শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৭

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৭
তাসনিম জাহান রিয়া

কফিশপের একটা টেবিল জুড়ে বসে আছে শ্রেয়সীর মা আর প্রিয়ন্তির বাবা। শ্রেয়সীর থেকে কয়েক হাত দূরেই সেই টেবিলের অবস্থান। অস্পষ্ট কিছু কথার আওয়াজ শ্রেয়সীর কানে আসছে।
এতো বছর পর আবার আমার পিছনে হাত ধুয়ে পড়ার কারণ তো আমি বুঝতে পারছি না বিপুল ভাই।

বুঝতে না পারার তো কোনো কারণ নেই শ্রেয়া। আমি তো কখনোই তোমার পিছু ছাড়িনি শ্রেয়া। বরং তুমিই আমাকে কখনো দেখেও দেখোনি। সব সময় আমাকে ইগ্নোর করে গেছে। আমার মাঝে কীসের কমতি ছিল শ্রেয়া? মিরাজের থেকে কোনো অংশে তো আমি কম ছিলাম না বরং সবসময় আমি মিরাজের থেকে এগিয়ে ছিলাম। দেখতে মিরাজের থেকে অনেক বেশি সুদর্শন ছিলাম। তবুও তুমি আমাকে বিয়ে না করে মিরাজকে বিয়ে করলে। কেনো শ্রেয়া? কেনো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাহিনের আব্বুর একটা সুন্দর মন আছে যেটা আপনার নেই বিপুল ভাই। শুধু দেখতে সুন্দর হলেই হয় না চরিত্রও সুন্দর হতে হয়। নাহিনের আব্বু আমি ছাড়া দ্বিতীয় নারীর দিকে কখনোই ফিরেই তাকায় না আর আপনি ঘরে বউ রেখে আরেকজনের বিবাহিত স্ত্রীর পিছনে পড়ে আছেন। বাইরে নজর না দিয়ে ঘরে নজর দিন সংসার সুন্দর হবে। আমার সাজানো গোছানো সংসারের দিকে হাত বাড়াতে আসবেন না। হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলে সেই হাত ভেঙে আমি গুড়িয়ে দিব।

শ্রেয়া বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শ্রেয়া বেগমকে দাঁড়াতে দেখে শ্রেয়সী আড়ালে চলে যায়।
তোমার সাজানো গোছানো সুখের সংসার আমি তছনছ করে দিব। আমি ভালো না থাকলে তোমাকেও ভালো থাকতে দিব না। তোমাকে যে আমি কোন দিক দিয়ে আঘাত করবো সেটা তুমি বুঝতেও পারছো না।

শ্রেয়া বেগম কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় পরমুহূর্তে দ্রুত পা ফেলে কফিশপ থেকে বেরিয়ে যান। কিয়ৎক্ষণ পর প্রিয়ন্তির বাবাও চলে যায়। শ্রেয়সীর কাছে পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে গেছে। প্রিয়ন্তির বাবার কেনো এতো তাদের ওপর রাগ তার কারণটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রিয়ন্তির মা চলে গেছে বা মিরাজ সরকার সাহায্য করেছে এটা উনার রাগের কারণ না। বরং উনি শ্রেয়া বেগমকে বিয়ে করতে পারেননি এটার জন্য প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছেন।

কাঁধের ওপর কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে শ্রেয়সী। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে অনুপম দাঁড়িয়ে আছে। অনুপমকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
কী ব্যাপার শ্রেয়সী? ভয় পেলে নাকি?
হুট করে এসে ছুঁয়ে দিয়েছেন তাই একটু চমকে গিয়েছিলাম।
কখনো আসছো? চলো আগে বসি।
কিছুক্ষণ আগেই আসছি।

তোমাকে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে? কিছু হয়েছে? কোনো ব্যাপার নিয়ে টেন্সড?
শ্রেয়সী বলবে নাকি বলবে না ভাবছে। আমতা আমতা করছে। ভাবলো অনুপমকে বলে দিবে। বললে মনটা একটু হালকা হবে। তার সামনে বসা পুরুষটাকে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। সে কখনোই অন্যের দূর্বলতা নিয়ে মজা উড়াবে না। অন্যের দূর্বল জায়গায় কখনোই আঘাত করবে না। অনুপম শ্রেয়সীর হাতের ওপর হাত রাখে। শ্রেয়সী একটু ভরসা পায়। শ্রেয়সী অনুপমের চোখের দিকে এক পলক তাকায়। তারপর নির্দ্বিধায় সব বলে দেয়। সব শুনে অনুপম কিছুক্ষণ ভাবে।

তুমি প্রিয়ন্তির সাথে সরাসরি কথা বলো এই ব্যাপারে। তবে তুমি আলাদা ভাবে একা কথা বলবে।
প্রিয়ন্তি খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। ওকে যতই প্রশ্ন করি না কেনো কোনো কিছুর উত্তর দিবে না।
প্রিয়ন্তি এখন যে মানসিক অবস্থা একটু ফোর্স করলেই সব বলে দিবে। এটা আমার বিশ্বাস। চিন্তা করো না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ সব ঠিক হয়ে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব প্রিয়ন্তির সাথে এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলো।
আচ্ছা।

মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় অনন্যার বাবার মাথায় হাত। প্রেসার বেড়ে হাই হয়ে গেছে। হুট করে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ তিনি বুঝতে পারছেন না। এই তো কিছুক্ষণ আগেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সবটা পাল্টে গেলো। অমির বাবা ফোন করে খুব বিনয়ে সাথে বলে দিয়েছেন এই বিয়েটা হবে না। উনার ছেলের অনন্যাকে পছন্দ হয়নি। এই কথা অনন্যার বাবার একটুও বিশ্বাস হয়নি। উনার মেয়েকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই। এমন মেয়ে লাখে একটাই পাওয়া যায়। উনি অমির চোখে অনন্যার জন্য মুগ্ধতা দেখতে পেয়েছেন। উনার দৃষ্টিশক্তি ভীষণ প্রখর। উনার চোখ কখনো ভুল দেখতে পারে না।

উনি সরাসরি অমিকে ফোন দেন। রিং হওয়ার কয়েক সেকেন্ডর মাঝেই ফোন রিসিভ হয়। অমি যেনো উনার ফোনেরই অপেক্ষায় ছিল। উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অমিই বলা শুরু করে।
আংকেল আপনি হাইপার হবেন না। আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। সবকিছু ফোনে বলা সম্ভব না। যা বলার আমি আপনাকে সামনাসামনি বলবো। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই আমি আপনাদের বাসায় আছে।

অমি ফোন কেটেই অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। এতকিছুর মাঝে অনন্যা নিশ্চুপ। তাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে না বিয়ে ভেঙে গেছে বলে তার খারাপ লাগছে নাকি ভালো লাগছে। নিষ্পাণের মতো নিজের রুমে বসে আছে। সে জানে এই বিয়ে ভেঙে গেলেও তার সাথে তন্ময়ের বিয়ে কখনোই হবে না। দেখা যাবে আগামীকালই তার বাবা আরেকটা পাত্রপক্ষ নিয়ে তার সামনে হাজির হবে।

আধ ঘন্টার মাঝেই অমি এসে অনন্যাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়। অনন্যার বাবা অমিকে দেখে রাগ দেখাতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে চুপ করে গেলেন। অমি শান্ত ভাবে এসে সোফায় বসে এক গ্লাস পানি খায়।
আংকেল আমি শুনছি আপনার আর আন্টির নাকি প্রেমের বিয়ে?

অমির কথা শুনে অনন্যার বাবা চমকে ওঠে। হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতীত আর কেউ এই কথাটা জানে না। ইনফ্যাক্ট এতো বছরে অনন্যা পর্যন্ত জানতে পারেনি। এসব কথা সন্তানরা জানলে তাদের সাহস বেড়ে যায় এটা উনার ধারণা।
অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি সবকিছু জেনেই অনন্যাকে দেখতে এসেছিলাম। শুধু এইটুকু জানতে পারিনি অনন্যার একজন ভালোবাসার মানুষ আছে।

জানলে আমি কখনোই অনন্যাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হতাম না। কিন্তু একটা বিষয় আমার ভাবতেই অবাক লাগছে অনন্যা একজনকে ভালোবাসে এটা জানার পরও আপনি অনন্যাকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। আপনার কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না। আপনিও তো একজনকে ভালোবেসেছেন। সেই মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কী কী করেছেন সেটা তো আপনার থেকে ভালো কেউ জানে না।

ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট একটু হলেও আপনি অনুভব করেছিলেন। তারপরও আপনি কীভাবে নিজের মেয়েকে সেই একই কষ্ট সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর জন্য ঠেলে দিচ্ছেন? আপনার হয়তো ভাবছেন তন্ময় বেকার, এমন বেকার ছেলের হাতে কীভাবে নিজের মেয়েকে তুলে দিবেন?

তন্ময় কিন্তু সারাজীবন বেকার থাকবে না। তন্ময় ভালো স্টুডেন্ট পড়াশোনা শেষে একটা না একটা চাকরি ঠিক পেয়ে যাবে। কিন্তু আপনি যদি জোর জবরদস্তি করে অনন্যা বিয়ে ঠিক করলেন। অনন্যা কোনো উপায় না পেয়ে সুইসাইড করলো।

একবার কল্পনা করে দেখুন তোলাল বেনারসিতে না সাদা কাফনের কাপড় পড়ে কেমন দেখাবে? পারবেন তো বাবা হয়ে নিজের সন্তানের লাশ কাঁধে নিতে? আমি আর কিছু বলবো না। ভাবুন আপনি। দেখুন আপনার বিবেক কী বলে। আজ তাহলে আমি আসি। আসসালামু আলাইকুম।
অমি আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে যায়।

দুই দিন পরের ঘটনা ব্যস্ততার কারণে শ্রেয়সীর আর প্রিয়ন্তির সাথে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। গ্রাম থেকে হেলাল সরকার এসেছে। নিজের জেঠুকে কাছে পেলে তো দুনিয়ার বাকি সবকিছু ভুলে যায় শ্রেয়সী। সকালবেলা শ্রেয়সী নাস্তা করছিল এর মাঝেই শ্রেয়সীর ফোনটা বেজে ওঠে। নীতু কল করেছে। প্রিয়ন্তি ভীষণ অসুস্থ। দুই দিন ধরেই প্রিয়ন্তিকে অসুস্থ দেখাচ্ছিল। গতকাল রাত জ্বরে কাহিল অবস্থা। শ্রেয়সী খাবার রেখে ওঠে পড়ে। হাত ধুয়ে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।

মাঝরাস্তায় ইভার সাথে দেখা হয়ে যায়। দুই জন একসাথে রওনা দেয়। ইভা আর শ্রেয়সী যখন পৌছায় তখন প্রিয়ন্তি ঘুমাচ্ছে। ইভা বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই ডক্টরকে ফোন করে বলে দিয়েছিল। তারা আসার আগেই প্রিয়ন্তিকে ডক্টর দেখে গেছেন। প্রিয়ন্তির জ্বর অনেকটাই কম। নীতু সারা রাত জেগে প্রিয়ন্তির কপালে জল পট্টি দিয়েছে। শ্রেয়সী নীতুকে ঘুমানোর জন্য পাঠিয়ে দেয়। ইভা মুহিবের সাথে ঔষধ আনতে গেছে।

শ্রেয়সী প্রিয়ন্তির পাশে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই প্রিয়ন্তি পিট পিট করে চোখ খুলে। শ্রেয়সী প্রিয়ন্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। প্রিয়ন্তিকে ওঠে বসতে সাহায্য করে শ্রেয়সী।
প্রিয়ন্তি?
হু।

তোর বাবা তোকে কী বলেছে? কী বলে ভয় দেখিয়েছেন উনি?
কী বলবে? আমাকে কেনো ভয় দেখাবে?
প্রিয়ন্তি আমার কাছ থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করিস না। আমি সবটা জানি। তোর বাবা নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রতিনিয়ত তোকে ব্যবহার করছে।

প্রিয়ন্তি কতক্ষণ শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে। অতঃপর শ্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
শ্রেয়সী আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। আমার তো বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই। আমি মরে গেলেই হয়তো সবাই মুক্তি পাবো।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৬

নিজের থেকেও বেশি যাকে ভালোবাসলাম। সেই মানুষটা নিজের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে ব্যবহার করছে। জানিস ঐ মানুষটাকে আমার বাবা বলতেও ঘৃণা হয়। উনি এমন একটা মানুষ যিনি না হতে পেরেছেন ভালো সন্তান না স্বামী আর না বাবা। এক সময় আমার মায়ের প্রতি ভীষণ অভিমান হতো।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৮