চৈত্রিকা পর্ব ৪১

চৈত্রিকা পর্ব ৪১
বোরহানা আক্তার রেশমী

বউ ভাতের জন্য সুন্দর করে সাজানো হয়েছে অর্পিতাকে। পুরো বাড়িতে আজও মেহমানের কমতি নেই। সকালের পর লজ্জায় আর চৈত্রিকা প্রহরের আশে পাশেও ঘেষেনি। প্রহর সকালের অবাকতাটা এখনো বোধহয় কাটিয়েই উঠতে পারেনি। কি থেকে কি হয়ে গেলো ভাবতেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। চারপাশের হট্টগোলের মাঝে বিরক্ত হচ্ছিলো সাথী। তাই চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। খানিক বাদেই দরজার বাহির থেকে চৈত্রিকা ডাকে। সাথী অলস পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। চৈত্রিকা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

‘একা একা কি করছিস? খাবি না তুই? জলদি চল!’
সাথী কোনো কথা না বলেই জড়িয়ে ধরে চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকাা একটু চমকায়। এক হাত সাথীর পিঠে রেখে নরম স্বরে বলে, ‘কি হয়েছে সাথী? মন খারাপ তোর!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাথী কোনো রকমে কান্না আটকে বলে, ‘আমি তোকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসি চৈত্র। তোকে বরাবরই নিজের বোন মেনে এসেছি। তোর সকল সিদ্ধান্তে আমি তোর পাশে থেকেছি। আমি সত্যিই চাই না তোর জীবনটা আরো এলোমেলো হোক! তুই এখান থেকে পালিয়ে যা বোন!’

সাথীকে সোজা করে দাঁড় করায় চৈত্রিকা। দু হাতে মুখ আগলে নিয়ে ভরসার স্বরে বলে, ‘ভয় পাচ্ছিস কেনো তুই? আমাকে চিনিস না? বুঝিস না? আমার যদি চলে যাওয়ার হতো তবে কি এখানে আসতাম? তোর হঠাৎ কি হয়েছে? পিয়াস রেনওয়াজ কিছু বলেছে তোকে? আবার কোনো ভয় দেখিয়েছে?’

সাথী জবাব দেয় না। মনে মনে ভীষণ আক্ষেপে ফেটে পড়ে৷ চৈত্রিকা বোঝে এতো সহজে কিছু বলার মেয়ে সাথী নাহ। অথচ এই সাথীই তাকে সবকিছু বলে শান্তি পেতো। ক’দিনের মাঝেই কি এমন হয়ে গেলো যে মেয়েটা তার থেকে কথা লুকাচ্ছে! চৈত্রিকা সাথীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে। অনেকক্ষণ নীরবতার পর বলে,
‘আমি জানি না কি কারণে তুই আমাকে নিয়ে এতোটা ভয় পাচ্ছিস! তোকে এর আগেও অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি পিয়াসকে বিয়ে করার কারণ কি! তুই কিছু বলিস নি। চুপ ছিলি পুরোটা সময়ই। তোর আমাকে নিয়ে ভয়ের কারণেই কি এই বিয়ে?’

সাথী নিঃশব্দে হাসে। ছোট্ট করে বলে, ‘সময় এলে তুই নিজেই সবটা জেনে যাবি।’
চৈত্রিকা হতাশার শ্বাস ফেলে। এ বিষয়ে যে এই মেয়েটা আর কিছুই বলবে না তা বুঝতে বাকি নেই। অগত্যা কথা না বাড়িয়েই সাথীকে টেনে নিচে নিয়ে যায় খাওয়ার জন্য। নিচে এসে সাথীকে খেতে বসিয়ে চৈত্রিকা চিত্র আর অর্পিতার কাছে যেতে নেয়। রাস্তায় পথ আগলে দাঁড়ায় পিয়াস। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চৈত্রিকা পিয়াসের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ পিয়াস বি’শ্রী রকম হেঁসে বলে,

‘কোথায় যাচ্ছেন ভাবীজান? অনেক তাড়া মনে হচ্ছে!’
চৈত্রিকা চোখ মুখ শক্ত রেখে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ। পথ ছাড়ুন!’
‘ছেড়ে দেবো তো। আগলে রাখার জন্য বসে নেই অবশ্য আমি। তো ২ বোনের একই বাড়িতে সময় কেমন কাটছে? বোন+বান্ধবী এখন তো জা হয়ে গেছেন। মজা হচ্ছে না?’

‘মজা হতো তো! কিন্তু আমার বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে একটা কু’কুরের সাথে তাই মজা বাদ দিয়ে একটু রেগেই আছি।’
চৈত্রিকা সূক্ষ্ম খোঁচা পিয়াসকে জ্ব’লিয়ে তোলে। ফোঁস করে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আপনি আমাকে কু’কুর বললেন!’
চৈত্রিকা না জানার মতো ভান করে বলে, ‘ছিঃ ছিঃ কি বলেন! আপনাকে কু’কুর বলার সাহস আছে নাকি আমার? কু’কুররাও তো লজ্জা পেয়ে যাবে!’

চৈত্রিকার একেকটা খোঁচা পিয়াসের মনে গেথে রইলো। দাঁতে দাঁত চেপে হজম করার চেষ্টা করে গেলো অনবরত। চৈত্রিকার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। চৈত্রিকা পিয়াসকে এড়িয়ে চলে যেতে নিলে পিয়াস আরো একবার ডাকে। ঠোঁটের কোণে কু’টিল হাসি ঝুলিয়ে বলে,
‘সব অ’পমান আজকের মতো গিলে নিলাম ভাবীজান। এগুলোর শোধ এক চালে দেবো। একটু সাবধানে থাকবেন!’

আত্মীয় স্বজন ধীরে ধীরে কমে গেছে বিকেলেই। পল্লবী সারাদিনের ধকল সামলে কেবলই রুমে ঢুকেছে। পেছন পেছন চৈত্রিকাও এসেছে। পল্লবী এসময় চৈত্রিকাকে দেখে খানিকটা চমকালেও তা বুঝতে দেয় না। হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘তুমি এই সময় বড় বউ! কিছু বলবা?’
চৈত্রিকা নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। মনে মনে সকল প্রশ্ন পর পর সাজিয়ে মুখ ভঙ্গি কঠিন করে৷ গম্ভীর স্বরে বলে,

‘আপনার সাথে কথা আছে আম্মাজান!’
‘হ্যাঁ বলো!’
চৈত্রিকা মিনিট দুয়েক ঝিম মে’রে দাঁড়িয়ে থাকে। পল্লবী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কিছু শোনার উদ্দেশ্যে! চৈত্রিকা চোখে চোখ রেখে সরাসরি বলে,

‘আমি আপনাকে যা জিজ্ঞেস করছি তার সরাসরি উত্তর দিবেন আম্মাজান। কোনো কিছু প্যাচাবেন নাহ। আমার এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার উদ্দেশ্য আপনি জানতেন প্রথম থেকেই? আমাকে নিজের প্রতি’শো’ধের হাতিয়ার বানালেন কেমন করে?’
পল্লবী এই দুটো প্রশ্নেই হকচকিয়ে যায়। কি উত্তর দেবে কিংবা মুখভঙ্গি কেমন করে তা বুঝেই উঠতে পারে নাহ। চৈত্রিকার এই হঠাৎ প্রশ্নগুলো যেনো তাার কাছে ধরা পড়ে যাওয়া চো’রের মতো। তবুও না দমে কন্ঠ শক্ত করে বলে,

‘আমি কিভাবে তোমার উদ্দেশ্য জানবো? কিসের উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছো তুমি? আর আমার কিসের প্রতিশো’ধ!’
চৈত্রিকা ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। হাত বগলদাবা করে শীতল কন্ঠে বলে, ‘আমি শুনেছি সবটা কাল। তবুও আপনি যদি অস্বীকার করতে থাকেন তবে ঠিক আছে! আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি কোনো রকম প্রতিশো’ধ ছাড়াই এ বাড়ির বউ হয়ে কাটিয়ে দেবো। এমনিতেও এখন জমিদার সাহেবকে ভালোবেসে ফেলেছি।’

পল্লবী আরো একবার চমকায়। শেষের বাক্য যে সত্য তা সে জানে। কিন্তু এই কঠিন মেয়েটি কি সত্যি প্রতিশো’ধ নেওয়ার খেলাটা ছেড়ে দেবে? পল্লবীর ভাবনার মাঝেই চৈত্রিকা উল্টো ঘুরে ঘর থেকে বের হতে নেয়। যত কদম এগোয় ঠিক ততোটাই অপেক্ষা করে আশাকৃত ডাকের। এবং তাকে সফল করে দিয়েই পল্লবী পিছু ডাকে। চৈত্রিকার হাসি প্রসারিত হয়। তবে মুহুর্তের মাঝেই তা বিলীন হয়েও যায়। পল্লবী গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে বলে,

‘বিছানায় বসো!’
চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে তাই করে। পল্লবী ঠিকমতো বাহিরটা পর্যবেক্ষণ করে ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়। চৈত্রিকার মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসে কিছুক্ষণ ঝিম মে’রে থাকে। চৈত্রিকা সময় দেয়। পল্লবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘তুমি এ বাড়ির বউ হওয়ার আগে থেকেই আমি তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলাম। তোমাকে এবাড়ির বউ হওয়ার সুযোগটাও আমিই করে দিয়েছি। চয়ন রেনওয়াজকে রাজি করিয়েছি আর বিয়ের প্রস্তাবটা তোমার মামিকে দিয়েছি।’
চৈত্রিকা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘সকল প্রশ্নের উত্তর দিন! আপনি কেমন করে জানলেন আমার প্রতিশো’ধ সম্পর্কে? নিজেরটার সাথেই বা কেনো গোলালেন আমাকে? আপনার সাথেই বা অতীতে কি হয়েছিলো? আর আপনি ছাড়া এসব কে কে জানে? আর আমার কেনো যেনো মনে হয় আমাকে দেওয়া পূর্বের সব চিরকুট, সব সাহায্য আপনার ছিলো! এটা কি সত্যি?’

পল্লবী সহসাই জবাব দেয় নাহ। ফের কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের উত্তরগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে নিলো। হাতে হাত চেপে চৈত্রিকার চোখে চোখ রেখে প্রথম থেকে বলতে শুরু করে,
‘আমার বিয়ের আগে আমি সদ্য মাধ্যমিক দেওয়া ছাত্রী ছিলাম। পড়ালেখায় ভালো হওয়ায় বাবা-মা এখনই বিয়ে দেবেন না বলে ঠিক করলেন। কিন্তু আমাদের গ্রামে একদিন চয়নের চোখে পড়ি আমি। চয়ন জমিদারের বড় ছেলে হওয়ায় বাবার মৃ’ত্যুর পর সেই জমিদারি কার্য পায়।

তার চরিত্র সম্পর্কে এই গ্রামসহ পাশের আরো প্রায় কয়েকটা গ্রামেও জানাশোনা ছিলো। জমিদারের ছেলে হওয়ায় কেউ কিছু বলতে নাা পারলেও নিজের মেয়েদের রাখে সাবধানে। আমি কিভাবে হুট করে যেনো ওর সামনে পড়ে যাই। এরপর আমার পিছে লাগে উঠে পড়ে। বাবা মা বিয়ে দিতে নারাজ হলে চয়ন সরাসরি মে’রে ফেলার হুমকি দেয়। বাবা মা এসবে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের নিয়ে গ্রাম ছাড়ে। কিন্তু পিছু পিছু সেখানেও চয়ন হাজির।

আমাদের বাড়িতে বয়ে এসে বাবাকে ফের কড়া গলায় বিয়ের প্রস্তাব দিলে বাবা রেগে থা’প্প’ড় বসিয়ে যা তা বলে দেয়। চয়ন ক্ষে’পে ওঠে। চারপাশের কিছু না দেখেই সেদিন রাতে আমার বাবা-মা’কে সেই বাড়ির মাঝেই পু’তে দেয়! চোখের সামনে নিজের বাবা-মা’কে মা’রতে দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে বি-বিবস্ত্র পাই। আমি চমকায়। চয়ন সেদিন শেষ চালে বাজিমাত করেছিলো।

আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে বাধ্য করেছিলো বিয়ে করতে। আমি তখন কাঠের পুতুল! অনুভূতিহীনের মতো বিয়েও করলাম। তবে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করলাম হয় ওকে মা’রবো নয়তো নিজে ম’রবো। ভাগ্যের পরিহাসে ওকে মা’রতে পারিনি আর না নিজে ম’রতে পেরেছি। আ’ত্মহ’ত্যা করার কথা ভাবলেও করতে পারিনি। বিয়ের পর হাজার বার হাজার ভাবে চয়নকে মা’রার চেষ্টা করেছি কিন্তু ‘ও’ এতোটাই চালাক, চতুর আর বিচক্ষণ ছিলো যে সবসময় আমাকে ধরে ফেলতো। আর এসবের জন্য আমার শা’স্তি ছিলো ভ’য়ং’কর।

একেকটা শা’স্তির কথা মনে পড়লে আমার এখনো শরীর কাঁপে। কখনো পিঠে চা’বুক দিয়ে মে’রে কেটে তাতে আবার লবণ, মরিচ লাগিয়ে দিতো, কখনো অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে দিতো, কখনো চা’মড়া ছি’লে নিতো! একেকটা শা’স্তির সময়ের আমার হাহাকার পুরো জমিদার বাড়ি কাঁপাতো কিন্তু ভয়ে কেউ এগোতো নাহ। কতোবার ওকে বলেছি আমাকে মে’রে ফেলতে কিন্তু মা’রেনি। জা’নো’য়া’রটা বাঁচিয়ে রেখে তিলে তিলে কষ্ট দিতে থাকে। এর মাঝেই জানতে পারি আমি অন্তঃসত্ত্বা। মাথায় পুরো আকাশ ভেঙে পড়েছিলো।

তখন আমি কিছু করলে যে আমার সন্তানটাও শেষ হয়ে যাবে এই ভেবে আর কিছু করতে পারলাম না। চয়ন নিজের সন্তান আসার খবরে খুশিই হয়েছিলো। তবে গোপনে এসে বলেছিলো আমি কিছু করলে এবার সবকিছুর শা’স্তি আমার সন্তান পাবে। মনে ঘৃ’ণা থাকলেও মাতৃত্ব আমাকে আর এগোতে দিলো নাহ। সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছি আমি। নিজের পরাজয়ের আক্ষেপে কেঁদেছি।

প্রহর হওয়ার পর আর কিছু করতে পারিনি। ছেলেটার কিছু করুক বা না করুক আমার যদি কিছু হয়ে যায় তখন আমার ছেলেটাকে একদম নিজের মতো অ’মানুষ বানিয়ে ফেলবে তা বুঝতে বাকি ছিলো নাহ। নতুন করে আরেক যু’দ্ধ শুরু হলো। চয়ন অ’ন্যায় করা শিখাতো আর আমি ছেলেকে ন্যায় শিখাতাম। ওরই অন্যায়কে কে’টে কুটে ন্যায়ে বদলে দিতাম। ছেলেটা হয়েওছিলো!

ওর বুঝ হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে পা’থর বানিয়ে দিলো চয়ন তবে মন থেকে ন্যায়, অ’ন্যায় মুছতে পারলো নাহ। প্রহরকে আমি মানুষ করতে পারলেও পিয়াসটাকে পারলাম না। একদম জাতের মতো হয়েছে। অ’মানুষ! চিত্রকে সবকিছু থেকে যথেষ্ট আগলে রেখেছে প্রহর। এতো বছরে সবকিছুর থেকে দুরে সরে এসেছিলাম শুধু মনে আক্ষেপের দলা গুলো টিকে ছিলো। এর মাঝেই সাদিক আর নাসিমার বিয়ে হয়।

কৌশলে ওদের সব ঘটনায় জানতে পারি আমি। তোমাকে দেখেছি আমি মহুয়ার মৃ’ত্যুর পর। জানতে পেরেছিলাম তুমি নাসিমার মেয়ে। তোমার সাথে কি হয়েছে সবটাই জেনেছিলাম। মনে হয়েছিলো এবার তোমার অ’ন্যায়ের সাথে সাথে নিজের সাথে হওয়া অ’ন্যায়ের শা’স্তিও হবে। তুমি বেঁচে আছো দেখে চয়ন প্রথমেই ভাবে তোমাকে মে’রে ফেলবে যেকোনো মূল্যে। ততদিনে আমি তোমার তেজ, সাহস সবটা সম্পর্কেই অবগত হয়ে গেছি। চয়নকে অনেক বুঝিয়ে প্রহরের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করলাম। কথা ছিলো বিয়ের পর প্রহর তোমাকে ধীরে ধীরে শা’স্তি দেবে। কিন্তু চয়ন আমার মূল উদ্দেশ্য জানতে পারেনি। ওর বিচক্ষণ বুদ্ধিও আমার কাছে হেরে গেছে। তোমাকে সব ধরনের চিরকুট, সাবধান বাণী সব আমিই দিতাম। অনেক সাবধানেই দিতাম।’

চৈত্রিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘জমিদার সাহেবকে নিয়ে যা বলতেন ওগুলো? নিজের ছেলেকে মা’রার জন্য উ’স্কে দিতেন আমাকে!’
‘নাহ নাহ। ওটা শুধুমাত্র তোমাকে দেখানোর জন্য ছিলো। আমি জানতাম বিয়ের পর তোমার ধারণা পাল্টাবে। আমি তোমার জীবন শেষ করে দেইনি। বরং তোমাকে তোমার যোগ্য জীবনসঙ্গী দিয়ে অ’ন্যায়ের শা’স্তি দেওয়ার সহজ রাস্তা দেখিয়েছি। আমি চাইলেই পিয়াস কিংবা চিত্রর সাথেও তোমার বিয়ে পাঁকা করতে পারতাম কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিলো তোমাকে শক্ত হাত দেওয়া।’

‘জমিদার সাহেব জানতেন সব? আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে উনি প্রথম থেকেই অবগত ছিলেন?’
‘প্রহর এক বছর আগের ঘটনা সবটাই জেনেছিলো। পরে এটাও জানতো তুমিই নাসিমার মেয়ে। তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে ওর দেড়ি হয়নি। নিজের স্বা’র্থে না, তোমার আর আমার স্বার্থেই বিয়ে করেছিলো তোমাকে।’

চৈত্রিকা অবাক হয়। ভীষণ রকম অবাক হয়। জমিদার সাহেব তার মানে সত্যিই সব জানতেন! সত্যিই কি চৈত্রিকাকে তার স্বা’র্থে বিয়ে করেছিলো নাকি এটার পেছনে জমিদার সাহেবের নিজেরও স্বা’র্থ আছে! ভেবে পেলো না। পল্লবী মাথা নিচু করে বসে আছে। চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পল্লবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘আপনার সাথে যা হয়েছে তা প্রচন্ড রকমের বা’জে হয়েছে। আপনার, আমার আরো যত মেয়ের সাথে অ’ন্যায় করেছে এরা! তার সবটুকু শা’স্তি আমি দেবোই। কথা দিলাম!’

পল্লবী অবাক চোখে তাকায়। চৈত্রিকা মুচকি হেঁসে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ভাবতে থাকে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ১ বছর আগের ঘটনা। সেদিন সত্যি সত্যিই চৈত্রিকা যখন ঘরে বই পড়ছিলো তখন বাড়িতে হৈ চৈ এর শব্দ হয়। চৈত্রিকা ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দরজা ঘেষে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিজের চোখে দেখেছিলো চয়ন, নাসিমা, সাদিককে! কি নি’ষ্ঠুর ভাবে চৈত্রিকার বাবাকে মে’রেছে!

একের পর এক আ’ঘাত করেই গেছে। চৈত্রিকা তখন গগনবিদারী চিৎকার করে ছুটে গেছিলো বাবার কাছে। কিন্তু নাসিমা তাকে পৌঁছাতে দেয়নি। চৈত্রিকা নিজের হাতটা শাড়ি ভেদ করে কোমড়ে রাখে৷ সেখানে এখনো একটা দাগ জ্বলজ্বল করছে। এই দাগটা তার মায়ের দেওয়া। নিজে হাতে তাকে ছু’ড়ির আ’ঘাতটা এই মা-ই দিয়েছিলো। জন্মও সে দিয়েছিলো আর মৃ’ত্যুও সেই দিতে চেয়েছিলো। ভাগ্য ভালো থাকায় শুধু আঁচড় পড়েছিলো জায়গাটাই। তবে আঁচড়টাও ছিলো ভীষণ গভীর। তখন বার বার চৈত্রিকার বাবা বলছিলো, ‘আমার চৈত্রকে ছেড়ে দাও! ওর তো কোনো দোষ নেই। ওকে মে’রো না! চৈত্র মা আসিস না কাছে। চলে যা মা!’

নাসিমার মন গলেনি। চৈত্রিকার শত আহাজারিতেও তার বাবার কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। ধাক্কা মে’রে ঘরে আটকে পুরো বাড়িতে আ’গুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। চৈত্রিকার আহাজারি, হাহাকার কেউ শোনেনি। নি’ষ্ঠুর গুলোর একটুও মায়া হয়নি। ভেবেছিলো চৈত্রিকা আর তার বাবা পু’ড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু বাড়িতে আ’গুন লাগার কয়েক মিনিটের মাথাতেই র’ক্তাক্ত শরীর নিয়েই মেয়েকে বাঁচিয়ে ছিলেন চৈত্রিকার বাবা।

আজও বাবার কথাগুলো চৈত্রিকার কানে বাজে। নিজের বাবাকে সে চোখের সামনে নিঃশ্বেষ হতে দেখেও কিছু করতে পারেনি। শেষ বারের মতো প্রিয় বাবার মুখটাও দেখার মতো ছিলো নাহ। সব পু’ড়ে ছাই হয়ে গেছিলো। চৈত্রিকার আক্ষেপ সে তার বাবাকে বাঁচাতে পারেনি! ভেতরের আক্ষেপ গুলোই হিং’স্র হলো।

প্রতিশো’ধের নেশায় বুদ হয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে প্রতিজ্ঞা করলো! কঠিন প্রতিজ্ঞা! ছোট্ট মেয়েটি নিজের বাবাকে চোখের সামনে ছটফট করে মা’রা যেতে দেখে, বাবার আহাজারি দেখে, তাকে বাঁচানোর সর্বস্ব চেষ্টা দেখে আর নিজের মায়ের বিশ্বাসঘা’তকতা দেখে হুট করেই বড় হয়ে গেলো। সব কিছু থেকে অনুভূতিহীন হয়ে হুট করেই সাহসী, তেজী হয়ে উঠলো।

চৈত্রিকা পর্ব ৪০

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। যদিও রমজান মাসে প্রতিদিন দুপুর বেলাতেই দিয়েছি কিন্তু ১ম পরিচ্ছেদের মতো এখন থেকে রাতেই পাবেন। নির্দিষ্ট কোনো টাইম বলতে পারছি নাহ তবে রাতেই দেবো। আর যেহেতু আপাতত কলেজ, কোচিং সব বন্ধ আর রমজানও শেষ তাই চেষ্টা করবো কিছুদিন নিয়মিত দেওয়ার। সবশেষে সকলকে ঈদ মোবারক। ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা প্রিয় পাঠক/পাঠিকা🖤)

চৈত্রিকা পর্ব ৪২