত্যাচার করি? ওর গায়ে হাত তুলি?”
রেশমা বানু কোনো জবাব দিতে পারে না। মিরা মিনমিনে গলায় বলে, ” আমার জন্য আপনার কিছু বলতে হবে না। আমি… ”

কথা শেষ করতে পারে না মিরা তার আগেই আশরাফুল বলে ওঠে, ” আমি কিন্তু তোমাকে কিছু বলিনি। তোমার বিষয়েও কোনো কথা বলনি প্রথমে। আমি শুধু লাবণির কাছে জানতে চাইলাম মা গেলে ও কিছু করতো কিনা। যাইহোক বাজার করতে হবে তাই লিস্ট নিতে এসেছি। ”

লাবণি হয়তো ভাইকে কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু আশরাফুল সে সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। চোখমুখ কুঁচকে মিরার দিয়ে চেয়ে রইলো সে। রেশমা বানু নিজের হাতে লিস্ট বানিয়ে মিরা দিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে কড়া গলায় বললো, ” রান্না জানি ভালো হয়, লোকের সামনে জানি মানসম্মান থাকে আমাদের। আর হ্যাঁ তোর ভালো কাপড় আছে তো?”
মিরা মাথা নাড়িয়ে না বলে, সত্যি বলতে তার ভালো কোনো কাপড় নেই। বিয়েতে যেসব কাপড় পেয়েছে তাই এতোদিন ধরে পরে আসছে সে। অভাব অনটনে বড় হওয়া মিরা খুব ভালো করে জানে কি করে একটা কাপড় বহুদিন ধরে ব্যবহার করতে হয়।

আশরাফুল বাজার থেকে ফিরে আসে। সাথে একজন লোকও আছে। এতো পরিমাণ রান্না মিরা একা কখন শেষ করবে মিরা জানে না। আজকের মেনুতে ইলিশ মাছ ভাজা, পোলাও, রোস্ট, গরুর গোশত, ডিম আর সালাত। সাথে অন্য কিছু আছে কিনা দেখতে হবে। ছয়টা বড় বড় ব্যাগ ভর্তি বাজার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১১টা ৩০ বাজে। সন্ধ্যার আগে সব রান্না শেষ করতে হবে। শাশুড়ি মায়ের কড়া নির্দেশ লোকজনের সামনে কাজ করা যাবে না। একটা শাড়ি পরে ঘুরঘুর করতে হবে। লোক দেখানো সংসার কিনা! মিরা ভেবেছিলো মাছ কুটে ধূয়ে রেখে দিবে, আর মশলা পিঁসে রাখবে। তারপর গোসল সেরে বাকিসব রান্না করবে। কিন্তু দেখলো আশরাফুল মাছগুলো বাজার থেকে কেটে এনেছে। ৩৫জন মানুষের রান্না একা করা সহজ ব্যাপার না।

আস্তে আস্তে একা হাতে সব কাজ করতে থাকে মিরা। রান্না শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে। কাজের চাপে গোসল করার সুযোগটুকু পায়নি সে। রেশমা বানু আর লাবণি ঘরের সবকিছু গুছিয়ে রেখেছে, প্লেট ধূয়ে সাজিয়েছে। তবে রান্নার কোনো কাজে হাত লাগায়নি।

সব রান্না শেষ করতে করতে মাগরিবের আজান দিয়ে দেয়। মিরা তড়িঘড়ি করে গোসলে করতে চলে যায়। রেশমা বানু মিরার খাটের উপর একটা শাড়ি রেখে গেছে সাথে কিছু গহনা। লোকের সামনে ভালো সাজতে মানুষ কিনা করে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাথরুমে চলে যায় মিরা। গোসল শেষ করে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। গহনাগুলো পরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেন নিজেই চিনতে পারে না সে, এতো সুন্দর লাগে মানুষকে সাজলে! হয়তো বা! মিরা মাথায় হিজাবটা জড়িয়ে নেয়। কত্ত লোক আসবে তাদের সামনে খোলা চুলে থাকতে চায় না সে। এতো সুন্দর করে সাজায় পরেও নিজেকে দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মিরার।

সব আয়োজন শেষ, বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মিরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মা’য়ের অপেক্ষায়। সবার পেছনে মিরার মা হেঁটে আসছে, পা যেন চলতে চায় না তার। মেয়ের সামনে দাঁড়াতে চায় না মোটেই।
মা’কে দেখতে পেয়েই মিরা তাকে জড়িয়ে ধরে। অবাধ্য চোখের পানি যেন বাঁধ মানতে চায় না। রেশমা বানু কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। দাওয়াতে আসা লোকজন সব জানলেও নতুন করে অবাক চোখে তাকায়। মিরা সব দেখতে পেয়েও চোখ বন্ধ করে থাকে। সকলে নিজের কাজে ব্যস্ত, মিরা মা’য়ের সাথে গল্প করছে, এমন সাজে মেয়েকে দেখে মা’য়ের চোখ জুড়িয়ে যায়।

হঠাৎ রেশমা বানু মিরাকে ডেকে নিয়ে যায়। দুইজন মহিলাকে কিছু খাবার দিয়ে আসতে বলে। তারা পাশের ঘরে বসে গল্প করছে। মিরা খাবারের থালা সাজিয়ে উনাদের দিকে যায়।
–” আচ্ছা এতো বড়লোক পরিবার এরা। বস কেন আমাদের অফিসের আায়ার মেয়েকে বিয়ে করলো বলো তো? এরা তো ধনী পরিবারের ভালো মেয়েকে ছেলের বউ করতে পারতো।”
–” আরে তুমি তো নতুন তাই জানো না। আমাদের অফিসে একটা কথা গুজব আছে। বস নিজের দোষ চাপা দিতে নাকি আয়ার মেয়েকে বউ করছে। ”

আলোছায়া পর্ব ২

মহিলা দুইজন উৎসুক হয়ে একে অপরের সাথে কথা বলছে। মিরা পা যেন ঘরের ভেতরে
যেতে চায় না। বড্ড জানতে ইচ্ছে করে কেন তাকে এই বাড়ির বউ করে এনেছে। কি দোষ চাপা দিতে তার জীবনে এতো কষ্ট নেমে এসেছে!

আলোছায়া পর্ব ৪