অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৬

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৬
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

আজ এক জায়গায় দাওয়াত পড়েছে বিধায় মাহমুদের বড়ো ভাইয়া তরীকে সাথে নেওয়ার জন্য তরীর বাবাকে ফোন করলেন। দাওয়াতের মূল উপলক্ষ্য মাহমুদ আর তরীর বিয়ে। তাদের নিয়েই পরিবারসহ দাওয়াত পড়েছে। বড়ো ভাইয়া ফোন হাতে নিয়ে বসে আছেন। রিং হলেও কোন রেসপন্স নেই। ইরা পাশেই জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখছে।
সকালে বাবার ফোন বেজে উঠলো। বাবাকে আশেপাশে না দেখে ছোট্ট অরু চোখ ডলতে ডলতে ফোন রিসিভ করে কানে তুললো।

-“হ্যালো কে?”
-“আমি তোমার বুড়ো বর বলছি গো, সুন্দরী বউ।”
কন্ঠস্বরে সম্পূর্ণ ঠাট্টার সুর টের পেলো অরু।
সকাল সকাল তার মেজাজ খা*রা*প হয়ে গেলো। চেঁচিয়ে বললো,
-“এই কে বলছেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হাসির শব্দ ভেসে আসছে। অরুর নাকের পাটা ফুলে উঠলো। সাথে গাল দুটোও ক্রমশ ফুলে উঠছে। নিমিষেই বুঝে গেল ফোনের ওপাশের মানুষটি কে!
বড়ো ভাইয়া বললেন,
-“আমি তোমার বর বলছি গো, বর।”
অরু রাগ ঝেড়ে বলল,

-“হি হি করে হাসছেন কেন? দাঁত ব্রাশ করেছেন?”
করুন সুর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
-“না, টুথপেষ্ট, ব্রাশ কিছুই নেই। তুমি কিনে দেবে?”
অরু বুঝলো সত্যিই ব্রাশ, টুথপেষ্ট নেই। সাথে সাথে নাক চপে ধরলো। দুর্গন্ধ লাগছে প্রকাশ করতেই “উঁহ”
শব্দ করলো।
তরী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-“কার সাথে কথা বলছিস, অরু?”
অরু নাকে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,
-“নাও, মাহমুদ ভাইয়ার ভাই। তুমিও নাকে হাত দাও। উনি ব্রাশ করেন নি। প্রচুর দুর্গন্ধ আসছে।”
তরী হাসতে হাসতে ফোন হাতে নিলো। মুঠোফোনেও যে কারো মুখের দুর্গন্ধ টের পাওয়া যায়, তা অরু না বুঝালে সে বুঝাতোই না।
ফোন কানে তুলে সালাম দিলো তরী।
ভাইয়া সালামের জবাব দিয়ে বললেন,

-“আঙ্কেল কোথায় তরী? আজ আমাদের দাওয়াত আছে সকলের। তুমি আর মাহমুদ যাচ্ছো। সেটা বলতেই আঙ্কেলকে ফোন করলাম।”
তরী মৃদুস্বরে বলল,
-“বাবাকে দেখছিনা। ঘরে ফিরলে কল ব্যাক করতে বলবো।”
ভাইয়া মেনে গেলেন।
নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রাখতেই বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল। মাহমুদও বেরিয়ে এসেছে। মিঠু ঘুমাচ্ছে। সে ছাড়া সকলেই টেবিলে উপস্থিত। তরী বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
-“বড়ো ভাইয়া কল দিয়েছেন, বাবা। তোমার সাথে কথা বলবে।”
মাহমুদ বলল,

-“আমাদের আজ দাওয়াত আছে। আপনার পারমিশন নিতেই বোধহয় ভাইয়া কল দিয়েছেন!”
তরীর বাবা মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও মুখে প্রকাশ করলেন না। তারা চাইলেই এখন তরীকে তার বাবার পারমিশন ছাড়া যেকোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। অথচ ভদ্রতা বজায় রেখে পারমিশন চাইতে কল করেছেন। নাস্তা করার আগেই তরীকে বললেন,
-“আমার ফোন এনে দে, তটিনী।”

তরী ফোন বাড়িয়ে দিতেই বাবা কল দিলেন মাহমুদের বাসায়। ওদের যাওয়াতে তিনি আপত্তি করেননি। মাহমুদ হাসলো। তার হাসি অগোচরেই থেকে গেল। চাইলে শুধু সে নিজেই পারমিশন নিতে পারতো। তবুও ভাইয়াকে দিয়ে কল করালো। দুজন পারমিশন চাওয়াতে প্রকাশ না করলেও তরীর বাবা যে সন্তুষ্ট হলেন তা বোঝাই যাচ্ছে। এভাবেই একটু একটু করে মনে জায়গা করে নেবে সে। একজন বড়ো ছেলের অভাব সে পূরণ করবে। জানেনা কতটা পারবে, তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে।
তরী অরুকে খাইয়ে দিচ্ছে। মাহমুদ অরুকে রাগিয়ে দিতেই বলল,

-“বাবা, অরু আর ভাইয়ার বিয়েটা কবে দিচ্ছেন?”
অরুর খাওয়া থেমে গেল। সে চোখ পাকিয়ে তাকালো মাহমুদের দিকে। তরী, বাবা সকলেই মিটিমিটি হাসছেন। আজ অরুকে রাগাতে তরীও যোগ দিল। বলল,
-“হ্যাঁ বাবা। আমরা দু-বোন এক বাড়িতে থাকবো। অরুকে নিয়ে তোমারও আর বাড়তি চিন্তা থাকলো না।”
অরু টুকটুক চোখে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে তেজী গলায় বলল,
-“তুমি আমায় ও বাড়ি কেন নিতে চাইছো, আমি বুঝিনা ভেবেছো?”
তরী না বোঝার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

-“কেন?”
অরু আরেকটু তেজ ঢেলে বলল
-“তুমি পায়ের উপর পা তুলে খাবে আর আমাকে দিয়ে কাজ করাবে। আমি সব জানি। আমিতো ছোটোবোন, তুমি আদেশ করলেও না করতে পারবোনা। তাই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছো।”
তরীর চোখ চড়কগাছ। সাথে বড্ড হাসি পেলো। মাহমুদ ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-“তরী, অরুকে সবকাজ শিখিয়ে দিও। আমাদের বাড়ি গেলে তো তাকে আবার কাজ করতে হবে।”
-“আমি কাজের মেয়ে না। কতটা স্মার্ট আমি, তুমি দেখেছো?”

অরুর রাগ বাড়িয়ে সকলেই আনন্দ পাচ্ছে। বাবা অরুর রাগকে কান্নার দিকে যেতে দেখে আদুরে স্বরে বললেন,
-“কে বলেছে আমার মা’কে বুড়োলোকের সাথে বিয়ে দেবো? তার জন্য ঘোড়ায় চড়ে সুদর্শন রাজকুমার আসবে।”
অরুর কান্না খানিকটা রোধ হয়ে এলো। যোখান থেকে শুরু হলো, সেখানেই থেমে গেল। সাথে তরী আর মাহমুদের সাথে বড্ড রাগ করলো।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছে তরী। একটুপরই তারা বের হবে। মাহমুদ ফ্রেশ হয়ে তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো। চেয়ারের উপর তোয়ালে ছুঁড়েই তরীর কাছাকাছি ঘেঁষলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়নার মাঝেই তরীর দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। তরী জমে গেল।

নড়চড় করলো না। গালদুটো ক্রমশ আরক্তিম হলো। ভীষণ ভালোলাগা মুহূর্তেও তার ভয়ঙ্কর লজ্জা হচ্ছে। ঢোক গিলে মাহমুদের কাছ থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলো। সরতে পারলোনা। শক্ত হয়ে আটকে রইলো মাহমুদের হাতের বন্ধনে। দুল খানিক সরিয়ে কানে শব্দ করে চুমু খেলো মাহমুদ। তরী চোখজোড়া আবেশে বন্ধ করে নিলো। ঘন হয়ে এলো মাহমুদের শ্বাস।
গভীর স্বরে বলল,

-“তুমি এই দুদিনেই ভীষণ ভয়ঙ্কর সুন্দরী হয়ে উঠেছো, তরী। আগের তুলনায় তোমাকে আমার আরো বেশি পেতে ইচ্ছে করে।”
তরীর ঠোঁটে লজ্জালু হাসি। মুখ লুকাতে এদিক ওদিক তাকালো। মাহমুদ তরীর এলেমেলো দৃষ্টিতেও মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছে। তরী কেবল মাহমুদের ক্ষীণ চোখজোড়ায় ব্যাকুলতা টের পাচ্ছে। এতটা কাছে থেকেও মানুষটা কতটা ব্যাকুল হয়ে উঠছে। লম্বা শ্বাস নিলো তরী। এবার নিজ থেকেই মাহমুদের উপর শরীরের ভর ছেড়ে দিল। সরে যাওয়ার জন্য বিন্দুমাত্র ছটফট করলোনা। মৃদু স্বরে বলল,

-“আমি তো আপনার কাছেই আছি। যতটা কাছে হলে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা, ঠিক ততটা কাছে।”
মাহমুদের স্বর গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। তরীর ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলল,
-“যেই তটিনীতে একদিন ভেসে গিয়েছিলাম, সেই তটিনীতে এবার আকন্ঠ মুগ্ধতায় ডুবে থাকতে চাই।”

তরী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে শার্টের কলারে আলতো হাত রাখলো। হুট করেই এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। মাহমুদের গলায় অধর ছুঁইয়ে ঝটপট সরে দাঁড়ালো। মাহমুদ আর তার নাগাল পেলোনা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই হিসহিসিয়ে হেসে বলল,
-“অসময়ে বড্ড জ্বালাচ্ছো, তরী। এই মুহূর্তে বের হতে না হলে জমের কাছে তোমার রক্ষা থাকতো না।”
তরীও হেসে বলল,

-“যেই জমের কাছে প্রেম আছে, তার কাছ থেকে রক্ষা পেতেও চাই না।”
চোখজোড়া ক্ষীণ করে রগঢ় করে মাহমুদ বলল
-“তাই না? খুব প্রেম পাচ্ছে?”
তরী জবাব না দিয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তৈরি হয়ে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তরী আর মাহমুদ বের হলো। অরুকে কোলে তুলে আগে আগে সিঁড়ি ধরে নামলো মাহমুদ। গাড়িতে চড়েই একহাতে তরীর হাত আঁকড়ে ধরলো। এদিকে অরুকে কোলে নিয়ে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে।

রামি আর মিঠু দুজনই ক্লাসে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন টিচার তাদের দুজনকে দুষ্টুমির জন্য ওয়ার্নিং দেন। আজ একেবারে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। রামি মাঝেমাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছে স্যারের দিকে। তিনিও আবার ওদের দুজনের দিকে চোখ রাখছেন। কান থেকে হাত সরিয়ে নিলো মিঠু। বেচারার হাত প্রচন্ড ব্যথা হয়ে আছে। তা দেখে স্যার তেড়ে এসে মা*রতে গেলেন। মিঠু বেঞ্চ ছেড়ে দৌঁড়ে টিচার ডেস্কের সামনে চলে গেল।

স্যার পূর্বের জায়গায় ফিরে ডেস্কের উপর দিয়ে মা*র*তে যেতেই ডেস্কসহ মিঠুর গায়ে পড়তে নিলেন। দু’হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে মিঠু। স্যার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। তিনি ওভাবে থেকেই মিঠুকে আঘাত করতে চাইলেন। স্যার সহ ডেস্ক ধরে রাখার শক্তি না পেয়ে ডেস্ক ছেড়ে একপাশে সরে গেল মিঠু।

স্যার ধপ করে ডেস্ক নিয়ে পড়লেন। ছাত্র-ছাত্রী সকলেই মুখ চেপে হাসছে। সবাই উনাকে” জম “স্যার বলে ডাকে। সেই জম স্যারকে জমের মুখে পড়তে দেখে কেউই মজা নিতে বাদ রাখলোনা। কারো হাসিরই শব্দ হলোনা। রামিটা একটু আওয়াজ করে হেসেই নিজের সর্ব*নাশ ডেকে আনলো। ক্ষেপা বাঘ মিঠুকে ছেড়ে রামির দিকে তেড়ে এলেন। যতদূর হাত চলেছে, রামিকে বেতের আঘাত করলেন। মিঠু নিজেই স্যারের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো।

-“স্যার ওর ভুল হয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন আর কাল থেকে দুষ্টুমি করবোনা। এভাবে মা*র*লে রামি অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
স্যার মিঠুকেও আচ্ছামতো পি*টি*য়ে শান্ত হলেন। দুই বন্ধু মা*রে*র দাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বের হলো। মাঠে ঘাসের উপর বসেই একে অপরকে পানি এগিয়ে যত্ন নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পরক্ষণেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে স্যারের কথা মনে করে হেসে কুটিকুটি হয়ে পড়লো। কেউ দেখলে বলবেই না একটু আগে দুজনকে স্যার বেধড়ক মা*র মে*রে*ছে।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৫

দাওয়াত থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল। তরীর ভীষণ মাথা ধরেছে। অরু আর তরীকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো মাহমুদ। ভাইয়া আর ভাবি কাল তাদের নিজের বাসায় চলে যাবেন।
অরুকে কোলে নিয়েও তরীর মাথাটা আলগোছে নিজের ঘাড়ের দিকে টে*নে নিলো মাহমুদ। অরুর আড়ালেই ভীষণ যত্নে তরীর মাথায় চুমু খেলো। পিঠের উপর হাত নিয়ে বলল,
-“ভালো হয়ে যাবে ব্যথা। তুমি চুপটি করে চোখ বুজে থাকো।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৭