শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৪(২)

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৪(২)
তাসনিম জাহান রিয়া

সকালেই যে এমন একটা চমক অপেক্ষা করছিল সেটা শ্রেয়সী কল্পনাও করতে পারেনি। নাহিন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। কথাটা নাহিন সকালের নাস্তা করতে বসে বলেছে এবং এটাও বলেছে সে কারো কোনো বারণ শুনবে না। আগামীকাল তার ফ্লাইট। শ্রেয়সী শোনার পর থেকেই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। শ্রেয়সী নিজের রুমে চলে আসে। তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। এদিকে মিহান হুট করেই কোথায় চলে গেছে।

ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুহিব তার মাকে নিয়ে গ্রাম থেকে একেবারে চলে আসবে। জানা গেছে মেঘলা আত্মহত্যা করেনি বরং তাকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ আন্দাজ করেছে মেঘলাকে প্রথমে গলা টিপে হত্যা করা হয়। তারপর পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মুহিব তার মাকে নিয়ে রিস্ক নিতে চাচ্ছে না। এই জন্য ছোট একটা রুম নিয়ে তার মাকে নিয়ে শহরে চলে আসবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিহানকে খোঁজা দরকার। মুহিবের জন্য বাসা দেখা দরকার। অনন্যার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এটা নিয়ে অনেক ডিপ্রেশড তন্ময়। এদিকে নাহিন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে শ্রেয়সীর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। শ্রেয়সীর ফোনের মেসেজ টোন বেজে ওঠে। শ্রেয়সী দ্রুত মেসেজ ওপেন করে। মুহিব মেসেজ করছে। মিহানকে পাওয়া গেছে। মিহান মুহিবদের গ্রামে গেছে মেঘলার কবরের পাশে বসে আছে। মিহানকে পাওয়া গেছে এটা শুনে শ্রেয়সী একটা সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। শ্রেয়সী অনুপমকে কল দেয়। কিন্তু অনুপম ফোন রিসিভ করছে না। শ্রেয়সী ফোনটা বেড সাইড টেবিলের ওপর রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ে।

ঘন্টা খানিক পরে অনুপম নিজেই কল ব্যাক করে। শ্রেয়সী ফোনটা দ্রুত রিসিভ করে। অনুপম মৃদু স্বরে বলে,
সরি একটু বিজি ছিলাম তাই তুমি ফোন করছো এটা দেখতে পাইনি।
ফোনটা রিসিভ করে শ্রেয়সী হাঁসফাঁস করছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না? অনুপম উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
এই শ্রেয়সী কী হয়েছে? কথা বলছো না কেনো? কোনো প্রবলেম হয়ছে? শরীর খারাপ লাগছে?
আমার সাথে আজকে একবার দেখা করবেন প্লিজ?

শ্রেয়সী আমার কিন্তু এবার অনেক টেনশন হচ্ছে। এভাবে কথা বলছো কেনো তুমি?
আমার কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। আপনাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনার বাসার সাথে ঐ কফিশপটাই একটু আসবেন।
কখন আসবো? এখন আসবো?
না এখন আসার দরকার নেই। দুপুর একটার দিকে আইসেন।
আচ্ছা। সাবধানে এসো।
আচ্ছা। আপনিও সাবধানে আসবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।
আল্লাহ্ হাফেজ।

প্রতিবার দেখা করার কথা হলে সবসময় অনুপম এসে ওয়েট করে। কিন্তু এই প্রথম বার শ্রেয়সী অনুপমের আগে চলে এসেছে। শ্রেয়সী পনেরো মিনিট আগে চলে এসেছে। ধীর পায়ে কফিশপের ভিতরে প্রবেশ করে।
শ্রেয়সী একটা ফাঁকা টেবিল দেখে বসে পড়ে।

হুট করে সামনের টেবিলে বসা মানুষ দুই জনকে দেখে চমকে ওঠে শ্রেয়সী। শ্রেয়সীর সামনের টেবিলে বসে প্রিয়ন্তি আর প্রিয়ন্তির বাবা। প্রিয়ন্তির বাবার মুখ দেখা যাচ্ছে না তবে পিছন দেখে আর প্রিয়ন্তিকে দেখে আন্দাজ করে নিয়েছে। প্রিয়ন্তির চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। বোঝায় যাচ্ছে কান্না করছে। শ্রেয়সী মুখ ঢেকে আস্তে করে গিয়ে প্রিয়ন্তির বাবার পিছনের চেয়ারটাই একদম বসে।

আব্বু তুমি আমাকে মেরে ফেলো। আমি আর পারছি না। নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট কীট মনে হচ্ছে। আর কতো অন্যায় করাবে তুমি আমাকে দিয়ে। আমাকে এসবের থেকে মুক্তি দাও। তোমার জন্য আজকে আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে বসেছি। বান্ধবীকে তো অনেক আগেই হারিয়ে ফেলছি।
আমার প্রতিশোধ এখনো পূর্ণ হয়নি। আমি চাই নাহিন আর শ্রেয়সী কষ্ট পাক। ওদের কষ্ট পেতে দেখলে ওদের বাবা কষ্ট পাবে। যেটা আমি চাই।

তোমার প্রতিশোধের নেশা আমার জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। আমার বাঁচার ইচ্ছে একদম শেষ হয়ে গেছে। আম্মু তোমাকে ছেড়ে গেছে তোমার অবহেলার কারণে। এভাবে তো কেউ বাঁচতে পারে না। সব মেয়েই চায় একজন উত্তম জীবনসঙ্গী। যে সব বিপদে আপদে তার পাশে থাকবে। কিন্তু তুমি? টাকা দেওয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করছো কখনো?

কখনো আম্মুকে জিঙ্গেস করছো যে আম্মু কেমন আছে? আম্মুর কী প্রয়োজন? কখনো জানতে চাওনি। নিজের প্রয়োজন ব্যতীত অন্য কোনো কথা আম্মুকে বলছো? কখনো আম্মুকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গেছো? সব প্রশ্নের উত্তর একটাই হবে ‘না’। আম্মুকে তুমি সব সময় হিউমিলিয়েট করেছো। আম্মু যে ঐ লোকটার সাথে চলে গেছে এটাই কী শ্রেয়সীর আব্বুর কোনো দোষ আছে? উনি তো আর জানতেন না আম্মু বিবাহিত।

উনি শুধু শ্রেয়সীর মামাকে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে সাহায্য করেছেন। এটাই তো শ্রেয়সীর আব্বুর কোনো অন্যায় নেই। অন্যায় যদি থেকে থাকে সেটা তোমার আর আম্মুর। তোমার অন্যায়টাই বেশি। সবকিছু তোমার চোখের সামনে ঘটেছে কিন্তু তুমি তখন চুপ করে ছিলে। তুমি তখন চাইছিলে আম্মু নামক বোঝাটাকে নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে। কিন্তু এখন যখন দেখছো আম্মু সুখে আছে এখন তোমার জেলাস ফিল হচ্ছে। তোমার ইগোতে লাগছে।

চুপ করো তুমি। তোমার কোনো কথা আমি শুনতে চাচ্ছি না। তুমি আমার কথা মতো কাজ করো। যদি তুমি আমার কথা মতো কাজ করতে না পারো তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দিব।
তুমি বলো না তুমি আমাকে ভালোবাসো। সেটা একদম মিথ্যা। তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তুমি কাউকে কখনো ভালোবাসতে পার না।

প্রিয়ন্তি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায় কফিশপ থেকে। প্রিয়ন্তির বাবা নিজের ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
তোমাকে আমি ভালো থাকতে দিব না। ইনফ্যাক্ট তোমার আশেপাশের মানুষগুলোকেও আমি ভালো থাকতে দিব না। ‘ভালো থাকা’ শব্দটা তোমার জন্য না। তোমার জন্য অনেক বড় ধামাকা অপেক্ষা করছে। এতোদিন দেশের বাইরে ছিল তাই শান্তিতে ছিলে। এখন বুঝবে কতো ধানে কতো চাল।

প্রিয়ন্তির বাবাও চলে যায় কফিশপ থেকে। শ্রেয়সী টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে। শ্রেয়সী এখন বুঝতে পারলো কেনো তার বাবা আর মার প্রিয়ন্তির প্রতি এতো টান। জেনে করুক আর না জেনে করুক একটা অপরাধবোধ তো আছেই। উনাদের কারণেই প্রিয়ন্তি আজ মা ছাড়া।

কপালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকায় শ্রেয়সী। অনুপমের চিন্তিত মুখটাকে হুট করেই শ্রেয়সীর ভীষণ ভালো লাগছে। কেনো ভালো লাগছে? সেই উত্তর শ্রেয়সীর কাছেও নেই।
তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে? জ্বর তো নেই। তাহলে কী মাথা ব্যথা করছে?
শ্রেয়সী জবাব দেয় না। বরং অনুপমকে নিজের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয়। শক্ত করে অনুপমের হাতটা নিজের মুঠো বন্দি করে।

আপনি কখনো আমাকে অবহেলা করবেন না তো? কখনো মনে হবে না তো যে আমি আপনার জন্য পারফেক্ট ব্যাক্তি নই। আমার সাথে যায় না এমন ভেবে আমাকে কখনো ছুঁড়ে ফেলে দিবেন না তো? আমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে প্লিজ আমাকে মেরে ফেলবেন। আপনি আমাকে অবহেলা করলে বা ছেড়ে গেলে আমি শেষ হয়ে যাব।
তুমি এসব কথা বলার জন্য আমাকে এখানে ডেকেছো? তুমি কী চাচ্ছো আমি এখান থেকে চলে যাই? তুমি জানো না তুমি আমার জন্য কী? এমন অদ্ভুত কথা কেনো বলছো তুমি? কী হয়েছে তোমার?

আমার জীবন কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমার জীবনের সাথে যুক্ত প্রত্যেকটা মানুষের সম্পর্ক ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। জীবনে এতো এতো লুকায়িত সত্যের মুখোমুখি হচ্ছি যে আমি আর নিতে পারছি না।
রিল্যাক্স। পানি খাও। নিজেকে একটু শান্ত করো। এতো প্রেসার নিয়ো না। ডাক্তার তোমাকে বেশি প্রেসার নিতে বারণ করেছে।

অনুপম নিজের হাতে থাকা বোতলটা এগিয়ে দেয়। শ্রেয়সী কোনো কথা না বলে এক চুমুকে সম্পূর্ণ বোতল খালি করে দেয়। শ্রেয়সী একে একে সকাল থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা খুলে বলে।
তুমি এখন এসব ভাববে না। আমি এখন তোমার পাশে আছি। এখন তুমি শুধু আমাকে নিয়ে ভাববে। মুহিবের জন্য বাসা দেখেছি। ওরা আজকালের মাঝে বাসায় উঠবে আর মিহানের খবর হয়তো জানোই।
হ্যাঁ মিহানকে ওর বাবা-মা জোর করে বাসায় নিয়ে গেছে।

একটু তো টেনশন ফ্রী হয়ছো? তন্ময়ের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। তোমরা পাশে থেকে হয়তো সাহায্য করতে পারো এর থেকে বেশি কিছু করতে পারো না। অনন্যার বাবা-মার যুক্তি একদম ঠিক আছে। কোনো বাবা-মাই চায় না নিজের মেয়েকে বেকার ছেলের হাতে তুলে দিতে।

আমি কী পারবো নিজের বোনকে একটা বেকার ছেলের হাতে তুলে দিতে? অবশ্যই না। উনারা এতো ভালো পাত্র পাওয়ার পর কেনো তন্ময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন? তন্ময়ের যে চাকরি হবে এটার কোনো গ্যারান্টি আছে? উনাদের দিক থেকে উনারা ঠিক তন্ময়ের দিক থেকে তন্ময় ঠিক। তবে তন্ময়কে উনাদের কনভেন্স করতে হবে। দুই থেকে তিনটা বছর যেনো অপেক্ষা করে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৪

(আপাতত একটু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। এক সপ্তাহ পর থেকে এক্সাম। চাইলেও প্রতিদিন গল্প দেওয়া সম্ভব না। যত দ্রুত সম্ভব গল্পটা শেষ করে দিব। আপনারা একটু কষ্ট করে কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন।)

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৫