হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩৭

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩৭
সাইয়ারা মম

-তুলি তুই এখানে কি করছিস ?
মাহিন অবাক হয়ে কথাটি বললেও তুলি কথাটিকে গুরুত্ব দিল না । একটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল
– কেন আর কার থাকার কথা বলছো ?
মাহিন একটু ইতস্তত করতেই তুলি ব্যঙ্গ করে বলল

– ও নীলুর কথা বলছো ? ও তো বলল মিহু নাকি মাঝ রাস্তায় কোন বিপদে পড়ছে তাই চলে গিয়েছে । আচ্ছা এসব কথা বাদ দাও তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে ।চলো নিচে
মাহিন তুলির দিকে তাকিয়ে নিচে চলে গেল । নীলু ওকে না বলে চলে গেল ? কথাটি ভাবতেই কেমন একটা বিষাক্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন হলো । সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে সদর দরজার দিকে চলতেই কোথা থেকে একটা আওয়াজ আসলো । আওয়াজ অনুসরণ করে দাদুর রুমের দিকে গেল । দরজায় হাত রেখে খুলতে যাবে ঠিক সেই সময়

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– ভাইয়া তুমি ওখানে কি করছো ?
– এখান থেকে একটা আওয়াজ এসেছে । আওয়াজ আসলো কি থেকে সেটা দেখতেই আসলাম
– তুমি এখন এটা নিয়ে বসে আছো ? ওদিকে সবাই তোমার অপেক্ষা করছে । চলো তো
মাহিনের মাথায় নীলুর কথা ঘুরছে বিধায় তেমন গুরুত্ব দিল না বিষয় টিতে । তুলির সাথে অন্য মনস্ক হয়ে চলে গেল । তুলি বিষয় টি দেখে মাহিনের অগোচরে একটা শয়তানি হাসি দিল । মনে মনে বলল

– নীলু তোমাকে আমি বলেছিলাম অতি বাড় বেড়ো না ঝরে পড়ে যাবে । আমার সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া । কত করে বললে না তোমায় যেরকম দেখায় আসলে তুমি সেরকম না । এখন দেখি তুমি কিরকম ? পারলে নিজেকে বাঁচাও
নীলুর জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে মিহুর দাদুর রুমে বাধা অবস্থায় পেল । একটু আগের কথা মনে করতেই মনে পড়ল কেউ ওকে মাথায় আঘাত করেছে আর তাতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ।

অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারল না কারণ ওর হাত পা আর মুখ বাধা ছিল । অনেক কষ্ট করে টেবিলের ওপর থেকে একটা বক্স ফেলল । তাতে শব্দ হওয়ার পরে মাহিনের কথা শুনতে পেল । নীলু মনে মনে অনেক প্রার্থনা করল মাহিন যেন ওকে এসে উদ্ধার করে । মাহিনের হাবভাবে বোঝা গিয়েছে যে মাহিন ও নীলুকে চায় । আর কিছু হোক বা নাই হোক ভালোবাসার জোরে যেন মাহিন এদিকে আসে । কিন্তু হঠাৎ তুলির কথায় নীলুর হৃদস্পন্দন থেমে গেল । চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল । নীলু চিৎকার করে বলতে চাচ্ছিল

– প্লিজ মাহিন ভাই আমাকে ফেলে যাবেন না । আপনার ভালোবাসার পরশ না পেয়ে আমি এই পৃথিবী ছাড়তে চাচ্ছি না । আমার মনে হচ্ছে আর আপনাকে দেখতে পারবো না । তবুও বলব আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি মাহিন ভাই
কিন্তু এসবের কোন কথাই মাহিনের কানে পৌঁছাল না । ভালোবাসার যতই শক্তি থাকুক না কেন মনের কথা জানার শক্তি নেই । নীলুর কাছে যে আশার আলো ছিল সেটা দপ করে নিভে গেল । সদর দরজা শব্দ করে বন্ধ হওয়ার আওয়াজ নীলুর হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেল । খুব করে আরফানের কথা মনে পড়ছে । বার বার বারণ করেছিল কিন্তু নীলু শুনল না । নীলু কাঁদতে থাকলো কিন্তু কিছুক্ষণ পরে নিজেক শক্ত করে বলল

– না নীলু তোকে নিজেকেই নিজের মুক্ত করতে হবে । নিজেকে বাঁচা তুই ।
নীলু কে টেবিলের সাথে বেধে রাখা ছিল । অনেক দ্রুত ওকে বাধার কাজটি করতে হয়েছিল বিধায় ওর শাড়ি দিয়েই ওকে বেধেছিল । হাতের নখ দিয়ে পেছন থেকে শাড়ির সুতা ছেড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না । অনেকক্ষণ পড়ে তিন কি চারটি সুতা ছিড়ল । তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়ল ।

আবার নিজেকে উৎসাহ দিয়ে কাজে লেগে পড়ল । প্রায় একঘন্টা এরকম করতে গিয়ে নখ থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়েছে । তারপরও শাড়িটা সব ছিড়তে পারল না । নীলু তবুও হাল ছাড়ল না । অনেক চেষ্টার পরে শাড়িটা ছিড়ে ফেলল । এতে নিজেকে মুক্ত করলেও হাতের বাধন ও ছিল টেবিলের সাথে । একটা বাধন খোলার পরে নীলু একটু শক্তি পেল । টেবিলটি ধরে ঝাকাতে লাগল ।

সেখান থেকে বিভিন্ন জিনিস পত্র পড়ার শব্দ হলো । নীলু অনেক কষ্ট করে হাতে বাধন খুলল তারপর নিজেকে মুক্ত করল । খুশি মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে লাগল । তখনই দরজার কাছে কারো হাটা শব্দ পেল । নীলুর মন খুশি হয়ে গেল । নিশ্চয়ই মাহিন এসেছে ভেবে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল মাহিন না এসে যদি আর কেউ এসে থাকে ? নীলু তাড়াহুড়ো করে লুকিয়ে পড়লো । আর তখনই দরজা খুলে কেউ ঘরে ঢুকল

মিহু বাসার সামনে এসে অবাক হয়ে গেল । এখন কি লোডশেডিং হচ্ছে নাকি ? না হলে বাসা অন্ধকার থাকবে কেন ? মেইন দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল । দরজা খোলা কেন ? আরফানের আবার কিছু হলো নাকি ? কথাটি মিহুর মাথায় আসতেই ভয় পেয়ে গেল । দ্রুত ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল সব জায়গায় অন্ধকার কিন্তু মোমবাতি দিয়ে রাস্তার মতো করে সারি সারি মোমবাতি সাজানো । আর তার মধ্যে গোলাপের পাপড়ি । দেখানো পথ দিয়ে হাটতে হাটতে আরফানের রুমের সামনে গেল । সেখানে একটা কাগজে লেখা

‘ ভেতরে প্রবেশ করুন ‘
মিহু ভেতরে প্রবেশ করতেই সারা রুম অন্ধকার দেখল । লাইট জ্বালাতেই মিহুর চোখ ধরে গেল । সারা রুমে গোলাপের গন্ধে মৌ মৌ করছে । বেডের ওপরে একটা বক্স রাখা আর সেখানে একটা চিরকুট ।
‘ মিহু আজকে আমার মনের মতো করে সাজবে ? তোমার ঐ অপরূপ রূপ দেখে ঘায়েল হতে চাই সব সময় । তুমি কি হবে আমার বেলী ফুল ? ‘

তারমানে আরফানের সব মনে পড়ে গিয়েছে? এ সুখ কোথায় রাখবে মিহু ? ওর ছোট্ট জীবনে এত আনন্দ কখনো পায়নি । বক্স খুলে সেখান থেকে একটা সাদা আর সোনালী রং এর মিশ্রণের কারুকাজের জর্জেট শাড়ী । তার ভেতরে আরেকটা চিরকুট

‘ একটু আমার জন্য চুল গুলো খোঁপা করো ‘
মিহুর চোখে পানি এসে গেল । ও দ্রুত শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল । রেডি হয়ে নিজেকে আরেকটু পরিপাটি করে বসল । কিন্তু এখন কোথায় যাবে ?
তখন বেডের ওপরে আরেকটি বক্স দেখতে পেল । বক্স টির রেপিং পেপার খুলে একটা ছোট পারফিউমের শিশি দেখতে পেল । আরো একটা চিরকুট পেল
‘ তোমাকে আমি কখনো উপহার দিতে চাইনা । আমি তোমাকে আমার একটা স্মৃতি দিতে চাচ্ছি । এই স্মৃতি তুমি যত্নে রেখ

অপর পৃষ্ঠায় লেখা ‘ আমাদের প্রথম মিলন স্থানে অপেক্ষা করছি ‘
বেলী ফুলের সুবাসের পারফিউম মিহুকে মুগ্ধ করল । নিজেকে বেলী ফুলের সুবাসে আবদ্ধ করল । তারপর রওনা দিল বাগানের উদ্দেশ্যে ।

আরফান বাগানের বেলী ফুল গুলো দিয়ে একটি গাজরা তৈরি করেছে মিহুর জন্য । এতক্ষণ বাতাসে বেলী ফুলের সুবাস হালকা থাকলেও এখন কড়া হতে লাগল । এর মানে আরফানের বেলী ফুল এসে গিয়েছে । আরফান পেছনে ঘোরার আগেই মিহু আরফানকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিল ।
– আপনার স্মৃতি মনে পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ । আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না ।
আরফান মিহুর হাত ধরে মিহুকে ওর সামনে আনলো । তারপরে মিহুর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
– মিহু আজ আমি নিজের হাতে তোমার ঐ খোপায় বেলী ফুল পড়াতে চাই ।

মিহু পেছন ঘুরলে আরফান মিহুর খোপায় বেলী ফুলের গাজরা গুঁজে দেয় । তারপর ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে
– আজ আমি কোনো দূরত্ব চাই না । আমি আমাদের সম্পর্ক টিকে মজবুত করতে চাই
মিহু লজ্জায় নুয়ে গেল ।
– কিন্তু তার আগে কয়েকটা কথা ক্লিয়ার করতে চাই । যেটা না জানালে আমাদের সম্পর্কে জোড়া লাগার আগেই ফাটল ধরবে । আমার আসলে স্মৃতি হারায় নি । আমি অভিনয় করেছিলাম ।

এমন একটা মুহূর্তে এসে এরকম একটা কথা শুনে মিহুর ঝটকার মতো লাগল । আরফান এসব কি বলে ?
– জানি তোমার কাছে বিষয় টা খারাপ লাগছে কিন্তু আমাকে আগে ক্লিয়ার করতে দাও । আমার সব থেকে কাছের বন্ধু আমাকে ধোঁকা দিয়েছে । আমি জানতাম আমার কোনো শত্রু আছে যে আমার ক্ষতি করতে চায় । এমন কি তোমার ও ক্ষতি করতে পারে । এই জন্য আমাকে নাটকটি করতে হয়েছে ।

– কিন্তু আপনি তো আমাকে এই বিষয়ে জানাতে পারতেন ? তাই না ?
– পারতাম বললে ভুল হবে না । তবে তোমাকে ঐ পরিস্থিতিতে জানাতে পারিনি ।
– এখন আপনি সবাইকে ব্যাপারটি জানাতে চাচ্ছেন ?
– না শুধু তোমাকে । বাকিদের কাছে আমি এখন আমার কম্পানির বিষয় টি বলতে চাচ্ছি না ।
– কম্পানির বিষয়?
– ফারিশ আমার কম্পানি আমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছে ।

মিহুর রাগ উঠলো । আরফানের সামনে পায়চারি করতে লাগল । আরফান সেটা দেখে মুখ কালো করে ফেলল । বলল
– মিহু তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ?
মিহু পাঞ্জাবির কলার ধরে টেনে দাতে দাত চেপে বলল – ছেড়ে যাওয়ার কথা আমি প্রথম দিনেই বলেছি । যে বাঙালি নারীরা এক সংসারে বিশ্বাসী আর আমিও এর ব্যতিক্রম নই ।
– তাহলে এমন করছো কেন ?

– কেন বুঝেন না ? এত সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে আমাকে তৈরি হতে বললেন এই ব্যাপারটি জানানোর জন্য ? মানে আমার দিকে একবারো তাকালেন না পর্যন্ত? কেমন দেখাচ্ছে সেটাও বললেন না । আর নিয়ে আসলেন কি ?

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩৬

আরফান এবার নিজের ধাচে ফিরে এসে বাকা চোখে মিহুর দিকে তাকিয়ে বলল – তোমাকে তো দেখতে আস্ত একটা বেলী ফুল লাগছে ? এই দেখো তোমার শরীর থেকে সেই সুবাসটা আসছে । আর তুমি তো জানোই বেলী ফুল আমি কত ভালোবাসি ? তা আমাকে কি শুধু অন্তরেই ভালোবাসবে ? নাকি মুখেও স্বীকার করবে ?

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩৮