শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৯

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৯
তাসনিম জাহান রিয়া

ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভাইয়া আপনি হয়তো অন্য কারো সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন। আমি আপনার পরিচিত কেউ না।
কী যে বলেন ভাবি? আমি আপনাকে চিনতে ভুল করবো? আমি নিজেকে চিনতে ভুল করলেও আপনাকে চিনতে ভুল করবো না।ভাবি আপনি রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন তো? এই মামা যাবেন। আপনি রিকশায় উঠেন ভাবি। এই মামা সাবধানে নিয়ে যাবেন।

লোকটা রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে গেলে শ্রেয়সী নিষেধ করে।
ভাইয়া আপনাকে দিতে হবে না। আমি দিয়ে দিব।
নিষেধ করবেন না ভাবি। আপনাকে ট্রিট করার সুযোগ প্রতিদিন পাব না।
শ্রেয়সী অবাকের ওপর অবাক হচ্ছে। লোকটাকে সে চিনে না। কিন্তু লোকটার ভাব সাব দেখে মনে হলো লোকটা তাকে আগেও দেখেছে। দেখেছে বললে ভুল হবে। যেনো অনেকদিনের পরিচিত।
ভার্সিটির সামনে নেমে শ্রেয়সী তন্ময়কে কল দেয়। সেকেন্ডের মাঝে তন্ময় কল রিসিভ করে। তন্ময় কল রিসিভ করতেই শ্রেয়সী মৃদু স্বরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কই তোরা?
আমরা টিএসসিতে আছি। তাড়াতাড়ি চলে আয়।
শ্রেয়সী দ্রুত পায়ে হেঁটে তন্ময়দের কাছে যায়। রোদের মাঝে রিকশা দিয়ে এসে ঘামে ভিজে গেছে। শ্রেয়সী খোলা চুলগুলো হাত খোপা করে নেয়। প্রিয়ন্তির পাশে ধপ করে বসে পড়ে। শ্রেয়সীকে দেখেই মিহান কটাক্ষ করে বলে,
মিস রোগী ভালো হয়ে গেছেন?
শ্রেয়সী মিহানের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়।
মিহান একটু ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলে,

ভয় পাইছি। এমনে তাকাইছ না।এটা তো আমার কথা না। তোকে দেখলেই এখন তোর ম্যাজিস্ট্রেট বলবে, ভালো হয়ে গেছেন মিস রোগী?
নিতু ঠোঁটে কামড়ে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে,
তারপর আমাদের শ্রেয়সী বলবে, আপনাকে দেখেই তো আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছি। আপনি ফটাফট আমার গালে একটু চুমু খান দেখবেন আমি একদম সুস্থ হয়ে গিয়েছি।
শ্রেয়সী মিহান আরো নিতুকে মৃদু রাগ দেখিয়ে বলে,

ভালো হচ্ছে না কিন্তু?
মুহিব গালে হাত দিয়ে বলে,
সবাই মিঙ্গেল। একমাত্র আমিই সিঙ্গেল। আমার কেউ নাই।
মিথ্যা বলিস না মুহিব। অন্য কেউ না জানলেও আমি কিন্তু জানি। তোমার কেউ আছে নাকি নাই। কাকে নিয়ে স্বপ্নে তুমি সংসার সাজাও সেটা কিন্তু আমি জানি।
মিহান একটু নড়েচড়ে বসে বলে,

শ্রেয়সী তুই একা না আমি আর তন্ময়ও কিন্তু জানি। কে সেই রমণী? সুন্দরী ললনা বাপের টাকাই করে ছলনা।
মিহানের শেষ হতে না হতেই ইভা ধুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয়। ইভা মিহানের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে,
মেয়েদের নামে উল্টা পাল্টা কথা বললে লাথি মেরে পাবনায় পাঠিয়ে দিব।
গাইস আই হেভ এ গভীর প্রশ্ন। সবারই কেউ না কেউ আছে। মিহানের খবর তো কেউ জানে না। মিহানের ললনা কে? জাতি জানতে চায়।

নিতুর কথায় ছয় জোড়া প্রশ্নবিদ্ধ নয়ন স্থির হয় মিহানের দিকে। মিহান একটু নড়েচড়ে বসে। গলা ঝেড়ে বলে,
কী? সবাই আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? আমাকে দেখতে কী অন্য গ্রহের প্রাণীদের মতো দেখাচ্ছে? সবাই মিলে আমাকে ইভটিজিং করার চেষ্টা করছিস না তো?
ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারব। একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবি না। তুই নিজের সম্পর্কে আমাদের কিছুই বলিস না। আজকে না বললে আমরা ছাড়বো না।

আমি ষোল বছর বয়সে এক অষ্টাদশীর প্রেমে পড়েছিলাম। অষ্টাদশী প্রথম দেখায় আমার হৃদয়হরণ করেছিল। জানি তাকে কখনো পাব না। সে আমার কপালে লেখা নাই।
প্রিয়ন্তি মিহানের পিঠে হাত রেখে বলে,
কেনো পাবি না তাকে? অবশ্যই পাবি। তোদের ভালোবাসা সত্যি হলে তোদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। তবে তোর কপাল পুড়েছে। সিনিয়র মেয়ে আর ম্যাডামের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। বিয়ের পর কড়া শাসনে রাখবে। কাশি দিতে গেলেও পারমিশন নিয়ে কাশি দিতে হবে।

তাকে পেলে যদি আমার কপাল পুড়ে। তাহলে আমি কপাল পুড়াতেও রাজি। কিন্তু তাকে পাওয়া সম্ভব না। আমার ভালোবাসাটা এক তরফা। সে কখনোই আমাকে ভালোবাসবে না।
মুহিব মিহানের পিঠ চাপড়ে বলে,
চাপ নিস না মামা। আমরা আছি না। মেয়ে রাজি নাহলে তুলে নিয়ে আসবো।
মিহান মুহিবের কথায় মৃদু হাসে কিছু বলে না।

ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে এখন সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। শ্রেয়সীদের ফ্ল্যাটটা তিন রুমের। একটা কিচেন আরেকটা বিশাল ড্রয়িংরুম।
হেলাল সরকার শ্রেয়সীদের বাসায় এসেছেন আজকে প্রায় দশদিন। উনি অনেক আগেই চলে যেতেন। যেতে পারেননি শ্রেয়সীর অসুস্থতার জন্য। হেলাল সরকারের সব থেকে বড় দুর্বলতা যে শ্রেয়সী। নাহিনের রুম থেকে পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করতে করতে বের হচ্ছেন হেলাল সরকার। উনি নাহিনের সাথেই থাকেন। শ্রেয়সী সোফার ওপর মন খারাপ করে বসে আছে। হেলাল সরকার শ্রেয়সী পাশে গিয়ে বসে। হেলাল সরকার শ্রেয়সীর মাথায় হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে,
আমার আম্মার কী মন খারাপ?

জেঠু তুমি চলে যাচ্ছো?
এখন যাচ্ছি না তো কাল সকালে যাব।
কাল সকালে কেনো? কোনো সকালেই যাবে না।
এমন বললে কী হয়? তোমার জেঠিমা একা ওখানে। আমার সবকিছুই তো সেখানে। সব রেখে কী থাকা যায়? থাকলাম তো অনেকদিন। আমি তো একেবারে চলে যাচ্ছি না। আমি আবার আসবো।

শ্রেয়সীর মা চা নিয়ে কিচেন থেকে বের হতে হতে হেলাল সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
ভাইজান মেয়েটা যখন এতো করে বলছে আর কিছুদিন থেকে যান। ভাবিকেও বলেন চলে আসতে।
তুমি আর আম্মার সাথে মিলে বাচ্চামো করো না। কতো কাজ বাকি আমার। নিজের বাড়ি ছেড়ে এখন আর কোথাও থাকতে ইচ্ছে করে না। বয়স তো কম হলো না। ছুটির ঘন্টা তো বেজে গেছে। হুট করেই একদিন চলে যাব। শেষ নিঃশ্বাসটা নিজের পূর্ব পুরুষদের ভিটেতেই ত্যাগ করতে চাই।

একদম এরকম কথা বলবে না। তোমার কিছু হবে না। তুমি এমন কথা বললে আমি কিন্তু কেঁদে দিব। আমি যতদিন বেঁচে থাকব তোমাকেও ততদিন বেঁচে থাকতে হবে। আমি তোমার আম্মা আর তুমি আমার ছেলে। মারা গেলে আমি আগে মারা যাব।

আমার পাগল আম্মাটা। আমি এতো তাড়াতাড়ি মরবো না। আমার যে এখনো আমার আম্মার বিয়ে দেখা বাকি।
ভাইজান আপনি শ্রেয়সীকে তো আসল কথাই বলতে ভুলে গিয়েছেন।
কী কথা? তুমি কী বলবে জেঠু?
চলো ছাদে যাই। আজকে দুজন ছাদে বসে গল্প করবো।
আচ্ছা চলো।

শ্রেয়সী একটা মাদুর নেয়। হেলাল সরকারের হাত ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে আসে ছাদে। ছাদের এক পাশে মাদুর পেতে বসে। হেলাল সরকারের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে শ্রেয়সী। শ্রেয়সী হেলাল সরকারের হাত নিজের মাথার ওপর রেখে বলে,
আজকে কিন্তু সেই ছোটবেলার মতো মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প শুনাতে হবে।
শুনাব গল্প। তার আগে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
কী কথা?

আমার আম্মা তো এখন বড় হয়েছে। তার তো বিয়ে দিতে হবে। আমি তার জন্য একটা ছেলে দেখেছি। ছেলে কলেজের প্রফেসার। আমার আম্মাকে এক দেখাতেই পছন্দ করে ফেলেছে। আমার আম্মা অনেক দিন তার এই ছেলের কাছ থেকে দূরে ছিল। বিয়ে দিয়ে আমার আম্মাকে কাছে রাখতে চাই। ছেলে আমাদের পাশের বাড়ি। আমার আম্মা কী তার ছেলের আবদার রেখে বিয়েতে রাজি হবে?

আমি তোমার কোনো কথা কখনো ফেলেছি। তুমি তো জানো তুমি আমার কাছে কী? সবার সাথে তোমার সম্পর্ক আপনিময় হলেও আমার সাথে তোমার সম্পর্ক তুমিময়। আম্মু ছোটবেলা মেরে, ধমকেও তোমাকে আপনি বলাতে পারেনি।
ধপ ধপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে দুজনেই পিছনে তাকায়। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
হয়তো বিড়াল হবে। তুমি শুনো আমার কথা। আমি কখনোই তোমার কাছ থেকে কিছু লুকাই না। আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করি জেঠু।

সেটা তো ভালো কথা। প্রফেসার টফেসার বাদ। আমার আম্মার বিয়ে তার সাথে হবে যাকে আমার আম্মা পছন্দ করে। আমার আম্মার পছন্দ কখনো খারাপ হতে পারে না।
কী করে?
ম্যাজিস্ট্রেট। তার সাথে বিয়ে হোক। তারপর ধরে বেঁধে নিয়ে তোমার ওখানে চলে যাব আর শহরে ফিরবো না। আগের দিনের মানুষের মতো মাটির ঘর তৈরি করে সেখানে সংসার করবো।
শ্রেয়সীর কথায় হেলাল সরকার মুচকি হাসে। অনেক রাত পর্যন্ত দুজন গল্প করে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৮

সকালবেলা ফুলগাছে পানি দিতে এসে শ্রেয়সীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সবগুলো টব ভাঙা। ফুলগাছগুলো কেউ কেটে ফেলেছে। শ্রেয়সীর সাজানো বাগান তছনছ করে দিয়েছে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১০