অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৭

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৭
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

ফেব্রুয়ারি মাসে রাতের আবহাওয়া ঠান্ডা হলেও দিনের আবহাওয়া বেশ খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে থাকে। মালামাল বহনকারী গাড়ি থেকে আসবাবপত্র নামাচ্ছে মাহমুদ। শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। তরী তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মানুষটিকে পরোখ করলো। তার ক্লান্ত চাহনিতেও কী যেন এক মায়া খুঁজে পেলো।

মোহ কাটিয়ে দেওয়া গেলেও মায়া কাটানো সহজ নয়। তরী তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রয়। চেয়ে দেখে তার ব্যক্তিগত মানুষটিকে। হুট করেই তার বড্ড হাঁসফাঁস লাগে। ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি আর লেবু বের করে নেয়। যত্ন করে সবার জন্য শরবত বানিয়ে রাখে। মাহমুদ সবটা নামিয়ে লোক নিয়ে তিনতলায় তুলে নেয়। তরী শরবতের মগ আর গ্লাস হাতে উপর থেকে তিনতলায় নেমে আসে। আয়েশা সুলতানার দিকে এক গ্লাস বাড়িয়ে উপস্থিত লোকজনকে গ্লাসে ঢেলে পরিবেশ করে দেয়। তারা নেমে যেতেই মাহমুদের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। আয়েশা সুলতানা নিজের ঘরে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়লেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাহমুদ এক টুকরো চুমুক বসিয়ে তরীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। তরী সাবধানী চোখের দৃষ্টি চারদিকে বুলিয়ে শান্ত হয়। কোথাও আয়েশা সুলতানা নেই। মাহমুদের বাড়িয়ে দেওয়া গ্লাস থেকে পরপর তিন চুমুক পান করেই ফিরিয়ে দেয়। আলতো হেসে বাকিটা মাহমুদ নিজেই গিলে নেয়। গ্লাস রেখে তরীর মাথায় টোকা মে*রে ফের নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তরী মেকি রাগ দেখিয়ে উচ্চস্বরে বলল,

-“আমাকে নির্যাতনের অপ*রাধে আপনার ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ”
মাহমুদ যেতে নিয়েও পা থামিয়ে দেয়। ঘর্মাক্ত শার্টের বোতাম সরিয়ে খানিকটা ফুঁ দিয়ে তরীর নাক টে*নে দিলো। অতঃপর রগঢ় করে বলল,
-“আমি দরজায় দাঁড়িয়ে বিরক্ত করবো। চলবে?”
তরী ফের মেকি রাগের সুরে বলল,
-“তবে পা*গ*ল বলে পাবনায় রেখে আসবো।”
মাহমুদ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

-“অবশ্যই পাবনা মেন্টাল হসপিটালের দুটো সিট বুক করবে। আমি যেখানে থাকবো, আমারও বউও সেখানেই থাকবে। আমি আবার তাকে ছাড়া থাকতে পারিনা। বুঝোইতো!”
তরী তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে খানিক বাদেই হেসে ফেললো। বলল
-“খুব ফ্লার্ট করছেন, না?”
মাহমুদ সম্মত না হয়ে বলল,
-“উঁহু, ফ্লার্ট করছিনা। ভালোবাসছি।”

অরু সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে হাট করে দরজা খোলা দেখে প্রবীণদের মতো কোমর ভেঙে হেঁটে চললো। তরীর হাতে হাতে সব গোছানোর চেষ্টা করছে। কাজ তো ঠিকমতো হচ্ছেই না, তবুও তরীর মনে হলো তাকে অন্তত সঙ্গতো দিচ্ছে।
আয়েশা সুলতানাও কাজে লেগে পড়লেন। তরী সবার জন্য আগে থেকেই রান্না করে রেখেছে। অরু হাতের কাজ এলোমেলো করে তরীকে বলল,

-“আমাকে আরেকটা কাজ দাও। কতদিন হলো কাজ করিনা। এভাবে শুয়ে-বসে কাটালো হবে?”
তরী হেসে ফেললো অরুর কথা শুনে। যেন পূর্বে কত কাজ করে এসেছে!
তরী বলল,
-“তোর কাজ করা লাগবেনা। পরে বলবি আমি পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছি আর তোকে দিয়ে খাটাচ্ছি।”
অরু মুক ভেংচি দিয়ে বলল,
-“হুহ, লাগবেনা তোমার কাজ দেওয়া।”

ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলো। সেদিন মাহমুদ তাকে একটা পুতুল কিনে দিয়েছিল, তাকেই কোলে নিয়ে খেলছে। বিড়বিড় করে আদর করছে। এই পুতুলটা পাওয়ার পর থেকেই সে পুতুলের মা হয়ে গিয়েছে। জড় পুতুলটির নড়াচড়া করার শক্তি পর্যন্ত নেই। তবুও অরুর মতে পুতুলটি কাঁদে, হাসে। সে পুতুল কোলে নিয়ে বলল,
-“একদম কাঁদে না। মা এখন তোমায় গোসল করিয়ে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়াবো। এখন কাঁদলে বড়ো একটা কুমির এসে তোমায় নিয়ে যাবে। আমার তুন্নুর তুন্নুর পাখি। তুমি কাঁদলে মায়ের ভালোলাগে?”
অতঃপর গলা চড়িয়ে বলল,

-“এখন কান্না না থামালে মা*র*বো কিন্তু।”
অরুর মতে তার বাচ্চা তার কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই তার গালে আদর দিয়ে বলল,
-“মা একটুও বকা দেবোনা, আমার তুন্নুর তুন্নুর পাখিকে।”
মিঠু স্কুল থেকে ফিরে আড়লে দাঁড়িয়ে বোনের খেলা দেখছে। ব্যাগ রেখে পকেটে দুটো চকলেট নিয়ে অরুর পাশে এসে বসলো। তার কোল থেকে পুতুল কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে বলল,

-“তোর বাচ্চাকে ঘর থেকে বের কর। সারাদিন ম্যা ম্যা করে বিরক্ত করে ফেলে।”
অরু ভীষণ ক্ষেপে গেল। নাক ফুলিয়ে ফোঁসফোঁস করে মিঠুর দিকে এগোচ্ছে। মিঠু এক নাম্বার বিপদ সংকেত টের পেয়ে নড়তে গিয়েও রক্ষা পেলোনা। অরু আগেই তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। এলোপাতাড়ি কয়েক ঘা লাগিয়ে মিঠুর বুকের উপর থেকে নেমে পুতুল কোলে তুলে নিলো। তাকে শুনিয়ে বলল,

-“মামা ভীষণ পঁচা। মা তোমাকে বের করে দেবো না। তুমি তো মায়ের তুন্নুর তুন্নুর পাখি। মামাকে বের করে দেবো বাসা থেকে, ঠিক আছে?”
মিঠু অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। ভাইয়ের দাম নেই। তাকে মে*রে পুতুল নিয়ে বাড়াবাড়ি, বাহ্!
মিঠুর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কা*ট*লো অরু।

মিঠু পকেটে হাত দিয়ে চকলেট দুটো নাড়াচাড়া করতেই অরু ভাবভঙ্গি পাল্টে সোজা মিঠুর সাথে ভাব জমাতে চলে এলো। ততক্ষণে পুতুল দূরে ছুঁ*ড়ে চলেও এসেছে। মিঠুর সাথে ভাব জমিয়ে চকলেট খাওয়া শেষ হতেই মিঠুর দিকে থুতু ছিটিয়ে পুতুল কোলে নিয়ে তরীর কাছে তিনতলায় চলে এলো। তপ্ত শ্বাস ছাড়লো মিঠু। এ জীবনে এই ঝগড়ুটে বুড়ীর সাথে সে পেরে ওঠেনি। সবসময় তাকে কুপোকাত করে অরু জিতে যায়। জীবনে আর পারবেও না।

তরীর আগের তুলনায় ব্যস্ততা বেড়েছে৷ নিজের আর বাবার দু-সংসারেই তাকে সময় দিতে হচ্ছে। অরু তার কাছেই সারাদিন থাকছে। বাবা বাসায় এলে তখন বাবার কাছে চলে যায়।
মাষ্টার্সের প্রিপারেশন চলছে তরীর। মাহমুদ রোজকার মতো কলেজ আসা যাওয়া করছে। চলছে তাদের গভীর প্রেম-নিবেদন, হাসিকান্না, খুনসুটি।

রামি, মিঠু, তরী-মাহমুদ, অরু, আয়েশা সুলতানা, সবাই ভালো আছে। তবুও সবার এই ভালো থাকায় তরী কোথাও একটা কমতি টের পায়। মায়ের কমতি। মায়ের অনুপস্থিতি তাকে যতোটা না পোড়ায়, তারচেয়ে অধিক পোড়ায় বাবার মায়া, ভালোবাসায়। এখনো মৃ*ত স্ত্রীর জন্য তিনি কাঁদেন। তরী একদিন মধ্যরাতে জেগে গুণগুণ কান্নার শব্দে থেমে গেল। উৎস বরাবর এগিয়ে গিয়েই থমকে গেল।

মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো বাবা জায়নামাজে বসে তাহাজ্জুদ পড়ে কাঁদছেন। নিজের জন্য, সন্তানদের জন্য, স্ত্রীর জন্য দোয়া করছেন। স্পষ্ট শব্দ ভেসে এসে তার কর্ণকুহরে বাড়ি খাচ্ছে। তরী খেয়াল করে দেখলো বাবা আর আগের মতো নেই। ভেঙে গিয়েছেন। শারীরিক, মানসিক দুদিক থেকেই তিনি ভেঙেছেন। চোয়াল ভঙ্গুর হয়ে চোখ কোটরে গিয়ে ঠেকেছে। আগের সেই আভিজাত্য এখন আর নেই। পুরো মানুষটাই কেমন জীর্ণশীর্ণ হয়ে থাকেন।

তরী বড়ো মেয়ে, বড়ো সন্তান। হুট করেই সে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। সে মেয়ে, বাবার সবটা খেয়াল করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কিছু কিছু ব্যাপারে প্রতিটি মানুষেরই একান্ত ব্যক্তিগত মানুষের দরকার পড়ে। তার জন্য যেমন মাহমুদ আছে, ঠিক তেমনই। সে সিদ্ধান্ত নিলো চাচা আর মামার সাথে কথা বলে বাবাকে বিয়ে করাবে।

মায়ের জায়গাটা নিয়ে কষ্ট পেলেও বাবার কষ্টটাও উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো। চাচা আর মামা দুজনের সাথে কথা বলেই বুঝতে পারলো তারা সম্মত আছেন। মাহমুদ নিজেও চাইছে তরীর বাবা ভালো থাকুক। সেও তরীর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালো। সকলেই একজোট হলো। একান্তভাবে কথা বলার জন্য মামা আর চাচা বাড়িতে এলেন। বাবার সাথে আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা তুলতেই বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।

-“এই সম্বন্ধে আমি কথা বলতে চাইনা। আমার বাচ্চাদের নিয়ে আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”
মামা বললেন,
-“রুবিনা আমার বোন। তার শূন্যস্থান পূরণ করতে আমি নিজেই চাইছি আপনি বিয়ে করুন দুলাভাই। কোন ভাই কিন্তু এটা চাইবেনা। আমি চাইছি। কেন শুনুন! তরীর এখন সংসার আছে। সে এসে সারাদিন আপনার সংসারে পড়ে থাকলে তো হবে না। হয়তো কেউ কিছুই বলবেনা। কিন্তু এক সময় মনে মনে ঠিকই বিরক্ত হবে। মেয়েটার কথাও ভাবুন। দু-সংসারে মন দিতে গিয়ে তার জিরোবার ফুরসত টুকু থাকেনা।। তাছাড়া আপনার শেষ বয়সে দেখার জন্য হলেও একটা মানুষ দরকার।”
তরীর বাবা গম্ভীর হলেন,

-“আর কয়েক বছর। তারপরই ছেলে উপযুক্ত হবে। তাকে বিয়ে করাবো। তখন পুত্রবধূ সংসার সামলাবে। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আমি। এখন আমার বিয়ের সময় না।”
তিয়াসের বাবা বললেন,

-“মিঠুর কত বছর বয়স? তুই এমনভাবে বলছিস, যেন তিন বছর পরই বিয়ে করিয়ে দিবি। যদি জামাইয়ের বদলি হয়ে যায় অন্যকোথাও, তখন তো তরীকেও যেতে হবে। সংসার সামলাবে কে?”
তরীর বাবা এক কথায় জানিয়ে দিলেন,
-“আমি কোন বিয়েসাদী করবোনা। খবরদার এসব যেন আমার ছেলেমেয়েদের কানে না যায়! তারা যেন বিন্দুমাত্র কষ্ট না পায় বলে দিলাম আমি।”

বাবার হুমকিতে মামা মনে মনে হাসলেন। মেয়ে নিজেই বাবাকে বিয়ে করানোর জন্য মাঠে নেমেছে। অথচ বাবা বলছে “ছেলেমেয়ে যেন না জানে”।
তরী এদিকটায় আসার চেষ্টাও করেনি। মামার কাছ থেকে পরে বাবার সিদ্ধান্ত শোনা যাবে। অরু আর মিঠুর জন্য সে আছে। কিন্তু বাবাকে দেখার জন্য, দুটো কথা মন দিয়ে শোনার জন্য কেউ নেই। তরী অন্তত বিয়ের পর এইটুকু বুঝতে পেরেছে। মাহমুদকে ছাড়া একরাত বাবার বাসায় থাকলেও তার ছটফট লাগে। আর বাবা মানুষটা এতগুলো বছর যেই সঙ্গীর সাথে কাটিয়ে দিয়েছেন, সে সঙ্গীকে হারিয়ে কতটুকু কষ্টে আছেন তরী একটু হলেও বুঝতে চেষ্টা করে।

রামি, মিঠু দুই দুষ্টু আজ ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছে। স্যার সামনে থেকে দ্রুত কথা বলায় থুতুর ছিটে এসে মুখে পড়লো রামির। দাঁতে দাঁত চেপে সবটা হজম করে আছে সে। মিঠু শব্দহীন শরীর দুলিয়ে হাসছে। নিজেকে কন্ট্রোল করার বৃথা চেষ্টা হিসেবে বারবার রামির প্যান্ট খামচে ধরছে। অগ্নি চক্ষু নিক্ষেপ করলো রামি। কাজ হলোনা। তার দৃষ্টি দেখে মিঠু আরো হেসে কুটিকুটি। স্যারের নজর পড়লো মিঠুর উপর। তিনি কলম ছুঁড়ে মা*র*লে*ন তার দিকে। মিঠু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন,

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৬

-“কী? সমস্যা কী তোমার? আমি পড়া বুঝাচ্ছি সেই খেয়াল আছে? তুমি বোধহয় সবটা পারো। দাঁড়াও, আজ সামনে গিয়ে আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে তুমি সবাইকে পড়া বুঝিয়ে দেবে।”
মিঠু ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। স্যার আরো কিছু কথা শুনিয়ে ক্লাস শেষ দিয়ে চলে গেলেন। ছুটির পরও মিঠু রামির মুখে থুতু পড়া নিয়ে হেসে গড়াগড়ি দেবার মতো অবস্থা করছে। রাগ হলো রামির। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“ইনসাল্ট কাকে বলে? স্যার আজ তোর ইনসাল্টের বেইজ্জতি করে ছেড়ে দিয়েছেন। তাটপরও ব্যাটা নির্লজ্জের মতো হাসে।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী শেষ পর্ব