শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৮

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৮
তাসনিম জাহান রিয়া

এখন আর আম্মুর প্রতি আমার কোনো অভিমান নেই, কোনো অভিযোগ নেই। সবারই তো ভালো থাকার অধিকার আছে। যে সবসময় অন্য মেয়ের কথা ভাবে, ঐ মেয়েকে ভালোবাসে এমন একটা স্বামী তো কেউ চায় না। সবাই তো স্বামীর ভালোবাসা চায়।

সব মেয়ে তো চায় তার স্বামী শুধু তাকেই ভালোবাসবে। আমার আম্মু তো তাদের থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। আব্বুর কাছ থেকে যা পায়নি অন্য একজনের কাছ থেকে তা পেয়েছে। তাই তো তার কাছে চলে গেছে।
আগে আমি ভাবতাম আব্বু অন্য কাউকে ভালো না বাসলেও আমাকে বাসেন। কিন্তু উনি আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন। উনি একমাত্র আন্টিকেই ভালোবাসেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তুই ভাবিস না আবার আমার আন্টির ওপর রাগ আছে। আমি সবকিছু হারিয়ে নাহিনকে আকঁড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনি আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিলেন। হুট কর এমনি এক দুপুরবেলা বলেন তোর আর নাহিনের সম্পর্কে ফাঁটল ধরাতে। তোদের দুজনের বিরুদ্ধে দুজনের মনে এমন বিষ ঢুকিয়ে দিতে যেনো দুজন দুজনের নাম শুনলেও সাপের মতো ফোঁস করে ওঠিস।

আমি রাজি হয়নি। আমি চায়নি তোদের ভাই বোনের এতো সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হোক। তোদের দুজনের প্রতি দুজনের টান, কেয়ার দেখতে ভীষণ ভালো লাগতো। বার বার মনে হতো আমার এমন একটা বড় ভাই থাকলে হয়তো আমাকেও এমন কেয়ার করতো। আমি রাজি না হওয়াতে উনি আমাকে হুমকি দেন যে উনি নাহিনের ক্ষতি করে দিবে। আমি একটু ভয় পেয়ে যাই। তবুও উনার কথায় আমি রাজি হই না। আমি ভাবলাম নাহিনের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিলেই হয়তো সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে। ভাবনা অনুযায়ী আমি নাহিনের সাথে ব্রেকআপ করে ফেলি।

কিন্তু উনি আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নাহিনের ক্ষতি করে দিলেন। নাহিনের এক্সিডেন্ট করিয়ে দিলেন। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভয় পেয়ে উনার কথায় রাজি হয়ে যায়। উনার কথা মতো আমি তোর আর নাহিনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করি। তোর সামনে নাহিনকে আরো খারাপ প্রমাণ করার জন্য উনি আমার সম্পর্কে তোর কাছে ভালো ভালো কথা বললেন। আমার অসহায়ত্বের কথা বললেন।

আমাকে ক্ষমা করে দিস শ্রেয়সী। আমার জন্য তোদের ভাই বোনের এতো সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলো। তুই ক্ষমা করে দিলেও আল্লাহ্ হয়তো আমাকে ক্ষমা করবেন না। দেখ না নাহিন সব জেনে গেলো। আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে তোদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছি। নাহিন আমাকে অনেক বিশ্বাস করেছিল আমি ওর মনটা ভেঙে দিলাম। মন ভাঙা মসজিদ ভাঙার সমান। তাই হয়তো আল্লাহ্ আমাকে কোনো মরনব্যাধী রোগে দিয়েছেন। আমার মনে হয় আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না।

একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবি না। তোর তেমন কিছু হয়নি। শুধু সামান্য জ্বর হয়েছে। তুই একদম চিন্তা করিস না আমি সব ঠিক করে দিব। উনি যতই আম্মুর প্রতি ভালোবাসা দেখান না কেনো। আমার মনে হয় না উনার মতো মানুষ কাউকে ভালোবাসতে পারে।

আম্মুর প্রতি এখন যা আছে সবটাই উনার রাগ, জেদ। প্রতিশোধের আগুনে উনি নিজেও জ্বলছেন সাথে আশেপাশের মানুষকেও পুড়াচ্ছেন। একদম চিন্তা করবি না আমরা আছি না তোর পাশে। নিজের খেয়াল রাখবি। আমাকে একটু যেতে হবে। নিতু আর ইভা তোর কাছে থাকবে। আমি আসছি।
ইভা ঔষধ নিয়ে ফিরতেই শ্রেয়সী হল থেকে বেরিয়ে আসে। হলের নিচেই তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে।
এই তন্ময় বাইক নিয়ে আসছিস?

হ্যাঁ।
আমাকে একটু বাসায় পৌছে দিয়ে আই তো।
এখনি চলে যাবি?
হ্যাঁ। একটু আর্জেন্ট। এখনি যেতে হবে। মিহান আর মুহিব আসেনি?
মিহান আর মুহিব পুলিশ স্টেশনে গেছে। মেঘলার আপুর হত্যার পিছনে যার হাত তাকে নাকি পুলিশ ধরে ফেলেছে। আচ্ছা চল তোকে পৌছে দিয়ে আসি।

তন্ময় বাইক স্টার্ট দিতেই শ্রেয়সী তন্ময়ের বাইকের পিছনে ওঠে বসে।
অনন্যার কী খবর? এতো এতো ঝামেলার মাঝে এই খবরটা আর নেওয়াই হয়নি।
অনন্যার বিয়েটা ভেঙে গেছে। ছেলে নিজে এসে বিয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে।
এটা তো খুশির খবর। তাহলে তুই এতো মনমরা হয়ে আছিস কেনো?

খুশি হয়ে তো লাভ নেই। আমি তো জানি এই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। এই বিয়ে ভেঙে গেছে বলে কী অনন্যার বাবা বসে থাকবে? দুই দিন পরেই দেখা যাবে আরেকটা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসছে।
তুই মন খারাপ করিস না। দেখবি যা হবে ভালো হবে। আল্লাহ্ ওপর বিশ্বাস রাখ। তিনিই সব ঠিক করে দিবেন। তন্ময় তোর ফোন বাজছে।

তন্ময় বাইক সাইডে রেখে ফোন রিসিভ করে। অনন্যা কল করেছে। খুবই সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা হয়। তবুও খুশিতে তন্ময়ের চোখ-মুখ চকচক করতে থাকে।
শ্রেয়সী অনন্যার বাবা আমাদের বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে। উনি অনন্যাকে বলেছেন আমি যেনো আজকেই বিয়ের কথাবার্তা বলার জন্য আমার বাবা-মাকে নিয়ে উনাদের বাসায় যাই।
এটা তো খুশির খবর। তুই অপেক্ষা করছিস কেনো এখনি যা। এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করিস না।

তুই যাবি না? বাকিরা যাবে না?
আমার এখন বাসায় যাওয়াটা বেশি প্রয়োজন। আমরা কী অনন্যাকে দেখি নাই? দেখেছি তো, তাহলে নতুন করে দেখার কী আছে? এতো মানুষ মিলে মেয়ে দেখতে যাওয়ার তো কোনো মানে হয় না। বরং মেয়েটার অস্বস্তি হয়, নিজেকে সস্তা মনে হয়। আজকে অনন্যাকে দেখতে যাবে তোদের বাড়ি থেকে অনন্যার সম্মান রক্ষা করা কিন্তু তোর দায়িত্ব। অনন্যা যেনো কোনো কিছুতে অস্বস্তি ফিল না করে, নিজেকে ছোট মনে না করে সেদিকে খেয়াল রাখবি। এখন আর সময় নষ্ট করিস না।

তোকে পৌছে দিয়েই বাসায় যাব। আব্বু-আম্মুকে নিয়েই অনন্যাদের বাসায় যাব।
আমাকে পৌছে দিতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো।
তন্ময় একটা রিকশা ডেকে শ্রেয়সীকে তুলে দেয়। তন্ময় শ্রেয়সীর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। শ্রেয়সী রিকশা দিয়ে যেতে যেতে বাকি বন্ধুদের এই খুশির খবরটা দিয়ে দেয়।

শ্রেয়সী নিজের বাসার সামনে না নেমে বাজারে নেমে যায়। কিছু ঔষধ কিনে বাজার থেকে বের হতেই চমকে ওঠে। মিরাজ সরকার রাস্তা পার হচ্ছেন এবং তার দিকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে একটা ট্রাক। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই মিরাজ সরকারের উনি হয়তো ট্রাকটাকে খেয়াল করেননি।

দুপুর হওয়ায় রাস্তায় তেমন মানুষ নেই। শ্রেয়সী মিরাজ সরকারকে ডাকা শুরু করে। গাড়ির তীব্র আওয়াজে শ্রেয়সী ডাক মিরাজ সরকারের কর্ণগোচর হয়নি। ট্রাকটা মিরাজ সরকারের কাছে আসতেই শ্রেয়সী একটা চিৎকার দিয়ে নিচে বসে পড়ে।

কিন্তু পরমুহূর্তেই অনুপম এসে মিরাজ সরকারকে টেনে সরিয়ে নেয়। এটা দেখে শ্রেয়সী মিরাজ সরকারের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই একটা বুলেট এসে মিরাজ সরকারের বুকের মাঝ বরাবর এসে লাগে। গুলিটা করেছে ট্রাকের ভিতর থাকা কেউ একজন। এটা দেখে শ্রেয়সী দাঁড়িয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার সাইডে পড়ে যায় শ্রেয়সী। অনুপম স্তব্ধ হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কী থেকে কী হয়ে গেলো কিছুই তার বোধগম্য হলো না।

অনুপম কী করবে ভেবে পাচ্ছে না? দিশেহারা হয়ে পড়ে। এদিকে মিরাজ সরকারের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেছে। শ্রেয়সী জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার সাইডেই পড়ে আছে। এদিকে মানুষের ভীড় জমে গেছে। কিন্তু কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৭

অনুপমের শুভ্র রাঙা শার্টটা রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। অনুপম সাহায্য চাইতেই অল্প বয়স্ক কয়েকটা ছেলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। একটা প্রাইভেটকার ডেকে নিয়ে আসে। মিরাজ সরকারকে প্রাইভেটকারে তুলে দেয়। অনুপম কোলে করে শ্রেয়সীকে প্রাইভেটকারে তুলে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৯