শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৬

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৬
তাসনিম জাহান রিয়া

শ্রেয়সী নিঃশব্দে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসে। ফ্ল্যাটের বাইরে একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। শ্রেয়সী ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে আসে। নিঃশব্দে অর্ধখোলা দরজাটা খুলে ছাদে প্রবেশ করে। ছাদে উঠার সিঁড়িটা যতোটা অন্ধকার ছাদের ভিতর ততোটাই আলোকিত। শ্রেয়সী গোল গোল চোখে তাকায় ছাদের শেষ প্রান্তে। ছাদের শেষ প্রান্তে রেলিংয়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে অনুপম। শ্রেয়সীর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠে। হালকা ধাক্কা লাগলেই অনুপম একদম নিচে পড়ে যাবে। অনুপম শ্রেয়সীর প্রতি যতটা যত্নশীল নিজের প্রতি ততোটাই উদাসীন। শ্রেয়সী অনুপমের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই খুব সূক্ষ্ম নজরে খেয়াল করেছে অনুপম বাইরের মানুষের সামনে যতোটা গোছানো নিজের আপন মানুষের কাছে ততোটাই অগোছালো।

নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে শ্রেয়সী। তার দৃষ্টি এলোমেলো। অনুপম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রেয়সীর দিকে। অগোছালোভাবে কপালের ওপর পড়ে আছে কিছু চুল। শ্রেয়সী অনুপমের সামনে দাঁড়িয়ে অনুপমের কপালে অবিন্যস্তভাবে পড়ে থাকা চুলগুলো গুছিয়ে দেয়। হাত সরিয়ে নিতে চাইলে অনুপম খপ করে শ্রেয়সীর হাতটা ধরে ফেলে। শ্রেয়সীর হাতটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে শ্রেয়সীর চোখের দিকে তাকায়। দৃষ্টি বিনিময় হয় কিয়ৎক্ষণ। অনুপম শ্রেয়সীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এইখানটা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে থাকে তোমাকে এক পলক দেখার জন্য। তুমি কী বুঝো না প্রতিটা মুহূর্ত হাঁসফাঁস করতে থাকি তোমাকে এক পলক দেখার জন্য? কেনো এতো অবহেলা করো? কেনো এতো কষ্ট দাও?
শ্রেয়সী নিশ্চুপ, তার কাছে অনুপমের প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। সত্যিই তো সে অনুপমকে বড্ড বেশি অবহেলা করছে। লাফিয়ে রেলিংয়ের ওপর থেকে নামে অনুপম। আচমকাই শ্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়সী শরীর শিরশির করে উঠে। প্রথম বারের মতো অনুপম তাকে জড়িয়ে ধরলো? হ্যাঁ, প্রথম বারের মতো। এর আগে কখনো অনুপম তার এতোটা কাছে আসে নাই। হাত ধরাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে হাত ধরাটাও ছিল পরিস্থিতি সাপেক্ষে। শ্রেয়সীর গাল জুড়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে। অনুপম খুব শক্ত করে শ্রেয়সীর মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। শ্রেয়সীর মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,

তুমি আমার জীবনে কাঠফাটা রোদ্দুরে এক পশলা বৃষ্টির মতো। যা এক মুহুর্তের জন্য এসে আমার হৃদয়কে শীতল করে দেয়। কিন্তু আমি তো চাই তুমি আমার জীবনে কাঠফাটা রোদ্দুরে এক পশলা বৃষ্টির মতো না বর্ষাকাল হয়ে আসো।
শ্রেয়সী প্রতিত্তরে কিছু বলে না তবে শক্ত করে অনুপমের বুকের কাছের টি-শার্টটা আকঁড়ে ধরে।

মিহানের ঘুম থেকে উঠার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। সে সকাল পাঁচটাই ঘুম থেকে উঠতে পারে আবার বেলা বারোটা পর্যন্তও ঘুমাতে পারে। চোখের ওপর সূর্যের আলো পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো মিহানের। সবে সকাল ছয়টা বাজে। রাতে জানালার পর্দা টেনে না দেওয়ার ফল এটা। সকাল সকাল মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো মিহানের। শরীরের ওপরের কাথাটা পা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ওঠে বসলো। হাই তুলে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গেলো সকালের জন্য হালকা নাস্তা তৈরি করতে। মিহান নিজের বাসায় আর থাকে না। তিন রুম বিশিষ্ট এই এতো বড় ফ্ল্যাটটা মিহান একা থাকে। মাঝে মাঝে মুহিব আর তন্ময় আসে।

চায়ের জন্য গরম পানি চুলায় বসাতেই কলিংবেল বেজে ওঠে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে যায় মিহানের। কাজের সময় ডিস্টার্বনেস তার একদম পছন্দ না। আজকাল মিহানের সবকিছুই বিরক্ত লাগে। কিছু কিছু মানুষকে দেখতেই ইচ্ছে করে না। তারা যদি মিষ্টি করে হেসে বলে, মিহান ভালো আছো? তখন মিহানের কাছে এর থেকে বেশি বিরক্তিকর আর কিছুই মনে হয় না। মিহান জানে তার বিরক্তির একটা জিনিস দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মিহান দরজা খুলেই কোনো দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

কী চাই?
মিহানের আকস্মিক প্রশ্নে ভয় পেয়ে যায় দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ষোড়শী কন্যা। মিহান আবারও একই প্রশ্ন করায় মেয়েটা অস্বস্তি নিয়ে হাতে থাকা টিফিন বক্সটা মিহানের দিকে বাড়ি দেয়। অতঃপর ভীত কন্ঠে বলে,
এটা আম্মু আপনার জন্য পাঠিয়েছে।
মিহান বক্সটা হাতে নিয়ে কিছু না বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়। এভাবে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় ষোড়শী কন্যার অভিমান হয় অভিমানে চোখে জলে টইটম্বুর হয়ে যায়। কিন্তু ষোড়শী কন্যার অভিমান তো মিহানের কঠোর হৃদয়কে ছুঁতে পারে না।

বহুদিন পর বন্ধুমহলে আড্ডা জমেছে। এতো এতো হইচই মাঝেও কোথাও যেনো একটা দূরত্ব চলে এসেছে। সেই প্রাণখোলা হাসিতে কেউ ফেটে পড়ছে না। সবার ঠোঁটের কোণেই ঝুলে আছে এক টুকরো হাসি। কিন্তু সেই হাসিটা একান্তই লোক দেখানো হাসি। কারো মনে আনন্দ নেই সবার মনেই বিষাদের ছায়া। কেউ ভালো নেই। সবার মনের কোণেই গোপন ব্যথা লুকিয়ে আছে।

এর মাঝে আগমন ঘটে প্রিয়ন্তির। এক কোণায় একদম চুপচাপ বসে পড়ে। সবার দৃষ্টি প্রিয়ন্তির দিকে। প্রিয়ন্তির দৃষ্টি নত। প্রিয়ন্তির মাঝে এসেছে আমূল পরিবর্তন। কয়েক মাস আগের প্রিয়ন্তির সাথে এই প্রিয়ন্তির কোনো মিল নেই। প্রিয়ন্তি আগে থেকেই কম কথা বলে এখন যেনো একদমি চুপচাপ হয়ে গেছে। একদম শুকিয়ে গেছে, গায়ের রংও কালো হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো আস্তরণ, রুক্ষ শুষ্ক ঠোঁট। প্রিয়ন্তির এই পরিবর্তন মানা যেতো যদি প্রিয়ন্তি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতো। কিন্তু তা তো একদমিই হয়নি। প্রিয়ন্তি এমন রেজাল্ট করেছে যেটা সবারই অপ্রত্যাশিত ছিল। প্রিয়ন্তির ডিপার্টমেন্টের প্রফেসাররাও অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে ছিল। প্রিয়ন্তি পরীক্ষায় ফেইল করেছে। যেমন তেমন ফেইল না একদম ডাবল জিরো পেয়ে ফেইল করেছে।

প্রিয়ন্তি তোর কী হয়েছে? তুই তো ফেইল করার মতো স্টুডেন্ট না? তাহলে এটা কীভাবে হলো?
মুহিবের প্রশ্নে প্রিয়ন্তি এক নজর তাকায় মুহিবের দিকে। সবাই অনেক প্রশ্নই করছে প্রিয়ন্তিকে। প্রিয়ন্তি কারো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না। বরং এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রেয়সীর দিকে। শ্রেয়সী একদম চুপচাপ, প্রিয়ন্তির সাথে একটা কথাও বলেনি। প্রিয়ন্তির এহেন অবস্থার কারণ তো শ্রেয়সীর অজানা নয়। প্রিয়ন্তি কী পরিমাণ মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেটা তো শ্রেয়সী জানে। না আছে ঘরে শান্তি আর না আছে বাইরে শান্তি।

নাহিনের সাথেও যে সম্পর্কটা আগের মতো নেই। প্রিয়ন্তি কেমন অসহায় দৃষ্টিতে শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রেয়সী নিজের ব্যাগটা নিয়ে ওঠে দাঁড়ায়। আজকে দুপুর বারটাই অনুপমের সাথে দেখা করার কথা। এর মাঝে প্রিয়ন্তির ডাক পড়ে। ডিপার্টমেন্টের প্রধান যিনি তিনি প্রিয়ন্তিকে ডাকছেন। প্রিয়ন্তি কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে ওঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে যায় তার ডিপার্টমেন্টের দিকে। অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করতে। পঞ্চাশ উর্ধ্ব বয়সী লোকটা প্রিয়ন্তির দিকে তীক্ষ্ম নজরে তাকায়। প্রিয়ন্তি ধীর সুস্থে সালাম দেয়। অস্বস্তিতে প্রিয়ন্তি হাঁসফাঁস করছে। প্রিয়ন্তির গলার স্বর অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে।

বসো।
প্রিয়ন্তি বিনা বাক্যে বসে পড়ে। বসার পর আরো বেশি অস্বস্তি লাগছে। বলার সাথে বসে পড়াটা কেমন দেখায়। প্রিয়ন্তির দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। হাত-পা অসম্ভব রকমের কাঁপছিল। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো পড়ে যেতো।
কাঠফাটা রোদের মাঝে হেঁটে গলা শুকিয়ে গেছে শ্রেয়সীর। অনুপমের আসতে এখনো ঘন্টা খানিক দেরি হবে। অনুপম কিছুক্ষণ আগেই মেসেজ দিয়ে জানিয়েছে শ্রেয়সীকে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৫

শ্রেয়সী মিনিট দশেক যাবৎ ধরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে। একবার ভাবলো প্রিয়ন্তিকে ফোন দিয়ে জিঙ্গেস করবে স্যার কী বললো। পরক্ষণেই ভাবলো এখন ফোন দেওয়া মানে কাঁটা গায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো হয়ে যাবে।
শ্রেয়সী একটা কফিশপে ঢুকে। কফিশপে ঢুকতেই শ্রেয়সীর পা জোড়া স্থির হয়ে যায়।
এরকম একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন সে হবে কখনো কল্পনাও করেনি শ্রেয়সী।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৭