শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৫

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৫
তাসনিম জাহান রিয়া

তন্ময় একটা চায়ের দোকানে বসে আছে। উদাসীন হয়ে গরম চায়ের চুমুক দিতে গিয়ে জিহ্বা পুড়ে যায়। তন্ময় চায়ের কাপটা পাশে রেখে দেয়। মিহান সিগারেটে সুখ টান দিতে দিতে এসে তন্ময়ের পাশে এসে বসে। এর মাঝে কেটে গেছে অনেকটা সময়। ঐদিন গ্রাম থেকে আসার পর মিহান একদম আগের মতো হয়ে গেছে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মিহান হুট করেই সুর তুলে। মিহানের সাথে তাল মেলায় তন্ময়।

এমন যদি হতো আমি পাখির মতো।
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ।
এমন যদি হতো আমি পাখির মতো।
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ।
বানাই বহুদূরে ক্লান্ত

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তন্ময়ের ঠিক সামনেই একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। গাড়ির নাম্বারটা দেখে তন্ময় গানের খেই হারিয়ে ফেললো। গলা থেকে একটা স্বরও বের হচ্ছে না। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিতেই শ্যাম বর্ণের যুবক বেরিয়ে আসে। লোকটা লম্বাই পাঁচ ফুট সাত থেকে সাড়ে সাত ইঞ্চি হবে। চেহেরার গঠনও অসাধারণ। হাতে দামি একখানা ঘড়ি। ফরমাল ড্রেসআপ পড়ে এগিয়ে আসছে। তন্ময়ের মনে হচ্ছে এই লোকটা একদম পারফেক্ট। উনার সাথে তন্ময়ের কোনো তুলনাই হয় না। উনার তুলনায় তন্ময় কিছুই না। তন্ময়ের নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে।
লোকটা একদম তন্ময় আর মিহানের সামনে এসে দাঁড়ায়।

হ্যালো গাইস।
মিহান অদ্ভুত চোখে লোকটার দিকে তাকায়। মিহান বা তন্ময় দুজনের থেকে একজনও জবাব দেয় না। মিহানের কাছে লোকটা একদমি অপরিচিত। মিহান বা তন্ময়ের কাছ থেকে কোনো রকম জবাব না পেয়ে লোকটা আলতো হেসে বলে,
তোমরা আমাকে চিনবে না। ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছি বলে কিছু মনে করো না। তোমরা দুজনেই আমার থেকে বয়সে ছোট। তোমরা তো অনন্যার বন্ধু। তোমাকে আমি অনন্যার সাথে দেখেছিলাম। আমি অনন্যার উডবি হাজবেন্ড।

‘উডবি হাজবেন্ড’ কথাটা বারংবার তন্ময়ের কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। এই কথাটা তো তার বলার কথা ছিল। পরিস্থিতির কারণে সব বদলে গেলো। সে তো শুধু অনন্যার বন্ধু নয় বরং বিশেষ বন্ধু। মিহান একটুখানি জায়গা ছেড়ে দিয়ে লোকটাকে বসতে বলে। লোকটাও নির্দ্বিধায় হাসি মুখে বসে পড়ে। তন্ময়ের কাছে লোকটার ব্যবহার ভীষণ ভালো লাগে। লোকটার যে একদমি অহংকার নেই তন্ময়ের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তন্ময়ের মনের মাঝে একটা প্রশান্তির ঢেউ বয়ে যায় এটা ভেবে যে তার অনন্যা ভালো একজন জীবন সঙ্গী পাচ্ছে। মিহান মৃদু স্বরে বলে,

আপনাকে কে বললো আমরা অনন্যার বন্ধু? আমরা তো পূর্ব পরিচিত নই।
আমাকে অনন্যার বাবা বলেছে।
আপনিও বিশ্বাস করে নিলেন? আমি যদি বলি আমরা
মিহানকে বলতে দেয় না তন্ময়। তন্ময় লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে,
কেমন আছেন আপনি?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমরা কেমন আছো?
মিহান বিড়বিড় করে বলে,

ভালো থাকার কারণটা কেড়ে নিয়ে জিঙ্গেস করছে কেমন আছো?
তন্ময় চোখ রাঙিয়ে তাকায় মিহানের দিকে।
আপনার নামটাই তো জানা হলো না।
আমার নাম অমি আহম্মেদ।
বাহ আপনাদের নামের তো বেশ মিল আছে অমি, অনন্যা। আমার বান্ধবীকে দেখে রাখবেন। অনন্যা খুব ভালো মেয়ে।
মিহান মৃদু হেসে বলে,

কী যে বলিস না তন্ময়। অনন্যা আবার ভালো থাকবে না? উনার অনেক টাকা আছে। অনন্যা অবশ্যই ভালো থাকবে।
টাকা দিয়েই কী সব পাওয়া যায়? কই টাকা দিয়ে তো ভালোবাসা পাওয়া যায় না।
হুট করেই তন্ময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। অন্যমনস্ক হয়েই জবাব দেয়,
আপানার বড়লোক। টাকা দিয়ে ভালোবাসা না কিনতে পারলেও, অন্যের ভালোবাসার মানুষটাকে ঠিকই কেড়ে নিতে পারেন।

কতোটা বলেই তন্ময় চমকে ওঠে। আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে অমির দিকে তাকায়। অমি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তন্ময় কিছু না বলে ওঠে দাঁড়ায়। তারপর দ্রুত পায়ে সেই স্থান ত্যাগ করে। তন্ময়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অমির দিকে তাকিয়ে স্লান হেসে বলে,
ভাইয়া আসি। ভালো থাকবেন আর ভালো রাখবেন। মনে রাখবেন কেউ খুব যতন করে নিজের কলিজাটা ছিঁড়ে আপনার হাতে তুলে দিচ্ছে।

মিহান অচেনা গন্তব্যের দিকে হাঁটা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে সুর তুলে,
পিরিতি কেমনে জ্বালায় আগে যদি জানতাম
তওবা কইরা কানে ধইরা পিরিত নাহি করতাম।
মিহানের গাওয়া লাইনগুলো স্পষ্ট অমি শুনতে পাচ্ছে। মিহান আর তন্ময়ের কথাগুলো বুঝতে অমির একটুও অসুবিধা হয়নি। সে আগেই কিছু আন্দাজ করেছিল। এখন সে শিওর। মিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অমির চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। তার চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে বছর কয়েক আগের ঘটনা।

তন্ময়ের জায়গায় তো একদিন সেও ছিল। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার জন্য নিজের আত্নসম্মান বিসর্জন দিয়ে পায়েও পড়েছিল। তবুও নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পায়নি। শেষ পর্যন্ত নিজেকে বুঝিয়ে ছিল নিজের ভালোবাসার মানুষটা সুখে থাকলেই সে সুখে থাকবে। আদৌও তার ভালোবাসার মানুষটা সুখী হয়েছিল? সুখপাখি ধরা দেওয়ার আগেই তো পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

অমি তার চোখের কোণে জমা অশ্রু কণা সন্তর্পণে মুছে নেয়। অমি গাড়িতে ওঠে বসে। ড্রাইভার খুব ধীর গতিতে ড্রাইভ করা শুরু করে। সে চায় তন্ময়ের পূর্ণতায় অনন্যা থাকুক। অনন্যারা অমির সাথে ভালো থাকে না। অনন্যার বেকার তন্ময়ের সাথেই ভালো থাকে।

অমি নিজের ফোনটা বের করে নিজের বাবাকে কল দেয়। কিয়ৎক্ষণের মাঝেই ফোন রিসিভ হয়। অমি কাতর গলায় বলে,
বাবা আমি এই বিয়েটা করবো না। আমার পক্ষে এই বিয়েটা করা সম্ভব না। বাবা তোমার কথা শুনে তো আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি। তুমি আমার একটা কথা শুনো প্লিজ। এই মেয়ে ছাড়া পৃথিবীর অন্য যেকোনো মেয়েকে আমি বিয়ে করতে রাজি।

অমি নিজের বাবাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দেয়। গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে দেয়।
কিছু কারণবশত নাহিনের যাওয়ার ডেইট পিছিয়ে গেছে। তার জন্য শ্রেয়সী একটা সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। সব রহস্য খুঁড়ে বের করার জন্য হাতে কিছুটা হলেও সময় পেয়েছে। শ্রেয়সী বুঝতে পারছে সে দিন দিন রহস্যের বেড়াজালে আটকে পড়ছে। চোখের সামনে যা ঘটছে তা আসলে সত্যি না আর যা সত্যি তা ঘটছে না। শ্রেয়সী বুঝতে পারছে প্রিয়ন্তির বাবা তাকে একটা অদ্ভুত গোলক ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে। উনি শ্রেয়সীকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন। ভীষণ চালাক একজন মানুষ। সবকিছু শ্রেয়সীর চোখের সামনে রেখেও আড়ালে রেখেছেন।

শ্রেয়সী খাতায় কিছু একটা আঁকাআঁকি করছে। শ্রেয়সীর ফোনটা ভাইব্রেট করছে। শ্রেয়সী ফোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। অনুপম কল করছে। এসব কিছুর চক্করে এখন সে আর অনুপমকে সময় দিতে পারে না। রীতিমতো অনুপমকে ইগ্নোর করছে সে।

শ্রেয়সী ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে অনুপমের অনুনয় মিশ্রিত কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হয়।
শ্রেয়সী একটু দেখা করবে? না করো না প্লিজ। তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। বুকের ভিতরটা কেমন হাঁসফাঁস করছে। আমি ছাদে আছি।
অনুপম আর কথা বাড়ায় না। কল কেটে দেয়। শ্রেয়সী ফোনটা রেখে শুভ্র রাঙা উড়নাটা শরীরে জড়িয়ে নেয়।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৪ (২)

( আপনাদের কথা দিয়েও কথা রাখতে পারছি না। আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে। এতোদিন গল্প না লেখার কারণে মারাত্মক রাইটিং ব্লকে চলে গিয়েছি। একটা বাক্য লিখতেও মিনিট কয়েক ভাবতে হয়। একেকটা বাক্য লিখেছি বার কয়েকবার কেটে। এখন থেকে কিছুদিন পরপর গল্প দেওয়ার চেষ্টা করবো। নিয়মিত গল্প দেওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব না।)

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৬