হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪৫

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪৫
সাইয়ারা মম

সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা প্রবাদটি যেমন ঠিক তেমনি কঠিন সময় পার হতে এক যুগ কেটে যায় কথাটিও ঠিক । তিল তিল করে সময় পেরোচ্ছে নীলুর এক্সিডেন্টের পরে । তবে সেই সময় গুলোকে যোগ করলে একটা বড় অঙ্কের যোগফল পাওয়া যাবে । সেই দিন আল্লাহ কাউকেই হতাশ করেন নি ।

নীলুর অপারেশন সাকসেসফুল হলেও নীলু চিরতরের জন্য কোমায় চলে গিয়েছে । কখনোই আর আগের মতো হতে পারবে না । যদি আলাদিনের চেরাগের কোনো দৈত্য এসে নীলুকে ভালো করে দেয় সেটা ভিন্ন ব্যাপার । কারণ আলাদিনের চেরাগ রূপ কথাতেই সম্ভব বাস্তবে নয় । নীলুর এক্সিডেন্টের এক মাস হয়ে গেল ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাহিন তো হাসপাতালের রুমকে নিজের ঘর বানিয়ে ফেলেছে । এখানেই ঘুমায় আবার এখান থেকেই অফিসে যায় । আবার অফিস থেকে এখানেই ফেরে । কারণ ও ঐ বাসায় যেতে চায় না যেখান থেকে নীলুর ক্ষতি হয়েছে আর জানতেও চায় না তুলি বা ওর মায়ের সাথে কি হয়েছে ।

নীলুকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নেওয়া সম্ভব নয় । কারণ যেহেতু আরফানের কম্পানি টা নেই তাই ওর আয়ের উৎস শূণ্য । ব্যাংকে যে পরিমাণ টাকা আছে তার অর্ধেকই নীলুর পেছনে খরচ হচ্ছে । যদিও নেহাল ও সাহায্য করছে । তবে নেহালের একার আয়ে সব কিছু চালানো টা সম্ভব হচ্ছে না । আবার ঐ ঘটনার পরে মিহুও একটু হালকা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সব মিলিয়ে আরফান একদম সম্বলহীন প্রায় । এদিকে পিহু প্রেগন্যান্ট । তাই নেহাল ও সব দিকে সামাল দিতে পারছে না ।

ঐদিন পুলিশ আসতে একটু দেরি করেছিল কারণ আতরের গোডাউনে ঢুকে আস্তানার মেইন দরজা খুঁজতে টাইম লেগেছিল । কিন্তু তারা আসার আগেই তুলি আর ওর মা মারা গিয়েছে । সরোয়ার বেঁচে থাকলেও হাসপাতালে নেওয়ার পরে মারা গিয়েছে।তারা বিষয় টা তদন্ত করে দেখবে আর বাকিদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে ।

সব কিছুর যেহেতু অবসান ঘটেছে তাই প্রিয়ন্তি চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আরফানের অনুরোধ আর মিহুর মায়া ভরা চাহনি তাকে যেতে দেয়নি ।
নেহালের আয়ে বসে বসে খাওয়াটাকে আরফানের কাছে ভালো লাগছে না । ওর নিজের কিছু করতে হবে তবে সেটা করতে টাইম লাগবে । তাই আরফান বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে কারণ ও চাচ্ছে না ওর জন্য সবাই আরো কষ্টে পরুক ।

– মিহু তোমার হলো ? আর কতক্ষণ লাগবে ? যেতেও তো টাইম লাগবে নাকি ?
সিড়ির গোড়ায় বসে গলা উচিয়ে কথা গুলো বলছিল । ভারী লাগেজ টেনে নিয়ে আসতে মিহুর টাইম লাগছে । যদিও আরফান বাকি গুলো নিয়েছে তবে এই লাগেজে ওর নিজের সব কিছু আছে সেটাই নিতে ওর কষ্ট হচ্ছে ।সিড়ি দিয়ে বহুত কষ্টে নেমে বলল

– চলুন ।
– কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
রেবেকার প্রশ্নে দুজনেই থমকে দাঁড়ায় । মিহু কাচু মাচু হয়ে বলল – মা আপনাকে তো আগেই বলেছি আমরা একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি সেখা থাকবো ।

– মানে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছো ?
মিহু উপর নিচে মাথা ঝাকালো । রেবেকা রাগন্বিত হয়ে বলল – আমি কি তোমাদের যেতে অনুমতি দিয়েছি ? তারপর উচ্চস্বরে বলল – একটা চড় মারবো । যাও নিজের রুমে যাও
মিহু আরফানের দিকে একবার তাকিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো ।

– আবার দাঁড়িয়ে আছে ? যেতে বলেছি না ।
– দেখুন মিসেস আকবর আপনি এভাবে ,,,
– চুপ । অ*সভ্য ছেলে !
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটা সদস্য অবাক হয়ে আছে । রেবেকা আরফানের সাথে এর আগে এমন অধিকার বোধ দেখিয়ে ব্যবহার করেনি । এমন কি আরফান নিজেও অবাক হয়ে আছে

– নিজের মাকে কেউ বাবার মিসেস বলে ডাকে ?
– আপনি ?
– আপনি কি ? হ্যাঁ কি বলবে ? বলবে এইতো যে আমার সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই ? আগে এটা ঠিক থাকলেও এখন আর নেই । কারণ আমার রক্ত তোমার শরীরে বইছে । তাই এতদিন আমি যেটা পারতাম না সেটা এখন জোর করে হলেও পারব ।

– কিন্তু আমি আমার ভাইয়ের টাকায় বসে বসে খেতে পারব না ।
– তাহলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাও । ভাই তুমি আমাকে ভাই হিসেবেও গ্রহণ করো আবার তার টাকাকে পর পর ভাবছো ? এতদিন কি আমরা তোমার ইনকামে খাই নাই ? তাহলে এখন তুমি এরকম করছো কেন ? তাহলে কি তুমি আমাকে আপন ভাই ভাবো না ?

– নেহাল সেরকমটা নয়
– তাহলে আর কোনো কথা নয় ।সব কিছু রুমে রেখে আসো ।
তখনই পিয়াসের বাবা এসে সোফায় ঠাস করে বসে পড়ল । আরফান তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল
– পিয়াসের কোনো খোঁজ পেলে ?
– না , অনেক খুজলাম কিন্তু কেউ কোনো খবর দিতে পারল না । সব কিছু ভালো ভালো কাটলেও পিয়াস আর বিদিশা যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল কেউ জানে না ।

৭ বছর পরে ,(কানাডার একটা আভিজাত্য হোটেল রুমে )
– ইয়াশা মামণি । এই কাগজটা পাপাকে দিয়ে আসো তো ।
মেয়েটি রুম থেকে দৌড়ে ব্যালকনিতে চলে গেল । সেখানে বসে তার বাবা আকাশের তারা দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে । তখন তার ৪ বছরের মেয়েটা আধো আধো বাংলাতে বলল

– পাপা , মাম্মি গিভ ইউ দিস কাগজ ।
তখন সে তার মেয়েকে কোলে নিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে
– মামণি ঠিক ভাবে বাংলাতে বলোতো
– মাম্মি গিভ
– না হবে না । সব গুলো ওয়ার্ড বাংলাতে বলতে হবে
– পাপা , হোয়াট ইজ দ্যা মিনিং অফ গিভ ,ইউ এন্ড দিজ ইন বাংলা ?
– প্রথমটা হলো দেওয়া পরেরটা তুমি আর পরেরটা এই
– ওওও । ইট মিনস মাম্মি তুমিকে এই কাগজ দেওয়া

সে হেসে দিল তার মেয়ের বাংলা বলার দক্ষতা দেখে । মেয়ের সাথে খুনশুটি করতে করতে মেয়ে তার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল । তখন সে ভেতরে এসে বিছানায় ভালো করে শুয়ে দিল । তারপর ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে সাজতে থাকা রমণীর দিকে তাকিয়ে বলল

– বিদিশা আমাকে কি মাফ করা যায় না ?
ঠোটে লিপস্টিক ঘষতে ঘষতে বলল – তুমি কি ভুল করেছো বলোতো যে আমি তোমাকে মাফ করবো ?
– আমি কি জানতাম সামান্য এই এগ্রিমেন্ট পেপারকে নিয়ে তুমি এত তুলকালাম বাজাবে ? আমি বলেছি তো ঐটা আমার ভুল ছিল তোমাকে বিয়ের দিন এগ্রিমেন্ট পেপার দেওয়া । তাই বলে কি প্রতি বিবাহ বার্ষিকী তে এই পেপারটা দিবে ?
– ধরে নাও এটা তোমার উপহার বিবাহবার্ষিকীতে ।

পিয়াস বিদিশার দিকে এগোতে এগোতে বলল – এক বাচ্চার মা হয়েও বিশ্বাস হয় না আমি তোমাকে ভালোবাসি?
বিদিশা ভাব নিয়ে বলল – কে যেন বলেছিল ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাবে ।
– আচ্ছা তোমার কি বললে বা করলে বিশ্বাস হবে যে আমি তোমাকে ভালোবাসি?

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪৪

– আপাতত দেশে নিয়ে চলো তারপর ভেবে দেখবো
– দেশে তো যাবই কিন্তু তার আগে ইয়াশার মাম্মির জন্য একটা সারপ্রাইজ দিয়ে
বলে বিদিশাকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে গেল । একটা গিফ্ট বক্স দিয়ে বলল – শুভ বিবাহ বার্ষিকী!

হৃদমাঝারে তুমি শেষ পর্ব