অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৪

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৪
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

হাতে সময় খুবই স্বল্প। এরমাঝে সবাইকে দাওয়াত করা, বিয়ের কেনাকাটা সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন তরীর বাবা। সাথে মামাও আছেন। মামি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিয়ের দুদিন আগেই একেবারে আসবেন। এখন সবার স্কুল খোলা, তাই মাঝেমাঝে আসা-যাওয়া করছেন।

যত দিন যাচ্ছে ততই তরী লজ্জায় সংকুচিত হচ্ছে। হুট করে তার ভেতরে ভয় ঢুকলো! সে চলে গেলে সবার কী হবে? বাবা একা হাতে বাহির, বাড়ি সবটা কিভাবে সামলাবেন? অরুকে কে দেখবে?
তরী ফোন হাতে হুট করেই মাহমুদকে কল দিলো। রিসিভ হওয়ার পরই হড়বড়িয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“আমি বিয়ে করবো না।”
মাহমুদের রগঢ় কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।
-“বেশ তো, করোনা। আমি না করেছি না-কি?”
তরী শক্ত হয়ে বলল,
-“আমি সিরিয়াস!”

মাহমুদ এবার বোধহয় একটু নড়েচড়ে উঠলো। রসিকতা ছেড়ে সেও যথেষ্ট মনযোগ দিলো তরীর উপর। খানিক চিন্তিত স্বরে শুধালো,
-“তুমি ঠিক আছো, তরী?”
-“না আমি ঠিক নেই।”
তরীর শরীর থরথর করে কাঁপছে। সবটা ভাবতে গেলেই কেমন মাথা ভার লাগছে। উত্তেজনা বশত মাহমুদকে এভাবে কল দেওয়া ঠিক হয়নি তার। বোধদয় হতেই স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।
মাহমুদ বলল,

-“আগে শান্ত হও। তারপর বলো কী হয়েছে? আমি শুনছি।”
তরীর চোখের পাতা মুদে এলো। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে গোল করে প্রশ্বাস ছাড়লো। মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে শান্ত হয়ে বসলো। বলল,
-“আমরা বিয়ে করে নিলে বাবা, অরু, মিঠু ওদের কী হবে?”
মাহমুদের স্বর শোনা গেল না। ওপাশ সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। তরী প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে মুখিয়ে আছে জবাবের আশায়।
মাহমুদ নরম স্বরে বলল,

-“সবাইকে দেখবো আমরা। তুমি চিন্তা করো না। আমরা দুজন সবটা সামলে নেবো। তুমি নাহয় আগে তোমার পরিবারকে সময় দিলে।”
তরী স্বস্তি পেলো মাহমুদের কথা শুনে। সে নিজেও কোমল হয়ে এলো। বলল,
-“তাহলে বলুন, আমি বিয়ের পর এখানেই থাকবো।”
-“থাকবে, সেটা সমস্যা না। সবাইকে দেখার জন্য হলেও তোমাকে থাকতে হবে। পরে অন্য একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।”
তরী শঙ্কা নিয়ে বলল,

-“কিন্তু আন্টি কি আমার বাবার বাসায় থাকা এলাউ করবেন?”
-“মা নিশ্চয়ই বুঝবেন। আমি কথা বলবো।”
-“সরি!”
তরীর নিচু স্বর।
মাহমুদ মৃদু শব্দে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“সেটা কেন?”
-“একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছি।”
-“আমি কিন্তু রেগে আছি, তরী।”

মাহমুদের স্বর ক্রমশই গম্ভীর হয়ে এলো। তরী ভয়কাতুরে গলায় বলল,
-“কেন? আমি তো সরি বলেছি।”
মাহমুদ আরেকটু গমগমে গলায় বলল,
-“সরি দিয়ে আমি কী করবো?”
-“তাহলে?”
-“ভীষণ ভালোবাসতে হবে।”

ক্ষণিকেই গাম্ভীর্যে ভরপর স্বর পালটে গেল। গলায় ভর করলো একরাশ ব্যাকুলতা, তীব্র অনুরাগ।
তরীর গালে লজ্জালু আভা ফোটে উঠলো। লজ্জা ঢাকতে চোখ বুজে নিলো সে। মনে হলো মানুষটা তার সমানেই দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করেই তাকে কঠিন লজ্জায় ফেলতে চাইছে।
তরীর জবাব না পেয়ে মাহমুদ বলল,
-“কী হলো? জবাব চাই আমার। বাসবে তো?”
টুক করেই লাইন ডিসকানেক্ট করে দিল তরী। ফোন হাতে নিয়ে অজান্তেই হেসে ফেললো। এখন অনেকটা হালকা লাগছে।

বিয়ের কেনাকাটা করতে তরীকে সাথে নিয়েই বের হলেন আয়েশা সুলতানা। মাহমুদ সহ তাদের পরিবারের সকলেই আছে। তরীর সাথে অরুও আছে।
শাড়ি দেখছিল সবাই। দোকানে আরো কয়েকজন মহিলা ছিলেন। রামির ঘড়িতে টা*ন পড়ে দাদুর বয়সি একজন ভদ্রমহিলার মাথার কাপড় ঝরঝর করে পড়ে যায়। মিঠুর চোখ আটকালো বৃদ্ধার মাথায়। তার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে ভ্যাবাচ্যাক খেয়েছে।

বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি কতবার হজ্জ করেছেন? তাছাড়া হজ্জে পুরুষের মাথা ন্যাড়া করা হয় জানতাম। নারীদেরও ন্যাড়া করা হয় জানতাম না।”
বৃদ্ধা তেতে উঠলেন। কেননা, উনার মাথায় একটা চুলও নেই। দ্রুত মাথায় আঁচল টে*নে কর্কশ কন্ঠে বললেন,
-“এই ছেলে অ*স*ভ্য*তা করছো কেন? মহিলা মানুষ দেখলে তোমাদের বখাটেপনা জেগে উঠে, তাইনা?”
রামি তব্দা খেয়ে বিড়বিড় করে বলল,

-“ঘড়ি গিয়ে এই এই কর্কশ গলার বুড়ির শাড়ির সাথেই আটকাতে হলো? দেশে কি মেয়ের অভাব পড়লো না-কি?”
পরক্ষণেই কৌতুহলের বশে বৃদ্ধাকে আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“বলুন না, হজ্জে কি মহিলাদের ও ন্যাড়া করা হয়?”

বৃদ্ধা এমন তেতে উঠছে কেন জানা নেই রামির। পাশের সবাই মিটিমিটি হাসছে। বৃদ্ধার সাথের একজন ইশারায় রামিকে চুপ থাকতে বললো। সেও চুপ করে গেল। যিনি চুপ থাকতে বলেছেন, সেই ভদ্র মহিলাই পরক্ষণে বললেন,
-“আমার শাশুড়ি ঔষধকে চিড়ামুড়ির মতো গেলেন। ভুলভাল ঔষধ খেয়ে সব চুল পড়ে টাক হয়ে গিয়েছেন। হজ্জে ন্যাড়া করা হয়নি।”

মহিলার ফিসফিসানো কন্ঠে এহেন জবাব শুনে রামি বিটকেলের মতো হেসে উঠলো। বারবার বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। বৃদ্ধা আড়চোখে তাকাচ্ছেন আর রাগে ফেটে পড়ছেন। রামিকে চোখ রাঙাতেই সে মৃদু শব্দে বলল,
-“দাদু আপনার কদবেলটা বেশ আকর্ষণীয়। একটু বেলের শরবত খাওয়াবেন?”
বৃদ্ধা রাগতে গিয়েও রাগলেন না। রামির কথায় তিনি নিজেও হেসে ফেললেন। বললেন,

-“আমার বাড়ি এসো। তোমায় কদবেলের শরবত খাওয়াবো।”
কেনাকাটা শেষ করে বৃদ্ধা পুত্রবধূ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তারাও কয়েকটা শাড়ি পছন্দ করে অন্যপাশে চলে গেল। তরীর পছন্দমতো তারজন্য প্রসাধনী থেকে শুরু করে সবটা কেনা হলো।

দু’পক্ষের হলুদের অনুষ্ঠান একইসাথে কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা হলো। তরীকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। অরু ঠিক তরীর মতোই তৈরি হলো। বসলো মাহমুদ, তরীর মাঝখানে। মাহমুদের বড়ো ভাইয়া এসে মাহমুদকে উঠিয়ে অরুর পাশে বসে পড়লেন ধপ করে। ছোট্ট অরুর নরম গাল দু-খানা টে*নে দিয়ে বললেন,
-“আমার বউকে দেখি মারাত্মক সুন্দরী লাগছে।”

অরু ক্ষেপে উঠলো। তার মিষ্টি চেহারায় রাগের আভা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। গাল দুটো ঘঁষে চললো অনবরত। নাকমুখ কুঁচকে বাজখাঁই গলায় বলল,
-“আমি হলাম স্মার্ট মেয়ে। এমন একটা বুড়ো লোককে আমি কখনোই বিয়ে করবোনা। আর আমার গাল ধরার সাহস করবেন না। হাত ভেঙে দেবো।”

বড়ো ভাইয়া অরুর দিকে আরেকটু চেপে বসলেন। ঘাড়ের উপর হাত দিয়ে বললেন,
-“রাগ করাতে বউকে আরো সুন্দরী দেখাচ্ছে। আজই বিয়ে করে নিয়ে যাবো।”
অরু ঘাড়ের উপর থেকে ঝাড়ি দিয়ে হাত সরিয়ে দিল। তার রাগের মাত্রা বাড়ছে। নাকের পাটা ফুলিয়ে ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো মেয়েটা। আর একটু হলেই কেঁদে ফেলবে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।”
-“আজ তোমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
অরু জেদ করে উঠে যেতে চাইলো। বড়ো ভাইয়া অরুর রাগ দেখে শব্দ করে হেসে ফেললেন। বললেন,
-“থাক, বিয়েটা আগামীকালই করবো।”

তিনি উঠে গেলেও অরু রক্তচক্ষু নিয়ে উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলেও তিয়াসের পরিবার থেকে কেউ এলেনা। হলুদের সাজ ছাড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই তরীর ফোন বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে “তিয়াস ভাইয়া” নামটা জ্বলজ্বল করছে। তরী ধরবেনা বলে ঠিক করলো। পরপর তিনবার রিং হওয়ার পরই সিদ্ধান্ত বদলে কল রিসিভ করলো। মুঠোফোন কানে তুলে চুপ করে রইলো। ওপাশ থেকে তিয়াসের স্বর শোনা গেল।

-“কেমন আছো, তরী?”
-“ভালো।”
ছোটো করে জবাব দিলেও ফিরতি তিয়াসকে কিছুই জিজ্ঞেস করলোনা সে।
তিয়াস চুপ থেকে নিজেই আবার বলল,
-“শুনলাম বিয়েটা তোমার পছন্দেই হচ্ছে!”
-“হ্যাঁ।”

এবারও অল্পকথায় জবাব দিলো তরী। তিয়াস বোধহয় ছোটোখাটো একটা ধাক্কা খেলো। ব্যথাতুর কন্ঠে বললো,
-“তুমি আমায় সবটা বলতে পারতে, তরী।”
তরী রাগ দেখালোনা। শান্তভাবেই জবাব দিলো,
-“বলিনি বলছো? আমি তোমাকে বলে দিয়েছি তোমাকে আমি নিজের বড়োভাই মানি। আমাদের মাঝে বিয়ের মতো সম্পর্ক আসতে পারেনা।”

-“তুমি নিজের পছন্দের ব্যাপারে আমাকে জানাতে পারতে।”
তরী নরম হলো খানিকটা। বলল,
-“তখন এতটা সাহসে কুলায়নি আমার। তাছাড়া পরবর্তীতে মায়ের মৃ*ত্যু*তে পরিস্থিতি ঘেঁটে গিয়েছে। তাই আর জানানোর সুযোগ হয়নি।”

-“তোমার জীবনের জন্য শুভকামনা রইলো। দোয়া করি ভালো থেকো।”
তিয়াস আর কথা বাড়ালোনা। কেমন করুণ স্বরে বাক্য শেষ করেই বিনাবার্তায় বিদায় নিলো। তরীর হুঁশ ফিরলো কল কাটার শব্দে।
ফোন রেখে চোখের পাতা এক করতেই রাজ্যের ঘুম এসে চোখে ভীড় জমালো।

মিঠু আর রামি দুজনই ম্যাচিং ড্রেস পরে ছোটাছুটি করছে। তাদের কাজ হলো বিয়ে বাড়িতে আনন্দ করা। তরীর বাবাকে অনেকক্ষণ হলো দেখতে না পেয়েই মামা উনার তালাশ করলেন। তরীও বাবার খবর জানেনা। কল দিলেও তিনি ফোন তুললেন না।

এদিকে বিয়ের সময়টা ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। তরীকে পার্লারে যাওয়ার জন্য তাড়া দেওয়া হলো। ইরা এসে বসে আছে তাকে নিয়ে পার্লারে যেতে।
পার্লার থেকে সোজা সেন্টারে চলে গেল ইরা আর তরী। সবাই উপস্থিত। বাবাকে মাত্রই আসতে দেখা গেল। শেষবার নিজ থেকেই ভাইকে নিয়ে আসতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিয়াসের বাবা আসবেন না মানে না। তরীর বাবা রিং ফেরত দিয়ে শেষমেশ ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।

বিয়ের কাজ কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। সবাই জানলো মাত্রই একজোড়া কপোত-কপোতী বন্ধনে আবদ্ধ হলো। তাদের পুরনো বিবাহের কথা চাপা রইলো নিজেদের মাঝেই। বিদায় বেলা ছিল তরী আর তার বাবার জন্য সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত। তরীর মায়ের কথা মনে পড়তেই বাবাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। ক্রমাগত হেঁচকি তুলে কেঁদেই যাচ্ছে।

বাবার চোখের অশ্রুও আজ বাঁধা মানছেনা। ২৪ বছর ধরে ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করা মেয়েটা চোখের পলকেই পরের অধীন হয়ে গেল। এই কয়েকটা মাস মায়ের অনুপস্থিতিতে বাবার সবরকম দেখাশোনা করেছে, সংসার সামলেছে তরী। বাবার কলিজা ফেটে এলেও তিনি খুব একটা প্রকাশ করতে পারলেন না। কেবল অশ্রুমাখা চোখে মেয়েকে বিদায় জানালেন। অরু অনবরত কেঁদেই চলেছে। মিঠুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তরী অরুকে বুকে জড়িয়ে মিঠুকে খুঁজে বেড়ালো। তরীর সাথে সাথে বাকিরাও মিঠুকে খুঁজলো।

মিঠু এককোনায় থম ধরে বসে আছে। রামি ব্যাপারটা জানাতেই অরুকে বাবার কাছে দিয়ে তরী এগিয়ে গেল। মিঠুর ঘাড়ে হাত রাখতেই সে হাসার চেষ্টা করে।
-“যাও অকর্মার ঢেঁকি। তেমাকে দিয়ে তো আমার কোন উপকার হলোনা। এবার তুমি ভালোয় ভালোয় বিদায় নিলেই তোমার ফোনটা আমি দখল করবো।”

বলতে বলতেই ঠোঁট ভেঙিয়ে কেঁদে ফেললো মিঠু। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করলো। তরী মিঠুকে বুকে চেপে ধরলো। মিঠু মায়ের মৃ*ত্যু*র সময় যেভাবে কেঁদেছিল, আজও তেমনটাই কাঁদছে।
-“তুমিও আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছো? মা তো অনেক আগেই পর করে দিয়েছে। তুমি আমাদের পর করে দিও না আপু।”

তিন ভাই-বোনই সমান তালে হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে। অরু কিছুতেই তরীকে যেতে দিতে চাইছেনা। ঝাপটে ধরে রেখেছে। আজ তার বড্ড একা একা লাগছে। ছোটো মানুষ বলে কাউকেই বোঝাতে পারছেনা। তরীও অরুকে রেখে এগোচ্ছে না। মাহমুদ নিজেই অরুকে কোলে তুলে বলল,
-“অরু আর মিঠু আমাদের সাথেই যাচ্ছে, তরী। তুমি প্লিজ আর কেঁদো না!”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৩

নিজ দায়িত্বে দাওয়াত খেয়ে নেবেন।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৫