চৈত্রিকা পর্ব ৪২

চৈত্রিকা পর্ব ৪২
বোরহানা আক্তার রেশমী

দিনকাল ভীষণ রকমের খারাপ যাচ্ছে অর্থির। কখনো মন খারাপ তো আবার কখনো শরীর ভীষণ খারাপ। চিত্রর বিয়ে শেষ হয়েছে প্রায় ১৫ দিন আগে। বউভাতের শেষে সেই যে নিবিড়কে দেখেছে তারপর আর ১৫ দিনে নিবিড়ের ছায়াটাও দেখা হয়নি। নিবিড়কে দেখার জন্য দিন দিন অস্থির হয়ে যাচ্ছে অর্থি।

অথচ আশ পাশ হাতড়েও নিবিড়ের দেখা পাচ্ছে নাহ। তার মাষ্টারমশাই কি এতোই অবুঝ! সে কি বুঝতেছে না ছোট্ট অর্থির মনের অবস্থা! মানুষটা কি এতোই পা’ষাণ হয়ে গেছে! নিবিড়ের কথা ভাবতেই ভেতরটা বিষাদে ভরে উঠে। জানালার কাছ থেকে সরে এসে বিছানার ওপর পা তুলে বসে৷ কিছুক্ষণ ঝিম মে’রে বসে থেকেও ভালো লাগে নাহ। কোনো কিছু না ভেবেই ঘর থেকে বের হয়। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে দেখে পল্লবী কাজ করছে। অর্থি ভয়ে ভয়ে নিচু স্বরে ডাকে, ‘আম্মাজান!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পল্লবী কাজ ছেড়ে তাকায় নিজের মেয়ের দিকে। মেয়ের পাংশুটে মুখ দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। নিজেও নরম স্বরে বলে, ‘কি হয়ছে আম্মা? কিছু বলবা?’
অর্থি মাথা নত করে বলে, ‘অনেক দিন থেকে তো বাহিরে যাই নাহ। আজ একটু যাই আম্মা? হিমানীদের বাড়ি পর্যন্তই যাবো। যাই?’
পল্লবীর মায়া হয়। এগিয়ে এসে মেয়ের কপালের একাংশে চুমু খেয়ে চুল কানের পিঠে গুজে দেয়। ছোট্ট করে বলে, ‘যাও! তাড়াতাড়ি আইসো আম্মা!’

অর্থি মাথা নেড়ে হাসে। নিজেও মায়ের গালে চুমু খেয়ে দৌড় লাগায়। পল্লবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অর্থি বাড়ি থেকে বের হয়ে মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে নেয়। বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাঁটতে থাকে হিমানীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিবিড়দের বাড়ি পেড়িয়েই হিমানীদের বাড়ি যেতে হয়। অর্থি কি মনে করে উঁকি দেয় বাড়ির মধ্যে৷ পুরো বাড়ি শুনশান দেখে খানিকটা অবাকই হয়। একটা ঘরের দরজা বাদে প্রায় সবগুলো ঘরের দরজা-ই বন্ধ। অর্থি বাড়ির মধ্যে ঢুকে দাঁড়াতেই গোঙানোর শব্দ আসে। অর্থি অবাক হয়। কেউ কি অসুস্থ! অর্থি সাহস নিয়ে উঁকি দেয় ঘরের ভেতর। সেখানে নিবিড়কে শুয়ে গোঙাতে দেখে চমকে ওঠে। কোনো কিছু না ভেবেই ছুটে নিবিড়ের কাছে যায়। ব্যস্ত স্বরে বলে,

‘কি হয়েছে মাষ্টারমশাই? এমন করছেন কেনো?’
জ্বরের ঘোরে অর্থির কন্ঠ শুনে তড়িঘড়ি করে চোখ মেলে তাকায় নিবিড়। চোখ পিটপিট করে অর্থিকে দেখে। জ্বরে চোখ ঝাপসা হয়। কোনো রকমে চোখ ডলে ভালো করে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি এখানে!’
‘আপনার কি হয়েছে আগে এটা বলুন! এমন লাগে কেন আপনার চোখ মুখ!’
নিবিড় রয়ে সয়ে বললো, ‘জ্বর আসছে।’

অর্থি সাথে সাথেই নিবিড়ের কপালে হাত দেয়। জ্বরের পরিমাণ দেখে ভীষণ রকমের ভয় পায়। অর্থি তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলে নিবিড় হাত টেনে ধরে। কোনো রকমে বলে, ‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘পানি আনি। আপনার মাথায় পানি ঢাললে জ্বর কমবে।’
‘লাগবে নাহ। তুমি বাড়ি চলে যাও!’
অর্থি অবাক হয়ে বলে, ‘কেনো?’

নিবিড় সঠিক জবাব না দিয়ে বলে, ‘যায়তে বলছি যাও!’
অর্থি শোনে নাহ। নাক মুখ কুঁচকে নিবিড়ের হাত শক্ত করে ধরে বলে, ‘আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকেন! চাচা, চাচি কই গেছে? তাদের দেখি না কেন!’
‘আম্মা নানী বাড়ি গেছে আর আব্বা দোকানে গেছে।’
‘আচ্ছা আপনি ছাড়েন আমি পানি নিয়া আসি!’

নিবিড় আরো শক্ত করে চেপে ধরে অর্থির হাত। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘তুমি আমার কথা বুঝো না কেন? চলে যায়তে বলছি কিন্তু আমি!’
অর্থি পাত্তা দিলো নাহ। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিছু না বলে বালতিতে করে অল্প খানিক পানি টেনে আনে। নিবিড়ের বার বার মানা করা স্বত্বেও কোনো রকম কথা কানে না নিয়ে অর্থি নিবিড়কে টেনে মাথায় পানি দেয়। বেশ অনেকটা সময় মাথায় পানি দেওয়ার পর বালতি সরিয়ে নিবিড়ের মাথা মুছিয়ে দেয়। তারপর সেই তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়েই নিবিড়কে জলপট্টি দেয়। নিবিড় চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘তুমি জিদ করতেছো কেন অর্থি? এভাবে আমার ঘরে কেউ তোমাকে দেখলে ভালো ভাবে নিবে নাহ।’
‘না নিলে না নিক! চুপচাপ শুয়ে থাকেন আপনি।’
নিবিড় ছটফট করতে থাকে। অর্থিকে এই সময়ে ভুল করেও কেউ তার ঘরে দেখলে সেইটা যে ভালো হবে না এটুকু সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলেও বোকা অর্থি বুঝতে পারছে নাহ। বেশ অনেকটা সময় জলপট্টি দেওয়ার পর নিবিড়ের জ্বরটা একটু হালকা হয়।

নিবিড় জ্বরের ঘোরে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে। অর্থি দু বার ডাকলেও নিবিড় জবাব দেয় নাহ। বোকা অর্থি ভেবে নেয় নিবিড় ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আলগোছে কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই নিজের ঠোঁট ছুইয়ে দেয় মাষ্টারমশাইয়ের কপালে। নিবিড় কেঁপে ওঠে। সাথে সাথেই বাহির থেকে দুজন লোক হৈ হৈ করে ওঠে। হুট করেই চেচামেচি আর হট্টগোলের শব্দে অর্থি আর নিবিড় চমকায়। চোখের পলকেই ঘটে যায় একের পর এক কান্ড।

নিবিড় আর অর্থির কথা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গেছে। যে দুজন লোক নিবিড় আর অর্থিকে একা ঘরে দেখেছিলো তারা যা তা বানিয়ে বানিয়ে বলে বদনাম রটাচ্ছে। জমিদার বাড়ির আঙিনায় সালিশ বসানো হয়েছে। সেখানেই আপাতত সবাই উপস্থিত। অর্থি একপাশে জড়োসড়ো হয়ে কান্না করছে। পাশেই পল্লবী, নাসিমা, শায়লা, নীরা, অর্পিতা, চৈত্রিকা দাঁড়িয়ে আছে। চয়ন, শিমুল, সাদিক, প্রহর, চিত্র সবাই বসে আছে। সামনেই অপরাধী ভঙ্গিতে নিবিড় আর নিবিড়ের বাবা দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের আরো বেশ কিছু লোকজন উপস্থিত আছে। দুরে দুরে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা সবটাই দেখছে। চয়ন গম্ভীর স্বরে নিবিড়কে বলে,

‘অর্থি তোমাদের বাড়িতে গেছিলো কেনো?’
নিবিড় কি বলবে বুঝতে পারে নাহ। গ্রামের একজন মুরব্বি ঠেস মে’রে বলে, ‘জমিদার সাহেব এই পেশ্নটা নিবিড় বাপজান রে না কইরা নিজের মাইয়ারে করেন তো! হেই কিল্লাইগা একলা একা মাইয়া হইয়া অবিয়াইত্তা পোলাডার ঘরে গেসে! এর উপর নাহি আরো কি আহাম কুহাম করছে! তা আপনের তো নিজের মুখ লুকাইয়া রাহান উচিত।’
চয়ন ক্ষে’পে ওঠে। গলা ফাটিয়ে ডেকে ওঠে অর্থিকে। অর্থি লাাফিয়ে ওঠে ভয়ে। কান্নার দমক বেড়ে যায়। পল্লবী শক্ত করে মেয়ের হাত চেপে ধরে। অর্থি ভয়ে নিজের মা’কে আঁকড়ে ধরতেই চয়ন বলে,

‘অর্থি এখানে আসো!’
অর্থি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বোঝায়। চয়ন রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই পল্লবী মেয়ের হাত টেনে সামনে এগিয়ে আসে। অর্থির কান্না তখনো বন্ধ হয়নি। বার বার কেমন কেঁপে উঠছে! নিবিড় জ্বর নিয়েও কোনো রকমে নিজের ভারসাম্য রেখে দাঁড়িয়ে থাকলেও অর্থির কান্না দেখে নিজের ভারসাম্য হারাতে থাকে। বোকা মেয়েটার এভাবে কান্না যে তার সহ্য হয় না মেয়েটা বোঝে না কেনো! ঝাপসা চোখে অর্থির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চয়ন অর্থির দিকে তাকিয়ে কড়া স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘গ্রামের মানুষ যা রটাচ্ছে এসব কি সত্য? তোমার আর নিবিড়ের মধ্যে কোনো রকম প্রণয় ঘটিত সম্পর্ক আছে? হ্যাঁ অথবা না তে জবাব দিবে!’

অর্থি কাঁদতে কাঁদতেই দুদিকে মাথা নাড়ায়। এর মাঝেই একজন বলে ওঠে, ‘মিছা কথা কইতেছে! আমরা নিজের চোক্ষে দেখছি ওরায় এক ঘরে! ছিঃ ছিঃ আমার কইতেই শরম করতাছে।’
নিবিড় প্রতিবাদ করে। কড়া কন্ঠে বলে, ‘মিথ্যা কথা বলতেছেন কেন? ও আর আমি কি এমন করছি যে আপনার লজ্জা লাগতেছে বলতে! আমাদের মাঝে তেমন কিছুই হয়নি। আমার আব্বা, আম্মা বাড়িতে ছিলো নাহ কিন্তু জ্বরে আমার অবস্থা খারাপ দেখে অর্থি আমার মাথায় পানি দিয়ে জলপট্টি দিয়েছে। আপনারা সব না দেখে না জেনেই অযথা দোষ দিচ্ছেন কেনো?’

নিবিড়ের বাবা নয়ন আহমেদ ছেলেকে ধমক দেন। নিচু স্বরে বলে, ‘চুপ কর নিবিড়!’
‘চুপ কেনো করবো আব্বা? উনারা অযথা ওই ছোট্ট মেয়েটার ওপর দোষ কেনো চাপাচ্ছে?’
এর মাঝেই ঠা’স করে শব্দ হয়। নিবিড় চমকে তাকিয়ে দেখে চয়ন অর্থিকে থা’প্পড় দিয়েছে। অর্থি ভয়ে জোড়ে কান্না করে ফেলে। চৈত্রিকা ছুটে আসে নিজ জায়গা থেকে। অর্থিকে জড়িয়ে ধরে। চয়ন রেগে চিল্লিয়ে বলে,
‘বেশি বড় হয়ে গেছো? জমিদারের মেয়ে হওয়া স্বত্বেও তোমাকে এসব করতে কে বলছে?’
প্রহর এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খোলে। গম্ভীর স্বরে বলে, ‘আব্বাজান ‘ও’ ছোট মানুষ। ওকে অযথা মা’রতেছেন কেন? আর কে কি বললো তা ধরতেছেনই কেন?’

চয়ন কিছু বলার আগেই আগের মুরুব্বিটা রাগী কন্ঠে বললেন, ‘মানতাছি আপনেরা জমিদার বংশের তাই বইলা কি নিয়ম মানতেন না? আপনাগো বাড়ির মাইয়া আর ওই পোলায় যখন এক লগে ধ*রা পড়ছে তহন ওগো বিয়া পড়ায় দেন!’
অর্থি আর নিবিড় দুজনেই চমকায়। চৈত্রিকা প্রহরের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ মানুষটা অর্থিকে নিয়ে ভীষণ সেনসিটিভ। সেখানে এতো কিছু কি হজম করে নিবে নাকি কথা বাড়াবে বুঝে আসলো নাহ। নিবিড় জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। চয়ন গম্ভীর স্বরে বলে,

‘আমার মেয়ের জীবন আমি ঠিক করবো ওর কার সাথে বিয়ে দেবো না দেবো! জমিদার বংশের মেয়ে হয়ে কখনোই একটা নিম্নবিত্ত পরিবারে আমি আমার মেয়ে দেবো নাহ। আর এই দুই লোক তোমার ঠিক করা তাই না নিবিড়! আমার মেয়েকে তুমিই উ’স্কিয়ে, ভুলভাল বুঝিয়েছো!’
নিবিড় চমকায়িত কন্ঠে বলে, ‘আমি ওকে উ’স্কাবো কেনো?’
‘এখন কিছু বুঝতেছো না তাই নাহ!’

চয়ন মুহুর্তেই দুজন মেইডকে ডাকে। তারা এসে চা’বুক দিয়ে যায় চয়নের হাতে। পুরো গ্রামবাসী হৈ হৈ করে ওঠে। চিত্র আর প্রহরও নিজ জায়গা ছেড়ে ওঠে। প্রহর ব্যস্ত গলায় বলে,
‘কি করছেন আব্বাজান! এগুলো কিন্তু অনুচিত। এখানে কথা বলার জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছে আর আপনি এটা কি করছেন!’

‘আমার মেয়ের জন্য যা ভালো হয় আমি তাই করছি। তোমরা চুপ করে থাকো!’
নয়ন আহমেদ রীতিমতো চয়নের পায়ে পড়ে যায়। ছেলের জান ভিক্ষা চেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। নিবিড় দ্রুত নিজের বাবার হাত চেপে ধরে। হাটু মুড়িয়ে নিচে বসে নিজের বাবাকে বলে, ‘কারোর সামনে নত হওয়ার দরকার নেই আব্বা। আমি জানি আমি কিছু করিনি।’

সাথে সাথেই গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিবিড়ের গায়ে চা’বুক ছুড়ে মা’রে চয়ন। নিবিড় ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে থাকে। অর্থি চৈত্রিকার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে আসে। নিবিড়কে আগলে বসেই কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘আব্বাজান মাষ্টারমশাইয়ের কোনো দোষ নাই। উনারে ছাইড়া দেন আব্বাজান! উনি কিছু করে নাই। উনার শরীর ভালো না। উনারে এভাবে মা’রলে উনি ম’রে যাবে!’

চয়ন পল্লবীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘ওরে এক্ষুনি সরাও!’
পল্লবী, শায়লা, নাসিমা মিলে অর্থিকে সরাতে নেয়। অর্থি বার বার কান্না করতে করতে নিবিড়কে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। তাতে চয়ন বিশেষ পাত্তা না দিলেও নিবিড় ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার জন্য অর্থির এই অস্থিরতা তার মনে শান্তি এনে দেয়। অর্থি চোখের আড়াল হতেই চৈত্রিকা এগিয়ে আসে। সরাসরি প্রহরকে বলে,
‘আপনি কিছু বলবেন নাকি আমি বলবো?’

প্রহর হাত বগলদাবা করে দাঁড়ায়। যেনো চৈত্রিকাকেই বলার অনুমতি দিলো। চৈত্রিকার কথায় চয়ন তার দিকে তাকায়। চৈত্রিকা কোনো কথা ছাড়াই আগে চয়নের হাতের চা’বুক টেনে ধরে। শক্ত কন্ঠে বলে,
‘উনাকে মা’রছেন কেনো? উনি কি করছে? গ্রামের কোন দুইজন কি দেখছে এতে যদি নিজের মেয়ের জন্য বিশেষ গুরুত্ব না দেন তাহলে নিবিড় ভাইয়ের বেলা গুরুত্ব দিচ্ছেন কেনো? আপনি জমিদার আর সে গ্রামের একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বলে!’

চয়ন ফুঁসে উঠে বলে, ‘বাড়ির বউ বাড়ির বউয়ের মতো থাকো! আমার কাজে বাধা দিলে এটা তোমার জন্য মঙ্গলজনক হবে নাহ। চা’বুক ছাড়ো!’
চৈত্রিকা উত্তর দেওয়ার আগেই গ্রামের লোকজন হৈ চৈ শুরু করে। কয়েকজন মুরুব্বি বিতর্ক করতে থাকে। চয়নকে সরাসরি বলে, ‘বড় বউ তো হক কতা-ই কয়ছে! আপনে তো নিবিড়রে মা’রতো পারেন না জমিদার সাহেব।

আর সব থেইকা বড় কথা হইলো আপনি নিবিড়রে মা’রেন, কা’টেন যাই করেন না ক্যারে! আপনার মাইয়ার বিয়া এই নিবিড়ের লগেই দেওন লাগবো। দু’র্নাম কিন্তু আপনার মাইয়ারই হয়ছে। মনে রাইখেন পোলা মাইনষের দু’র্নাম হয়ও না থাহেও নাহ। তাই আগে ভাগেই নিজের মাইয়ার বিয়াডা আগে দিয়া দেন! আর নাইলে আমরা আপনের ওই ক’লঙ্কিনি মাইয়ারে এই গেরামে থাকতো দিমু না। চুন, কালি মাখাইয়া গেরাম ছাড়া করুম।’

চয়ন ক্ষে’পে ওঠে। কিন্তু সকলের একই কথার পিঠে দমে যায়। চৈত্রিকা প্রহরের পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলে, ‘বিয়েটা হলে কি খুব ক্ষ’তি হবে জমিদার সাহেব? নিবিড় ভাইজান আর অর্থি কিন্তু একে অপরকে ভালোবাসে। যা-ই করবেন একটু ভেবে কইরেন!’

প্রহর ভেতরে ভেতরে চমকালেও বাহিরে প্রকাশ করে নাহ। চয়ন, সাদিক আর গ্রামবাসীর মধ্যে একটা ঝামেলা বাধতে খুব একটা দেড়ি হয় না। প্রহর সবাইকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘আমার বোনরে নিয়ে একটাও বাজে কথা বললে জিভ টেনে ছি’ড়ে নিবো। এতক্ষণ যাবত চুপচাপ সব দেখছি মানে কি প্রহর রেনওয়াজের সম্পর্কে সব ভুলে গেছেন! আপনারা চাইছেন নিবিড় আর অর্থির বিয়েটা যেনো দিয়ে দেই! ঠিক আছে। তাই হবে।’

চয়ন হুং’কার ছেড়ে বলে, ‘তুমি কি পা’গল হয়ে গেছো? কি যা তা বলতেছো?’
‘যা তা বলছি নাহ। আপনি নিজেই পরিস্থিতিটা আরো বিগড়ে দিয়েছেন আব্বাজান। আগে যা-ও কথা বলে সব সমাধান করা যেতো আপনি নিবিড়কে আ’ঘাত করে সেই পথও বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই আপনি চুপ থাকুন। আমি আমার বোনের খা’রাপ চাইবো নাহ। অন্তত নিজের স্বা’র্থের জন্য ওকে ব্যবহারও করবো নাহ। নিবিড় ভালো ছেলে। পড়ালেখা জানা ছেলে। তাছাড়া আমাদের অর্থিও যথেষ্ট পছন্দ করে ওকে। তাই বিয়েটাতে কোনো সমস্যা নেই।’

চয়ন এক পার্ট চেচামেচি করে রেগে চলে যায়। প্রহর সবার সাথে কথা বলে শান্তমতো। কিন্তু সবার একটাই কথা বিয়ে এক্ষুণি দিতে হবে নয়তো এক্ষুণি গ্রাম ছাড়তে হবে। প্রহর ঝামেলা বাড়ায় নাহ। নয়ন আহমেদের থেকে অনুমতি নিয়েই মসজিদের ঈমাম ডাকায়। ওই আঙিনায় বসেই কয়েক মিনিটের মাঝেই নিবিড় আর অর্থি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। কি থেকে কি হয়ে গেলো তা যেনো দুজনেরই মাথার ওপর দিয়ে যায়। বুঝতেই পারে না কিছু। দুজনেই ভাষাহীন। ওদের বিয়ে সম্পূর্ণ হতেই যে যার মতো চলে যায়। প্রহর গম্ভীর ভাবে নিবিড়কে বলে,

‘তোমার ভরসায় নিজের বোনকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। এমন কিছু করবে না যাতে আমার বোনকে কখনো কাঁদতে হয়! তাহলে যেভাবে তোমার ভালোবাসা পেলে ওভাবেই আমি কেড়ে নিতে দুবারও ভাববো নাহ। আপাতত বাড়ির ভেতর চলো! আযান দিয়ে দিবে এখনই।’
সবাই ধীরে ধীরে বাড়িতে প্রবেশ করে। চৈত্রিকা আশে পাশে কোথাও সাথীকে না দেখে নীরাকে জিজ্ঞেস করে, ‘সাথী কোথায় বুবু?’

‘আমি তো জানি না ভাবিজান। সাথী মনে হয় নিচেই নামেনি।’
চৈত্রিকা চমকে ওঠে। এতো ঝামেলার মাঝে তার একটু খেয়াল ছিলো নাহ। দ্রুত সবকিছু পেড়িয়ে সাথীর ঘরের সামনে যেতেই দেখে দরজা হালকা ভেজানো। চৈত্রিকা ভয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়। সাথে সাথেই আযান শুরু হয়। চৈত্রিকার চোখের সামনে সিলিং এ থাকা সাথীর লা’শ ঝুলতে থাকে।

চৈত্রিকা পর্ব ৪১

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ঈদের সময় যেহেতু বুঝতেই পারছেন ব্যস্ততার জন্যই কাল দিতে পারিনি। তবে এখন থেকে কিছুদিন প্রতিদিন গল্প পাবেন। রিচেক করা হয়নি একটু মানিয়ে নিবেন। আজকের পর্বটা এলোমেলো হয়েছে খুব!)

চৈত্রিকা পর্ব ৪৩