চৈত্রিকা পর্ব ৪৩

চৈত্রিকা পর্ব ৪৩
বোরহানা আক্তার রেশমী

সিলিং এ সাথীকে ঝু’লতে দেখে চৈত্রিকা ‘সাথী’ বলে চিৎকার করেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। চৈত্রিকার চিৎকার শুনে প্রহরসহ বাড়ির কমবেশি সবাই ছুটে আসে। চৈত্রিকাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে কেউ কোনো দিকে না তাকিয়েই আগে চৈত্রিকাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চৈত্রিকাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার মাঝেই অর্থির নজর পড়ে খোলার দরজার ভেতরে। সাথীকে ঝু’লতে দেখে ভয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। নিবিড় ভ্রু কুঁচকে অর্থিকে আগলে নিতেই অর্থি ভয়ে ভয়ে আঙুল তুলে ঘরের ভেতর ঈশারা করে। নিবিড় সেদিকে তাকিয়ে নিজেও থমকে যায়। ছোট্ট করে প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘প্রহর ভাইজান সাথী!’
প্রহর নিবিড়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। চৈত্রিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ পিটপিট করতে থাকে। একে একে সবাই খেয়াল করে সাথী সিলিং এ ঝু’লছে। নীরা, অর্পিতা আর অর্থি মুহুর্তেই শব্দ করে কেঁদে ওঠে। প্রহর ফাঁকা ঢোক গিলে একবার সাথীর ঝু’লন্ত লা’শের দিকে তো আরেকবার তাকায় চৈত্রিকার অবচেতন মুখের দিকে। এর মাঝেই চয়ন, সাদিক, শিমুল, পিয়াসও চলে আসে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাথীকে ঝু’লতে দেখে পিয়াস হায় হায় করে ওঠে। প্রহর, চিত্র আর নিবিড় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। কারো মৃ’ত্যুতে যে পিয়াস হায় হায় করার মতো মানুষ না তা বোধহয় তাদের থেকে কেউ ভালো জানে নাহ। প্রহর কাউকে কিছু না বলেই চৈত্রিকাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে যায়।

সাথে ডাকে শায়লাকে। পল্লবী কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবে বুঝতে পারে নাহ। নাসিমার মতো কঠিন, পা’ষাণ মহিলাও সাথীর লা’শ দেখে কেঁপে উঠেছে। চিত্র পুলিশকে খবর দেয়। নিজেরা আগেই সাথীকে নামায় না। পিয়াস আচমকাই পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। উপস্থিত সবাই অবাক। পিয়াস কেনো কাঁদছে কেউ বুঝে ওঠে নাহ। নিবিড় অর্থিকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। বোকা মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে প্রায় নেতিয়ে পড়ছে।

জ্বর শরীরে নিবিড়ের মনে হলো সে বোধহয় স্বপ্নই দেখছে! হুট করেই তাদের বিয়ে আর এখন সাথীর লা’শ! এগুলো তো স্বপ্ন ছাড়া সম্ভব নয়। পরপর কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে চোখ পিটপিট করে ঝাপসা চোখ পরিষ্কার করে নেয়। মিনিটের মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে সাথীর মৃ’ত্যুর খবর। এই সাঝের বেলাতেই গ্রামের লোকজন একরকম ছুটে আসে প্রায়। জমিদার বাড়ি থেকে খবর দেওয়ার আগেই কথায় কথায় আজম আলী আর সনিয়া বেগম খবর পেয়ে যায়।

হুট করেই এমন একটা খবর দুজনের কেউ বিশ্বাস করে উঠতে পারে নাহ। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ছুট লাগায় জমিদার বাড়ির দিকে। বুকের ভেতরটা দুজনের চিনচিনে ব্যাথায় ছেয়ে গেছে। এর মাঝেই পুলিশও চলে আসে। সাথীর লা’শ তারাই নামায়। সাথীকে হলরুমে শুইয়ে রেখেছে। আশে পাশে জমিদার বাড়ির সবাই বসে কাঁদছে। সনিয়া বেগম জমিদার বাড়ির হলরুমে পা রাখতেই সবার কান্নার সুর ভেসে আসে।

ফাঁকা ঢোক গিলে ভীতু চোখে আশে পাশে চোখ বুলায়। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে সাথীর ফ্যাকাশে মুখ। মেয়েকে মেঝেতে শুইয়ে রেখে আশে পাশের লোকজন কাঁদছে! এই দৃশ্য একজন মায়ের কাছে কতোটা কষ্টের তা একজন প্রকৃত মা-ই বুঝতে পারেন। আজম আলী মেয়ের মুখ দেখেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেন। সনিয়া বেগম এগিয়ে মেয়ের কাছে পৌঁছাতে পারে নাহ।

জ্ঞান হারিয়ে তিনিও মেঝেতেই লুটিয়ে পড়েন। পল্লবী আর নীরা ছুটে আসে। দ্রুত সনিয়া বেগমকে ধরে সোফায় শুইয়ে দেন। মেইডকে ডেকে পানি এনে ছিটিয়ে দিতে থাকে মুখে। বাড়ির অবস্থা আরো খারাপ হয়। আশে পাশের লোকজন কা’না’ঘু’ষা শুরু করেছে। এতো ভালো একটা মেয়ে হুট করে আ’ত্মহ’ত্যা কেনো করলো এইটাই কেউ ভেবে পাচ্ছে নাহ। সনিয়ার বেগমের জ্ঞান ফিরানোর মাঝেই প্রহর নিচে নামে।

এতক্ষণ সে চৈত্রিকার কাছে ছিলো। এতোটা সময় চলে যাওয়ার পরও চৈত্রিকার জ্ঞান ফিরেনি। শায়লা আছে এখনো ওখানেই। বাড়ির পরিবেশ খারাপ হওয়ায় সে নিজেই চলে এসেছে। পুরো বাড়িতে মৃ’ত্যুর কান্না যেনো প্রহরের গায়ের লোমকূপ দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এই নির্দোষ মেয়েটা কেনো এমন একটা কাজ করলো এটা ভেবেই বুক ভারী হয়ে আসে। প্রহর রেনওয়াজ তো পা’ষান অথচ সাথীর মৃ’ত্যুতে সে নিজেকেই সামলাতে পারছে নাহ। প্রহর চুপচাপ এসে সাথীর লা’শের সামনে বসে থাকে। চয়ন আর সাদিক পুলিশের সাথে কথা বলেছে। তারা চায় লা’শকে পোস্টমর্টেম করতে। এটা শুনেই আজম আলী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘আমার মাইয়ারে আর কষ্ট দিয়েন না আপনারা। আমার মাইয়াটা এমনিতেই অনেক কষ্ট নিয়া দুনিয়া ছাড়ছে। ওরে কা’টা ছে’ড়া কইরেন না। দুনিয়াতে থাকতে মাইয়ার কদর করি নাই অথচ এখন আমার বুকটা ফা’ইটা যাইতেছে। আল্লাহ গো!’
প্রহর যথেষ্ট অপছন্দ করা স্বত্বেও আজম আলীর একেকটা আহাজারী অনুভব করতে পারলো। বেশি কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো নাহ। আশ পাশ হাতড়েও বলার মতো দুটো শব্দও সে পেলো না। কথা বলার সময় বুঝতে পারে তার গলা কাঁপছে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে একদম নিচু স্বরে বলে,

‘কোনো পোস্টমর্টেম হবে নাহ।’
পুলিশের এসআই বিনয়ের স্বরে বলতে চায়, ‘কিন্তু স্যার! এটা তো সুই’সা’ইড কেইস! আমাদের তো পোস্টমর্টেম করতেই হবে।’

‘করতে হবে নাহ। হবে না যখন বলেছি তখন হবে নাহ। তাছাড়া ওর বাবাও তো চাচ্ছে নাহ। সাথীর মা, চৈত্রিকা উনারা দুজনই অবচেতন। এখন তো আরোই কোনো রকম সিদ্ধান্ত নিতে চাই নাহ।’
এসআই চুপ করে যায়। এর মাঝেই সনিয়া বেগমের জ্ঞান ফিরে আসে। লাফিয়ে উঠে পল্লবীর হাত ধরে বলে, ‘জমিদার গিন্নি আমার সাথী কই? আমার মেয়েটা কই? আমার বুক খালি করে আমার মেয়ে কোথাও যায়তে পারে নাহ। কই আমার মেয়ে? দেখি সরেন!’

পল্লবী সনিয়া বেগমকে শান্ত করতে চাইলেও কোনো কাজ হয় নাহ। সনিয়া বেগম সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে পাগলের মতো নিজের মেয়ের কাছে যেতে চাইতে থাকে। ছুটে আসে নিজের মেয়ের লা’শের কাছে। মেয়ের মাথার কাছে বসে দু গাল আগলে নিয়ে পাগলের মতো বলতে থাকে,

‘মা! এই মা! তুই উঠবি না? দেখ আমি সব রাগ, অভিমান ভুলে তোর কাছে চলে আসছি। এই মা দেখ তোর মা আর কিছু মনে রাখে নাই। তাকাবি না মায়ের দিকে? মায়ের সাথে অভিমান হয়ছে মা? আচ্ছা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কখনো তোর সাথে রাগ করবো নাহ। তাকা আমার দিকে! আর কতক্ষণ ঘুমাবি! তাকা না মা!’
সনিয়া বেগমের এমন উন্মাদনা দেখে উপস্থিত সবাই কেঁদে ফেলে। নীরা এগিয়ে এসে সনিয়া বেগমকে কোনো রকমে বলে, ‘আম্মা এদিকে আসেন! এমন করবেন না আম্মা।’

সনিয়া বেগম এক ঝটকায় নীরার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। চোখ মুখ কুঁচকে নীরাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘কান্না করছো কেনো হ্যাঁ? দুরে যাও আমার থেকে। কাছে আসবে না একদম। আমি আমার সাথীর কাছে থাকবো।’

কথা শেষ করেই মেয়ের গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে বসে থাকে। মেঝেতে প্রায় গা ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে আগলে নিয়ে বসে থাকে। পাগলের মতো বিড়বিড় করে কি সব বলতেই থাকে। কেউ ভেবে পায় না এই মহিলাটিকে ঠিক কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়! এর মাঝেই সিড়ি দিয়ে উন্মাদের মতো ছুটে আসে চৈত্রিকা। চারপাশে কোনো কিছু না দেখেই সাথীর লা’শের পাশে বসে পড়ে৷ প্রহরসহ বাকি সবাই চমকায়। শায়লা পিছু পিছু এসে চৈত্রিকাকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু চৈত্রিকা কাউকে ধরতে দেয় নাহ। সাথীর পাশে আলগোছে বসে আস্তে আস্তে ডাকতে থাকে। কিন্তু ছুঁতে গেলেই সনিয়া বেগম হুং’কার ছাড়েন। চৈত্রিকার হাত টান মে’রে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে,

‘সর! দুরে যা আমার মেয়ের থেকে! খবরদার আমার মেয়েকে ছুঁবি না তুই। এই তুই যা! যা এখানে থেকে!’
সনিয়া বেগম রীতিমতো ধাক্কা দেয় চৈত্রিকাকে। অর্পিতা চৈত্রিকাকে ধরে কান্নারত অবস্থাতেই বলে, ‘কি করছেন মামি!’
চৈত্রিকা কোনো শব্দ করে না। সনিয়া বেগম কারোর কথা শোনেন নাহ। মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে ফের গালের সাথে গাল ঘেঁষে পড়ে রয়। চৈত্রিকার চোখ থেকে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়ে। প্রহর নিজ জায়গা থেকে উঠে এগিয়ে এসে চৈত্রিকার কাছে বসে। চৈত্রিকাকে আগলে নিয়ে নিজের বুকে ঠায় করে দেয়। চৈত্রিকা প্রহরের শার্ট আঁকড়ে ধরে কান্না করতে থাকে। প্রহর চৈত্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘কান্না করো না। মামির মাথা ঠিক নেই তাই এমন বলছে! নিজেকে সামলাও! তুমি নিজেকে না সামলাতে পারলে মামিকে সামলাবে কে?’
প্রহর যত সহজে কথা গুলো বললো ঠিক ততটাই কঠিন এই কাজগুলো। সে নিজেই নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে এরা নিজেদের সামলাতে পারবে এটা ভাবাই বোধহয় বিলাসিতা! চৈত্রিকা প্রহরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একদম ধীরে এগিয়ে যায় সনিয়া বেগমের দিকে। সনিয়া বেগমের দিন দুনিয়ার ধ্যান বোধহয় তখন নেই। চুপচাপ নিজের মেয়েকে নিয়ে পড়ে আছেন তিনি। চৈত্রিকা ফাঁকা কয়েকটা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে সনিয়া বেগমের বাহুতে হাত দেয়। কান্নারত, ভাঙা কন্ঠে মিনমিনিয়ে ডাকে,

‘মামি! ও মামি!’
সাথে সাথেই সনিয়া বেগম ভ’য়ং’কর হয়ে ওঠেন। নিজের মেয়েকে ছেড়ে তিনি সহসাই সোজা হয়ে উঠে ঠা’স করে থা’প্পড় বসিয়ে দেয় চৈত্রিকার গালে। চৈত্রিকার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

‘তুই না বলছিলি আমার মেয়েরে আগলাইয়া রাখবি! এই আগলাইয়া রাখছিলি আমার মেয়েরে! এইটাই তোর আগলাইয়া রাখার নমুনা! আমি তোরে নিঃস্বার্থে মেয়ের মতো ভালোবাসছি। আগলাইয়া রাখছি। কখনো তোর ওপর দুইটা ক’টু বাক্যও ছুড়ে মা’রি নাই। সেই তুই আমার মাইয়ারে কাইড়া নিলি! তুই কেমনে পারলি এইটা? কেমনে পারলি? আমার বুক খালি করতে তোর আত্মা কাঁপে নাই? তুই না এই জা’নো’য়া’রদের শা’স্তি দিতে আইছিলি! দেস নাই কেন? নিজের সংসারে মায়ায় পইড়া গেছিস তাই না! মাঝখান দিয়ে আমার মাইয়াডা ব’লি হয়ে গেলো। তুই! তুই আমার মাইয়ারে মা’ইরা ফেলছিস। তোরে কোনো দিন আমি মাফ করমু নাহ। দুর হ সামনে থেকে!’

চৈত্রিকাকে ছু’ড়ে মা’রে সনিয়া বেগম৷ পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। চৈত্রিকা পা’থরের মতো চুপচাপ শুধু বসে থাকে। প্রহর ফের আগলে নেয়। কিন্তু চৈত্রিকা অনুভূতিশূণ্যের মতো শুধু চেয়ে থাকে। চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়লেও মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সনিয়া বেগম পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে আঁচড় কা’টেন আর বিলাপ করতে থাকেন,

‘ওহ আল্লাহ! জীবনে বুঝে কখনো অ’ন্যায় করিনি। তুমি আমার কোন অ’ন্যায়ের শা’স্তি আমার মেয়েরে দিলা আল্লাহ! একজন মায়ের কোল খালি করলা কেমনে? আমার মৃ’ত্যুটা তুমি আগে দিলা না কেন?’
নিজের বুকেই নিজে থা’প্রাতে থাকে অনবরত। পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তার বুকের জ্বা’লা কেবল তিনিই বুঝছেন। তার নি’র্দোষ মেয়েটা অকারণেই চলে গেলো দুনিয়াবি ছেড়ে। একজন মায়ের কাছে এটার মতো কষ্টজনক বোধহয় আর কিছুই নেই।

রাতের অন্ধকার থাকা অবস্থাতেও সাথীর কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। গরমের দিন! সারা রাত লা’শ রাখলে লা’শ ধীরে ধীরে প’চন শুরু করবে৷ একেই তো আ’ত্ম’হ’ত্যা করা লা’শ! তাই কেউ দেড়ি করতে চাইলো নাহ। সাথীর ধোয়ানো থেকে শুরু করে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সনিয়া বেগম আকাশ পাতাল ফাটিয়ে চিৎকার করে কাদছিলেন। ৪/৫ জন মিলে ধরেও তাকে সামলানো দায় হয়ে যাচ্ছিলো।

শেষ সময়ে সাথীর কাছে আসেনি চৈত্রিকা। দুর থেকে একবার মুখ দেখেই ঘরে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে। প্রথমবারের মতো দুর্বল স্বত্তায় চৈত্রিকাকে দেখে প্রহর কিছুই করতে পারেনি। চুপচাপ নিজের বুকে আগলে রেখেছিলো। কিন্তু কবর দিতে যেতে হবে বলে সে চৈত্রিকাকে নীরা, অর্পিতা, শায়লার কাছে রেখে চলে যায়। চৈত্রিকার কান্নার দমকে তারা ৩ জনও কেঁদেছে।

প্রহর, আজম আলী, চিত্র আর নিবিড়ই খাটিয়া তুলেছিলো। অন্যদের ধরতে দেয়নি প্রহর। আজম আলী নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও পারে নাহ। পুরো রাস্তা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে৷ আ’ত্ম’হ’ত্যা করা লা’শ এবং রাতের বেলা হওয়া স্বত্বেও বেশ অনেক মানুষ জানাযায় সামিল হয়। কবর দেওয়া শেষে সবাই চলে আসলেও আজম আলী মেয়ের কবর ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।

প্রথমবারের মতো নিজের সমস্ত পা’প মনে পড়ে তার। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। প্রহর, নিবিড়, চিত্র ৩ জনই দাঁড়িয়ে দেখে। সত্যিই বোধহয় পৃথিবীতে হাজারটা খা’রাপ মানুষ থাকলেও কোনো খা’রাপ বাবা নেই। বেশ অনেকটা সময় পর ৩ জন মিলেই আজম আলীকে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। বাড়ির তখনো তুলকালাম অবস্থা। সনিয়া বেগম কান্না করতে করতে গলা ভাঙিয়ে ফেলেছে তবুও থামার নাম নেই।

বার বার সাথী সাথী করে কান্না করেই যাচ্ছে। প্রহর এক নজরে সবটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে যায়। চৈত্রিকা ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। কান্নাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। অর্পিতা, নীরা প্রহরকে আসতে দেখে নিজেরা বেড়িয়ে যায়। প্রহর দরজা আটকে চৈত্রিকার পাশে নিজেও শুইয়ে পড়ে। চৈত্রিকা টের পেয়েও কিছু বলে নাহ। প্রহর নিজে থেকে চৈত্রিকাকে টেনে নিজের কাছে আনে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। চৈত্রিকা মুখ গুজে দেয় প্রহরের বুকে। গা থেকে আতরের সুবাস ভেসে আসে। চোখ থেকে টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। হুট করেই প্রহরের থেকে ছিটকে সরে আসে। বড় বড় শ্বাস নেয়। প্রহর অবাক হয়। চৈত্রিকা চোখ বন্ধ করে বলে,

‘সবাই খু’নী। এরা সবাই খু’নী। কেউ ভালো নাহ। আমিও খু’নী। আমার জন্য সাথী ম’রে গেছে। আমি বাঁচতে চাই নাহ। কিন্তু তার আগে এদেরকে বাঁচতে দিতে চাই নাহ।’
চোখ মেলে তাকায় চৈত্রিকা। কান্নার ফলে চোখ ফুলে আছে। সাথে লাল হয়ে গেছে৷ ঘাড় ফিরিয়ে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সময়ের কাটা যত ঘুরবে তত একজন একজন করে জা’নো’য়া’রহীন হবে দুনিয়া। ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি সাথীর সাথে হওয়া অ’ন্যায়ের শা’স্তি দিতে না পারি তাহলে নিজেই নিজের গলা কে’টে ফেলবো। এটা আমার প্রতিজ্ঞা!’

চৈত্রিকা পর্ব ৪২

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গত পর্বে কমবেশি সবাই ধুয়ে দিছেন আমারে😑 সত্যি বলতে প্রতিটি চরিত্রের সাথে আমি নিজেই এমন ভাবে জড়িয়ে গেছি যে সাথীর মৃ’ত্যুর এই পর্বটা লিখতে গিয়ে বেশ কয়েকবার থেমেছি এবং আবার লিখেছি। জানি না কতটা আবেগ তুলে ধরতে পেরেছি তবে এটু্কু বলতে পারি এই পর্বটা একটু হলেও পাঠকগণের হৃদয় কাঁদাবেই। সাথীর সাথে হয়তো অ’ন্যায় হয়ে গেলো তবে সবকিছুর পেছনেই একটা করে কারণ থাকে। আশা করবো আপনারা বুঝবেন। না বুঝলে আমারে ধুয়ে দিতে থাকেন🌚)

চৈত্রিকা পর্ব ৪৪