শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৯

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৯
তাসনিম জাহান রিয়া

জ্ঞান ফেরার পর থেকেই শ্রেয়সী পাগলামি করে যাচ্ছে। তাকে সামলানো যাচ্ছে না। হেলাল সরকার আর অনুপম দুজন মিলে শ্রেয়সীকে সামলাতে পারছে না। শ্রেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে নাহিন। শ্রেয়া বেগম স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। উনার বুঝতে একটুও বাকি নেই যে এই কাজটা কে করেছে। উনার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে একটা মানুষ এতোটা নিচে নামতে পারে। মিরাজ সরকারের অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এখনো অপারেশন চলছে। এর মাঝেই পুলিশ এসে উপস্থিত হয়। অনুপম পুলিশকে বিস্তারিত বলছিল। পুলিশ অনুপমকে প্রশ্ন করে,

স্যার আপনার বা আপনাদের কী কাউকে সন্দেহ হয়?
অনুপম কিছু বলার আগেই শ্রেয়সী বলে ওঠে,
সন্দেহ হয় তো না না আমি একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত আমার আব্বুকে মারার চেষ্টা প্রফেসার বিপুল করেছেন।
এসব কী বলছিস শ্রেয়সী?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

খারাপ লাগছে না তোমার? খারাপ তো লাগবেই হবু শ্বশুর বলে কথা। হবু শ্বশুরের বিরুদ্ধে কথা বললে তো খারাপ লাগবেই। এখনো তো উনারাই তোমার সব। আমরা তো কেউ না। তোমার যা ইচ্ছে তা করতে পারো আমি ঐ লোকটাকে ছাড়বো না। উনাকে উনার পাপের শাস্তি পেতেই হবে।
কী উল্টা পাল্টা কথা বলছিস তুই? মাথা ঠিক আছে তোর? উনি এসব কেনো করতে যাবেন? বাবার সাথে উনার কোনো শত্রুতা আছে? পাগল হয়ে গেছিস তুই।

শ্রেয়া বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শ্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
তুই যে ব্যাপারে জানিস না সে ব্যাপারে কথা বলবি না নাহিন। অফিসার আমি প্রফেসার বিপুলের বিরুদ্ধে কেইস করবো। এটেম টু মার্ডার কেইস।
নিতু, মুহিব আর মিহান দৌড়ে আসে শ্রেয়সীর কাছে।
শ্রেয়সী আংকেলের এখন কী অবস্থা?
জানি নারে। এখনো কোনো খবর পাইনি।

ডক্টর বেরিয়ে আসে অপারেশন থিয়েটারে থেকে। সবাই ছুটে যায় ডক্টরের কাছে।
আমার আব্বু এখন কেমন আছে? আমার আব্বু ভালো হয়ে যাবে তো?
আপনি শান্ত হন ভাবি। অপারেশন সাকসেসফুল। তবে উনার জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত আমরা কিছু বলতে পারবো না। উনি তো বহু রোগে আক্রান্ত। তাই উনার লাইফ রিস্কটা বেশি। নাহলে এধরনের ইনসিডেন্টে রোগীর অবস্থা এতোটা জটিল হয় না।
ডক্টর চলে যায়। শ্রেয়সী ধপ করে সোফায় বসে যায়। নাহিন শ্রেয়সীকে ধরতে গিয়েও ধরে না। কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল তাকে আটকে দিচ্ছে। চাইলেও পারছে না শ্রেয়সীর কাছে যেতে।

তন্ময় অস্থির হয়ে সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়। অনন্যা খেয়াল করেছে ফোন আসার পর থেকেই তন্ময় অস্থির হয়ে গেছে। হুট করে এভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সবাই তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তন্ময় যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তন্ময়ের বাবা পিছন থেকে ডেকে ওঠে,
কোথায় যাচ্ছো তন্ময়?
হসপিটালে যাচ্ছি আব্বু। শ্রেয়সীর আমাদের প্রয়োজন।
অনন্যার বাবা গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

তুমি এভাবে যেতে পারো না। আমার মেয়েকে দেখতে এসে হুট করে তুমি অন্য মেয়ের জন্য অনুষ্ঠানের মাঝখানে চলে যাবে, এটা
আমি মেনে নিব না। এটা করলে আমার মেয়েকে অপমান করা হবে। তুমি যদি এখন এখান থেকে চলে যাও তাহলে তোমার সাথে কোনোদিন আমার মেয়ের বিয়ে দিব না।
তন্ময় অসহায় ভাবে অনন্যার দিকে তাকায়। অনন্যা বুঝতে পারে খারাপ কিছু হয়েছে নাহলে তন্ময় এতোটা অস্থির হয়ে পড়তো না।

তুমি হসপিটালে যাবে কেনো? শ্রেয়সী আপুর কিছু হয়েছে?
শ্রেয়সীর কিছু হয়নি। তবে আংকেলের গুলি লেগেছে। কেউ আংকেলকে মারার চেষ্টা করেছিল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এই হাসিখুশি মানুষটা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। আংকেল আমাদের বিপদে আপদে সবসময় বন্ধুর মতো পাশে থেকেছে। আজকে উনার এতো বড় বিপদে আমি উনার পাশে থাকতে পারছি না। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে।
কে বলেছে তুমি পাশে থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। আব্বুর কথায় তুমিও থেমে যাচ্ছো?বন্ধুর বিপদে তুমি তাঁর কাছে যাচ্ছো না। আমাদের যে এই বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে সেটা তোমার বন্ধুদের জন্য। তুমি তো অমি ভাইয়াকে আমাদের ব্যাপারে কিছু বলোনি।

অমি ভাইরা তোমার আর আমার ব্যাপারে এমনি এমনি সব জেনে গেছে? এখানেও তোমার বন্ধুদের হাত আছে। সরাসরি না বললেও পরোক্ষভাবে অমি ভাইয়াকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে। অমি ভাইয়া বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পরই কী আব্বু বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে? উহু এটাও করেছে তোমার বন্ধুরা। আব্বুর হাতে পায়ে ধরে তোমার সাথে আমার বিয়ে দিতে অনুরোধ করে গেছে। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। হাতের ধন কখনো পায়ে ফেলো না। পরে আফসোস করবে।

তুমি হসপিটালে যাবে আর সাথে আমিও যাব। এখনি চল। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাবে না।
কাউকে তোয়াক্কা না করে অনন্যা তন্ময়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসে। তন্ময় বাইক স্টার্ট দেয় অনন্যা শক্ত করে তন্ময়ের কাধ চেপে ধরে।
আমার বন্ধুরা এমন হারামি। তলে তলে এতকিছু করলো আমাকে কিছু জানাইনি পর্যন্ত। শালার আমি কিছু বুঝতেই পারলাম।
আমিও কিছু জানতাম না। আমাকে সবটা অমি ভাইয়া বলেছেন।

দীর্ঘ সাত ঘন্টা পর মিরাজ সরকারের জ্ঞান ফিরে। সবাই যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে। এতক্ষণ যেনো সবার শ্বাসটা গলায় আটকে ছিল। সাত ঘন্টা সবার কাছে সাত বছরের মতো মনে হয়েছে। প্রতিটা মিনিট সবার ভয়ে ভয়ে কেটেছে। এই বুঝি কোনো খারাপ খবর আসলো।

এরপরের সময়গুলো খুব দ্রুত কেটে গেলো। প্রিয়ন্তি বাবা পলাতক। উনার কোনো সন্ধান পুলিশ পায়নি। মিরাজ সরকার সুস্থ হয়ে উঠলেন। তন্ময় আর অনন্যার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। আপাতত তন্ময় আর অনন্যা আকদ হবে। পরে তন্ময়ের পড়াশোনা শেষ হলে অনন্যাকে বড় করে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। শ্রেয়সী আর অনুপমের সম্পর্ক আগের মতোই সুন্দর আছে। নাহিন আর প্রিয়ন্তির সম্পর্কটা যেনো ঠিক হতে গিয়েও হয়নি।

জ্ঞান হারানো মেয়ের কী হয়েছে? আজকে এতো চুপচাপ কেনো?
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আপনি বুঝতে পারছেন না আমি অভিমান করেছি?
এই না একদম অভিমান করবে না। মেয়েরা অভিমান করলে আমি ভীষণ ভয় পাই। মেয়েদের অভিমান হয় ভীষণ ভয়ঙ্কর। তারা একজনের সাথে অভিমান করে আরেকজনকে বিয়ে করে ফেলতে পারে।
শ্রেয়সী অনুপমের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়।

এভাবে তাকাচ্ছো কেনো? আমি কিন্তু একটা শব্দও মিথ্যে বলিনি। তুমি যদি অভিমান করে বিয়ে করতে চাও কোনো অসুবিধাই হবে না। তোমার জন্য পাত্র তো রেডিই আছে। তোমার প্রফেসার।
শ্রেয়সী রেগে গিয়ে আলতো হাতে অনুপমের সাথে বাহুতে থাপ্পড় দেয়। অনুপম বুঝতে পারছে শ্রেয়সী ভীষণ রেগে যাচ্ছে। দেখা যাবে রেগে গিয়ে এখনি কেঁদে দিবে। অনুপম কান ধরে বলে,

সরি জ্ঞান হারানো মেয়ে আর মজা করবো না। রাগ করো না প্লিজ। চলো তোমাকে ভার্সিটিতে পৌছে দিয়ে আসি।
অনুপম শ্রেয়সীকে ভার্সিটি পৌছে দিয়ে চলে যায়। শ্রেয়সী গিয়ে ক্যান্টিনে বসে। আস্তে আস্তে সবাই চলে আসে। তন্ময় আসতেই সবাই একসাথে বলে ওঠে,
মামা ট্রিট কবে দিবা?

শালা তোরা ট্রিট চাস? লজ্জা করে না? তলে তলে সব সেটিংস করে ফেললি আর আমাকে কিছু জানালি না। এদিকে আমি প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেই বিরহে দেবদাস হয়ে যাচ্ছিলাম।
একেই বলে জাতে মাতাল তালে। এতো কষ্ট করে সবকিছু করলাম এখন আমাদেরই গালি দিচ্ছে।
নিতু কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে,

এই কিপ্টার কাছ থেকে ট্রিট পাওয়ার আসা বাদদে। শালা কী পরিমাণ কিপ্টা দেখ আমাদের একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিল না। এই কিপ্টার কথা বাদ দে। তোরা কী জানিস আমাদের মিহানের মনের ঘরে এখন ষোড়শী কন্যার আনাগোনা?
ইভা মিহানের চুলে হাত চালিয়ে দিয়ে বলে,

কী ব্যাপার মিহান বাবু তলে তলে তলে এতদূর আর আমরা কিছু জানি না?
আমার মনের ঘরে শুধু একজনের আনাগোনা। অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ।
সে তো আর নেই। কোনোদিন আর ফিরে আসবে না। সেটা সম্ভবও না।
তোকে কে বললে শ্রেয়সী সে নেই? সে তো আছে আমার মনের মণিকোঠায় আর চিরকাল থাকবেও। অন্য কারো ঠায় হবে না সেখানে। অল্প বয়সী মেয়ে আবেগে ভাসছে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৮

এরকম আবেগে ভেসে আমাকে কেউ কেনো ভালোবাসে না? আমার এতো কষ্ট কোথায় রাখবো?
মুহিব আলতো হেসে বলে,
অনন্যাকে একটা কল দেই। সেই তোর এতো এতো কষ্ট রাখার ব্যবস্থা করে দিবে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪০