শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪১

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪১
তাসনিম জাহান রিয়া

অবন্তী আমার দুই বছরের জুনিয়র ছিল।আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম তখন ও ক্লাস সেভেনে পড়তো। তখন থেকেই আমাদের প্রণয়ের সূচনা। জানো আমাদের কখনো ফোনে কথা হতো না। আমাদের মাঝে মেসেজ আদান-প্রদান হতো না। কারণ তখন আমাদের পার্সোনাল ফোন ছিল না। আমাদের মাঝে বাক্য বিনিময় হতো চিঠির মাধ্যমে। একসাথে স্কুল থেকে ফিরতাম। দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

অবন্তীর লাজুক হাসি আমি এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে দেখতাম। আমি কলেজে ওঠি আমাদের দেখা হওয়া কমে যায় তবে আমাদের ভালোবাসাটা কমেনি। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার আমরা দেখা করতাম। সারা সপ্তাহ উৎকন্ঠা হয়ে অপেক্ষা করতাম কবে বৃহস্পতিবার আসবে। কলেজে ওঠার ধরুন আব্বু আমাকে একটা বাটন ফোন কিনে দিয়েছিলেন। অবন্তী ওর আম্মুর ফোন দিয়ে লুকিয়ে কল দিয়ে কথা বলতো। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হই ও কলেজে ওঠে। তখন অবন্তির আব্বু ওকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ চলে যায়। তোমার বাবার কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। আমাদের দেখা করাটা কমে যায়। মাসে দুই মাসে একবার দেখা হতো। তবে ফোনে নিয়মিত কথা হতো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারা রাত জেগে মেসেজ করতাম। ফোনে কথা বলতাম না যদি কেউ শুনে ফেলে সেই ভয়ে আর তখন শ্রেয়সী আমার সাথে ঘুমাতো। শ্রেয়সী ছোটবেলা থেকেই আমি বলতে পাগল ছিল। আমাকে ছাড়া ঘুমাতো না খেতো না। অবন্তীর সাথে যখন দেখা করতে যেতাম তখনও শ্রেয়সী আমার সাথে যেতো। দুজনের বেশ ভাব ছিল। শ্রেয়সীর সামনে ফোনে কথা বলতাম না যদি আম্মুকে কিছু একটা বলে দেয় এই ভয়ে। যতই হোক বাচ্চা মানুষ মুখ ফসকে আম্মুকে কিছু বলে দিল আর রক্ষে ছিল না। এখন আমার অবাধ স্বাধীনতা। সারাদিন ফোনে কথা বললেও কারো কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে না। কিন্তু দেখো এখন আর কথা বলার মানুষটাই নেই।

নাহিন নিজের ফোন বের করে একটা নাম্বারের ওপর হাত বুলায়। এই নাম্বার থেকে কোনো কল আসে না আর না আসে কোনো মেসেজ। আমি কল দিলেও কেউ রিসিভ করে না কথাও বলে না। তবুও আমি রোজ রাতে কল দেই। এই নাম্বারে কল না দিলে আমার ঘুম আসে না।
এখানে আমার বাবার অন্যায় কোথায়? আমার বাবা কী করেছিল?

তোমার বাবাই তো সবচেয়ে বড় অন্যায়টা করেছিলেন। আমার ভালোবাসার মানুষটাকে মেরে ফেলেছিলেন। অবন্তীর তখন টেস্ট পরীক্ষা চলছিল। সামনেই এইচএসসি পরীক্ষা। আমি নিজে থেকেই যোগাযোগ কমিয়ে দেই। পড়াশোনার ওপর যথেষ্ট মনোযোগ দিতে বলি। অবন্তী একদিন বলেছিল ওর কলেজের একটা স্যার আকার ইঙ্গিতে বুঝানোর চেষ্টা করে যে ওকে পছন্দ করে। আমি ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে উল্টো ওকে বুঝিয়ে বলি যে, পছন্দ করা তো খারাপ বিষয় না। স্বাভাবিক একটা মানুষকে একটা মানুষ পছন্দ করতেই পারে।

সে যদি তোমাকে বিরক্ত করে তাহলে অন্য কথা। বিরক্ত করলে আমাকে জানাবে তখন আমি বিষয়টা দেখবো। আমাদের মাঝে এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা হয় না। টেস্ট পরীক্ষা শেষে অবন্তীকে নিয়ে কোনো একটা ঝামেলা হয় কিন্তু ও আমাকে জানায় না। হয়তো আমি টেনশন করবো বলেই জানায়নি। আমারো তখন পরীক্ষা চলছিল তাই খবর নিতে পারিনি। মাস দুয়েক পরের ঘটনা সন্ধ্যা সাতটা বাজে অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে কল আসে। আমি সচরাচর অপরিচিত নাম্বার রিসিভ করি না। দুই বার রিং হয় আমি রিসিভ করি না। তৃতীয় বার রিং হতেই জরুরি ফোন ভেবে রিসিভ করি। রিসিভ করতেই একটা গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

অবন্তী তোমার কাছে?
আমার বুঝতে একটুও বাকি থাকে না যে এটা অবন্তীর বাবার গলা। উনার প্রশ্নে আমি একটু হকচকিয়ে যাই। উনার এমন প্রশ্নের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
অবন্তী আমার কাছে থাকবে কেনো? অবন্তী কে? আর আপনিই বা কে?
দেখো ছেলে আমার সাথে নাটক করার চেষ্টা করো না। আমি ভালো করেই জানি অবন্তীর সাথে তোমার সম্পর্ক আছে। এখন ভালোই ভালোই বলে দাও অবন্তী কোথায়?

বুঝতে পারলাম অবন্তীর বাবা সব জেনে গেছে। তাই না লুকিয়ে বলে দিলাম,
আংকেল আজকে সারাদিন অবন্তীর সাথে আমার কথা হয়নি। সন্ধ্যার দিকে ফোন দেই অবন্তী ফোন ধরেনি। অবন্তী কী বাসায় নেই?

অবন্তীকে আজকে বিকেল থেকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবন্তীর বান্ধবীর কাছ থেকে তোমার নাম্বার পেলাম। অবন্তী তোমার কাছে না গেলে আমার মেয়েটা কোথায় আছে? আমার মেয়েটার কোনো বিপদ হয়নি তো?
আংকেল এসব বলবেন না। অবন্তীর কিছু হবে না। আমি অবন্তীর কিছু হতে দিব না। আংকেল আপনি অবন্তীর কলেজের আশেপাশে, অবন্তীর ক্লাসমেটদের বাড়ি আর শিক্ষকদের বাড়িতে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমি আসছি।

বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান সেদিন অবাধ্য হয়েছিল। যে ছেলেটা রাত আটটাই বাসা থেকে বের হওয়ার কথা কল্পনা করতো না। সেই ছেলেটা কাউকে কিছু না জানিয়ে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। আমি যখন শম্ভুগঞ্জে পৌছায় তখন অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে কল আসে। আমি সেকেন্ড বিলম্ব না করে কলটা রিসিভ করি। অতঃপর ভেসে আসে অবন্তীর গলা। নাহিন আমাকে বাঁচাও। অতঃপর ভেসে আসে একটা পুরুষালি কন্ঠস্বর “মেয়ে তোমার সাহস তো কম না। আমার ফোনে হাতে দিয়েছো।” আমি অবন্তীকে তখন অস্থির হয়ে জিঙ্গেস করতে থাকি। অবন্তী তুমি কোথায়? কে তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে? একটা শব্দই আমার কর্ণগোচর হয়, স্যার। তারপর নিস্তব্ধ। আমি কল দেই কিন্তু ততক্ষণে লোকটি ফোন বন্ধ করে দিয়েছিল।

আমি আংকেলকে ফোন করে সবটা জানাই। আংকেল পুলিশ নিয়ে খোঁজতে বের হন। আমি কিশোরগঞ্জ পৌছে আংকেলকে ফোন দিলে আংকেল ফোন রিসিভ করে না। আমি উপায় না পেয়ে অবন্তীর বাসায় চলে যাই। আমি গিয়ে আমার অবন্তীকে পাইনি পেয়েছিলাম অবন্তীর লা/শ। অবন্তীর বাবা সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিল। আমি স্তব্ধ হয়ে দেখেছিলাম এক অসহায় বাবার কান্না। সেদিন এক ফোটা চোখর জলও ফেলেনি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যেদিন ঐ নর/পশুকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারবো সেদিন কান্না করবো।

চিৎকার করে কাঁদবো। পরেরদিন আমি, আংকেল আর পুলিশ অবন্তীর কলেজে যাই। সব শিক্ষকের কন্ঠস্বর শুনি। কারো ভয়েস আমার শোনা ভয়েসের সাথে মিলে না। তোমার বাবা সেদিন ছুটিতে ছিলেন। উনার বিষয়ে কেউ কিছু বলেনি। হয়তো কেউ ভাবতেও পারেনি তোমার বাবার মতো একটা মানুষ এরকম একটা কাজ করতে পারে। হুট করেই একদিন তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়। টাকা দিয়ে তোমার বাবা তদন্ত বন্ধ করে দেয়।

তারপর অনেকগুলো বছর কেটে যায়। শ্রেয়সীকে কলেজের পৌছে দিতে গিয়ে তোমার বাবার সাথে আমার পরিচয় হয়। কন্ঠস্বর চিনতে আমার একটুও অসুবিধা হয় না। আমি তৎক্ষণাৎ কোনো একশন নেইনি কেনো জানো? আমি চেয়েছিলাম উনার দূর্বল জায়গায় আঘাত করে তিলে তিলে মারতে। তাই তোমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করি। তুমি নিজে থেকেই আমার সাথে সম্পর্ক জড়িয়ে যাও। যদি তুমি সত্যি সত্যিই আমার প্রতি দূর্বল থাকতে তাহলে কখনোই আমি তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াতাম না। কিন্তু তুমি তো দূর্বল ছিলে মিহানের ওপর। মিহানকে জ্বালানোর জন্য আমার সাথে নাটক করেছো।
প্রিয়ন্তি ভীতু চোখে নাহিনের দিকে তাকায়। তা দেখে নাহিন আলতো হাসে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪০

আমি এটাও জানি তুই ঐদিন সুইসাইড মিহানের জন্য করেছিলে। তুমি মানতে পারছিলে না মেঘলার সাথে মিহানের বিয়েটা। তবে তোমার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। তুমি যেমন নিজের স্বার্থে আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছো। আমি ঠিক তেমনি নিজের স্বার্থে তোমার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছি। আমার লাইফে অবন্তীর জায়গা কেউ নিতে পারবে না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪২