হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪৩

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪৩
সাইয়ারা মম

হাসপাতালের করিডোরে সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে । মিহুকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে । সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে । কারো বলার কিছু নেই । মিহু হাটু মুড়ে হাসপাতালের দেওয়াল ঘিরে বসে আছে । ওর কেন যেন নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে । ওর কারণেই তো নীলু ঐ বাসায় থেকে গেল ।

মিহুর মনে হচ্ছে কোনোভাবে ওর জীবনের বিনিময়ে হলেও নীলুকে বাচতে হবে । আরফান শক্ত হয়ে বসে আছে । কারো কথা বলার কোনো ভাষা নেই ।
মাহিন এতক্ষণ কোথায় যেন ছিল । এলোমেলো পায়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল মিহুর দিকে । ওর চেহারা উস্ক খুস্ক । চোখ দুটো লালা হয়ে গিয়েছে । কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ওর অবস্থা শোচনীয় হয়ে গিয়েছে । কেমন একটা মাতাল মাতাল হয়ে গিয়েছে । ধীর গতিতে মিহুর দিকে গিয়ে ওর পাশে বসে পড়ে । মিহু মাহিনের আগমনে চোখ তুলে তাকায় ।
মাহিন মিহুর হাতটা নিজের কাছে নিয়ে বলতে শুরু করে

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– মিহু তুই আমাকে একটা কথা বলেছিলি মনে আছে ?
মাহিনের মুখ থেকে মদের দূর্গন্ধ আসছে । মিহু অবাক হয়ে বলে – মাহিন ভাই তুমি মদ খেয়েছ?
– আরে কোথায় মদ খেলাম ?

– তুমি মদ না খেলে তোমার মুখ থেকে এমন দূর্গন্ধ আসছে কেন ? আর তোমার অবস্থা এরকম মাতাল মাতাল কেন ?
– তুই ওসব কথা রাখ । তুই আগে বল আমাকে একটা ওয়াদা করেছিলি তোর মনে আছে ?
মাহিনের এমন ব্যবহারে সবাই ই অবাক হলো । একটু পরে যা হলো সেটা হাসপাতালের প্রতিটা সদস্যকে অবাক করে দিল । মাহিনের এই ব্যবহারে মিহু যখন দাঁড়িয়ে পড়ল তখন মাহিন হঠাৎ করে মিহুর পা ধরে কেঁদে উঠল । চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল

– তুই একদিন আমাকে বলেছিলি আমি যাকে ভালোবাসি তাকে তুই এনে দিবি । তুই এখন সেই ওয়াদা ভাঙতে পারবি না । আমার নীলুকে আমার কাছে এনে দে । ও এমনিতেই মাথায় তেমন চাপ নিতে পারে না । এত বড় একটা এক্সিডেন্ট কীভাবে সহ্য করবে ? ও তো খুব ছোট একটা মেয়ে । ওকে তুই আমার কাছে এনে দে ।

ওর রক্তাক্ত শরীর আমি দেখতে পারছি না । ওকে বলে দে আমি কখনো আর বেশী সময় নেব না । সব সময় আমি ভেবে চিন্তে অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেব । ও বলেছিল বেশি সময় নিতে গেলে হারিয়ে যাবে । প্লিজ ওকে আমার কাছে এনে দে । ওকে বল ও যেন হারিয়ে না যায় । আমাকে যা শাস্তি দেবে সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব । প্লিজ এনে দে
মাহিনে এমন ব্যবহারে সবাই অবাক হয়ে আছে । মিহু মাহিনের পা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল

– ভাইয়া সব ঠিক হয়ে যাবে । তুমি প্লিজ শান্ত হও । এভাবে মদ খেয়ে মাতাল হলে কি সব ঠিক হবে ? আল্লাহ কে ডাকো । আল্লাহ বান্দার বিপদের সময়ে মুখ ফিরিয়ে নেন না । আল্লাহর কাছে বলো ।
মাহিন মিহুর তেমন কোনো কথাই কানে নিচ্ছে না । নিজের মনে বির বির করে যাচ্ছে । বসা থেকে দাঁড়িয়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজা ধরে ধাক্কা দিতে দিতে বলল

– তোমরা এমন কেন । আমার নীলুকে আমার কাছে আসতে দাও । ওকে আমার এখনো অনেক কথা বলার আছে । আমার নীল পরী আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না । ও শুধু আমার ।
কেউ বের হচ্ছে না দেখে আরো জোরে চেচাতে চেচাতে বলতে লাগল – তোমরা খুব খারাপ । তোমাদের আমি অনেক টাকা দেব ।

সেটা দিয়ে তোমরা অনেক কিছু কিনতে পারবে । তোমরা আমার নীলুকে দিয়ে দাও । আমি কাউকে কিছু বলব না ।
আরফান এগিয়ে গিয়ে মাহিন ধরে এনে বসালো । আরফানকে ছেড়ে ছুড়ে মাহিন উঠে যেতে চাচ্ছে । কিন্তু মাহিনের শরীর দুর্বল হওয়ার কারনে আরফানের কবল থেকে মুক্তি পেল না । তাই উপায় না পেয়ে আরফানের হাতে কামড় দিয়ে দৌড়ে আবার দরজা ধাক্কাতে লাগল । এবার নেহাল সহ আরো অনেকে মাহিনকে ধরল তারপর একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিল । মাহিন ধীরে ধীরে চুপ হয়ে যেতে লাগল । ওকে একটা কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো ।

সময় চলে যাচ্ছে । সকাল থেকে দুপুর হয়ে গিয়েছে কিন্তু কারো কোথাও যাওয়ার বা অন্য কিছুর করার নাম নেই । কেউ কাউকে খাওয়ার কথা বলতে পারছে না । কারণ এখন কারোর ই খাওয়ার ইচ্ছা নেই । একজন ডাক্তার বের হলে আরফান দাঁড়িয়ে যায় ।

– ডক্টর আমার বোন কেমন এখন ?
ডক্টর শুকনো মুখে বলল – এখানে পেশেন্টের লিগ্যাল অভিভাবক কে ?
– আমি । আমাকে বলুন , আমার বোন হয় ।
– আপনাকে একটু আমার সাথে আসতে হবে ।
সবাই আরফানের দিকে তাকিয়ে আছে । আরফান একবার সবার দিকে নজর বুলিয়ে ডক্টরের সাথে চলে গেল ।

-মিস্টার আরফান অপারেশনের সময় আমরা যেটা দেখতে পেলাম আর বুঝলাম পেশেন্ট কে ইচ্ছা করে এমন করা হয়েছে । কারণ একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কার কারণে এরকম হতে পারে না ।
– কিছু কি খারাপ ঘটেছে ডক্টর?
– আপনি আগে নিজেকে শক্ত করুন । আপনি যদি ভেঙে পড়েন তাহলে বাকিদের কি হবে ?
– আমার বোনটা কি বাঁচবে ডক্টর?

– বাঁচার আশা আছে তবে সেটা খুবই ক্ষীণ । পেশেন্টের মাথায় ট্রাকের হেড লাইটের কাচ গভীরভাবে ঢুকে গিয়েছে । এখন আমাদের মাথার একটা অপারেশন দরকার । যদি অপারেশন করি তাহলে বাচার সম্ভবনা 0.005 পারসেন্ট ।
– যদি অপারেশন না করা হয় ?
– অপারেশন না করলে তার বাচার মেয়াদ একসপ্তাহ । কারণ কাঁচের পজিশন ভালো না । এখন আপনাকে অপারেশন করতে হলে বন্ড সই করতে হবে ।

– মানে পেশেন্টের কিছু হলে আপনারা কেউ দায়ী নয় তাইতো ?
– জ্বী । আরেকটা কথা অপারেশন করলে যদি বেচেও যায় তাহলেও তিনি সুস্থ ভাবে থাকবেন না । তিনি কোমায় চলে যাবেন । এমন কি যদি কোমা থেকে ফেরেন যদিও এটা অসম্ভব প্রায় তাহলে মেমরি লস্টের সম্ভাবনা হান্ড্রেড পারসেন্ট । তবে এগুলো যদি বেচে থাকেন সেই ক্ষেত্রে । এখন সব কিছু আপনার হাতে ।
– কোথায় সই করতে হবে ?

হাসপাতালের ছাদে আরফান চুপচাপ বসে আছে । আকাশের দিকে তাকিয়ে নীলুর সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো ভাবছে । মিহু আরফানকে ছাদে আসতে দেখে নিজেও ওর পেছনে পেছনে আসল । চুপচাপ আরফানের পেছনে দাড়াল কিন্তু আরফান মিহুর অস্তিত্ব টের পেল ।
– মিহু আমার কাছে এসে বসো ।

মিহু আরফানের কথা মতো ওর কাছে গেল । আরফান হঠাৎ করে মিহুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল
– মিহু আমি নিজের হাতে আমার বোনকে মেরে ফেললাম । আজ যদি সই না করতাম তাহলে ও আরো এক সপ্তাহ বাচতো । আমি কি করে এসব করতে পারলাম ।

– আরফান আপনি এভাবে খারাপ দিকটা ভাবছেন কেন ? নীলুর কিছু হবে না । দেখবেন নীলু আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছে । শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করুন । একমাত্র আল্লাহ ই সকল কিছুর মালিক
– তাই যেন হয় । আমার বোনটা যেন হাসি খুশি থাকে । আল্লাহ যেন আমার বোনকে বাঁচিয়ে রাখে ।

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪১+৪২

(আসসালামু আলাইকুম । কেউ ছোট বলে লজ্জা দেবেন না । আবহাওয়া ভালো না তাই কারেন্ট নেই । ফোনে চার্জ ও নেই । আপনাদের কথা দিয়েছিলাম যে প্রতিদিন গল্প দেব । তাই যতটুকু পেরেছি লিখেছি । ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন । ধন্যবাদ)

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪৪